ধূসর_রঙের_জলছবি #অস্মিতা_রায় (তিন )

0
257

#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(তিন )
-“ঝগড়া তো সব স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই হয়। তোমাদের মধ্যে এমন কী হল যার জন্য আমার মেয়েটা সটান বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল!”
-“আমার অন্যায় হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারি নি মালবিকা এমন একটা কাজ করবে।”
-“বুঝতে পারো নি বললে কী করে হবে! মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। মালবিকার সব দায়িত্ব তো এখন তোমারই!”
মালবিকার বাবার ভর্তসনায় শুভেন্দু আর কিছু না বলে চুপ করে মাথা নিচু করে রইলো। নিজেকে খুব ছোটো মনে হচ্ছে ওর। মালবিকার বাপের বাড়িতে এসে ওকে খুঁজে পায় নি শুভেন্দু। কেউই কিছু বলতে পারছে না। শুভেন্দুর অবস্থা দেখে মালবিকার মা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “ছেলেটাকে এমনি এমনি দোষ দিও না তো! মৌ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে। ও কী করবে না করবে তার সব দায় শুভেন্দুর কী করে হয়! তাছাড়া মৌ যে কেমন খামখেয়ালি সেটা তো আমরা বরাবরই জানি।দোষারোপ না করে ভাবো যে মৌকে কীভাবে খুঁজে বের করা যায়। ” মালবিকার বাবা বললেন, “হ্যাঁ পুলিশে খবর দিতে হবে আর কী!” একথা শুনে শুভেন্দু বলে উঠল, “পুলিশে খবরটা আসলে দিতে চাইছি না। লোক জানাজানি হবে। পরিবারের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি।” মালবিকার বাবা বললেন, “আশ্চর্য ব্যাপার বটে! আমার মেয়েটা কোথায় গেল, কেমন আছে, ওর কোনো ক্ষতি হয়ে গেল কীনা এসব চিন্তার থেকে এখন তুমি পরিবারের মানসম্মান নিয়ে বেশি ভাবছো!” এমন সময়ে মালবিকার বোন তমালিকা বলে উঠল, “বাবা পুলিশে খবর দেওয়ার আগে একবার কৌস্তভদার কাছে জিজ্ঞেস করলে হয় না?” শুভেন্দু জিজ্ঞেস করল, “কে কৌস্তভদা?মালবিকার সেই বন্ধু? আমাদের বিয়ের দিন মালবিকার পিঁড়ি ধরেছিল যে?” তমালিকা বলল, “হ্যাঁ। ও ছোটো থেকেই দিদির খুব ভালো বন্ধু। ওকে বরাবর অনেক কিছু শেয়ার করতো দিদি দেখতাম।আমাদের বাড়ির বিভিন্ন দরকারে ডাকলেই কৌস্তভদা চলে আসতো।ওকে একবার জিজ্ঞেস করা যেতে পারে দিদির খবর।”
কৌস্তভের বাড়িতে ফোন করে ওর কলকাতার ফোন নম্বরটা নেওয়া হল। সেখানে ফোন করার পর ফোন বেজে যাচ্ছে অনবরত। কেউ ধরছে না। তমালিকা বলল, “কী ব্যাপার! আজ তো রবিবারের দুপুরবেলা। কৌস্তভদার তো এখন বাড়িতেই থাকার কথা!” শুভেন্দুর হঠাৎ কেমন একটা সন্দেহ হল। তমালিকাকে বলল, “কৌস্তভের কলকাতার ঠিকানাটা দিতে পারবে?”
-“হ্যাঁ, সে জোগাড় করা যাবে? কেন? “
-“তাড়াতাড়ি জোগাড় করো। আমি এখুনি টিকিট কাটবো। কলকাতা যাবো। “
-“কেন তোমার কি মনে হচ্ছে যে দিদি কৌস্তভদার সাথেই গেছে? “
-“হতেও তো পারে। “
মালবিকার বাবা বলে উঠলেন, “শুধুমাত্র একটা আন্দাজ থেকে তুমি কলকাতা চলে যাবে!আর এদিকে পুলিশকে কোনো খবর দেবে না? মৌয়ের যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়!ও নিজেই যদি উল্টোপাল্টা কোনো কান্ড ঘটিয়ে বসে!“ শুভেন্দু বলল, “আন্দাজ হলেও আমি শুধুই অন্ধকারে ঢিল ছুড়ছি তা নয়। দেখুন, মালবিকার সঙ্গে আমার ঝামেলাটা হয়েছিল আগের সপ্তাহে। তখন তো ও চলে যায় নি! এই কটাদিন চুপচাপ শান্তভাবেই ছিল। আজ যাওয়ার সময়ও গুছিয়ে চিঠিটা লিখে গেছে। তার মানে ও ঠান্ডা মাথায় গুছিয়ে প্ল্যান করেই বেরিয়েছে। আমার মন বলছে, মালবিকার কোনো ক্ষতি হবে না। মালবিকা জেদি, খামখেয়ালি ঠিকই তবে বোকা নয়। চিঠির শেষ কথাগুলোয় দেখুন, ও বলেছে ডিভোর্স দরকার হলে ওকে খুঁজে নিতে। এর মানে ও নিজের কোনো ক্ষতি করবে না। ও শুধুই আবেগের বশে কাজটা করেছে তা নয়।আর বেরিয়ে ও আপনাদের কাছেও আসে নি যখন, তাহলে অন্য কোনো পরিচিত কারোর কাছেই যাবে। কৌস্তভ যদি ওর ভালো বন্ধু হয়েই থাকে, তাহলে হতেও পারে ও বেরোনোর সময় কৌস্তভের সাহায্য নিয়েছে কোনোভাবে।এদিকে রবিবারের দুপুরবেলা কৌস্তভের ফোন বেজে যাচ্ছে তবু ও ধরছে না যখন, এর মানে কৌস্তভ ওর ঘরে নেই। আমার ব্যাপারটা কেমন দুইয়ে দুইয়ে চার লাগছে।তাই আমি কৌস্তভের সঙ্গে একবার দেখা করে মালবিকার খোঁজ নেবো।“ মালবিকার বাবা বললেন, “বলছো? বেশ, তাহলে আমার জন্যও কাটো টিকিট। আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।”

***********************************

গতবছর ঝিলম এসে প্রথম দিয়াকে বলেছিল, “জানিস দোতলায় একটা যা ছেলে এসেছে না উফফ! যেমন হ্যান্ডসাম তেমন ব্রিলিয়ান্ট!আমি তো এক দেখাতেই প্রেমে কুপোকাত হয়ে গেছি!” দিয়া বলেছিল, “তাই নাকি?নাম কি তার? “
-“অরণ্য। চল না নিচের রাস্তায় গিয়ে হাঁটি। ছেলেটা এখনই ঘর থেকে বেরোবে। “
ঝিলমের পিরাপীড়িতে ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে গেছিল দিয়া। আর ঝিলমের যেমন ভাবনা, তেমনি ঘটনা। একটু পরেই বেরিয়ে এলো সেই ছেলে। ওদের দিকে একবার তাকিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। ঠিকই বলেছে ঝিলম। ছেলেটা দেখতে খুব সুন্দর। দিয়াকে কনুই দিয়ে ঠেলে ঝিলম ফিসফিস করে বলল, “দেখলি? এই হচ্ছে অরণ্য। “
এরপর থেকে গত একবছরে ওদের দুজনের গল্পের বেশিরভাগটাই জুড়েছিল অরণ্যর ব্যাপারে আলোচনা। অরণ্যকে দেখতে পেলেই উঁকিঝুঁকি দিতো ঝিলম। অরণ্য হয় তো বুঝতো সবই। তবে পাত্তা দিতো না কোনোদিনই। তবে এর মধ্যে একদিন এক কান্ড ঘটল।বিকেলবেলা দিয়াদের ব্যালকনিতে বসে দুজন গল্প করছিল। দিয়াদের বাড়িতে সেদিন আর কেউ ছিল না। এমন সময় ওরা দেখতে পেলো অরণ্য বাইরে থেকে এসে এন্ট্রান্সের গেটটা খুলছে। হঠাৎ দুষ্টুবুদ্ধি চাপলো ঝিলমের মাথায়। হাতের কাছে যে জলের বোতলটা ছিল সেটা খুলে উপুড় করে দিল অরণ্যর মাথায়। আচমকা গায়ে জল পড়তে “কে কে ” বলে উপরে তাকালো অরণ্য। ঝিলম ততক্ষনে ছুটে ভেতরে পালিয়েছে। অরণ্য চোখ তুলে একা দিয়াকেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। দিয়াকে উদ্দেশ্য করেই অরণ্য বলে উঠল, “হোয়াট ননসেন্স!”ভুরুদুটো কুঁচকে গেছে অরণ্যর। সুন্দর ছেলেরা রেগে গেলে কী আরো সুন্দর দেখায়? অরণ্যর দিকে তাকিয়ে দিয়া কোনো জবাবদিহি করতে ভুলে গেল।
পরে অরণ্যর সঙ্গে অনেকবার সামনাসামনি দেখা হয়েছে দিয়ার। প্রত্যেকবার ওর মনে হয়েছে সোজাসুজি অরণ্যকে গিয়ে বলে, সেদিন উপর থেকে গায়ে জল ফেলার কাজটা ও করে নি। তবে পারে নি। ওর কোন কথাটাই বা কবে কাকে ঠিক করে বুঝিয়ে বলতে পেরেছে ও? তাছাড়া অরণ্য ছেলেটা এত গম্ভীর থাকে যে দেখলেই দিয়ার কেমন ভয় ভয় করে। আর ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে সেই ছেলেটাই কীনা ওকে অংক পড়াতে আসবে! দিয়া যে অংকে এত কাঁচা সেটা বুঝে যাবে যে অরণ্য! এর চেয়ে বেশি লজ্জা আর কী হতে পারে দিয়ার!
প্রতাপ দিয়াকে আবার জিজ্ঞেস করল, “কী রে বললি না তো কী অসুবিধা ছেলেটার কাছে? ” দিয়া তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “না বাবা এমনি অসুবিধা নয়। তবে ভাবছিলাম বেশি চাপ হয়ে যায় যদি। ” প্রতাপ বলল, “একটা মাস পড়ে দেখ। তারপর দেখা যাবে।” দিয়া আমতা আমতা করে বলল, “আচ্ছা।”
কথামতো শুরু হল অরণ্যর দিয়াকে এসে পড়ানো। প্রথমদিন ভয়ে কাঁপছিলো দিয়া।অরণ্যর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলো না।অরণ্য অংক শেখানোর সময় যে কী বলে গেল কিছুই বুঝলো না দিয়া। শেষে অরণ্য জিজ্ঞেস করল, “তুই কি বুঝতে পারছিস না, নাকি বুঝতে চাইছিস না? এত অন্যমনষ্ক কেন?” দিয়া কাঁচুমাচু মুখে অরণ্যর দিকে হতাশ চোখে তাকালো। চোখে চোখ পড়তে অরণ্য একটু হাসল।হাসিটার মধ্যে যেন স্নেহ মেশানো একটু প্রশ্রয় মিশে আছে।এই প্রথমবার অরণ্যকে হাসতে দেখলো দিয়া। তাও এত সামনে থেকে।হাসিটার দিকে তাকিয়ে রইলো দিয়া।

(ক্রমশ)

© Asmita Roy

———————————————————-

পরবর্তী পর্ব আসতে চলেছে খুব তাড়াতাড়ি। আপডেট পাওয়ার সুবিধার জন্য এই পেজটি ফলো করে যুক্ত থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here