#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(চার )
অরণ্য খুব ধরে ধরে অংক শেখায়। প্রতিটা চ্যাপ্টারের সোজা অংক দিয়ে শুরু করে। তারপর ঠিক সেই ধরনের আরেকটা অঙ্কই দিয়াকে করতে দেয়। দিয়া সেটা পেরে যাওয়ার পরে ওকে বলে, “এই তো সুন্দর বুঝে গেছিস। “ তারপর আস্তে আস্তে কঠিন অংক ধরে।এছাড়া ভৌতবিজ্ঞানও খুব সুন্দর করে বোঝায় অরণ্য। দিয়ার চোখের সামনে অণু-পরমাণুর দৃশ্যগুলো ফুটে ওঠে যেন।অরণ্যর বোঝানোর কায়দাটা ভারী ভালো। যতটুকু দরকার ততটুকুই বলে। তাছাড়া রেগুলার হোমওয়ার্ক দেয় আর পরের দিন এসে চেক করে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছোটো ছোটো পরীক্ষা নেয়। তাতে দিয়া বেশিরভাগই ফুল মার্কস পায়।
সায়েন্স গ্ৰুপকে বরাবর ভয় পেয়ে আসা দিয়ার আজকাল সাবজেক্টগুলোকে ভারী ভালো লাগতে শুরু করেছে। সুবীর স্যার প্রথম থেকেই অনেক কঠিন কঠিন বিষয় দিয়ে শুরু করতো। সেগুলো কিছুই বুঝতো না দিয়া। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই ‘অংক পারে না ’, ‘সায়েন্স বোঝে না’ এই ধরনের লাগানো তকমার কারণে ও নিজেও সেটাই বিশ্বাস করতো। অরণ্য এসে ওর সেই ভুল ধীরে ধীরে ভেঙে দিয়েছে। আজকাল নিজের উৎসাহেই অনেক বেশি অংক প্রাকটিস করে ও। খুব ভালো লাগে বিজ্ঞান পড়তে। সুবীর স্যারের কাছে টিউশন ছেড়ে দিয়েছে দিয়া। অরন্য সপ্তাহে দুদিন এসে ওকে পড়িয়ে দিয়ে যায়। এছাড়া পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নানারকম গল্প করে অরণ্য। কসমলোজি, ইতিহাস, ভূগোল। অরণ্য নিজে নানা বিষয় পড়তে ভালোবাসে।দিয়ার সঙ্গে সেগুলো যখন গল্প করে ও, দিয়া তখন মন দিয়ে শোনে। সত্যি বলতে কী অরণ্য পড়াতে আসার দিনগুলোর জন্য দিয়া মনে মনে উন্মুখ হয়ে থাকে। আর কোনো এক অমোঘ টানে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ও দোতলায় অরণ্যর দরজার দিকে একবার তাকায়। যদি একবার দেখা হয়ে যায়! অরণ্যর কলেজ থেকে ফেরার সময় হলে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি দিয়াকে যেন ঘাড় ধরে ওকে ব্যালকনিতে দাঁড় করায়।
আস্তে আস্তে দিয়ার ক্লাস টেনের বোর্ড এক্সাম এগিয়ে আসছে। ঝিলমও ব্যস্ত নিজের টুয়েলভের পড়াশোনা নিয়ে।এক শীতের দুপুরে ব্যালকনিতে বসে নরম রোদে পিঠ দিয়ে টেস্ট পেপার সলভ করছিল দিয়া। অরণ্য আসারও সময় হয়ে গেছে। গেটের আওয়াজে ফিরে তাকালো দিয়া। অরণ্য ঢুকছে। কিন্তু একি! অরণ্যকে কেমন অপ্রকৃতিস্থ লাগছে যেন! হাঁটার সময় পাগুলো কেমন এলোমেলো ভাবে ফেলছে!চোখদুটো টকটকে লাল! শরীর খারাপ নাকি অরণ্যর! দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁটটা একবার কামড়ালো দিয়া। বাড়িতে কেউ নেই। যাবে নাকি একবার অরণ্যর ঘরে?
সাতপাচঁ ভেবে শেষ অবধি স্থির করে ফেললো দিয়া। অরণ্যর ঘরে বেল বাজানোর পর অরণ্য এসে দরজা খুলল। দিয়াকে দেখে চমকে গেল অরণ্য। বলল, “কী ব্যাপার? তুই হঠাৎ এখানে?” অরণ্যর মুখে ভকভক করছে মদের গন্ধ। দিয়া বলল, “ঢোকার সময় তোমাকে দেখে কেমন একটা সন্দেহ হল। তুমি ঠিক আছো তো?” চোখ মুখ কঠিন হয়ে গেল অরণ্যর।কড়া ভাবে বলল, “দ্যাট ইজ নট ইওর বিজনেস। গেট লস্ট।” দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছিল অরণ্য। এর মধ্যেই দিয়া জোর করে ঢুকে গেল অরণ্যর ঘরে।
**********************************
“যে শাখায় ফুল ফোটে না,
ফল ধরে না একেবারে
তোমার ওই বাদলবায়ে
দিক জাগায় সেই শাখারে।
শ্রাবনের ধারার মতো
পড়ুক ঝরে,পড়ুক ঝরে….”
আপনমনে গান গেয়ে চলেছে মালবিকা। চুপ করে শুনছে কৌস্তভ। কাল কলকাতা পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেছিল। মালবিকাকে নিজের বাড়িতেই নিয়ে এসেছে ও। কাল রাতে মালবিকা পাশের ঘরে ঘুমিয়েছে।কৌস্তভকে ফোন করে জানিয়েছিল মালবিকা,ওর পক্ষে আর সংসারে থাকা সম্ভব নয়। প্রতি মুহূর্তে ওর দমবন্ধ হয়ে আসে ওখানে। ওর সন্মান ওখানে পাপোষের চেয়েও কম। মালবিকার বাপের বাড়িও উদাসীন এই ব্যাপারে। মালবিকা ওখান থেকে বেরোতে চায়। কৌস্তভের সাহায্য লাগবে ওর। বেশি কিছু ভাবে নি কৌস্তভ। মালবিকা নিজে থেকে ওর কাছে সাহায্য চেয়েছে আর ও সাহায্য করবে না তাই কি হয়! মালবিকার বিয়ের আগেও ওদের বাড়ির নানা দায়দফায় ছুটে যেত কৌস্তভ।বিয়ের দিনও বরযাত্রী আপ্যায়ন থেকে শুরু করে মালবিকার পিঁড়ি ধরে যত্ন করে ঘোরানো, সব কাজই নিষ্ঠার সঙ্গে করেছিল ও।
মালবিকার জন্য একটা বাড়ি ভাড়া ঠিক করে রেখেছে কৌস্তভ। আজ বিকেলে জিনিসপত্রসমেত মালবিকাকে রেখে আসবে ওখানে। অবশ্য জিনিসপত্র বলতে মালবিকার কাছে কিছুই নেই তেমন।
গানটা শেষ করে কৌস্তভের দিকে তাকালো মালবিকা। জিজ্ঞেস করল, “আমি কি খুব খারাপ?” কৌস্তভ বলল, “খারাপ কেন হতে যাবি?”
-“স্টুডেন্ট লাইফে পড়াশোনা মন দিয়ে করি নি। নিজের পায়ে না দাঁড়িয়েই বিয়ে করে নিলাম।সেই সংসারেও অ্যাডজাস্ট করে থেকে যেতে পারলাম না। সন্তানের জন্ম দিলাম, সেই দুধের শিশুটাকেও ফেলে চলে এলাম।সময়ের কোনো কাজই আমি সময়ে করতে পারলাম না।”
উঠে গিয়ে মালবিকার মাথায় হাত রাখলো কৌস্তভ। বলল, “জীবন কি শেষ হয়ে গেছে তোর ?সময় অসময় বলে কিছু হয় না।আগে যা করিস নি এখন সেগুলো কর। শোন, নিজের সন্মান সবার আগে।এখন তুই পড়াশোনা করে একটা চাকরি জোটা। তোকে নিজেকেই অনেক লড়তে হবে এখন। এর মধ্যে টুবলুকে সঙ্গে নিয়ে তুই কিভাবে বেরোতি?এখন তুই মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু কর। আমি পাশে আছি।” কৌস্তভের হাতটা ধরল মালবিকা। এতক্ষনের অবরুদ্ধ কান্না ঝরঝর করে ঝরে পড়লো মালবিকার গাল বেয়ে। বলল, “আমি পারবো তো?”
-“অবশ্যই পারবি। কতজন কতো কী পারছে আর তুই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবি না! তারপর না হয় টুবলুকে তুই নিজের কাছে নিয়ে আসিস।”
-“আমি তোর বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। আপাতত একটা ছোটোখাটো কাজ জোগাড় করে দে না আমাকে। আমার কাছে কাজের কোনো ছোটোবড়ো নেই। যেকোনো কাজ করতে আমি রাজি আছি।”
কৌস্তভ কিছু না বলে মালবিকার চোখের জলটা হাত দিয়ে মুছিয়ে দিল। মালবিকার ক্ষতবিক্ষত মনটা ভারী দুর্বল হয়ে গেছিল। আচমকা কৌস্তভের বুকে নিজের মাথাটা রাখলো ও। মালবিকা, যাকে কৌস্তভ এতদিন ধরে চেয়ে এসেছে, যাকে না পেয়ে ওর বুকের এই জায়গাটা এতদিন ধরে শূন্য রয়ে গেছিল, সে হঠাৎ এত কাছে আসাতে কৌস্তভ একটু বেসামাল হয়ে গেল।জড়িয়ে ধরল মালবিকাকে।কৌস্তভের হাতটা মালবিকার কোমর বেয়ে কাঁধ অবধি উঠে এলো।নিজের মুখটা নামিয়ে এনে মালবিকার কপালে একটা চুমু দিল কৌস্তভ।
-“মালবিকা! ছিঃ!” হঠাৎ দরজার কাছ থেকে একটা অস্ফুট স্বর ভেসে এলো। কৌস্তভ আর মালবিকা দুজনেই চমকে দরজার দিকে তাকালো।দরজাটা যে ছিটকিনি লাগানো নেই একথা ওদের কারোরই খেয়াল ছিল না। দরজায় স্তম্ভিতভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ সুপুরুষ;তাকে খুব ভালোমতো চেনে কৌস্তভ। শুভেন্দু দাশগুপ্ত। মালবিকার স্বামী।তার পেছনে মালবিকার বাবা।
মুখ খুলল মালবিকা, “শুভেন্দু তুমি! এখানে কীভাবে এলে?বাবা,তোমরা কিভাবে বুঝলে আমাকে এখানে পাওয়া যাবে?” শুভেন্দু বলল, “সেটা কিভাবে বুঝলাম তা বোঝার মতো বুদ্ধি যদি তোমার থাকতো তাহলে তো হয়েই যেত। ছি!আমি ভাবতে পারি নি, তুমি তলে তলে এমন চরিত্রের! আমাকে বিয়ে করে আমারই পয়সায় খেয়ে পরে তুমি তার মানে এতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে প্রেম চালিয়েছো! আর এখন তুমি ওর হাত ধরে পালিয়ে এসে ফস্টি নস্টি করছো!আগেই কেন ওকে বিয়ে করো নি তুমি?কেন আমাকে ঠকালে?” কৌস্তভ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “শুভেন্দুদা তুমি মালবিকাকে ভুল বুঝছো। ওর আমার সঙ্গে কোনো প্রেম ছিল না। আমার সঙ্গে বিয়ের পরে ও কোনো পরকীয়াও করে নি…” শুভেন্দু হাত তুলে কৌস্তভকে থামিয়ে দিল। বলল, “আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই না। যে দৃশ্য আমি নিজের চোখে দেখলাম সেটা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। মালবিকা, আমি কৌস্তভের কাছে এসেছিলাম তোমার খোঁজ করতে। ভাবি নি তোমাকে এভাবে দেখবো। অনেক জ্বালা,অনেক অনুতাপ নিয়ে ছুটে এসেছিলাম তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে। নাউ আই আন্ডারস্ট্যান্ড, ইউ ডোন্ট ডিসার্ভ মাই অ্যাপলোজি।নিজের সংসার ভেঙে তুমি নিজের সিদ্ধান্তে বেরিয়ে এসেছো। আর কোনোদিন ফিরো না তুমি। টুবলুকে আমি একাই বড়ো করতে পারবো । আর কী লিখেছিলে, ডিভোর্সের কথা! তারপর কৌস্তভকে বিয়ে করবে তুমি?আমার জীবনটাকে নষ্ট করেছো তুমি, তোমাকেও আমি সুখী হতে দেবো না। পাবে না তুমি ডিভোর্স। দেখো, একটা নামহীন সম্পর্কে থেকে তোমার বন্ধু কতদিন তোমার দায়িত্ব নেয়।” মালবিকার বাবা এতক্ষন চুপচাপ ছিলেন। এবার বললেন, “আমাদের এভাবে মুখ পোড়ালি মৌ! কোনোদিন তো আমাদের বলিস নি কৌস্তভের সঙ্গে তোর প্রেম আছে! তোকে জিজ্ঞেস করেই আমরা তোর বিয়ের সম্বন্ধ দেখেছিলাম।” মালবিকা বলল, “বাবা, তোমরা আমাকে পুরোপুরি ভুল বুঝছো।আমি কাউকে ঠকাইনি।”
-“থাক না মৌ। যা দেখার আমরা তো দেখলামই। চলি। বাবা হিসেবে এটুকুই বললাম, ভালো থাকিস।”
দরজা থেকেই বিদায় নিল শুভেন্দু আর মালবিকার বাবা। ওদের যাত্রাপথের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মালবিকা।
(ক্রমশ)
© Asmita Roy
——————————————————
পরবর্তী পর্ব আসতে চলেছে খুব তাড়াতাড়ি। আপডেট পাওয়ার সুবিধার জন্য এই পেজটি ফলো করে যুক্ত থাকুন।