#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(ছয়)
দিয়ার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। সবাইকে চমকে দিয়ে সেকেন্ড হয়েছে ও। বিশেষ করে সায়েন্স গ্ৰুপটায় এত ভালো নম্বর দিয়া কোনোদিন পায় নি । প্রতাপ আর কাকলি দারুন খুশি। অরণ্য ছেলেটা ঘষেমেজে দিয়াকে তৈরি করে দিল বটে! তবে দিয়া বলে বসল, “আমি সায়েন্স নেবো না।“ কাকলি বলল, “কেন?” দিয়া বলল, “যা নম্বর পেয়েছি অরণ্যদার জন্যই। শুধু অংক শেখানো বা সায়েন্স বোঝানো নয়। অরণ্যদা আমাকে সব সাবজেক্টই ভালোবাসতে শিখিয়েছে। ও না থাকলে আমি কিছুই পারতাম না।“ অরণ্য বলল , “তুই পেরেছিস নিজের মেধার জোরেই। কাউকে কিছু শেখানো যায় না যদি না সে নিজে সেটা গ্রহণ করতে না জানে। আর আমি তো আছিই এখনও । যতটা সম্ভব হেল্প করে দেবো।”
ফিজিক্স অরণ্যর নিজের খুব পছন্দের সাবজেক্ট। তাই দিয়াকে ও মূলত ফিজিক্সটাই পড়াচ্ছে ইলেভেন থেকে। তবে কেমিস্ট্রি আর অংকও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করিয়ে দেয় ও।দিয়াকে পড়াতে গিয়ে টাকার হিসেব করে না অরণ্য।এই পরিবারটার সঙ্গে ও নিজের অজান্তেই মানসিকভাবে জড়িয়ে গেছে। স্নেহার সঙ্গে দেখা করে যেদিন মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে অসুস্থ হয়ে গেছিল ও, সেদিন রাতে দিয়ার বাবা মা ওদের বাড়িতেই খেতে ডেকেছিলেন অরণ্যকে। আপত্তি করেছিল অরণ্য। তবে শেষ অবধি সেই আপত্তি থাকে নি। তারপর থেকে দিয়ার মা মাঝে মাঝেই এটা ওটা খাওয়ায় ওকে। ও একা থাকে বলেই হয় তো একটা মায়া ওদের। মায়েরা কি এমনই হয়! অরণ্য কোনোদিন নিজের মা-কে কাছে পায় নি।
স্নেহার করা অপমানটা আজও কানে বাজে অরণ্যর। “ যে ছেলে কোনোদিন নিজের বাবা-মায়ের বন্ডিং দেখে বড়ো হয় নি, যার বাবা-মা সংসার করতে জানে না, তাঁদের ছেলে হয়ে তুই কীভাবে বুঝবি সম্পর্কের কী মূল্য!” বাড়ির সবার যথেষ্ট আদর পেয়েই বড়ো হয়েছে অরণ্য, তবে বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ শুনেছে, ওর মা নাকি ওকে ছেড়ে চলে গেছে। তবে ওর বাবা ওকে খুব ভালোবাসে। তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে ওর মনে হয়, আর সবার মতো ওরও যদি বাবা মা একসঙ্গে থাকতো তাহলে ব্যাপারটা কেমন হতো!
সামনে রবীন্দ্রজয়ন্তী। পাড়ার ক্লাবের অনুষ্ঠানে দিয়া এবার নাচ করবে। একদিন পড়তে পড়তে দিয়া বলে উঠল, “তুমি প্রোগ্রাম দেখতে আসবে অরণ্যদা?”
-“আমি তো এসব বুঝি না !”
-“তাতে কী! এসে দেখোই না। খুব ভালো লাগবে।” দিয়ার ডাগর দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে অরণ্য মাথা নেড়ে বলল, “বেশ।”
গেছিল অরণ্য। পাঁচটা মেয়ের গ্ৰুপে নাচলো দিয়া। “বিপুল তরঙ্গ রে…” গানের সাথে সাথে নিজের শরীরে হিল্লোল তুলে নাচল দিয়া। দিয়ার টানা টানা চোখের অভিব্যক্তি আর মিষ্টি হাসির মিশেলে গানের সুর যেন অন্য মাত্রা পেলো। খালি হাতে যায় নি অরণ্য। বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে ক্যামেরাটা নিয়ে এসেছে। তাতে বেশ ক’টা ফটো তুলে নিল নৃত্যরতা দিয়ার। মেয়েটা ওর মায়ের কাছে অনুযোগ করছিল শুনেছে অরণ্য, প্রত্যেকবার নাকি অন্য মেয়েদের কত সুন্দর সুন্দর ফটো ওঠে। ওর ফটো কেউ তোলে না। ফটোগুলোকে ওয়াশ করিয়ে প্রিন্ট করে রাখলো ও।
পরের মাসে দিয়ার জন্মদিন। দিয়ার জন্মদিনে একটা আইটেম ও নিজের হাতেই করে। এবছর জন্মদিনের কেকটা নিজের হাতেই বানালো দিয়া । ভ্যানিলা ফ্লেভারের স্পঞ্জি কেকটা খাইয়ে অরণ্যদাকে তাক লাগিয়ে দিতে হবে তো! তবে জন্মদিনের সন্ধ্যায় যে ওর নিজের জন্যই এত ভালো একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল, সেটা ও ভাবতেই পারে নি। ওর জন্মদিনের উপহার হিসেবে রবীন্দ্রজয়ন্তী প্রোগ্রামে ওর নাচের বিভিন্ন বিভঙ্গের ফটো প্রিন্ট করিয়ে এনেছে অরণ্য। অরণ্যদার ফোটো তোলার হাত তো দারুন ভালো! এই প্রথম ওর নাচের কেউ এত ভালো ফটো তুলে দিয়েছে। তবে দিয়ার খুশির আরো বেশি কারণ, হয় তো ফটোগুলো অরণ্য তুলে দিয়েছে বলে। ওকে এতটা গুরুত্ব দিল অরণ্য!
********************************
আজ ফিরতে ফিরতে বেশ বেলা হয়ে গেল মালবিকার। ডক্টর মুখার্জীর মেয়ের আজ জন্মদিন। অনেক কিছু রান্নাবান্না হয়েছে সেই উপলক্ষ্যে। তবে আজ সেজন্য কিছু উপরি আয়ও হল। টাকাটা এখনই খরচ করা যাবে না। পরে কোনো প্রয়োজন পড়লে হাত দেবে।দুপুরের কড়া রোদটা যেন আগুনের মতো লাগছিল ওর গায়ে। রোদের আগুন, রান্নার আগুন, দারিদ্রের আগুন, একা বাঁচার লড়াইয়ের আগুন এখন মালবিকার নিত্যসঙ্গী।মাঝে মাঝে ভাবে মালবিকা জেদের বশে ঘর ছাড়ার কোনো দরকার আদৌ ছিল কী ওর! বেশ তো ছিল নিরাপদ আশ্রয়ে।শ্বশুরবাড়িতে অপমান কোন মেয়ে না সহ্য করে! একটা কথাই তো আছে, যে সয় সে রয়। তবে মালবিকা কেন পারলো না সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে! যদিও মালবিকা বোঝে, এখন আর ঠিক ভুল নিয়ে ভেবে ওর কোনো লাভ নেই। যে পথে ও নেমে এসেছে, সেই পথ ধরেই ওকে এগিয়ে যেতে হবে।
কৌস্তভ আপত্তি করে বলেছিল, “তা’বলে তুই শেষমেষ রান্নার কাজ করবি?”মালবিকা বলেছিল, “যে কাজ পাচ্ছি হাতে সেটাই এখন লক্ষী।সৎপথে করলে,কাজের কোনো ছোটোবড়ো হয় না।”
-“তুই এখন পড় না!তোর বাড়িভাড়া, খাওয়ার খরচ এগুলো আমার দায়িত্ব। তুই এত চাপ নিচ্ছিস কেন?”
-“তো নেবো না চাপ! যতটুকু হেল্প না নিলেই নয় ততটুকু হেল্প তোর কাছে নিতে হবে এখন আমায়, তবে hনিজের পুরো দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে কেন চাপাবো!”
-“তোর এমন কাজ করতে কষ্ট হবে না! তোর বাবা একজন স্কুল টিচার, তোর বর অতোবড়ো একজন ইঞ্জিনিয়ার…”
-“বাবা আর বরের পরিচয় ছেড়ে তো আমি বেরিয়েই এসেছি। আর কলকাতায় আমাকে কে চেনে!তাছাড়া রান্না করা আমার কাছে আর নতুন কী কাজ! শ্বশুরবাড়িতেও রান্না করতাম, এখন না হয় তাই করেই কিছু রোজগার করি।”
সেই কথামতো মালবিকা আটমাস হল দুটোবাড়িতে রান্না করছে। সকালবেলা যায় ডাক্তারবাবুর বাড়ি, আর সন্ধ্যেবেলা এক বয়স্ক দম্পতির বাড়ি। ওর নিজের দুবেলার খাওয়াটা ওখান থেকেই হয়ে যায়। আর মাইনের টাকা দিয়ে ও নিজের বাড়িভাড়াটা দেয়। ওকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তোমাকে দেখে তো ঠিক রান্নার লোক মনে হয় না!ভদ্রঘরের মেয়ে বলে মনে হয়। মালবিকা এই প্রশ্নের জবাব দেয় নি। তবে যাই হোক, মালবিকার রান্না আর ওর গোছানো স্বভাবের জন্য দুটো বাড়িই ওর উপর খুশি। রান্নার কাজের ফাঁকে ও চাকরির পরীক্ষার পড়াশোনা করছে। এখন আর কেউ ওকে কোনোকিছু নিয়ে কথা শোনায় না। ওর এই জীবনটায় আছে অনেকটা স্বাধীনতা আর সঙ্গে কঠোর সংগ্রাম।
রোদের তাপটা বড্ডো গায়ে লাগছে। সামনের গলির মুখটায় একটা কল দেখা যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল মালবিকা । শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে সামনে তাকাতেই দেখলো, সামনের বাড়িটার গায়ে একটা হোর্ডিং-এ বড়ো বড়ো করে লেখা, “যত্ন সহকারে শেখানোর জন্য গানের শিক্ষক চাই।” গলির মধ্যে বলে এতদিন বাড়িটা লক্ষ্য করে নি ও। বাড়িটার গায়ে লেখা ‘সুরধারা সংগীত একাডেমি।“ তার মানে এটা একটা গানের স্কুল। এগিয়ে গিয়ে বাড়িটার দরজায় কড়া নাড়লো মালবিকা।
“আপনার নাম?” টেবিলের সামনে বসে থাকা বয়স্ক ভদ্রলোকটি জিজ্ঞেস করল। মালবিকা একটু ইতস্তত করে বলল, “মালবিকা দাশগুপ্ত।” শুভেন্দুর সঙ্গে ডিভোর্স হয় নি ওর। সম্পর্ক না থাকলেও শুভেন্দুর পদবীই ব্যবহার করতে হল ওকে।
(ক্রমশ)
© Asmita Roy
—————————————————–
পরবর্তী পর্বের আপডেট পাওয়ার জন্য আমার পেজটি ফলো করে যুক্ত থাকুন।