ধূসর_রঙের_জলছবি #অস্মিতা_রায় (নয়)

0
198

#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(নয়)
কৌস্তভ ওকে খুব ভালোবাসে একথা ভালো করেই জানে মালবিকা। তবে আজকাল সেই ভালোবাসার মধ্যে একটা একরোখামি চেপে বসেছে। শারীরিক খিদেটা কৌস্তভের মধ্যে একটু বেশিই আছে, এটা বুঝতো মালবিকা। বিয়ের আগে বন্ধুর মতো অনেক খোলামেলা আলোচনা হতো এসব টপিক নিয়ে ওদের মধ্যে। আজকাল যেন কৌস্তভ আরো বেশি পাগল হয়ে উঠেছে।
অন্যান্য সমস্ত বিষয়ে ইচ্ছে অনিচ্ছের মতো শারীরিক চাহিদাও বিভিন্ন মানুষের কম বেশি হতেই পারে, এ কথা মালবিকা মানে।তবে মালবিকার আজকাল ভীষণ বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কৌস্তভের ওর শরীরের প্রতি সাংঘাতিক আকর্ষণ। কৌস্তভ আজকাল সমানে ওর কোমর, বুক ছুঁয়ে যেতে, ওকে চুমু খেতে চেষ্টা করে। যদিও এর জন্য কৌস্তভকে মালবিকা রেপিস্ট মানসিকতার বলে দেগে দেবে না । কৌস্তভ বারবার ওকে বলে, “তোকে আমি খুব ভালোবাসি, আমি কি করবো! মনের টান থেকে তো শরীরের প্রতিও টান আসে। শুধু প্লেটনিক লাভ বলে কি কিছু হয়!” মালবিকা বিরক্ত হয়ে বলে, “তোর কোনো প্রেম ভালোবাসা আমি চাই না। শুধু বন্ধুত্বটাই চাই। আমার কাছে শরীর শরীর করে ঘ্যানঘ্যান করিস না। মেন্টালি তুই সত্যি আমার অনেক কাছের, তবে ফিজিক্যালি সবার সাথে ক্লোজ হওয়া যায় না। ঘেন্না লাগে!” কৌস্তভ আহত হয়ে বলে, “আমাকে এত ঘেন্না তোর!”
শুভেন্দুর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের বোঝাপড়া ভালো ছিল মালবিকার। টুবলুও স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। জীবনে যৌনতা খুব গুরুত্বপূর্ণ একথা মানে মালবিকা, তবে যৌনতা নিয়ে কোনো মাত্রাছাড়া পাগলামি ওর নেই। শুভেন্দুর মধ্যেও অমনটা দেখে নি ও।কৌস্তভের এই স্বভাব ওকে ক্রমশ বিরক্ত করে তুলছে। আজকাল এড়িয়ে চলে ও কৌস্তভকে।
মালবিকার আজকাল রোজগারপাতি বেশ বেড়েছে আগের তুলনায়। বিভিন্ন জায়গা থেকে গানের প্রোগ্রামের ডাক পায় ও। গানের স্কুলটা তো আছেই।এছাড়া নিজেও কিছু ছাত্রছাত্রীকে বাড়িতে গিয়ে গান শিখিয়ে আসে ও। রান্নার কাজ ছেড়ে দিয়েছে ও এখন। পেপারে বিজ্ঞাপন দেখে একটা অফিসে পরীক্ষা দিয়েছিল ও। সেখানে ক্লারিকাল কিছু কাজ করে ও এখন।সব মিলিয়ে বেশ চলছে। নিজের গানটা নিয়ে অনেক বেশি স্বপ্ন দেখে ও আজকাল। ও কী পারবে না একদিন কোনো বড়ো শিল্পী হয়ে উঠতে!ওর একদিন নিজস্ব অ্যালবাম বেরোবে, টিভিতে ওর গান শুনবে সবাই!হতে পারে না এমন! শুভেন্দু দেখবে, যে মেয়েকে ওরা সবাই মিলে অবহেলা, অপমান করেছিল সেই মেয়েই নিজের পরিশ্রমে কতটা উন্নতি করেছে!
প্রায় দুবছর হতে চলল,সংসার ছেড়ে এসেছে মালবিকা। এর মধ্যে কেউ ওর কোনো খোঁজ নেয় নি, ও কেমনভাবে আছে, কোথায় আছে। শুভেন্দু ওকে পুরোপুরি ভুল বুঝলো। ওর বাবা মাও কোনো কথা বলার প্রয়োজন মনে করল না ওর সঙ্গে। ওর ছেলেটা এতদিনে বেশ বড়ো হয়ে গেছে নিশ্চয়ই! মালবিকা ভাবল, একদিন শুভেন্দুকে ফোন করবে ও।
সেই ভাবনামতো সামনের টেলিফোনবুথ থেকে শ্বশুরবাড়ির নম্বরটা ডায়াল করল ও। রিং হচ্ছে। বুক কাঁপছে মালবিকার। খানিকক্ষণ পর ওর শাশুড়ি এসে ফোন তুলল। “হ্যালো….হ্যালো কে বলছেন…. হ্যালো!” মালবিকা কোনো জবাব দিতে পারছে না। ভীষণ ভয় করছে ওর, কম অপমান করে নি এই মহিলা ওকে। আবার যদি আজ কোনো অপমান করে বসে! এমন সময়ে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো পাশ থেকে। টুবলু! তাড়াতাড়ি কথা বলতে গেল মালবিকা। সেই সময়ই শাশুড়ি টুবলুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, “এই তো সোনা মানিক আমার! কাঁদে না সোনা। এখন চান করে ভাতু খেয়ে ঠাম্মির কাছে গল্প শুনে শুনে ঘুমু করবে তো টুবলুবাবু, তাই না!” টুবলু কান্না থামিয়ে হেসে উঠল। শাশুড়ি এদিক থেকে সারাশব্দ না পেয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো,মনে হয় টুবলুর কাছেই গেল।
যা ভেবেছিল, ঠিক তাই। টুবলু মালবিকাকে ছাড়াও সত্যি ভালো আছে। জীবন কারোর জন্যই থেমে থাকে না। ঠিক এগিয়ে চলে।যে শাশুড়ি ওকে এত কষ্ট দিয়েছে, সেই শাশুড়িই টুবলুকে স্নেহচ্ছায়া দিয়ে বড়ো করছে। মালবিকা এই ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হল টুবলু ভালো আছে।নিজের বাপের বাড়িতে একবার ফোন করবে ভাবলো ও। নম্বরটা ডায়াল করেও থেমে গেল।চোয়াল শক্ত করল মালবিকা।বলতে গেলে প্রায় শূন্য হাতেই এই শহরে এসেছিল ও। ক্রমাগত একলা লড়াই করে করে নিজের পায়ের তলায় কিছুটা মাটি তৈরি করেছে। আরো সফল হতে হবে ওকে। ততক্ষন ওর এই একলা থাকার লড়াইটা জারি থাকুক।

*******************************

অরন্যর খালি মনে হয় ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। দিয়াকে তো ওর শুধু পড়ানোরই কথা ছিল। অথচ না চাইতেও বিভিন্ন ঘটনায় দিয়া আর অরণ্য বেশি কাছাকাছি এসে যাচ্ছে।দিয়ার বাবা মা নিশ্চয়ই পছন্দ করবেন না ব্যাপারটা।দিয়া ভারী মিষ্টি মেয়ে। না চাইলেও আজকাল দিয়ার স্নিগ্ধ মিষ্টি মুখখানা ওর মনে ভেসে ওঠে মাঝে মাঝেই। এদিকে অরণ্যর প্রতি দিয়ার দুর্বলতাটা জাস্ট বয়সজনিত ইনফ্যাচুয়েশন, একটা মোহ ছাড়া তো আর কিছুই না! ঠিক এই বয়সেই স্নেহার সঙ্গে ওর প্রেম হয়েছিল। কাঁচা বয়সের সেই প্রেম বড়ো নিষ্পাপ। কিছুদিন পর সেই স্নেহাই ওর বাবা-মায়ের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলে ওকে ছেড়ে গেল! স্নেহা ছেড়ে যাওয়ার কষ্টের চেয়েও এই অপমান ওর কাছে বেশি কষ্টের। এক বছর বয়সেই অরণ্যর মা ওকে ছেড়ে, সংসার ত্যাগ করে চলে গেছিল। কারণ, বনিবনা হয় নি। অরণ্য শুনেছে, ওর পরিবারের সবাইকে এগুলোর জন্য আশেপাশের লোকজনের অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তারপর আস্তে আস্তে যা হয়, সব প্রসঙ্গই এক সময় থিতিয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তাই হল। তবে এখনও মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে এই প্রসঙ্গ উঠে আসে বই কী! অরণ্য ভাবে ওর বাবা বিয়ে করে তাহলে সারাজীবন পেলো কী! বনিবনার যদি এতই অভাব থাকে, তাহলে বিয়ে করার দরকারটাই বা কী! অরণ্য ঠিক করে নিয়েছে, এসব হৃদয়ঘটিত সম্পর্কটম্পর্কে ও আর কখনও জড়াবে না। বিয়ে তো নৈব নৈব চ! ছোটো থেকেই ও লেখাপড়ায় খুব ভালো। অনেক বড়ো হওয়ার স্বপ্ন দেখে ও। নিজের মতো বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াবে অরণ্য। অবশ্যই সঙ্গে ওর বাবাও থাকবে। ওর বাবা ওকে কখনও ছেড়ে যায় নি, অরণ্যও ওর বাবাকে আগলে রাখবে।
অরণ্য মন শক্ত করল, দিয়ার ভাবনা ওর মনে ও আসতে দেবে না। তবে দিয়ার সঙ্গেও ও কোনো বাজে ব্যবহার করবে না।ব্যাপারটা বুদ্ধি করে সন্তর্পনে সামলাতে হবে।
প্রতাপকাকু এখন অনেকটাই সুস্থ। সেদিন একটু ওনার সাথে দেখা করতে গেল অরণ্য।দিয়া বাড়িতে নেই।মানুষটা মানসিকভাবে যথেষ্ট ভেঙে পড়েছে। অরণ্যকে বলল, “কী বিপদে পড়লাম বলো দেখি! আমার এমন একটা অসুখ হল, কতদিন দোকান বন্ধ, ব্যবসায় কত ক্ষতি হচ্ছে!” অরণ্য বলল, “আপনি বেশি চিন্তা করবেন না কাকু। আপনি ঠিক ব্যবসা সামলে উঠবেন। তাছাড়া এখন কাকিমা তো থাকছেনই দোকানে।আপনি এখন একটু টেনশন ফ্রি থাকুন।” প্রতাপ আবারও বলল, “ কিভাবে টেনশন ফ্রি থাকি বলো! দিয়াটার সবে টুয়েলভ। এর মধ্যে যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তবে কী হবে! ওর পড়াশোনা, বিয়ে থা সবই তো বাকি! একটা ভালো ছেলের খোঁজ পেলে আমি একটু নিশ্চিন্ত হতাম।” কথাটা শুনে অরণ্যর একটু অস্বস্তি হল। বলল, “দিয়ার তো সবে টুয়েলভ এখন। এত তাড়াতাড়ি ওর বিয়ে নিয়ে ভাবছেন কেন!” প্রতাপ বলল, “ বিয়ে নিয়ে এখুনি ভাবছি না, তবুও নিজের জন্য ভয় লাগে। কোনদিন কী হয়ে যায়! যদি দিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরার মতো কাউকে দেখে যেতাম, তাহলে আমি একটু নিশ্চিন্ত হতাম।” এমন সময়ে দিয়া ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “নানা বিষয় নিয়ে টেনশন করা হচ্ছে বাবার একটা ফেভারিট হবি। ভুলভাল ভাবনা ছাড়ো তো বাবা! একটা কাজের কথা শোনো, এবার আমাদের মহালয়ার প্রোগ্রামে উদ্বোধন করতে কাকে আনা হবে বলে ঠিক হয়েছে জানো?” প্রতাপ বলল, “কাকে?” দিয়া বলল, “মালবিকা দাশগুপ্ত, বাবলুদা জানালো।ওই যে রবীন্দ্রসংগীত করেন.. অরণ্যদা তুমি চেনো ওনাকে?” মালবিকা দাশগুপ্তর নামটা শুনেই অরণ্য চমকে উঠেছে। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মালবিকা দাশগুপ্তই তো ওর জন্মদাত্রী! সে আসছে এই পাড়ার ক্লাবের প্রোগ্রামে! অরণ্যকে চুপ দেখে দিয়া বলল, “কী গো? চেনো না? উনি তো বেশ বিখ্যাত সিঙ্গার। আমি ওনার গানের খুব ফ্যান। উনি মেইনলি রবীন্দ্রসংগীত করেন ঠিকই, তবে কিছু আধুনিক গানেরও অ্যালবাম আছে ওনার।” অরণ্য বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও চিনি।” দিয়া বলল, “মহালয়ার প্রোগ্রামে তুমি থাকবে তো? দেখো আমাদের কত বড়ো করে প্রোগ্রাম হয়!” অরণ্য কিছু না বলে মাথা নাড়লো।
অরণ্য আর দিয়া দুজনেই এক এক করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কাকলি প্রতাপকে বলল, “হ্যাঁ গো, তোমার কী খেয়েদেয়ে কাজ নেই! টেনশনে তুমি এখন দিয়ার বিয়ের চিন্তা করছো! তাও আবার অরণ্যর সাথে এসব নিয়ে গল্প করছো!” প্রতাপ বলল, “ অরণ্য ছেলেটা বেশ ভালো না? দিয়ার সঙ্গে মানাবে ভালো।” কাকলি বলল, “কী! অরণ্য আর দিয়া! তুমি এসব ভাবছো!”

(ক্রমশ)

© Asmita Roy

—————————————————–

পরবর্তী পর্বের আপডেট পাওয়ার সুবিধার জন্য আমার পেজটি ফলো করে সঙ্গে থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here