নাইওরি
মৌরি মরিয়ম
শেষ পর্ব
জামাই নিয়ে মাছ ধরতে ময়নার বিলে গিয়ে সেখানেই তাকে খুন করে বিলে ফেলে এলো জালাল জব্বার ও জয়নাল মির্জার লোকেরা। তবে মৃত্যুর আগে রঞ্জু এটা জেনে যেতে পারলো যে তার বাবার ঠিক কোন অপরাধের জন্য তাকে মরতে হচ্ছে। এও জানতে পারলো, কাচারি ঘরে কোনো বিড়াল ছিল না। ছিল হাত-মুখ বাঁধা তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। তাকেই বাঁচাবার শেষ চেষ্টাসরূপ শব্দটা করেছিল সে। জালাল জব্বার রসিয়ে রসিয়ে বলছিল সেসব কথা!
আহারে জীবন! আরেকটি বার জেসমিনের সাথে দেখা হলো না। শোনা হলো না তার না বলা সেই কথাগুলো! এতগুলো দিন অপেক্ষার কোনো অর্থ রইলো না। কে জানতো মাত্র এক মাসের ব্যবধানে এতকিছু ঘটে যাবে!
সেই রাতেই জেসমিনকে কাচারি ঘর থেকে তার ঘরে আনা হলো। কিন্তু এখানেও তাকে আটকে রাখার নির্দেশ দিলেন জয়নাল মির্জা। জেসমিনের দরজার বাইরে একজনকে পাহাড়ায়ও বসানো হলো।
রঞ্জুর মৃত্যুর খবর পেয়ে জেসমিন মাটিতে শুয়ে পড়ে বলল,
“আমারেও ওই মাটিতে মিশাইয়া দেও তোমরা!”
কিন্তু চিৎকার করার মত শক্তি আর তার অবশিষ্ট নেই। সে শুধু উদ্ভ্রান্তের মত কেঁদে চলেছে। উল্টোপাল্টা প্রলাপ বকছে। কোহিনূর বানু জয়নাল মির্জাকে বললেন,
“আর কত পাপ করবেন? নিজের মাইয়ারেও যে কেউ বিধবা করতে পারে আপনেরে না দ্যাখলে জানতাম না।”
জয়নাল মির্জা মেয়েছেলের কথা গায়ে মাখেন না। সে তার ঘরে গিয়ে শান্তির ঘুম দিল। হারুন ব্যাপারী অতি বাড় বাড়ছিল। এতদিনে তাকে একটা উপযুক্ত জবাব দেয়া গেছে। জয়নাল মির্জার সাথে লাগতে আসলে কী হতে পারে সেটা এবার বুঝবে।
পরদিন দুপুরের খাবার খাওয়াতে জেসমিনের ঘরে ঢুকলেন কোহিনূর বানু। বাইরে পাহাড়াদার। তাই জেসমিন ফিসফিসিয়ে বলল,
“মা আমার পেটে রঞ্জুর বাচ্চা।”
এ কথা শুনে আৎকে উঠলেন কোহিনূর বানু। যে খবরে খুশি হবার কথা সে খবরে আজ সে খুশি হতে পারছে না। তার কষ্ট আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। জেসমিন আবার বলল,
“আমি পলাইয়া যামু। আমারে সাহায্য করো মা। অরা বাচ্চাডার কথা জানতে পারলে রাখতে দেবে না।”
“কিন্তু পলাইয়া যাবি কোতায়?”
“শ্বশুরবাড়ি যামু। হেরা জাগা না দিলে একদিকে যামু যাইয়া। কপালে যা আছে তাই হবে। আমি খালি বাচ্চাডারে জন্ম দিতে চাই মা। আমার রঞ্জুর একমাত্র চিহ্ন ও। আমি অরে সারাজীবন আমার লগে রাখতে চাই। তোমার দুইডা পায়ে ধরি আমারে পলাইতে সাহায্য করো।”
কোহিনূর বানু শতভাগ নিশ্চিত বাচ্চার কথা জানাজানি হলে জেসমিন যা বলেছে তাই হবে। তিনি রাতের খাবার খাওয়ানোর ছুঁতোয় জেসমিনের ঘরে ঢুকে হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেন কোহিনূর বানু। তারপর ফিসফিস করে বললেন,
“এই টাহা কয়ডা রাখ। কামে লাগবে। আর পাশের বাড়ির আয়নালরে কইয়া ঘরের সিঁধ কাটনের ব্যবস্থা কইর্যা রাখছি। রাইত বাড়লে আইয়া কাইট্যা দেবে। বাইর হইয়া যাইছ।”
জেসমিন মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল,
“মাগো সারাটা জনম তোমারে খালি জ্বালাইসি। আমারে মাফ কইরা দিও।”
কোহনূর বানুও চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। সে মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
“পাগল মাইয়া আমার! যেখানেই থাকোস নিজের যত্ন নিবি, মার দোয়া সবসময় তোর লগেই আছে। অনেক দূরে চইলা যাইস। এই শকুনের দল জানি তোর নাগাল না পায়! এত বড় দুনিয়ার কোনো না কোনো খানে তোর জায়গা নিশ্চয়ই হবে।”
জেসমিন মাঝরাতে পালিয়ে গেল। দৌড়াতে দৌড়াতে যখন শ্বশুরবাড়ি পৌঁছালো তখন ভোর হয়ে গেল। বাড়িতে ঢুকে উঠান পার হয়ে ঘরে ঢোকার সিঁড়িতে উঠলো। তারপর আচমকাই ঘরের ভেতর থেকে রোকেয়া আর হারুন ব্যাপারীর কথা শুনতে পেয়ে থেমে গেল। রোকেয়া বেগম বিলাপ করছিলেন,
“আপনেরে আমি বলছিলাম জয়নাল মির্জার লগে গ্যাঞ্জাম কইরেন না। গ্রামের সবাই মানা করছিল। আপনি শুনেন নাই। কি এক জমি নিয়া পইড়া ছিলেন। কী লাভ হইল জমি পাইয়া? ছেলে তো হারাইলেন। আবার জমির আশায় ছেলে বিয়া করাইলেন ওই কষাইয়ের বাড়িতে। এত লোভ ক্যান আপনের? এখন দেন, আমার ছেলেরে ফেরত দেন।”
হারুন ব্যাপারী বললেন,
“কাইন্দ না রঞ্জুর মা। আমাদের ছেলেকে যে এইভাবে হত্যা করেছে তাকে আমি ছাড়ব না। জেসমিন একদিন না একদিন এই বাড়ি আসবে। তার বাপের চোখে ফাঁকি দিয়ে হলেও আসবে। সেইদিন জেসমিনকে টুকরা টুকরা করে তার বাপের কাছে উপহার পাঠাব।”
জেসমিন কেঁপে উঠলো। রোকেয়া বেগম বললেন,
“আপনাদের খুনাখুনি তো চলতেই থাকবে…
জেসমিন বাকি কথা আর শুনলো না। শোনার দরকারও নেই। চুপিচুপি কয়েক পা পেছনে এসে উলটো ঘুরে দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রাস্তায় উঠেও দৌড়াতে লাগলো। দৌড়াতে দৌড়াতে কোন দিকে গেল সে জানেও না। একসময় ভোর হয়ে এলো। এবার দৌড় থামিয়ে সে মাথায় ঘোমটা তুলে হাঁটতে লাগলো। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে এক নদীর ঘাটে এসে পৌঁছালো। ততক্ষণে সূর্য মাথার উপরে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। একটা নৌকায় অনেক যাত্রী উঠছে। নৌকা কোথায় যাবে সে জানেনা। তবু উঠে পড়লো।
নৌকার এক কোনায় বসে আঁচল দিয়ে ঘাম মুছলো। তখনই হাতে পড়ল আঁচলে বাধা রঞ্জুর চিঠিটা। বাঁধন খুলে চিঠিটা বের করলো জেসমিন। সেখানে লেখা,
তুমি নেই সঙ্গে সখি
তুমি নেই চোখেরও সমীপে,
আছো তুমি অঙ্গে সখি
আছো পরশও প্রতাপে।
যে অঙ্গসুধা এনেছি ভরে হৃদয় কোঠর
ফুরাবেনা গেলে সহস্র কোটি বছর
তুমি নেই বক্ষে সখি
তুমি নেই কক্ষে,
আছো তুমি রোমন্থনে
আছো স্মৃতির দংশনে।
রঞ্জুর হাতের লেখা! লেখাটার উপর হাত বুলিয়ে চিঠিটা ভাঁজ করে আবার আঁচলে বেঁধে রাখলো জেসমিন। নৌকা এ ঘাট ও ঘাট ঘুরে শেষ ঘাটে যখন থামলো তখন সে একটা বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছালো। উঠে পড়লো বাসে। বাস কোথায় যাবে তা জানার আগ্রহ তার নেই। সে শুধু দূরে যেতে চায়। এইসব মারামারি খুনোখুনি থেকে অনেক দূরে। যেখানে গেলে সে তার সন্তানকে নিয়ে নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারবে।
সমাপ্ত
আগের পর্ব,
https://facebook.com/100044423166701/posts/553458459478255/