নাইওরি পর্ব ২

0
462

নাইওরি
মৌরি মরিয়ম

পর্ব ২

আষাঢ় মাস। ভরা বর্ষায় টলমল জলে ভরে উঠেছে পুকুর। ঝরে পড়া অজস্র সোনালু ফুল পুকুরের জলে ভাসছে। জেসমিন সেই পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটলায় বসে ভাতিজা, ভাইঝিদের সাথে নিয়ে আধাপাকা আমের ভর্তা বানাচ্ছে। ভর্তা আবার দুই পদে বানানো হচ্ছে। বাচ্চাদের জন্য ঝাল ছাড়া, বড়দের জন্য ঝাল দিয়ে।
আউশ ধান উঠেছে। মির্জা বাড়ির বউরা সকাল থেকে বড় বড় পাতিলে সেই ধান সেদ্ধ করছে। চুলার পাশে বড় হোগলা বিছানো। পাতিলের ধান প্রথমে সেই হোগলায় ঢেলে ফেলা হয়। বাড়তি পানিটুকু ঝড়ে গেলে সেই ধান ডালা ভরে নিয়ে উঠানে অন্য শুকনো হোগলার উপর ঢালা হয়। আমন ধানের সময় অবশ্য সরাসরি উঠানেই ধান শুকানো হয়। প্রথমে উঠানটা গোবর দিয়ে লেপে নেয়া হয়, এতে মাটি শক্ত হয়, ধান উঠানোর সময় আলগা মাটি উঠে আসেনা। কিন্তু আউশ ধানের সময় হুটহাট বৃষ্টি নেমে পড়ে বলে হোগলার উপর শুকানো হয় যাতে বৃষ্টি নামলে দ্রুত তুলে ফেলা যায়। কোহিনূর বানু বড় বউ আসমাকে নিয়ে ধান সেদ্ধ করছেন। আসমা ভূতের মত কাজ করতে পারে। জনশ্রুতি আছে, কেশবপুরের এতবড় পালের দিঘি নাকি এক রাতে কেটেছিল ভূতেরা। সেই দিঘি কাটার গল্প একেকজনের মুখে একেক রকম। আসমা তেমনি এক দিনে মনকে মন ধান সেদ্ধ করে ফেলতে পারে। আসমা সাথে থাকলে তার তেমন বিশেষ কোনো কষ্ট হয় না।
একজন কাজের মহিলা ডালা ভরে ধান উঠানে নিচ্ছে। ছোট বউ মিনু আরেকজন কাজের মহিলাকে নিয়ে সেই ধান আউলে দিচ্ছে। ইদানীং মিনুকে বেশি কষ্টের কাজ তিনি দিচ্ছেন না। কারণ তার ধারণা মিনু পোয়াতী হয়েছে। কিন্তু বান্দর মেয়েছেলে এত গুরুত্বপূর্ণ কথা তার কাছে কেন এখনো গোপন রেখেছে বুঝতে পারছে না!
যে পরিমাণ ধান সেদ্ধ করতে হবে তাতে এই ক’জন হিমশিম খাচ্ছে। আরও লোক দরকার কিন্তু আর কাউকে এই মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছেনা। এমতাবস্থায় জেসমিনের বাচ্চাদের সাথে বসে আম ভর্তা বানানোটা গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

কোহিনূর বানু এই গেরস্ত বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন ৯ বছর বয়সে। তখনও সাবালক হননি। তার শাশুড়ি করিমন বিবির ছিল মাথার ব্যামো। এই ব্যামো শুধুশুধু হয়নি। এর পেছনে আছে বিরাট ইতিহাস। করিমন বিবি প্রায়ই স্বপ্নে দেখতেন, সাতটি মটকা ভরা কাচা টাকা। ঢাকনাগুলো ওঠে নামে। ভেতরে টাকা দেখা যায়। একটা গায়েবি আওয়াজ বলে, “এই সব টাকা তোর।”
করিমন বিবি যক্ষের ধনের কথা শুনেছেন তবে তার সাথে এমন কিছু হবে বিশ্বাস করতে পারতেন না।
এরপর একদিন সেই গায়েবি আওয়াজ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। তাকে বলল, “ওঠ করিমন, দেখ তোর উগুইরতলার (চাল ডালের মটকা মাটিতে রাখলে নষ্ট হয়ে যায়, সেসব রাখার জন্য কাঠের তৈরি উঁচু তাকের মত জিনিস) নিচে সাতটা মটকা ভরা টাকা। সব তোর। আওলা মাটি(পুকুরে পানির নিচের ভেজা মাটি) দিয়ে ঘরবাড়ি সারাবাড়ি লেপে গোসল করে আসবি। তারপর পানিতে একফোঁটা গোবর দিয়ে তাতে মটকা থেকে কিছু কাচা টাকা নিয়ে জ্বাল দিলেই সব টাকা তোর হয়ে যাবে। কেউ দেখার আগে সব কাজ শেষ করবি।”
করিমন বিবি বিছানা থেকে নেমে উগুইরতলায় মটকাগুলো দেখতে পেলেন। ঢাকনা তুলে দেখলেন সবগুলো মটকা ভরা কাচা টাকা। সে দ্রুত পুকুর থেকে আওলা মাটি তুলে ঘর লেপেপুছে পরিস্কার করলেন। এরপর গোসল করে এসে চুলা ধরালেন। এসবই দূর থেকে লক্ষ্য করলেন তার বড় জা জমিলা বিবি। তার বড় সন্দেহ হয়। এতরাতে করিমন কেন ঘর লেপে! সে বিষয়টা বোঝার জন্য এগিয়ে যায়। করিমন একটা হাড়িতে পানি ও একফোঁটা গোবর দিয়ে চুলায় বসালেন। ঘরে আসবেন টাকা নিতে তার আগেই জমিলা বিবি নাপাক শরীরে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
“তোমাগো আগুন তাওয়াডা কই গো করিমন?”
আগেকার দিনে আগুন বড় সহজলভ্য ছিল না। সারারাত মাটির পাত্রে তুষের ভেতর জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে এক বিশেষ পদ্ধতিতে আগুন সংরক্ষণ করা হত। সেই পাত্রের নাম ছিল আগুন তাওয়া। সেই আগুন তাওয়ার ছুঁতোয় যেইনা জমিলা বিবির নাপাক শরীরে ঘরে পা দিল অমনি টাকা ভরা সাতটা মটকা গড়গড়িয়ে নেমে গেল পানিতে। এরপর উধাও। সেই থেকেই যক্ষের ধনের শোকে করিমন বিবি পাগল। প্রবাদ আছে, যারে ধরে যক্ষা, তার নাই রক্ষা। করিমন বিবিরও রক্ষা হয় নি। তিনি এমন বদ্ধ পাগল ছিলেন যে তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। গেরস্ত বাড়ির সকল কাজের সাথে পাগল শাশুড়ির সেবা, সবই কোহিনূর বানুকে বড় জায়ের সাথে ভাগে করতে হতো সেই ৯ বছর বয়স থেকে। জেসমিনটা যেরকম কামচোর হয়েছে যদি এরকম কোনো বাড়ি গিয়ে পড়ে কীভাবে সামলাবে কে জানে!
কোহিনূর বানু রান্নাঘর থেকেই হাঁক ছাড়লেন, “ও লো নবাবের বেডি, আর কত গায়ে বাতাস লাগাইয়া চলবি? আসমার লগে একটু ধানের পাতিলডা ধরলেও তো পারোস।”
জেসমিন পুকুরপাড় থেকেই বলল, “অতবড় পাতিল আমি জাগাইতে পারি?”
“পারবি না ক্যা? ভাত খাও না তুই? পরের বাড়ি যাইয়া কেমনে করবি?”
“যহন পরের বাড়ি যামু তখন ঠিকই পারমু। দুই চক্কু দিয়া তো দেখতেইয়াছি কোন কাম ক্যামনে করে।”
কোহিনূর বানু বললেন, “এত বড় বড় বয়ান না দিয়া মিনুর লগে ধান আউলা গিয়া। পাতিল জাগাইতে পারবি না বুঝলাম। ধান আউলাইতে তো পারবি। হেইডা কইরা আমারে উদ্ধার করো।”
“না, ধানও আউলাইতে পারমু না। বাপের বাড়ি বইয়াও কাম করমু, পরের বাড়ি যাইয়াও কাম করমু। সারাজনম কি কাম কইরা কাটামু? ও ছোট ভাবি, তুমি কও দেহি বাপের বাড়ি থাকতে কি তুমি কোনো কাম করতা?”
মিনু হাসলো শুধু, কিছু বলল না। কোহিনূর বানু জানতেন এ মেয়ের সাথে কথা বলে লাভ নেই। তবুও বলার কাজ বললেন। বউরা বলতে তো পারবে না যে তিনি মেয়েকে কাজ করতে না বলে শুধু বউদের দিয়েই কাজ করান!

আমভর্তা বানানো শেষ হলে কলাপাতায় করে সেই ভর্তা বাড়ির সকলের কাছে পৌঁছানো হলো। সবাইকে দিয়ে তারপর জেসমিন খাওয়া শুরু করলো। আম কুচি কুচি করে কেটে তাতে লবন, মরিচ পোড়া, সরিষাবাটা আর লেবুপাতা দিয়ে মেখেছে। এ যেন অমৃত!
বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। আশেপাশে সবাই সব কাজ ফেলে ধান তুলতে দৌড়ে এলো শুধুমাত্র জেসমিন ছাড়া। বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল রঞ্জু ও তার বন্ধু মানিক। এ বাড়ির ধান ভিজে যাচ্ছে বলে তারা দৌড়ে এসে ধানের হোগলা তুলতে লাগলো।
এবার কোহিনূর বানু রীতিমতো রেগে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, “নবাবের বেডি তোর ঠ্যাং যদি আমি আইজ না ভাঙছি! বিষ্টি নাইম্যা গেল। অন্য বাড়ির পোলারা আইয়া ধান উডায় তাও তুই ধরোনা? তোরে পয়দা করছিলাম ক্যা আমি?”
সর্বনাশ! অন্য বাড়ির ছেলেরা আবার কেন আসলো! তোরা পথ দিয়ে যাচ্ছিলি যা না বাবা। অযথা ঘরে আগুন লাগাতে কেন এলি? এসব ভাবতে ভাবতেই জেসমিন গিয়ে ধানের হোগলা ধরলো। রঞ্জু ধান ঘরে তুলতে তুলতে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল, স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো পরী তার হোগলার উল্টোপাশের দিকটা ধরলো। একটা ছাপাশাড়ি প্যাঁচ দিয়ে পরা। লম্বা চুলগুলো লাল ফিতেয় কলাবেনী করা। গায়ের রঙ দুধে আলতা, গালের রগগুলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটে চোরা হাসি। পরী তার দিকে তাকালো না।

কেশবপুর গ্রাম থেকে বের হতে না হতেই ঝুমবৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। কাচা রাস্তা কাদামাটিতে মাখামাখি হয়ে আছে। হাঁটতে গিয়ে পা গেঁথে যাচ্ছে।
মানিক বলল, “ভুল অইয়া গেল রে ব্যাডা।”
রঞ্জু তখনো একটা ঘোরের মধ্যে। পরিটাকে সে কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না। ঘোরের মধ্যেই সে মানিকের কাছে জানতে চাইল, “কী ভুল?”
“বৃষ্টি থামা পর্যন্ত চেয়ারম্যানবাড়ি থাকা উচিত আছিল।”
রঞ্জু এবার আচমকা বলল, “ঠিক বলছিস। আরও কিছুক্ষণ থাকা উচিত ছিল। পরিটারে আরও দেখতে পারতাম তাহলে।”
“এ রঞ্জু তোর কী অইছে? পরি কই পাইলি? হাবিজাবি কী কস?”
“যে মেয়েটা আমার সাথে ধানের হোগলা ধরল তার কথা বলি। পরির মত সুন্দর। কালকে আবার আসব ওকে দেখতে।”
মানিক এবার আঁৎকে উঠলো, “সর্বনাশ। এইসব চিন্তা একদম বাদ দিয়া দে। জেসমিন কার মাইয়া জানোস?”
“বাহ ওর নাম জেসমিন! কামিনী ফুল!”
“রঞ্জু জেসমিন চেয়ারম্যানের মাইয়া। জানতে পারলে খুন করব তোরে।”
“রাখে আল্লাহ মারে কে?”
এ কথা বলে হেসে ফেলল রঞ্জু।

চলবে…

আগের পর্ব,
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=545852366905531&id=100044423166701

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here