নাটাই ঘুড়ি পর্ব-১

0
3131

#নাটাই_ঘুড়ি
।।১।।
ভোর ছয়টায় যখন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়, আম্মু দরজা খুলে দুধ নেয় গোয়ালার কাছ থেকে, তখন মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায় মীরার। আজকেও ভেঙে গেল।
মীরার সাথে শোয় তার চাচাত বোন নীরা আপু। বড় চাচার মেয়ে।
সাবধানে ওর গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে আস্তে আস্তে সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে নেমে এল মীরা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল নীরা আপুর ঘুমন্ত সুন্দর মুখের দিকে।
মীরার নামটা নীরা আপুর সাথে মিলিয়ে রাখা। যদিও নীরা আপুর সাথে কিছুমাত্র মিল নেই তার।
না চেহারায় না স্বভাবে। নীরা আপু কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।
দারুণ সুন্দরী। একদম বড় চাচির মত গায়ের রঙ, মুখটা পানপাতা শেইপের, কাটা কাটা নাক মুখের গড়ন, কেউ যেন নিখুঁত করে তৈরি করেছে।
কথার ঝালটাও সেই রকম। বড় চাচার যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন দাদার ব্যবসার অবস্থা ছিল রমরমা।
প্রচুর যৌতুক এনে অবস্থাপন্ন ঘর থেকে মেয়ে আনা হয়েছিল বড় চাচার জন্য। আর মীরার আব্বুর বিয়ের সময় দাদার অবস্থা কিছুটা পড়ে গিয়েছিল।
তাছাড়া মীরার আম্মু আব্বুর মনে হয় বিয়ের আগেই কিছুটা ভাব ভালোবাসা হয়ে থাকবে। তাই মীরার আম্মুর বিয়েতে তেমন কোনো বাছাবাছি কিংবা যৌতুক আদায় করার সুযোগ পাওয়া যায়নি।
বড় ঘরের মেয়ে আগুন সুন্দরী বড় চাচির সামনে মাঝারি ঘর থেকে আসা মাঝারি চেহারার মীরা তাই আম্মুকে বরাবরই ম্রিয়মাণ থাকতে দেখেছে ছোটবেলা থেকেই। সে অবশ্য এইসব কেয়ার করে না।
মীরা আম্মুর গায়ের রঙ পেয়েছে। স্বাস্থ্যও মোটার দিকে, চেহারাও কেমন চাকমা চাকমা ধরণের।
মীরার মুখটা কেমন গোল, মাঝে মাঝে তার মনে হয় নাকের ওপরে কম্পাস রেখে ঘোরালে নিখুঁত একটা সার্কেল হয়ে যাবে। ব্যাপারটা ভেবেই হাসি পেয়ে গেল তার। ফিক করে হেসে ফেলল সে।
কানে এল দাদির কোরান তেলাওয়াতের শব্দ। ফজরের নামাজ পড়ে সূর্য ওঠার আগে পর্যন্ত কোরান তেলাওয়াত করে দাদি। তারপর ইশরাকের নামাজ পড়ে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাদির কোরান তেলাওয়াত শুনতে শুনতে বাইরে ভোরের আলো ফুটে ওঠা দেখতে লাগল মীরা। চায়ের কড়া লিকারে আস্তে আস্তে ড্যানিশ ঢেলে দিলে কুচকুচে কালো চা যেমন আস্তে আস্তে সুন্দর সোনালি রঙের হয় অবিকল সেরকম ধীরে ধীরে নীলাভ আকাশটা ফরসা হয়ে উঠছে।
দাদা আর বড় চাচাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, মসজিদ থেকে ফিরছে। মীরা চট করে সরে এল পিলারের আড়ালে।
বড় চাচি এখনো বের হয়নি ঘর থেকে, আম্মু নাস্তা বানাচ্ছে ফুলিকে নিয়ে। ও এই বাসায় আছে গত ছয় বছর ধরে।
ছয় বছর আগে ওর খালার সাথে এক শীতের সকালে এই বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছিল ফুলি। তখন মনে হয় বয়স বারো তেরো হবে।
ওর খালা নির্বিকার মুখে বলেছিল, ওর স্বামী নাকি ওকে নেয় না, দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। ছোট একটা বাচ্চা আছে দুই মাসের, তাকে নিয়ে বড় বিপদে পড়েছে।
তখন মীরাও ছোট, ক্লাস থ্রিতে পড়ে কেবল। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।
এই বাড়ির পেছনে একটু দূরে তখন একটা পুকুর ছিল। মীরা স্কুল থেকে ফিরে আসার পর ওকে সাথে নিয়ে দুপুরবেলা সেই পুকুরে নেমে ওর দিকে পেছন ফিরে ব্লাউজ আলগা করে স্তনে চাপ দিয়ে দিয়ে বুকের দুধ বের করে করে পুকুরের পানিতে ফেলে দিত ফুলি।
মীরা পুকুরে নামত না, পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকত পাহারায়। ফুলি তখন শাড়ী পরত।
মীরা তখন ছোট, তখন হালকা হালকা বুঝেছিল বিষয়টা। পুরোপুরি বুঝেছিল ওর ছোট ভাইটার জন্মের পর।
ফুলি আসার এক বছর পর জন্ম হয় ওর ছোট ভাই মাশুকের। ওর জন্মের পর দুই তিন ঘন্টা পর পর ঘরের এক কোণায় বসে বুকে নিয়ে ওকে খাওয়াত আম্মু।
আম্মুর শ্যামলা মুখটা তখন ভরে যেত অদ্ভুত এক আলোতে। তখন মীরা তার ছোট্ট মনে হিসেব মিলিয়েছিল ফুলির বুকের দুধ ফেলে দেওয়ার রহস্যের।
ফুলি বলেছিল, সন্তান কাছে না থাকলে বুকে যে দুধ জমে ওঠে, তা যেখানে সেখানে ফেলতে নেই। নদীতে ফেলা যায়, নদী না পেলে পুকুরে।
পরের বছর খবর এসেছিল ফুলির ছেলেটা মরেছে পানিতে ডুবে। নানীর তত্ত্বাবধানে ছিল, হাঁটতে শেখার পর দুরন্ত ছেলে ডুবে মরেছে ওই পুকুরে ডুবেই।
মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদেকেটে ছেলের বাবাকে শাপশাপান্ত করেছিল ফুলি। তারপর অবশ্য কেটে গেছে আরো চার বছর।
সবকিছুই বদলে গেছে অনেক। বাড়ির পেছনের পুকুরটা, যেখানকার পানিতে মিশে ছিল ফুলির বুকের দুধ, সেটা এখন আর নেই।
পুকুর ভরাট করে বিল্ডিং উঠেছে নতুন। বিল্ডিংটার উল্টো দিকে নতুন একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছে “ইস্টার্ন” নামে।
ইদের সময় মার্কেট থেকে হাল ফ্যাশনের জামা কিনে এনে পরে ফুলি। ছেলের কথা ওর মনে পড়ে কিনা বোঝা যায় না।
ওইটার পাশে যে লোহার গেটওয়ালা পুরানো, জায়গায় জায়গায় রঙ উঠে যাওয়া ময়লা ময়লা হলুদ রঙের দোতলা বিল্ডিংটা আছে, ওইটাই মীরাদের বাড়ি। বাড়ির নাম “আমেনা মঞ্জিল”।
আমেনা মীরার দাদার মায়ের নাম। মীরাদের বাসায় থাকে দাদা, দাদি, আব্বু, আম্মু, বড় চাচা, বড় চাচী, ছোট চাচা, ফুপি।
পারফেক্ট যৌথ পরিবার। মীরার দাদার আগে অনেক টাকাপয়সা ছিল।
তখন বাসার সবার সাথে খুব হম্বিতম্বি করতেন। শেয়ার মার্কেটে বড় ধরণের লস খাওয়ার পর এখন ঝিম মেরে গেছেন।
এখন আর কোনো কিছুতেই দাদা কিছুই বলেন না। আব্বু আর চাচারা মিলে দাদার ব্যবসা দেখে।
বছরে একবার গ্রামের বাড়ি থেকে যখন চাল আসে তখনও দাদার কোনো হেলদোল দেখা যায় না। অথচ আগে দাদা নিজেই দাঁড়িয়ে সব মেপে নিতেন।
আম্মু চাচিরাও এখন আর দাদিকে অত মানে না। আগে দাদির হুকুম ছাড়া কিছুই রান্না হতো না।
শহর থেকে তিন চার ঘন্টা দূরত্বে গ্রামের বাড়িতে দাদার ব্যবসা। পুকুরে মাছ ছেড়েছে, মুরগির ফার্মে মুরগি।
ক্ষেতে বর্গা চাষীরা কাজ করে, আরো কী সব যেন। গিয়ে সবকিছু তদারকি করতে হয়।
দুই একদিন পর পর খুব ভোরে আব্বু আর চাচারা চলে যায় অটোতে করে। মীরাদের বাসায় লোকজন অনেক, শোয়ার জায়গার খুব সমস্যা।
মীরার ছোট ভাইটা শোয় আম্মু আব্বুর সাথে। নীরা আপুর বড় ভাই মুশফিক ভাইয়া ঢাকায় ওদের খালার বাসায় থেকে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে।
গত বছর মুশফিক ভাইয়া ঢাকায় চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ছোট চাচা আর মুশফিক ভাইয়া এক রুমে থাকত। এখন ছোট চাচা একাই থাকে ওর রুমে।
পড়ালেখা শেষ, বি সি এসের পড়া পড়ে। ছোট চাচার সাথে কার যেন লাইন চলছে ইদানিং, মেয়েটার নাম খুব সম্ভব তিথি।
ছোট চাচা আজকাল ব্যাক ব্রাশ করে চুল আঁচড়ায়, মুখে আফটার শেভ লোশন গায়ে বডি স্প্রে মাখে। গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারে কেমন যেন অনীহা দেখায়, টের পায় মীরা।
আলো ফুটে গেছে, আর দেরি করা যাবে না। নীরা আপুকে তুলে মীরার নিজেরও রেডি হতে হবে।
নীরা আপু সকালে অঙ্ক স্যারের বাসায় ব্যাচে পড়তে যায়, আপুর কলেজ নয়টা থেকে। মীরার স্কুল আটটা থেকে।
দেরি হয়ে যাচ্ছে, মীরা গিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকল নীরা আপুকে। নীরা আপুর স্যারের বাসায় পাঁচ মিনিট দেরি করে ঢুকলেও অসুবিধা নেই, মীরার এসেম্বলিতে দেরি করে ঢুকলে সমস্যা।
কালকে সারাদিন একটু মেঘলা মেঘলা বৃষ্টি বৃষ্টি ছিল, ড্রেসগুলো পুরোপুরি শুকায়নি। তাই মাগরিবের পর ড্রেসগুলো বারান্দায় এনে শুকাতে দেওয়া হয়েছিল।
নীরা আপুকে বিছানায় মোচড়ামুচড়ি করতে দেখে মীরা কাপড়ের বালতি নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। দৌড়াদৌড়ি করে রেডি হতে হবে এখন, মোটেই সময় নেই।
(আপনাদের ভালো লাগলে চলবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here