নাটাই ঘুড়ি পর্ব-১০

0
861

#নাটাই_ঘুড়ি
।।১০।।
আজকে শুক্রবার। এইদিন দুধওয়ালা একটু দেরিতেই আসে।
স্কুল কলেজ কিছু না থাকায় নাস্তা বানানোর তাড়া থাকে না। অন্তত আধ ঘন্টা বেশি ঘুমানো যায়।
মীরার আম্মু জোহরা ফজরের কাজা নামাজ পড়ে মোনাজাতে বসেছিলেন। অন্যদিনের চেয়ে মোনাজাতে বেশি সময় লাগছিল আজকে।
মনটা অস্থির হয়ে আছে। আজকে কয়দিন হয়ে গেল ইমরুলকে পাওয়া যাচ্ছে না।
মোবাইল ফোন রেখে গেছে। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করতে লোক পাঠানো হয়েছে।
তিনি দোয়া ইউনুসের একটা খতম পড়া শুরু করেছেন। ফুলবাড়িয়ার পীর সাহেবের দেওয়া।
একেবারে অব্যর্থ খতম। মীরার জন্মের পর আবার যখন গর্ভবতী হলেন তখন বড় ভাবির নাক উঁচু স্বভাবটা খুব বেড়ে গিয়েছিল।
তখন খুব অস্থির লাগত। আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছার ওপরে কারো কোনো হাত নেই, তারপরও অস্থির লাগত।
সেই সময় একদিন বাড়ি যাওয়ার পথে ফুলবাড়িয়া গিয়েছিলেন আব্বার সাথে। পীর সাহেবের দেওয়া খতম শিখে এসেছিলেন।
তারপর সতি সত্যি মাশুকের জন্ম হলো। খবর পাওয়ার সাথে সাথে পীর সাহেবের দরবারে জোড়া খাসি পাঠিয়েছিল আব্বা।
এখন আবার এত দিন পরে ইমরুলকে পাওয়ার জন্য মানত নিয়ে বসেছেন। সংসারের কাজকর্ম করে সময়ই তো পাওয়া যায় না।
চোখের জল বাধা মানছে না। তসবির গুটি ঘুরছে।
এর মধ্যেই প্রচণ্ড জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দ হচ্ছে। দরজাটা কেউ খুলছে না কেন?
মীরা বিরক্ত হয়ে বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করে সময় দেখল। সাতটা বাজে।
এত সকালে কে এল আজকে? দুধওয়ালা?
প্রায় একই সাথে দরজার সামনে পৌঁছাল মীরা আর মীরার আম্মু। মীরাই দরজা খুলল এগিয়ে গিয়ে।
সুরমা স্টোর্সের এসিস্ট্যান্ট ছেলেটা, নাম মিনহাজ, দাঁড়িয়ে আছে ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাতেও বস্তাভর্তি বাজার দেখা যাচ্ছে।
জোহরা ভীষণ অবাক হয়ে বললেন, “এসব কী?’
মিনহাজ বলল, “স্যার বলল আজকে নাকি আপনাদের বাসায় বিয়ের মেহমানরা আসবে!”
জোহরার আচমকাই মনে পড়ল আসলেই তো, আজকে তো নাইমাকে দেখতে আসার কথা! ইমরুল হারানোর মধ্যে তারা সবাই ভুলেই গিয়েছিলেন।
মেয়ে পছন্দ হলে আজকেই পাকা কথা করে ফেলতে হবে, মেঘে মেঘে বেলা তো অনেক হলো। কিন্তু কথা হলো শিহাব জানল কীভাবে?
“এসব কে পাঠাতে বলেছে?’
মীরা তাড়াতাড়ি বলল, “ছোট চাচা!”
জোহরার চোখের কোণা আবার ভিজে উঠল। তিনি তাড়াতাড়ি চলে গেলেন ফুলিকে ডেকে তুলতে।
ওর ঘুম ভাঙলেও ওঠে না, মটকা মেরে শুয়ে থাকে। না ডাকা পর্যন্ত ওঠে না।
লোকজন আসবে দুপুরে, দুপুরের খাবার, বিকেলের নাস্তার আয়োজন করতে হবে। কিছুক্ষণ পরই দেখা গেল আমেনা মঞ্জিল গমগম করছে।
নীরার কোচিং আছে, মীরার ওপরে দায়িত্ব পড়ল ফুপিকে নিয়ে পার্লারে যাওয়ার। বাসায় সাজাতে সাহস হচ্ছে না কারো।
রিকশায় উঠে নাইমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “একটা বুড়া লোকের সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য সবাই এত অস্থির হয়ে উঠল কেন বল তো?”
মীরা কী বলবে ভেবে পেল না। খানিকক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে বলল, “বুড়ো বলছ কেন?”
“কেন তুই দেখিস নাই যে মাথায় চুল নাই?’
মিরা সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “অনেকের চুল অল্প বয়সেই পড়ে যায় ফুপি!”
“তোকে বলেছে! তোর মাথা!”
নাইমা কেঁদে ফেলল।
“বুড়া ব্যাটা, এক বাচ্চার বাপ…”
মীরা মৃদু স্বরে বলল, “তুমি এভাবে বলছ কেন? ভদ্রলোকের বউ মারা গেছেন এটা তো আর তার দোষ না!”
“নিশ্চয়ই এমনই অত্যাচার করত যে বউটা সহ্য করতে না পেরে মরেই গেছে!”
“সেটাই ধরে নিচ্ছ কেন? অন্য কিছুও তো হতে পারে!”
নাইমার গাল বেয়ে পানি পড়েই যাচ্ছে। রাস্তার লোকজন অবাক হয়ে তাকে দেখছে।
মীরা অস্বস্তি নিয়ে বলল, “ফুপি, প্লিজ! লোকজন দেখছে তো!”
“দেখুক!”
এই শহরে পার্লার বলতে সবেধন নীলমণি একটাই। পার্লারের মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “কী প্রোগ্রাম ম্যাডাম?”
মিরা কিছু বলার আগেই নাইমা ঝাঁঝালো স্বরে উত্তর দিল, “কুলখানি!”
মীরা তাড়াতাড়ি বলল, “পার্টি মেক আপ দেবেন। খুব বেশি লাইট টোন করার দরকার নেই, নেচারাল টোনেই গর্জিয়াস সাজ দেবেন।“
এই কথাগুলো ফেসবুকে মেক আপের লাইভ ভিডিও দেখে শেখা। তাদের কাছে মেক আপের ভালো প্রোডাক্ট নেই বলে, নয়ত বাসাতেই সাজানো যেত।
নীরা আপু বেশ ভালো সাজে। অল্প কিছু দিয়ে সাজলেই জলপরী দেখায় তাকে।
নাইমার চোখ বেয়ে অনবরত গড়িয়ে পড়া জল সামলাতে সামলাতে সাজাতে সময় লাগল প্রায় তিন ঘন্টা। প্রায় ছুটতে ছুটতে বের হলো মীরা।
আম্মু বার বার করে বলে দিয়েছিল, অতিথিরা আসার আগেই বাসায় পৌঁছাতে হবে, তাদের সামনে দিয়ে বাসায় ঢোকাটা ঠিক হবে না। কিন্তু সেই তো দেরি হয়েই গেল।
বাসার সামনে রিকশা থেকে নামতেই এগিয়ে এল মোড়ের নেড়ি কুকুরটা। করুণ মুখে লেজ নাড়তে লাগল তাদের দিকে তাকিয়ে।
মীরা চিনতে পারল, এই কুকুরটা ছোট চাচার প্রায় পোষ্য বলা চলে। ছোট চাচা প্রায়ই একে মোড়ের দোকান থেকে বিস্কিট কিনে খাওয়াত।
এই কয়দিন ছোট চাচা নেই, নিশ্চয়ই খাওয়া জোটেনি। নাইমা পার্স থেকে টাকা বের করে মীরাকে দিয়ে বলল, “মীরা যা তো এক দৌড়ে গিয়ে দোকান থেকে বিস্কিট নিয়ে আয়।“
মীরা অস্বস্তির সাথে বলল, “আর এর মধ্যে যদি গেস্টরা চলে আসে? আমাদের এখন ঢুকে যাওয়া উচিত না? রান্না হলে আমি এসে খাইয়ে যাব একে!”
নাইমা ধমক দিয়ে বলল, “তোকে যা বলছি তাই কর! আজ সারাদিন বাসায় নানান ভেজাল চলবে! এটাকে খাওয়ানোর কথা মনেই থাকবে না তোর!”
মীরার আশঙ্কাই সত্য হলো। কিছুক্ষণ পর যখন গাড়িটা এসে থামল তখন নাইমা গেটের সামনে গভীর মনোযোগে সামনে ঝুঁকে কুকুরকে বিস্কিট খাওয়াচ্ছে।
গাড়ি থেকে নেমে একজন বয়স্ক মানুষ বললেন, “এইটাই তো আমেনা মঞ্জিল?”
নাইমা জবাব না দিয়ে মীরার হাতে বিস্কিটের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। মীরা বিস্কিটের প্যাকেট হাতে নিয়ে বোকার মত বলল, “জি এইটাই।“
“আলহামদুলিল্লাহ্। সবাইকে খবর দাও, আমরা খন্দকার বাড়ী থেকে আসছি।“
কিছুক্ষণ পর নাইমার ডাক পড়ল বসার ঘরে। সে তার ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে ছিল।
ব্যাপক ধাক্কাধাক্কির পর যখন সে বের হলো দেখা গেল তার মুখে মেক আপের অস্তিত্ব নেই। মীরার বড় চাচি আর্তনাদ করে উঠলেন।
নাইমা রক্ত চক্ষু করে তাকিয়ে বলল, “চুপ!”
আসলে সেই বা কী করবে। নিজের ঘরে ঢুকেই এমন হু হু করে কান্না এসে গেল।
কাজল ধুতে গিয়ে মুখের মেক আপও ধুয়ে গেছে। অনেক ক্ষণ ধরেই বসে আছেন তারা, আবার নতুন করে সাজানোর সময়ও নেই।
অগত্যা যেমন আছে তেমনভাবেই বসার ঘরে পাঠানো হলো নাইমাকে। সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল তাকে যে প্রশ্নই করা হবে উত্তরে একটা গ্যাঞ্জাম পাকিয়ে উঠে আসবে।
কিন্তু কার্যত দেখা গেল সেরকম কিছুই হলো না। যে বয়স্ক লোকটি গাড়ী থেকে নেমেছিলেন তিনি বরের বাবা।
তিনি বললেন, “সব তো সিভিতেই লেখা আছে, আর কী জিজ্ঞেস করব?”
খাওয়া দাওয়া শেষে বিকেলের চায়ে চুমুক দিতে দিতে তিনি বললেন, “মেয়ে আমাদের খুবই পছন্দ হয়েছে, মাশাল্লাহ! ঢোকার
সময়ে দেখলাম মেয়ে কুকুরকে বিস্কিট খাওয়াচ্ছে। আমার মা মরা নাতির জন্য এরকম একটা মায়াবতী মেয়ে দরকার ছিল। ঢোকার সময় সাজগোজ করা দেখলাম, পরে সাজ ছাড়াও দেখলাম। আমার আর কিছু বলার নাই। তবে আমার ছেলে আজকে আসতে পারেনি। ছেলেটার জ্বর চলে আসছে। মা মরা ছেলে। বাপকে ছাড়তে চাইল না। আর আজকালকার ছেলে। মুরুব্বিদের সাথে মেয়ে দেখতে চাইল না। মেয়ের সাথে একবার একা কথা বলতে চায়, বিয়েতে মত আছে কিনা এইটা জানার জন্য।“
মীরার বড় চাচি তাড়াতাড়ি বললেন, “মেয়ের মত আছে, খুব মত আছে। মত থাকবে না কেন? আমাদের মতই মেয়ের মত।“
“তারপরও ছেলে একবার আলাদা কথা বলতে চায়, যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে।“
মীরার বড় চাচি পাংশু মুখে নাইমার নাম্বার কাগজে লিখে দিলেন। একবার ভাবলেন ভুল নাম্বার লিখে দেবেন কিনা।
নাইমা আবার কি গণ্ডগোল বাধায় কে জানে?
বরপক্ষ অনেক মিষ্টি এনেছিল, মীরার আম্মু ফুলির হাতে মিষ্টি দিয়ে মীরার সাথে শিহাবদের বাসায় পাঠালেন রাতে। হাজার হলেও প্রতিবেশী, শুধু ফুলিকে দিয়ে পাঠালে ভালো দেখায় না।
শিহাব ভাইয়ার আম্মু রাতের রুটি বানাচ্ছিলেন, মিরা জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া কোথায় আন্টি?”
“ঘরে, আজকে আগেই চলে এসেছে, মাথা ধরেছে নাকি।“
মীরা প্লেটে করে মিষ্টি নিয়ে শিহাবের ঘরের দরজায় নক করল। শিহাব ঘর অন্ধকার করে বসে ছিল, জিজ্ঞেস করল, “কে?”
“আমি, মীরা!”
শিহাব দরজা খুলল। খালি গায়ে শুয়ে ছিল বোধহয়।
মীরা আসায় তাড়াহুড়ো করে শার্ট পরে দরজা খুলেছে, শার্টের বোতাম ভুল ঘরে লাগানো। মীরা প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল, “মিষ্টি খান ভাইয়া!”
“কীসের মিষ্টি?”
মিরার পুরনো দুষ্টুমি মাথায় চাগাড় দিয়ে উঠল। ঝলমলে গলায় বলল, “নীরা আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল, সেই মিষ্টি!”
শিহাব বিছানায় বসে পাথরের মত মুখ করে মিষ্টি খাচ্ছে। মীরা টেবিলে বসে পা দোলাতে লাগল।
প্রবল হাসিতে তার পেট ফেটে যাচ্ছে।
(পরের পর্ব পরশু দিন সন্ধ্যায় ইন শা আল্লাহ্‌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here