- #নাটাই_ঘুড়ি
।।১১।।
রাজধানী শহরে যে এত সরু কোনো গলি থাকতে পারে তা ইমরুলের ধারণার বাইরে ছিল। এই গলিতে পাশাপাশি দুটো রিকশা একসাথে চলতে পারে না।
গলির ওই মাথা থেকে ক্রমাগত হর্ন বাজাতে বাজাতে রওনা দেয় এই মাথায় আসার জন্য। যদি একই সময়ে দুই মাথা থেকে দুটা রিকশা রওনা দিয়ে দেয় তখনই বাধে বিপত্তি।
গলির মাঝামাঝি দুটো রিকশা মুখোমুখি হয়। দুই রিকশাওয়ালা এক প্রস্থ গালিগালাজ করার পর কেউ একজন রণে ভঙ্গ দিয়ে ব্যাকে যায়।
অন্য রিকশাওয়ালা বিজয়ীর ভঙ্গিতে গলি পার হওয়ার পর প্রথম রিকশা গলি পার হতে পারে। যদিও এই দৃশ্য কালেভদ্রে দেখা যায়।
ইমরুল যখন এসে পৌঁছাল তখন ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। সত্যি বলতে সকালের প্রথম কোচে ঢাকায় আসতে এতটা সময় লাগেনি যতটা সময় ঢাকায় আসার পর এই ঠিকানা খুঁজতে লাগল।
পকেট থেকে কাগজটা বের করে আরেকবার মিলিয়ে নিল সে, না ঠিকই তো আছে। গলির মুখে মিষ্টির দোকান, বড় তাওয়ায় সিঙাড়া সমুচা জিলাপি ভাজা হচ্ছে।
সন্তর্পণে গলির ভেতরে পা দিল ইমরুল। পথের দুপাশে গায়ে গায়ে লাগোয়া বাসা।
বাসাগুলোর দেয়ালে কেমন পুরনো পুরনো গন্ধ, সবুজ শ্যাওলা ধরে আছে। ড্রেন সাদা হয়ে আছে কারো ঢেলে দিয়ে যাওয়া ভাতের মাড়ে।
বেশিরভাগ বাসার দরজা জানালা খোলা, অন্দরমহল পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ইমরুলের চাপা অস্বস্তি হতে থাকে।
১৯/২, অবশেষে ঠিক বাসাটার সামনে এসে দাঁড়াল ইমরুল। বাসার সামনে এক তরুণী কোমর বেঁধে ঝগড়া করছে ময়লাওয়ালার সাথে।
ইমরুল বাসাটার বাইরে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। কী করবে বুঝতে পারছিল না।
ময়লাওয়ালা তর্কের এক পর্যায়ে ইমরুলকেই সাক্ষী মেনে বসল, “দেখেন তো স্যার, এইডা যে হ্যাগো বাসার ময়লা না হেইডা আমি বুঝমু ক্যামনে?”
তরুণী খিঁচিয়ে উঠল, “এই যে ভদ্রলোক! আপনি নিজের কাজে যান না! দাঁড়িয়ে কি তামশা দেখেন?”
ইমরুল আমতা আমতা করে বলল, “কামরান কি এই বাসায় থাকে?”
তরুণী একবার আপাদমস্তক ইমরুলকে দেখে নিয়ে ময়লাওয়ালার হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে গেল।
“দুলাভাই আপনার কাছে কে যেন আসছে!”
ময়লাওয়ালা টাকা বুঝে পেয়ে ইমরুলকে সালাম দিয়ে মানে মানে কেটে পড়ল। কিছুক্ষণ পর ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কামরান।
“আরে, আসছিস তুই? চল চল, তোর জন্য বের হতে পারছিলাম না!”
কামরান পুরো দস্তুর বাইরে বের হওয়ার জন্য তৈরি, ইস্ত্রি করা শার্ট আর ফরমাল প্যান্ট পরা, পায়ে এপেক্সের দামি শু। ইমরুল কিছু বলার সুযোগ পেল না।
রাস্তায় নেমে কামরান লক্ষ্য করল ইমরুলের কাঁধে ব্যাগ। সে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “ইস আমি তো খেয়ালই করিনি! আয় ভেতরে।“
দরজা খোলাই ছিল। সেই মারমুখী তরুণির তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে দিয়ে ইমরুল ঘরে ঢুকল।
বিছানার ওপরে একটি মেয়ে ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে ছিল। কামরান তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “শম্পা, এইটা হলো ইমরুল। আমার বোজম ফ্রেণ্ড। আমাদের এখানে কয়টা দিন থাকবে।“
শম্পা নামের মেয়েটি জবাব দিল না। ইমরুলের অস্বস্তির সীমা রইল না।
ঘর সাকুল্যে দুটো, দরজা দিয়ে ঢুকতেই প্রথম ঘর, সেখানেই বড় একটা বিছানা পাতা। এখনো মশারি খোলা হয়নি।
সামনের দুটো কোণা খুলে আধভাঙা তাঁবুর মত পেছনের দুই কোণার ওপরে কোনো মতে উঠিয়ে রাখা হয়েছে। ইমরুলের মনে হলো হয়ত এরা মশারি খোলে না। শোবার সময় হলে সামনের দুই কোণা টানিয়ে আধভাঙা তাঁবুকে সম্পূর্ণ করে শুয়ে পড়ে।
এক পাশে বড় পানির কলসি রাখা, আরেক পাশে মিটসেফ। মিটসেফের ওপরে রাইস কুকার।
বড় একটা স্টিলের আলমারি, সেটার ওপরে রাজ্যের জিনিস স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সেই সব জিনিসপত্রের মধ্যে একটা বড় কালো প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে লেপও উঁকি দিতে দেখা গেল।
ঘর দেখে ইমরুলের প্রথম দর্শনেই যা মনে হলো তা হচ্ছেঃ এই ছোট্ট একটা ঘরে এতগুলো জিনিস আঁটল কীভাবে?
শম্পার অস্বস্তিকর নীরবতা আর অন্য মেয়েটির তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে দিয়েই কামরান প্রথম ঘর পেরিয়ে ইমরুলকে নিয়ে এল দ্বিতীয় রুমে। এই ঘরটি প্রথম ঘরের চেয়ে ছোট।
এক নজর দেখে ইমরুলের মনে হলো এই ঘরটি সম্ভবত রান্নাঘর কাম স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এক পাশে চুলায় রান্না হচ্ছে।
অন্য পাশে আলু পিঁয়াজ আটার বস্তা দেখা যাচ্ছে। একটা ক্যাম্প খাটও আছে।
কামরান নিজেই ইমরুলের কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে নিয়ে রাখতে রাখতে বলল, “দোস্ত, তোর যতদিন খুশি থাক। এই আস্তানা একদম নিরাপদ। পুলিশের বাবাও খুঁজে বের করতে পারবে না তোকে!”
পেছন থেকে সেই মেয়েটি এগিয়ে এসে বলল, “পুলিশের কথা হচ্ছে কেন?”
ইমরুল বিব্রত হয়ে বলল, “আসলেই তো! পুলিশের কথা আসলো কীজন্য?”
“কথার কথা বললাম আর কী! তোর বাড়ির লোক নিশ্চয়ই খুঁজছে তোকে!”
“আমরা বাসায় কোনো ঝামেলা জায়গা দিতে পারব না বাবা!” বলে উঠল মেয়েটি।
“আমার বাড়িতে আমার দোস্ত জায়গা পাবে না মানে?” হুংকার দিয়ে উঠল কামরান।
আর কোনো কথা বলল না মেয়েটি। চুলায় রান্না চাপানো ছিল, গজগজ করতে করতে খুন্তি নাড়তে লাগল।
কামরান ইশারা দিয়ে বলল, “বেরিয়ে আয়।“
বেরিয়ে আসতে আসতে ইমরুল দেখল, এই ঘরের ওপরে দড়ি টানিয়ে অন্তর্বাস শুকাতে দেওয়া হয়েছে। কি একটা অবস্থা!
এখানে তাকে থাকতে দিতে হলে ঘরের মানুষের বিরক্ত হওয়াই স্বাভাবিক। ইমরুল রাস্তায় নেমে বলল, “দোস্ত আমি বরং চলে যাই?”
“যাবিটা কোথায়? যাওয়ার জায়গাটা কোথায়, বলে দিয়ে চলে যা!”
ইমরুল চুপ করে রইল।
“সকালের নাস্তা ভালোভাবে হয়নি নিশ্চয়ই। আমার বাসায় নাস্তার টাইম তো ওভার। আয় খাওয়া দাওয়া করি। এই দোকানে ফার্স্ট ক্লাস সিঙাড়া বানায়।“
গলির মুখের মিষ্টির দোকানে বসে সিঙাড়া খেতে খেতে ইমরুল বলল, “আমাকে একটা চাকরি দিবি বলেছিলি।“
“আরে চাকরি কি আমি পকেটে নিয়ে ঘুরি নাকি? সিভি বানাতে হয়, সব জায়গায় যেতে হয়। ঢাকায় পা দিয়েই চাকরি পাওয়া যায় না।“
“কতদিন লাগতে পারে?”
“তার আগে তোর ফোনের একটা গতি করতে হবে। আগের নাম্বার কি পার্মানেন্টলি অফ?”
ইমরুল কথা না বলে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।
“তাহলে সিম কিনতে হবে। নতুন নাম্বার দিয়ে সিভি বানাতে হবে। এটাই প্রথম কাজ।“
“কোথা থেকে করব এসব?”
“একা পারবি না। আয় চল আমার সাথে।“
দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা রাখল ইমরুল। এই রাস্তাটা তুলনামূলক বড়।
তাও খুব একটা বড় না। দুটো রিকশা কোনোমতে পাশাপাশি চলতে পারে এই ধরণের।
এই সরু রাস্তার পাশেই এক কলাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে তার ভ্যান ভর্তি কলা নিয়ে। কামরান দুটো কলা কিনে ফেলল।
একটা ইমরুলকে দিয়ে অন্যটা নিজে খাওয়া শুরু করল।
“আরে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, খা শালা। লাঞ্চের দেরি আছে। আজকে বহুত দেরি হয়ে গেল আমার তোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে। শালার তোর ফোন থাকলে এতক্ষণ ওয়েট করতাম না। বের হয়ে যেতাম। বাসা খুঁজে পাস কিনা এইজন্য বাসায় বসে ছিলাম।“
ইমরুল অপরাধী মুখ করে বলল, “স্যরি।“
“স্যরি *দাইতে হবে না। কলা খা। পেটটা ভরা থাকবে। শালার পেটের জন্যই তো এত কষ্ট।“
নিজের কলা খেয়ে শেষ করে খোসাটা ড্রেনের দিকে উদ্দেশ্য করে ছুঁড়ে দিল কামরান। মিস করল। খোসাটা পড়ল ড্রেনের ঠিক সামনে।
কোথা থেকে একটা ছাগল এসে মহানন্দে খাওয়া শুরু করল সেটা। এই শহরে ছাগল কোথা থেকে এল, ইমরুল সেটাই অবাক হয়ে ভাবছিল।
কামরান তার দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল, “এত চিন্তা করিস না। কারো রিজিকের অভাব হয় না। যার রিজিক যেখানে থাকে, সে সেইখানে যায়।“
(পরের পর্ব পরশু দিন সন্ধ্যায় ইন শা আল্লাহ্)