#নাটাই_ঘুড়ি
।।১২।।
নেতৃত্বের গুণাবলী কিছু কিছু মানুষের স্বভাবজাত। রিম্মি এমনই একজন মানুষ।
অন্যেরা তার কথা সহজে চট করে ফেলে দিতে পারে না। সে যে খুব সুশ্রী দেখতে ঠিক তা নয়।
তবে চেহারায় একটা আলগা চটক আছে। চিবুকের দিকটায় একটা আদুরে ভাব ওর মুখের প্রধান আকর্ষণীয় দিক।
চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, কেউ ওর চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। অস্বস্তিতে চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
রিম্মির নিজস্ব থিওরি হলো, ভদ্র সমাজের যে কোনো পুরুষ প্রথমে মেয়েদের চোখের দিকেই তাকায়। যে মেয়ের চোখের দৃষ্টি যথেষ্ট তীব্র নয়, তার চোখ থেকেই দৃষ্টি অন্য কোনো দিকে যাওয়ার সুযোগ পায়।
রিম্মির কোনো অস্বস্তিকর দৃষ্টি কিংবা অপ্রীতিকর স্পর্শের অভিজ্ঞতা নেই। বাংলাদেশের মেয়ে হিসেবে এটা সত্যিই বিরল।
এর জন্য রিম্মি নিজেকেই ধন্যবাদ দেয়। অবশ্য ইদানীং মাঝে মাঝে ধন্যবাদ না দিয়ে অভিশাপও দেয়।
রিম্মির বিয়ে করা বর সাতদিন ওর সাথে থেকে এক বিছানায় ঘুমিয়েও ওকে কোনো স্পর্শ কিংবা চুমুর অভিজ্ঞতা দিয়ে যায়নি। এর জন্যও রিম্মির নিজেকেই দায়ী মনে হয়।
অবশ্য রিয়াসাতের এফেয়ার ছিল। ইউনিভার্সিটি অফ এলবার্টায় যেখানে সে পড়ে সেখানে এক স্বর্ণকেশীর সাথে লিভ ইনে ছিল সে।
বাসায় জানাবার সাহস করে উঠতে পারেনি। ছুটিতে দেশে আসার পর যখন রিম্মির সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল তখনো চুপ করেই ছিল রিয়াসাত।
হয়ত আশায় ছিল রিম্মিকেই সব খুলে বলবে। কিন্তু পাত্র পাত্রী একা একা দেখা করার প্রস্তাব এক কথায় নাকচ করে দিয়েছিল রিম্মি।
তার কাছে এসব সব সময়ই বড্ড বোকা বোকা বলে মনে হয়। সব কিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার পর খানিকটা প্রেম প্রেম ভাব করা।
কী দরকার! বড়রা বিয়ে ঠিক করেছেন যেহেতু, নিশ্চয়ই ভালো কিছুই হবে।
অগত্যা রিয়াসাতও লক্ষ্মী ছেলের মত চোখ বন্ধ করে কবুল বলে ফেলল। বিয়ের রাতে রিম্মি যখন বলল ওর খুব ক্লান্ত লাগছে ঘুমিয়েও গেল প্রায় সাথে সাথেই।
রিম্মির এখন মাঝে মাঝে আফসোস হয়। ঠিক সাতদিন পরই রিয়াসাতের ফ্লাইট ছিল।
সাতটা দিন এর বাসায় ওর বাসায় দাওয়াত খেয়েই কেটে গেল। রিম্মির স্বভাবগত কাঠিন্য রিয়াসাতকে ওর সাথে সহজ হতে দেয়নি।
রিয়াসাত ওকে ক্যাথির কথা জানিয়েছিল এয়ারপোর্টে পৌছে। ফোনটা ফ্লাইট মুডে দেওয়ার আগে হোয়াটস এপে ক্যাথির ছবি পাঠিয়ে লম্বা মেসেজ করেছিল রিম্মিকে।
সেই মেসেজ জুড়ে ক্যাথির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আর রিম্মির কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা। ক্যাথিকে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না। রিম্মি যেন তাকে ভুল না বোঝে। তাকে ক্ষমা করে দেয়। এডমন্টন পৌঁছে সে রিম্মিকে মুক্ত করে দেবে। যে করেই হোক পরে রিম্মির দেন মোহরের টাকা শোধ করে দেবে। রিম্মি অনেক ভালো একটা মেয়ে। তার একটা লাভিং কেয়ারিং লাইফ পার্টনার পাওয়ার পূর্ণ অধিকার আছে। সে কেন রিয়াসাতের মত সেকেণ্ড হ্যাণ্ড একটা ছেলের জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট করবে যে কিনা কখনোই তাকে ভালোবাসতে পারবে না?
রিম্মির কি হইচই করা উচিত ছিল? মাঝে মাঝে তার মনে হয় তার মধ্যে বোধ হয় আসলেই কিছু কিছু অস্বাভাবিকতা আছে।
রিয়াসাতকে সি অফ করতে রিম্মির শ্বশুর শাশুড়িও গিয়েছিলেন। কথা ছিল রিয়াসাত চলে যাবার পর রিম্মি তাদের বাসায় যাবে, থাকবে যতদিন ইচ্ছা।
সব সময় ফোন টেপাটিপি করা, ফেসবুকে নোটিফিকেশন চেক করার অভ্যাস রিম্মির নেই। কাজেই সে রিয়াসাতের মেসেজটা দেখতে পেল এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফিরে।
দুপুরে খেল না সেদিন। অভুক্ত অবস্থায় মাথা ভালো কাজ করে। এটাও ওর নিজস্ব থিওরি।
শাওয়ার নিয়ে লম্বা ঘুম দিয়ে উঠল রিম্মি। কড়া করে এক কাপ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে বসল নিজের রুমের ব্যালকনিতে।
নিজের রুম? আপনমনেই হেসেছিল রিম্মি সেদিন।
এটা তো আসলে রিয়াসাতের রুম। সে যাই হোক। এখন এটাই তার রুম।
খালি পেটে মগভর্তি ব্ল্যাক কফি ছোট ছোট চুমুক দিয়ে শেষ করতে ঠাণ্ডা মাথায় নিজের পরবর্তী করণীয় ঠিক করেছিল রিম্মি। শাশুড়ির কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিল ক্যাথি কে।
ভূত দেখার মত চমকে উঠেছিলেন মহিলা। জিজ্ঞেস করেছিলেন ওর কথা কীভাবে জানল রিম্মি।
উত্তরে রিয়াসাতের মেসেজটা উনার সামনে মেলে ধরেছিল রিম্মি। থম ধরে গিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা।
তারপর উনিও ক্ষমা চেয়েছিলেন। ক্ষমা চেয়েছিল ওদের পরিবারের সবাই।
রিম্মি শুধু হেসেছিল। সব ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে রিম্মির আব্বু খুব রাগারাগি করেছিলেন রিয়াসাতের বাবার সাথে।
দুজন বন্ধু ছিলেন। তাই রিম্মির আব্বু রিয়াসাতের ব্যাপারে খুব বেশি খোঁজ খবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
পুরো ঘটনায় যে সবচেয়ে বেশি নির্লিপ্ত ছিল সে রিম্মি নিজে। তাকে নিজের বাসায় ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
উত্তরে রিম্মি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে দেন মোহরের টাকা কড়ায় গণ্ডায় বুঝে না পেলে এই বাড়ী থেকে যাবে না। যেতে বলেছে তাকে জোরাজুরি করা হলে সে প্রতারণার মামলা ঠুকে দেবে এই পরিবারের বিরুদ্ধে। জেনে শুনে কেন তাদের পুরুষত্বহীন ছেলেকে তার ঘাড়ে গছিয়ে দেওয়া হলো। সাতদিন এক সাথে সংসার করার পরেও রিম্মি এখনো কুমারী, এটা মেডিকেল পরীক্ষায় খুব সহজেই প্রমাণ করা যাবে।
এরপর ঠাণ্ডা মেরে গেছে রিয়াসাতের পরিবার। রিম্মির বাসা থেকেও এখন আর যেতে বলে না তাকে।
কারণটা পরিষ্কার। রিম্মির ছোট বোন নিম্মির বিয়ের কথা চলছে।
এই মুহূর্তে রিম্মির ডিভোর্স হলে নিম্মির বিয়ে দিতেও অসুবিধা হবে। তাছাড়া রিম্মির কাছে ওর আব্বু অপরাধী।
মেয়েটা পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করতে চেয়েছিল। তিনি যথেষ্ট খোঁজ না নিয়েই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন নিজের বন্ধুর ছেলের সাথে। এখন মেয়ের সামনে দাঁড়াতে অস্বস্তি বোধ করেন তিনি।
রিম্মির সামনে অপরাধবোধে ভোগেন ওর শাশুড়িও। আর এই দুই পরিবারের অস্বস্তির পুরো ফায়দা ওঠায় রিম্মি।
অবশ্য খুব খারাপ কিছু সে করে না। শুধু নিজের মত চলে, যদি সেটাকে ফায়দা ওঠানো বলা যায় আর কী।
ক্লাস থাকুক বা না থাকুক প্রতিদিন ভার্সিটিতে আসে, কালচারাল গ্রুপগুলোতে সময় দেয়। ইচ্ছে হলে সিনেমা হলে ঢুকে সিনেমা দেখে, ইচ্ছে হলে রেস্টুরেন্টে খায়।
ইচ্ছে হলে বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যায়, তবে খুব বেশি রাত করে না। মোট কথা এমন কিছুই করে না যার জন্য ওকে সীমা লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায়।
ওর শাশুড়ী অবশ্য ওর আড়ালে বোনদের কাছে ওকেই দায়ী করে আফসোস করেন। ওর মধ্যে যদি যথেষ্ট আকর্ষণী ক্ষমতা থাকত, তাহলে হয়ত রিয়াসাত ওই সাদা পেতনিকে ভুলে গিয়ে বউয়ের প্রেমে পড়তে পারত।
রিম্মি নিজেও জানে কথাটা সত্যি। পুরুষরা আসলে মেয়েদের ব্যক্তিত্ব পছন্দ করে না।
রিম্মির ব্যক্তিত্বই ওর মূল বিকর্ষণ।
এই মুহূর্তে রিম্মি বসে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্রান্সফিউশন ডিপার্টমেন্টের সামনে টুলে। তার সামনে ফ্যাকাসে মুখে রক্ত দিচ্ছে নতুন মুরগি।
মুরগির নাম মুশফিক। পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসে ছিল
রিম্মি ধরে নিয়ে এসেছে। ও জানে, এখন থেকে নিয়মিত রক্ত দেবে সে।
মুশফিক ওর হাতে দেওয়া বলের মত জিনিসটা পাম্প করছে, আর ব্যাগটা ভরে উঠছে। দেখতে দেখতে ভরে গেল ব্যাগটা।
নার্স এসে ব্যাগটা খুলে নেওয়ার পর মিষ্টি করে হাসল রিম্মি। বলল, “চলুন আপনাকে জ্যুস খাওয়াই!”
“রোগী আপনার কী হয়?”
“আমার কিছু হয় না। আমি ব্লাড কালেকশন প্রোগ্রামগুলোতে যাই তো। আমি খুব ভালো ডোনার কালেক্ট করতে পারি। এইজন্য ক্লাবগুলোতে আমার নাম্বার দেওয়া আছে। আজকে এই পেশেন্টের ব্লাড ম্যানেজ হচ্ছিল না। ওরা আমাকে সন্ধানী থেকে ফোন করেছে। আমি তখন পাবলিক লাইব্রেরিতে ছিলাম। লাকিলি সিঁড়িতে আপনাকে পেয়ে গেলাম।“
হাসিমুখে কথা বলছিল রিম্মি, আর মুশফিকের বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়ছিল শিরশিরে একটা অনুভূতি। যে অনুভুতির সাথে এর আগে তার কখনো পরিচয় হয়নি!
(পরের পর্ব পরশু দিন সন্ধ্যায় ইন শা আল্লাহ্)