#নাটাই_ঘুড়ি
।।২।।
এই ছোট্ট শহরে পূর্ব পশ্চিমে একটা মাত্র বড় রাস্তা চলে গেছে আর উত্তর দক্ষিণ বরাবর তিনটা মাঝারি রাস্তা। বাকি সবই ছোট ছোট গলি।
মীরাদের বাসা থেকে বের হলে একটু দূরেই একটা লাকড়ির দোকান। সেখানে বড় দাড়িপাল্লায় মেপে লাকড়ী বিক্রি হয়।
আজকে স্কুলে যাওয়ার সময় টের পেল মীরা, ও পাশের বাড়ির শিহাব ভাইয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে গলির মাথায়। আজকাল দাঁড়িয়ে থাকে প্রায়ই।
কিছু কিছু দৃষ্টি অনুভব করা যায়। শিহাব ভাইয়ার দৃষ্টিটা মীরা অনুভব করতে পারে খুব করে।
শিহাব ভাইয়াদের বাসায় আগে খুব যাতায়াত ছিল ওদের ছোটবেলায়। মীরার আম্মুর সাথে আগে খুব সখ্য ছিল শিহাব ভাইয়ের আম্মুর।
খুব মনে আছে, ওদের ছোটবেলায় রোজার দিনে ইফতারের প্লেট, শীতের দিনের ভাপা পিঠার আদান প্রদান চলত। এক এক বাসার বুট বড়া পেঁয়াজুর স্বাদও খুব করে আলাদা হয়।
এক এক মায়ের হাতের রান্না আর বানানো পিঠাও হয় এক এক রকম! অন্য বাসার ইফতার আর পিঠার প্রতি তাই থাকত ভিন্ন রকম আকর্ষণ।
খুব ছোটবেলায় বৈশাখী মেলায় এক সাথে যেত আমরা দুই বাসার বাচ্চারা, ইদের দিনে বেড়াতে যাওয়া হত ওদের বাসায়। শিহাব ভাইয়াদের কোন চাচা যেন বিদেশে থাকতেন, তাই তাদের বাসায় ফ্রিজে থাকত বিদেশি চকোলেট।
বেড়াতে গেলে শিহাব ভাইয়া তার ভাগের বিদেশি চকোলেট থেকে মীরাদেরও চকোলেট দিত।
একদিন এক চৈত্র মাসের দুপুরে খাঁ খাঁ রোদ্দুরে অফিস থেকে ফিরে এলেন শিহাব ভাইয়ের বাবা। আন্টি অবাক হয়ে অসময়ে অফিস থেকে ফেরার কারণ জানতে চাইলে বলেছিলেন, “শরীরটা খারাপ লাগছে, এক গ্লাস লেবুর শরবত দাও তো জাহান।“
এই দৃশ্য অবশ্য মীরা নিজের চোখে দেখেনি, শুনে শুনে কল্পনা করে নিয়েছিল। তার কল্পনাশক্তি মাশাল্লাহ ভালো।
আন্টি লেবুর শরবত নিয়ে ফিরে এসে দেখেছিলেন মানুষটা মাটিতে পড়ে আছেন। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে।
আন্টির চিৎকারে ছুটে এসেছিল আশেপাশের সবাই, সেই সবার মধ্যে পাশের বাড়ির ওরাও ছিল। মোড়ের ফার্মেসি থেকে ডাক্তার এসে পালস পায়নি, চোখের মণির ওপরে টর্চের আলো ফেলে দেখেছিল নিষ্প্রাণ মণির নাড়াচাড়ার অনুপস্থিতি।
ক্লাস সেভেনের মীরা সেদিনই জেনেছিল, মরে গেলে মানুষের চোখের মণিতে আলো ফেললেও মণির কোনো হেলদোল হয় না। এসবই আজ থেকে দু বছর আগের ঘটনা।
দু বছর আগে আচমকা হার্ট এটাকে বাবা মারা যাওয়ার পর বাসার বড় ছেলে হওয়ায় সংসারের হাল ধরতে হয়েছে শিহাব ভাইয়াকে। আর দিনে দিনে যোগাযোগ কমেছে দুই পরিবারের।
ওদের বাড়িটা তিন তলা ফাউণ্ডেশন দেওয়া। ছাদের ওপরে তিনতলার কাজ শুরু করার পর পর মারা গিয়েছিল শিহাব ভাইয়ার বাবা।
আর পালটে গিয়েছিল সব হিসাব নিকাশ। বাড়ির কাজ আর শেষ করা হয়নি, ডিগ্রি কলেজের পড়া স্থগিত রেখে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল শিহাব ভাইকে।
জানা গিয়েছিল অফিসের প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে বড় অংকের টাকা লোন নিয়ে বাড়ির কাজে হাত দিয়েছিলেন শিহাব ভাইয়ার বাবা, তাতেও কুলায়নি বলে গ্রামের বাড়ির সম্পত্তিতেও তার অংশ ভাইদের কাছে বিক্রি করে নগদ টাকা এনেছিলেন। আর তাই তাঁর মৃত্যুর পর কারো কাছ থেকে, কোথাও থেকে কোনো পাওনা টাকা পাওয়ার কথা ছিল না তাঁর পরিবারের।
আংকেলের মৃত্যুর পর কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন আন্টি, সবটা জানার পর চোখের জল শুকিয়ে গেল তাঁর। মরাবাড়িতে আসা অতিথিরা কী খাবে সেই বন্দোবস্ত না করেই উঠোনে বাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে বসে রইলেন চুপ করে, আকাশ পানে দৃষ্টি মেলে।
পরে মীরার আম্মুই খাবার পাঠিয়েছিল আমাদের বাসা থেকে, অতিথিদের সামলে সুমলে ম্যানেজ করে খাইয়েছিল আম্মুই।
এখন শিহাব ভাইয়াদের বাড়ির সামনে যে বড় উঠোনটা, যেখানে বাগান করার কথা ছিল আংকেলের, পরিকল্পনা ছিল গেটের সামনে উঠিয়ে দেবেন বাগানবিলাস আর মাধবীলতার ঝাড়, সেখানে এখন ছোট ছোট কয়েকটা টিনশেড ঘর তোলা হয়েছে। সেই ঘরগুলোতে এখন কয়েক ঘর ভাড়াটিয়া থাকে।
সেই ভাড়াটিয়ারা বেশিরভাগই কামলা শ্রেণীর। উঠোনের এক মাথায় কমন বাথরুম, আরেক মাথায় কল পাড়।
সেই কল পাড় আর বাথরুমের সিরিয়াল নিয়ে চলে নিত্য ক্যাচম্যাচ। ফলাফল যে উঠোন জুড়ে ফুলেদের হাওয়ার সাথে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে খেলা করবার কথা ছিল, সেখানে এখন প্রতি সকালে চলতে থাকে গালাগালির গুলিবর্ষণ।
এখন আর শিহাব ভাইয়ার গায়ে থাকে না প্রবাসী চাচার এনে দেওয়া সাদা ধবধবে টি শার্ট আর হাল ফ্যাশনের জিন্সের প্যান্ট। দাগ লাগা মলিন গেঞ্জি আর দর্জি দোকান থেকে কাপড় কিনে সস্তায় বানানো গ্যাভার্ডিন কাপড়ের প্যান্টে শিহাব ভাইকে এখন বড় বেশিই ম্রিয়মাণ মনে হয়।
বড় রাস্তার ওপরে যে মনোহারী দোকানটা, সুরমা স্টোর্স, সেটা শিহাব ভাইয়ার। সকাল দশটায় গিয়ে দোকান খোলে সে।
মাঝে মাঝে কোনো কোনো শুক্রবার কিংবা এমনি কোনো ছুটির দিন স্কুল না থাকলে যদি ওদের এমন কিছু কেনার থাকে যেটা এই মোড়ের মুদি দোকানে পাওয়া যায় না, এই যেমন নীরা আপুর নেল পালিশ কিংবা রিমুভার কিংবা মীরার পাঞ্চ ক্লিপ কিংবা বাহারি ডায়েরি, তাহলে শিহাব ভাইয়ার দোকানে যায় ওরা। শিহাব ভাইয়া এখন আর তার দোকানে গেলে ফ্রি চকোলেট খাওয়ায় না।
বাসার চকোলেট থেকে চকোলেট খাওয়ানো যায়, দোকানের টাকায় কেনা হিসেবের চকোলেট থেকে ফ্রি চকোলেট সাধা যায় না। বোধহয় সেই লজ্জাতেই নুয়ে থাকে শিহাব ভাই।
কিন্তু মলিন গেঞ্জি পরা, সংসারের হাল ধরতে গিয়ে ডিগ্রি কলেজের পড়া শেষ করতে না পারা শিহাব ভাইয়ার সাথে ঝকঝকে হাল ফ্যাশনের ড্রেস পরা নিখুঁত সুন্দরী নীরা আপুর কিছু হওয়ার নয়। দুজনের মেলে না।
না শিক্ষায়, না পরিবারে, না অর্থে, না সামাজিক অবস্থানে। শিহাব ভাইয়ার ছোট বোন সোনিয়ার বিয়ে হয়েছে গ্রামের দিকে, মীরাদের দাদার বাড়ি আর জমিজমা থেকে খুব বেশি দূরে নয় সেটা।
সিজনের সময় সোনিয়ার বর মীরার দাদার জমিতে বর্গা চাষ করে। বাবা মরা মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো আর কীইবা সম্বন্ধ আসার কথা ছিল!
সোনিয়ার বিয়েতে দাওয়াত দিয়েছিল ওদের, সোনিয়ার বর কী করে জানার পর কেউই যায়নি ওরা। সামান্য বর্গা চাষির বিয়েতে যাওয়া মানায় না ওদের।
তবে মীরার আম্মু বোধহয় মনে মনে পছন্দ করে শিহাব ভাইয়ার মাকে, আগের সখ্য ভুলে যেতে পারেনি এখনো। কাউকে না জানিয়ে মীরার আম্মু সোনিয়ার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিল কানের এক জোড়া মাকড়ি।
মীরার হাত দিয়েই পাঠিয়েছিল, তাই ও জানে। বাসার আর কারো মনে হয় জানা নেই এই ঘটনা।
নীরা আপুকে দেখলেই ঝড়ো হাওয়ার মুখে পড়া প্রজাপতির পাখার মত তির তির করে কাঁপতে থাকে শিহাব ভাইয়ার ভেতরটা, চলমান লোহার টুকরোর সামনে ঘূর্ণায়মান কম্পাসের কাঁটার মত ঘুরতে থাকে, খুব করে টের পায় মীরা। ছোট হলে কী হবে, খুব ছোট তো নয় সে।
ছোট চাচার বইয়ের টেবিল থেকে না বলে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে ফেলেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টান, ভালোবাসা প্রেম নয় আর বুদ্ধদেবের তিথিডোর। খুব বোঝে সে এগুলো।
এই যে সাত সকালে উঠে শিহাব ভাইয়ার দাঁড়িয়ে থাকা আপুর প্রতীক্ষায়, এটাও বেশ লাগে মীরার। ভাবতে ভালো লাগে কোনো একদিন তার জন্যেও এমন করে দাঁড়িয়ে থাকবে কেউ।
আচ্ছা তখন কি মীরা ফিরে তাকাবে! নাকি নীরা আপুর মতই সগর্বে হেঁটে চলে যাবে না দেখার ভান করে!
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অবশ্য কোনো আশা দেখি না সে। এমন গোল মুখের মেয়ের জন্য কেই বা দাঁড়িয়ে থাকবে, কার দায় পড়েছে!
চলার গতি বাড়িয়ে দিল মীরা, স্কুলের এসেম্বলির সময় হয়ে এল বলে। দেরি করে ঢুকলে আবার কথা শুনতে হবে।
পা চালিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সেই সকালে অকারণেই সিদ্ধান্ত নিল মীরা, কোনো একদিন কেউ যদি তাকে ভালোবাসার কথা বলেও, সে তাকে খুব নিষ্ঠুরের মত ফিরিয়ে দেবে। কোনো একদিন কাউকে অকারণেই খুব দুঃখ দেবে মীরা।
কেন দেবে? সেটা নিজেও ঠিক করে বলতে পারবে না সে।
আর সব কেনর কি উত্তর থাকে!
(আগামী পর্ব পরশু দিন ইন শা আল্লাহ্)