#নাটাই_ঘুড়ি
।।৩।।
আজকে শুক্রবার, ওদের কারো স্কুল কলেজ কিছু নেই। গতকাল সারাদিন ঝুম বৃষ্টি গিয়েছে, কালকে কাপড় ভিজানো হয়নি।
আজকে তাই সকাল সকাল নাশতা করেই তিন বালতি ভর্তি কাপড় ধুয়ে দিয়েছে ফুলি। ফুলি একা তিন বালতি কাপড় নিয়ে ছাদে উঠতে পারবে না বলে মীরার ওপর দায়িত্ব পড়েছে ওর সাথে এক বালতি কাপড় নিয়ে ছাদে ওঠার।
শুক্রবার নীরা আপুর বিভিন্ন ক্যারিকেচার করার দিন, সকাল থেকেই শুরু হয় এইসব। হাতে মুখে ডাল বাটা দেওয়া, চুলে মেহেদি লাগিয়ে বসে থাকা, টক দই লাগানো ইত্যাদি ইত্যাদি।
বেশি সুন্দরী হওয়াও আরেক ঝামেলার বিষয়, মেইনটেইন করতে হয়। এই যে এখন এই সকাল নয়টাতেই নীরা আপু হাতে ডাল বাটা লাগাচ্ছে।
এরপর মুখে লাগিয়ে বসে থাকবে। দৃশ্যটা অনেক দিন ধরে দেখলেও এখনো দেখতে অসহ্য লাগে।
কাজেই মীরা খুশি মনেই বালতি ভর্তি কাপড় নাড়ার জন্য ছাদে রওনা হলো। নীরা আপু পেছন থেকে চিৎকার করে মনে করিয়ে দিল ছাদ থেকে ওর জন্য মেহেদি পাতা তুলে নিয়ে আসতে।
রান্নাঘর থেকে একটা বাটি নিয়ে কাপড় ভরা বালতির ওপরে বসিয়ে নিল মীরা। সকাল সাড়ে নয়টার মত বাজে, এখনই রোদে গা চিড়বিড় করছে।
ছাদে বত্রিশটা গাছের টব আর বড় একটা ড্রামে মেহেদি গাছ। ফুলি কাপড় মেলে দিতে দিতে মীরা মেহেদি গাছ থেকে পাতা তুলতে শুরু করল।
বাটি মোটামুটি ভর্তি করতে করতে ফুলির কাপড় মেলা শেষ। ছাদ থেকে নেমে যাবার উপক্রম করছে এমন সময় পেছন থেকে ডাক শুনল, “এই মীরা!”
ফিরে তাকাল মীরা। ছোট চাচা ডাকছে।
ছোট চাচা ছাদে প্রায়ই আসে। ফোনে কথা বলতে আর সিগারেট খেতে।
এতক্ষণ মনে হয় কোণার রুমে ঘাপটি মেরে ছিল। এই ছাদের এক কোণে একটা রুম আছে।
রুমটা স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হলেও একটা খাট, একটা টুল আর এটাচড বাথরুমও আছে। গ্রাম থেকে কোনো অতিথি আসলে তাদের এখানে জায়গা দেওয়া হয়।
মীরা ছোট চাচার ডাক শুনে তার কাছে গিয়ে বলল, “কী বলছ?”
ছোট চাচা বিছানায় শুয়ে ছিল। পা নাচাতে নাচাতে বলল, “ফুলি আমাদের দুই কাপ চা দিয়ে যা তো।“
মেহেদি পাতা ভর্তি বাটি ফুলির হাতে ধরিয়ে দিল মীরা। ফুলি নিচে নেমে যাওয়ার পর ছোট চাচা বলল, “খবর শুনেছিস?”
“কী খবর?”
“ওল্ড ম্যান তো আমাদের এই আমেনা মঞ্জিল মর্টগেজ রেখে টাকা ধার নিয়েছিল। এখন সেই মর্টগেজ পার্টি টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। ওল্ড ম্যান তো এসব আমাদের কাউকে জানাচ্ছে না। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে।“
ওল্ড ম্যান অর্থাৎ মীরার দাদা। ছোট চাচা আড়ালে দাদাকে ওল্ড ম্যান ডাকে।
“তোমাকে কে বলল?”
“বলেছে কেউ। এসব খবর চাপা থাকে না। দুএকদিনের ভেতরে তোরাও জানবি। যখন পথে বের করে দেবে তখন স্যাণ্ডেল পরার টাইম পাবি না।“
ছোট চাচার গলায় চাপা আনন্দের আভাস। যেন বিষয়টা খুব আনন্দের।
স্যাণ্ডেল পরতে না পেরে খালি পায়ে পথে নেমে যাওয়ার দৃশ্যটা কল্পনা করে সে খুব আনন্দিত। মীরা ছোট চাচার সামনে রাখা টুলে বসতে বসতে চিন্তিত গলায় বলল, “এখন কী হবে ছোট চাচা?”
ছোট চাচা উদাস গলায় বলল, “কী আর হবে। যা হওয়ার তাই হবে। গ্রামে ফিরে যাও-ব্যাক টু ভিলেজ। গ্রামের বাড়িতে চলে যাব আমরা সবাই।“
“তোমার তিথিমণি গ্রামে গিয়ে থাকতে পারবে?“
তিথি ছোট চাচার গার্লফ্রেণ্ড, ছোট চাচা তাকে আদর করে তিথিমণি ডাকে। খুব সম্প্রতি সেটা জেনেছে মীরা।
ছোট চাচা বিমর্ষ মুখে বলল, “তিথির বিয়ে হয়ে যাবে রে। লক্ষণ সুবিধার না।“
“এক কাজ কর। তোমরা বিয়ে করে ফেলো।“
“আরে না। বিয়ে করে নিয়ে তুলব কোথায়?”
“কেন, এখানে!”
“এখানে, পাগল! কয়েকদিন পর যখন রাস্তায় নামতে হবে?“
মীরা হালকা গলায় বলল, “রাস্তায় নামতে হলে নামবে। অল্প কয়েকটা দিনই তো। অল্প কয়েকদিন গ্রামে থাকতে পারবে না?”
“জানি না পারবে কিনা। ওকে এখনো বলার সাহস পাইনি।“
“কী করে সেই তিথিমণি?”
“একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরি করে।“
“ব্যস তাহলে তো হয়েই গেল। তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই নেই। ওর স্কুলে ভ্যাকেন্সি নেই?”
“না। আর থাকলেও ঢুকতাম না।“
“কেন?”
“ওখানে বেতন অনেক কম, আর কাজের প্রেশার অনেক বেশি। ওখানে ঢুকলে আর বি সি এসের জন্য পড়ার সময় পাব না।“
“তাহলে তো বেশ সমস্যাই হলো।“ আমিও চিন্তায় পড়ে গেলাম।
ফুলি ঢুকল চা নিয়ে। চা দিয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই চাচা বলল, “এই যাচ্ছিস কোথায়, দাঁড়া! দেখে নেই আগে চিনি টিনি সব ঠিক আছে কিনা!”
ফুলি দাঁড়াল। চাচা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একটা তৃপ্তির শব্দ করে বলল, “একদম ঠিক আছে, ফার্স্ট ক্লাস চা। যা, তোকে দশে দশ দেওয়া গেল।“
ফুলি মুখে ওড়না চাপা দিয়ে হাসছে। চাচা ধমক দিয়ে বলল, “হাসিস কেন? যা নিচে গিয়ে ওল্ড ম্যানকে বল পঞ্চাশ টাকা দিতে। মোড়ের দোকান থেকে পঞ্চাশ টাকার পুরি নিয়ে আয়।“
মীরা চিন্তিত গলায় বলল, “দাদা দেবে না।“
“এই কথাটা খুব ঠিক বলেছিস। ওল্ড ম্যান নাও দিতে পারে। একদম মিজারেবল ওল্ড ম্যান।“
ফিক করে হেসে ফেলল মীরা। চাচা বিরক্ত গলায় বলল, “শুধু শুধু হাসিস কেন? শুধু শুধু হাসে কারা জানিস? শুধু শুধু হাসে বোকারা।“
মীরা হাসতে হাসতেই বলল, “চাচা, কথাটা মিজারেবল হবে না। কথাটা হবে মাইজার।“
চাচা ঝিম ধরে গেল।
ফুলি পাশ থেকে ফোড়ন কাটল “মামা এইজন্যই মনে হয় আফনের পাস হইতেছে না।“
চাচা তাকাল চোখ গরম করে। তারপর বলল, “বেশি কথা বলিস না। যা আম্মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে পুরি আনতে যা। তাড়াতাড়ি যা। এক ছুটে যাবি, এক ছুটে আসবি। চা শেষ হওয়ার আগে পুরি নিয়ে ফেরত আসতে হবে।“
ফুলি নেমে গেল। চাচা বলল, “এই ছাদে একটা পিকনিক করতে হবে বুঝলি।“
মীরা অবাক হয়ে বলল, “আমাদের বাসা থেকে বের করে দেবে, আর এই পরিস্থিতিতে তোমার পিকনিক করার কথা মনে হচ্ছে?”
“আরে বোকা বের করে দিলে পিকনিক করার জন্য ছাদ পাবি কোথায়? সবাই জানাজানি হওয়ার আগেই পিকনিকটা হয়ে যাওয়া উচিত।“
“এটা অবশ্য একটা ভালো কথা বলেছ।“
“মেন্যু কী হবে?”
“খিচুড়ি।“
“ইয়েস খিচুড়ি। সাথে ডিম ভুনা আর মুরগির মাংস। বাজারে দেখতে হবে ভালো জলপাই উঠেছে কিনা। খিচুড়ির সাথে একটু জলপাইয়ের আচার না থাকলে জমে না।“
“কোক স্প্রাইট, সালাদ।“
“কোক স্প্রাইট দুই পদ করতে পারব না। যেটাই খাবি একটা খাবি।“
“তোমার তো কোক না হলে চলে না। আমি কোক খাই না।“
ফুলি এসে ঢুকল পুরির ঠোঙা নিয়ে। ছোট চাচা হুংকার দিয়ে বলল, “কাগজ কলম নিয়ে আয়, লিস্ট করে ফেলি। শুভ কাজে দেরি করতে নাই। আর ছোট কাগজ আনবি না, খবরদার। আমার টেবিল থেকে এ ফোর সাইজের সাদা কাগজ নিয়ে আয়। যা করব সুন্দরমত প্ল্যান করে করব।“
“কীসের লিস্ট করবেন মামা?”
“ছাদে পিকনিক হবে, সেই লিস্ট। তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়।“
ফুলি খুবই উৎসাহের সাথে দৌড়ে গেল। রুটিন কাজের বাইরে যে কোনো কিছু করতেই তার উৎসাহের কোনো কমতি নেই।
আর শুধু ফুলি কেন? সব মানুষই কি তাই করে না?
নিজের বৃত্ত থেকে বের হওয়ার অর্থহীন চেষ্টা নিরন্তর করে যায় মানুষ। যদিও দিন শেষে আবার নিজের বৃত্তেই ঘুরপাক খায়, তাতেই স্বস্তি বোধ করে। পুরনো সবকিছুর মায়ার টানে আটকে যায়। দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা পুরনো ক্যালেণ্ডারটাও ফেলে দিতে ইচ্ছে করে না।
কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সময় প্রতিবারই মনে হয়, না জানি কি মজা হবে। কিন্তু দিন শেষে বাসায় নিজের ঘরে ফিরে এসে ঘরের পুরনো জামাটা পরে আরামের নিঃশ্বাস ফেলে সবাই।
(আগামী পর্ব পরশু দিন সন্ধ্যা আটটায় ইন শা আল্লাহ্)