নাটাই ঘুড়ি পর্ব-৩২

0
805

#নাটাই_ঘুড়ি
।।৩২।।
আংটি বদল হয়ে গেছে নাইমা আর শাহীনের, নাইমাকে ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আহনাফও এসেছে, সে খুবই উত্তেজিত। তার আনন্দ যেন আর বাঁধ মানছে না।
ভেতরের ঘরে বসে নাইমা আর আহনাফ গুটুর গুটুর করে গল্প করছে, আর বাইরের ঘরে মুরুব্বিরা এখন দেন মোহর নিয়ে আলোচনা করছেন। দেন মোহর আগে থেকে ঠিক করে রাখলে পরে বিয়ের দিন ঝামেলা কম হয়।
মীরার দাদা লজ্জিত মুখে বললেন, “শাহীন তো আগেই এতগুলি টাকা দিয়ে ফেলেছে, এখন আর দেন মোহর কীসের। শাহীনের টাকাও আমি ধার হিসেবেই ধরেছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শোধ করে দেব।“
শাহীনের আব্বা অবাক হয়ে বললেন, “কীসের টাকা?’
এবার সবার অবাক হওয়ার পালা। “সে কী? শাহীন আমাদের নামে ব্যাংকে বায়ান্ন লাখ টাকা জমা করে দেয়নি? তবে নাইমা যে বলল…”
শাহীন ভীষণ অবাক হয়ে বলল, “আমি দিয়েছি? বায়ান্ন লাখ টাকা! কে বলল? নাইমা! এত টাকা কোথায় পাবো আমি? আমি তো আরো লজ্জায় ছিলাম, নাইমা আমার কাছে টাকা ধার চেয়েছিল, তখন আমার অনেকগুলো বিল আটকা ছিল, হাতে ক্যাশ টাকা ছিল না তাই দিতে পারিনি! আমি তো ভেবেছিলাম সামনের মাসে দেবো!”
“তাহলে কে দিল এতগুলো টাকা?’
মীরা এতক্ষণ বিস্ফারিত চোখে দেখছিল সব। আচমকা বলে উঠল, ‘শিহাব ভাই!”
মীরার আম্মু বলল, ‘কি আজে বাজে কথা বলছিস! ও এত টাকা পাবে কোথায়?”
মীরা কেঁদে ফেলল। “শিহাব ভাইয়া দোকান বিক্রি করে টাকা দিয়েছে আম্মু। আমাকে ফোনে জিজ্ঞেস করেছিল আমাদের ঠিক কত টাকা ধার আছে। আমি তো তখন বুঝতে পারিনি!”
“কিন্তু শিহাব না বলে টাকা দিতেই বা যাবে কেন?”
এ কথার উত্তর মীরা জানে। শিহাব নীরাকে ভালোবাসে।
তাই নিজে সর্বস্বান্ত হতেও তার আপত্তি নেই। কিন্তু এত কথা মীরা এখন সবাইকে বোঝাবে কীভাবে!
ঠিক এই সময় উদ্ভ্রান্তের মত বাসায় এসে ঢুকল শিহাব। আজকে দরজা খোলাই ছিল “আমেনা মঞ্জিল” এর।
ঢুকেই পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল নীরার হাতের দিকে। না, দুই হাতের অনামিকাই খালি, কোনো আংটি নেই কোথাও।
চোখে চোখে এক রাজ্যের কথা হয়ে গেল দুজনের।
পাশাপাশি দাঁড়ানো ছিল নীরা, মীরা দুই বোন। শিহাবকে দেখেই মীরার মুখটা হয়ে গেল ঠিক চোরের মত।
সে বলে উঠল, “ভাইয়া আপনার মাথা ব্যথা কমেছে? আসেন ভেতরে আসেন, আজকে মজার মজার নাস্তা হয়েছে, আপনি তো কিছুই খাননি!”
মীরা শিহাবকে নিয়ে এল তাদের ঘরে। ভেতরে ঢুকেই কান ধরল মীরা।
“স্যরি, ভাইয়া, প্লিজ, ভুল হয়ে গেছে আমার, মাফ করে দেন আমাকে!”
“উফ, মীরু, তুমি…” কথা জোগাচ্ছিল না শিহাবের মুখে।
মীরা কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, “স্যরি, আমি আপনার সাথে ফান করছিলাম! আমি আসলে বুঝিনি এত কিছু হয়ে যাবে!”
“তুমি জানো তুমি কী করেছ?’
কাঁদতে শুরু করল মীরা।
“প্লিজ, ভাইয়া, স্যরি…”
“আচ্ছা ঠিক আছে!”
মীরা চোখ মুছে বলল, “আপনি খাবেন না?”
শিহাব হেসে বলল, “খাব!”
এরই মধ্যে নীরা এসে দাঁড়িয়েছে। থমথমে মুখে বলল, “আপনি দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন?”
শিহাব ফ্যাকাসে মুখে বলল, “কে বলেছে?”
মীরা সরে গেল খাবার আনার ছুতোয়। নীরা বলল, “কে বলেছে, সেটা তো বিষয় না। বিক্রি করেছেন কিনা সেটা বলেন।“
“হ্যাঁ।“
“কেন? কী করেছেন এত টাকা?”
“ছিল, আমার একটা দরকার ছিল।“
“কী দরকার ছিল?”
শিহাব এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে গাঢ় স্বরে বলল, “আমি খুব ছোট বয়স থেকে একজনকে ভালোবাসি নীরা। তাকে, তার পরিবারকে ঘর ছাড়া হতে দেখতে পারতাম না।“
নীরার চোখে জল জমে উঠছে। চোখের পাতায় জলের ঘন পর্দার আড়ালে ঝাপসা হয়ে আসছে শিহাবের মুখ।
নদীর এপাড় ভেঙে ওপাড় গড়ে ওঠার মত ভেতরের ঘরে তখন ঢেঁকির পাড় পড়ছে নাইমার বুকের ভেতরে। সব কথাই কানে এসে পৌঁছেছে তার।
তাহলে শাহীন টাকা দেয়নি! শাহীনের যে মহত্ত্ব দেখে মুগ্ধ হয়ে সে বিয়েতে মত দিয়েছিল, সেই মহত্ত্বই যদি মিথ্যা হয়ে যায়, নাইমা আর বিয়েটা করবে কেন তাহলে?
দু হাতে নিজের কপাল টিপে ধরল নাইমা। শুধু শুধু কেন নিজের স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দেওয়া?
বেশ তো ছিল সে! নিজের মত করে কাটিয়ে দিতে পারত বাকিটা জীবন!
নিজের ওপরেই ভীষণ রাগ উঠে যাচ্ছে নাইমার এখন। অথচ কাউকে দোষ দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।
শাহীন একবারও এমন কিছু বলেনি যে তাকে প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে। তাহলে শুধু শুধু এই মুক্ত জীবনের ডানা কাটা পড়বে নাইমার?
কীসের বিনিময়ে? আগের বউটা কেন শাহীনকে ছেড়ে চলে গেল, সেই খোঁজটুকু পর্যন্ত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি সে!
নিজেকে আস্ত একটা গাধা বলেই মনে হচ্ছে তার এখন। মুখ কালো করে উঠে দাঁড়াল নাইমা।
কপাল থেকে টিপ খুলে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় খুলে রাখল। তার গম্ভীর মুখ দেখে আহনাফ ভয়ে ভয়ে বলল, “তোমার কি মাথা ব্যথা করছে আন্টি? টিপে দেব?”
নাইমা আহনাফের দিকে তাকিয়ে ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার নিজের মত কাটানো জীবনে ডেকে সেধে আনা আরেক আপদ!
“তুমি বসো না আন্টি! আমি টিপে দেই!”
আহনাফ প্রায় জোর করেই ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলে বসাল নাইমাকে। আর ছোট ছোট আঙুলে মাথা টিপে দিতেও শুরু করল।
সত্যি সত্যিই আরামে দুই চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগল নাইমার। আর একই সাথে মনটা ছেয়ে গেল অদ্ভুত এক অপরাধ বোধে।
এই বাচ্চাটার কী দোষ? সে তো তাকে প্রায় মায়ের জায়গায় বসিয়েই ফেলেছে!
শাহীন টাকা দেয়নি, শুধুমাত্র এই কারণে কি এই শিশুটির মন ভেঙে দেওয়া ঠিক হবে? নাইমা মন ঠিক করে ফেলল।
চোখ খুলে হাসল আহনাফের দিকে তাকিয়ে। আহনাফ উৎসাহী ভঙ্গিতে বলল, “ব্যথা কমে গেছে আন্টি?”
নাইমা মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ।“
“তুমি যখন আমাদের বাসায় যাবে, মাথা ব্যথা করলেই আমি টিপে দেবো!”
নাইমা জড়িয়ে ধরল আহনাফকে। নাহ, সওদা নেহাত খারাপ হবে না হয়ত।
স্বাধীনতা হারিয়ে যদি এই নিষ্পাপ ভালোবাসার খনি পাওয়া যায়, নাইমা হয়ত খুব একটা ঠকবে না জীবনের হিসেবে!
(পরের পর্ব পরশু দিন সকালে ইন শা আল্লাহ্‌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here