নাটাই ঘুড়ি পর্ব-৩৪

0
1113

#নাটাই_ঘুড়ি
।।৩৪।।
দাদা অসুস্থ থাকায় মুশফিক ব্যস্ত ছিল, সবচেয়ে বড় কথা মুশফিকের আব্বু ঢাকায় ছিল। আর পপিরও ছিল টানা ডিউটি, কোনো ডে অফ পাচ্ছিল না।
তাই রিম্মিকে দেখতে যেতে বেশ কিছুদিন দেরিই হয়ে গেল ওদের। গতকাল পপির পোস্ট এডমিশন নাইট ডিউটি ছিল, অবশেষে আজকে সে সুযোগ পেয়েছে মর্নিং সেশন শেষ করে বাসায় চলে আসার।
পপি আর মুশফিক রুবেলের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে রিম্মিকে দেখতে এসেছে। এর আগে বন্যার রিলিফ, শীতের সময়ে শীতবস্ত্র রিম্মি কালেক্ট করে নিজের বাসায় এনে রেখেছে, রিম্মির একা একা এগুলো ক্যারি করে নিতে কষ্ট হবে বলে রুবেল এগিয়ে এসে নিয়ে গিয়েছে।
সেই সূত্রে রিম্মির বাসার ঠিকানা ছিল রুবেলের কাছে। নিকেতন থেকে গুলশান এক নাম্বার, দূরত্ব খুব বেশি না হওয়ায় সুবিধাই হয়েছে।
তারপরও ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ওদের বাসায় যখন ওরা পৌঁছাল তখন বাজছে বেলা সাড়ে এগারোটা। দুবার কলিং বেল বাজার পর দরজা খুলল রিম্মিই।
দরজা খুলে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে অবাক হয়ে, যেন চিনতেই পারছে না। পপিই প্রথম কথা বলল, “ভেতরে আসতে বলবে না?”
সম্বিত ফিরে পেল রিম্মি, “আসুন আসুন! আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে যে!”
পপি ইঙ্গিতে মুশফিককে দেখিয়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে তুমি করেই বললাম, তোমরা আমার ছোটই হবে বয়সে! মুশফিক যে বাসায় থেকে পড়াশোনা করে, আমিও সেই বাসায় ভাড়া থাকি। আমাকে তুমি এর আগে দেখেছ, ডিএমসির ওয়ার্ডে! ও যে রোগীটাকে রক্ত দিয়েছিল…”
“ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ চিনতে পেরেছি, আপু!”
“ও নিয়ে এল, ওর কাছে খবর পেলাম, তুমি নাকি বেশ অসুস্থ, ক্লাস করতে পারছ না!”
খানিকটা শুকিয়ে গেছে রিম্মি, মুখটা শুকিয়ে চেহারাটা দেখতে হয়েছে ঠিক বাচ্চা মেয়েদের মত। মুশফিক অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছিল রিম্মিকে।
রিম্মি কিছুটা বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, “না আপু, আসলে টাইফয়েড ধরা পড়ল, কিছু খেতেও পারছিলাম না। ডাক্তার ভর্তি হতেও বলেছিল, আমিই হইনি। বাসাতেই ইঞ্জেকশন আর স্যালাইন নিলাম।“
মুশফিক উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “বল কী! তোমার এই অবস্থা, একটা ফোন করতে কী হত?”
রিম্মি উত্তর না দিয়ে বলল, “আপু বসুন, আমি আপনাদের জন্য চা নিয়ে আসি!”
বাধা দেওয়ার আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল রিম্মি। দুই চোখ ফেটে জল আসছে তার।
অসহ্য বুক ভাঙা কষ্ট হচ্ছে। এই মুশফিক কেন আবার এসে দাঁড়াল তার সামনে?
রান্নাঘরে ময়নার মা তরকারি কুটছিল। এক চুলায় চা বসাল রিম্মি।
রিম্মির শাশুড়ি তার ঘর থেকে ডেকে বললেন, “রিম্মি কে এসেছে বাসায়?”
রিম্মি এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমার ক্যাম্পাসের ছোট ভাই আর একটা ডাক্তার আপু, আমি অসুস্থ খবর পেয়ে আমাকে দেখতে এসেছে!”
রিম্মির শাশুড়ি উঠে এলেন। ড্রয়িং রুমের পর্দা সরিয়ে ঢুকলেন ঘরে।
রিম্মিও এল পেছন পেছন। রিম্মির শাশুড়িকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল দুজনেই।
“আপু, উনি আমার শাশুড়ি। আপনারা বসুন, চা হয়ে গেল মনে হয়।“
অতিথি আপ্যায়নের জন্য ওকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে পপি বাধা দিয়ে বলল, “তুমি তো বেশ সুস্থই আছ দেখতে পাচ্ছি, তবে ক্লাসে যাচ্ছ না কেন?”
রিম্মির শাশুড়ি অপ্রসন্ন মুখে বললেন, “হ্যাঁ, তোমরা একটু নিয়ে যাও বুঝিয়ে সুঝিয়ে! সবাই তো আমাদেরকেই দোষ দেবে! এমনিই ছেলে থাকে না দেশে, ছেলে ছাড়া ছেলের বউ পালার কী যে যন্ত্রণা!”
রিম্মি চোখ তুলে বলল, “আমি কি আপনাকে কখনো কোনো যন্ত্রণা দিয়েছি মা?”
“ক্লাসে যাচ্ছ না যে, এটাই তো যন্ত্রণা! সবাই ভাববে আমরা ক্লাসে যেতে না দিয়ে আটকে রেখেছি, বাসার কাজ করাচ্ছি!”
রিম্মি বেশ সহজ ভঙ্গিতেই বলল, “আমার আর পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না!”
রিম্মির মুখে এমন কথা নতুন।
পরিস্থিতি সহজ করার জন্য পপি বলল, “আসলেই! জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টাই আমরা পড়াশোনা করে নষ্ট করে ফেলি! কোনো মানে হয় না।“
“চা তিতা হয়ে যাবে”, বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল রিম্মি।
চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসছিল রিম্মি, তার শাশুড়ি বললেন, “থাক আর এখানে কেন, একবারে তোমার ঘরে নিয়ে বসাও না! তোমরা দুপুরে খেয়ে যাবে তো?”
“না না আন্টি, আমরা কিছু খাব না!”
“তাই বললে কী হয়? এই প্রথম আসলে আমাদের বাসায়!”
রিম্মি চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে রেখে এসে বলল, “আপু আসুন আমার ঘর দেখে যান।“
পপি বেশ সহজভাবেই উঠে এল। রিম্মির ঘরটা প্রায় অবিবাহিত মেয়েদের মতই সাজানো।
যুগল জীবনের তেমন কোনো চিহ্ন নেই। রিম্মি নিজে থেকেই বলল, “আমার হাজব্যাণ্ড দেশের বাইরে পড়তে গেছে, তাই আমার শাশুড়ির অনেক চিন্তা আমাকে নিয়ে। নানান লোকে নানান কথা বলে তো!”
পপি চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “জানি, বুঝি।“
রিম্মি আর পপি মুখোমুখি বসেছে বিছানায়। মুশফিক বসেছে একটু দূরে, রিম্মির পড়ার টেবিলে।
“এই বাসায় আর কে কে থাকে?”
“আমি, আমার শ্বশুর শাশুড়ি।“
“তোমার হাজব্যাণ্ডের ভাই বোন নেই?”
“আছে, বিয়ে হয়ে গেছে আপুর। স্বশুরবাড়িতে থাকে।“
“তোমাদের প্ল্যান কী, তোমার পড়া শেষ করে বাইরে চলে যাওয়ার? তোমার হাজব্যাণ্ড কি চলে আসবে দেশে নাকি ওখানেই সেটল হবে?”
“এখনো ঠিক করিনি আপু।“
রিম্মির চোখ ভরে বার বার জল আসছে। সে প্রাণপণে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে।
আজ বুঝি সব বাঁধ ভেঙে গেল বলে। রিম্মি জানে, একটু দূরেই তার জন্য এক সমুদ্র মুগ্ধতা আর ভালোবাসা নিয়ে বসে আছে মুশফিক, অথচ এই ভালোবাসা তার জন্য নয়।
পপি কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে রিম্মিকে দেখে মুশফিককে বলল, “নিচের দোকান থেকে আমার জন্য একটা ওষুধ নিয়ে আসো তো!”
রিম্মি ব্যস্ত হয়ে বলল, “কী ওষুধ আপু? আমাকে বলেন আমি দারোয়ানকে দিয়ে আনিয়ে দিচ্ছি!”
“না, ওকেই পাঠাচ্ছি।“
পপি ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে ওষুধের নাম লিখে দিল। সে জানে এটা কাছে পিঠে কোথাও পাওয়া যায় না।
এই ওষুধ কিনে আনতে মুশফিককে একটু দূরে বড় রাস্তায় যেতে হবে।
মুশফিক বেরিয়ে যেতেই পপি রিম্মিকে বলল, “তোমার কী হয়েছে আপু? আমাকে বল!”
এইটুকু আদরের কথায় রিম্মির চোখের কোল উপচে জল গড়িয়ে পড়ল। ঢোক গিলে চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আপু, আপনি প্লিজ মুশফিককে বলবেন, ও যেন আর আমার সামনে না পড়ে। ও যদি এরকম অস্থিরতা করতে থাকে, তাহলে আমি ক্যাম্পাসে যাই কী করে?”
পপি তাকিয়ে রইল স্থির দৃষ্টিতে। রিম্মি থেমে থেমে বলল, “আমি পড়াটা শেষ করতে চাই আপু। পড়াটা শেষ করা আমার নিজের জন্য প্রয়োজন। জীবন এই সুযোগ আমাকে বার বার দেবে না, তাই না?”
“ঠিক আছে, আমি বুঝতে পেরেছি। আমি বলে দেব ওকে।“
“আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না আপু।“
“না ভুল বুঝিনি।“
“আমি এখন মুশফিককে একটা মিথ্যা বলব। আপনি চমকে উঠবেন না।“
“কী মিথ্যা?”
রিম্মি জবাব দিল না। পপি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “যাই আজকে। তুমি আবার ক্লাস করা শুরু কর।“
“হ্যাঁ করব আপু।“
লিফটে করে পপিকে এগিয়ে দিতে নামল রিম্মি। মুশফিক তখন সদ্যই ওষুধ কিনে গেট দিয়ে ঢুকেছে।
রিম্মি যেন আচমকাই মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল, “আপু, আপনি তো আমাকে গাইনি ম্যাডামের ঠিকানা দিলেন না?”
“গাইনি ম্যাডাম?” প্রথমে বুঝতে পারল না পপি।
“হ্যাঁ, আপনাকে বললাম না এখন যে ম্যাডামকে দেখিয়েছি তাকে আমার পছন্দ হয়নি? আপনার ম্যাডামের ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিয়েন।“
“ও আচ্ছা, ঠিক আছে।“ আর কোনো কথা খুঁজে পেল না পপি।
রিম্মি মুশফিকের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, “আমার কাজগুলো ভালোই সামলে নিচ্ছিস শুনলাম! আরো দেড় বছর সামলাতে হবে, ম্যাডাম বলেছে আমার রেস্ট দরকার, এত জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করলে বেবির ক্ষতি হতে পারে!”
“বেবি?”
“হ্যাঁ, আমি প্রেগন্যান্ট তো, এইজন্যই তো দুর্বল হয়ে গেছি একদম, এনিমিয়া হয়ে গেছে!”
মুশফিক মাথা নাড়ল। হ্যাঁ প্রেগন্যান্ট তো হতেই পারে রিম্মি।
রিম্মি একবার বুঝি ভাসা ভাসা বলেছিল সম্পর্ক ভালো নয়, ডিভোর্স হতে পারে। তারপর তো বেশ অনেকদিন ধরেই এড়িয়ে চলেছে তাকে।
হয়ত ওর হাজব্যাণ্ড দেশে এসেছিল, ঝগড়া মিটে গেছে হয়ত। হতেই তো পারে।
মুশফিক হাসিমুখে মাথা নেড়ে বলল, “তুমি কোনো চিন্তা করো না! আমি সব ভালোমতই সামলে রাখব!”
“তোর জন্য একটা টিউশ্যনি দেখেছিলাম, ভার্সিটির কাছেই। হলে উঠে যাইস, তাহলে পড়াতে সুবিধা হবে। এই যে নাম্বার।“
নাম্বার লেখা ছোট একটা কাগজ মুশফিকের হাতে তুলে দিল রিম্মি। পপিকে নিকেতনের রিকশায় তুলে দিয়ে মুশফিক চলে গেল গুলশান লেকের পাড়ে। সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত চুপচাপ বসে রইল সেখানে।
এক সময় দিনের আলো মিলিয়ে গিয়ে চায়ের ওপর সর পড়ার মত ধূসর সন্ধ্যা নেমে এল চারপাশে। এত মলিন, এত বিষণ্ণ সন্ধ্যা বুঝি আর কখনো আসেনি আগে।
সন্ধ্যা হলেই এখানে বাদুড়ের ওড়াউড়ি শুরু হয়ে যায়। শীতের দেরি আছে, তবু কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। দিনের বেলায় অতটা বোঝা না গেলেও এখন একটু একটু ঠাণ্ডা বাতাস বইছে।
রাত বাড়ছে। শুরু হচ্ছে মুখে রঙ মাখা সুখী সুখী চেহারার দুঃখী মেয়েদের আনাগোনা।
লেকের পাড়ে ঘন হয়ে জমতে থাকা অন্ধকারের কাছে রিম্মির স্মৃতি জমা রেখে উঠে দাঁড়াল মুশফিক।
বাসায় ফেরার পর খালু বললেন, “এত দেরি হলো যে? বাসায় তো একটা নিয়ম কানুন আছে! এরকম করলে তো এই বাসায় থাকা যাবে না!”
মুশফিকের কেন যেন রাগ উঠে গেল আচমকা। ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আমি চলে যাচ্ছি, থাকব না এই বাসায়।“
“চলে যাচ্ছি মানে? কোথায় গিয়ে উঠবা?”
“হলে, সবাই যেখানে থাকে সেখানেই থাকব।“
“সুখে থাকতে ভূতে কিলায়, না?”
কোনো উত্তর দিল না মুশফিক। অতি দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে নিল।
নিজের ট্রাংক আর বড় হ্যাণ্ড ব্যাগ নিয়ে সে যখন রাস্তায় এসে দাঁড়াল তখন রাত প্রায় দশটা। এক বন্ধুকে ফোন করে বলল হলের গণ রুমে যেন তাকে ঢুকতে দেওয়া হয় সেই ব্যবস্থা করে রাখতে।
আজকে মুশফিক ভীষণ এলোমেলো হয়ে আছে, হলে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আচমকা হুড়মুড় করে পড়ে গেল সে। তার বন্ধুটি তাকে টেনে টেনে তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল, “বেশি ব্যথা পেয়েছিস?”
উত্তর দিল না মুশফিক। জিন্সের প্যান্ট ছিঁড়ে হাঁটুর কাছে কোথায় জানি কেটে গেছে।
জ্বালা করছে। তার চেয়ে বেশি হু হু করছে বুকের ভেতরটা।
হাঁটু ডলতে ডলতে আরো একবার বুক ভাঙা কষ্ট নিয়ে নিজেকে মনে করিয়ে দিল মুশফিক, রিম্মির সাথে তার আর কোনো দিন দেখা হবে না! রয়ে যাবে শুধু বুকের বাম পাশে কোথায় যেন বিশাল এক শূন্যতা!
(পরের পর্ব পরশু দিন সন্ধ্যায় ইন শা আল্লাহ্‌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here