নাটাই ঘুড়ি পর্ব-৮

0
867

#নাটাই_ঘুড়ি
।।৮।।
মীরার প্রথম সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। রেজাল্ট যতটা খারাপ হবে বলে সে ভেবে রেখেছিল বাস্তবে তার চেয়েও বেশি খারাপ হলো।
জেনারেল ম্যাথ, হায়ার ম্যাথ, ইংলিশ দুই পেপার মোট চার সাবজেক্টে পাস মার্ক ওঠেনি। হেড স্যার বলে দিয়েছেন যারা কোনো সাবজেক্টে পাস মার্ক তুলতে পারেনি তাদের গার্জিয়ানকে আগামীকাল স্কুলে এসে কথা বলে যেতে হবে।
গার্জিয়ান এসে দেখা না করলে আর সায়েন্সে ক্লাস করতে দেবেন না।
বাসায় ফিরতেই ইচ্ছা করছে না আজকে। মীরা গেট দিয়ে বের হয়ে সময় কাটানোর জন্য ঝালমুড়ী কিনল।
ঝালমুড়ি, ফুচকা, বড়ইয়ের আচার, জলপাইয়ের আচার সবকিছু খেয়ে প্রায় এক ঘন্টা সময় কাটিয়ে অবশেষে রিকশা করল মীরা। অনন্তকাল তো আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে এইসব খেয়ে যাওয়া যায় না। তাছাড়া টাকাও ফুরিয়েছে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে মীরা ভাবছিল এখন কী করা যায়। আব্বুকে যেতে বললে তো মার খেতে হবে।
শুধু সিগনেচারের বিষয় হলে না হয় নকল করে দিয়ে দিত। কিন্তু এটা তো দেখা করতে যেতে হবে, শুধু সিগনেচার দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। ছোট চাচাকে বলে দেখা যেতে পারে।
মীরা বাসায় এসে দেখে হুলুস্থূল কারবার। আজকে শনিবার, ফুপির ব্যাংক ছুটি।
চোখের নিচের কালি দূর করার জন্য তার একটা আই ক্রিম ছিল। সেটা কিছুদিন ধরেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
আজকে সবকিছু ঘেঁটে ঘুঁটে ফুলির ব্যাগ থেকে উদ্ধার হয়েছে সেটা। ফুপি চেঁচিয়ে পাড়া উদ্ধার করছে।
এইসব গণ্ডগোলের মধ্যে টুক করে ঘরে ঢুকে গেল মীরা। ব্যাগপত্র রেখে শুকনো মুখে ছোট চাচার ডেরায় গেল।
ছোট চাচা ছাদের কোণার রুমে শুয়ে ছিল। সবকিছু শুনেটুনে বলল, “এটা কোনো বিষয়ই না। যাব। কিন্তু এর বিনিময়ে তুই কী করবি আমার জন্য?”
“আমি?”
“হ্যাঁ, তুই। এই ফেভারের বদলে কী দিবি আমাকে?”
“বল কী করতে হবে?”
ছোট চাচা খানিকক্ষণ মাথা চুলকে বলল, “এখন কিছু মনে আসছে না। মনে পড়লে তখন বলব।“
মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তাহলে কালকে তুমি যাচ্ছ?”
“হ্যাঁ, যাচ্ছি। মনে রাখিস, পাওনা থাকলাম কিন্তু!”
“মনে থাকবে।“
পরদিন স্কুল থেকে ফিরে ছোট চাচা চিন্তিত মুখে বলল, “তোর অবস্থা তো আসলেই ভয়াবহ রে! চার সাবজেক্টে ফেল করলি কীভাবে?”
মীরা হাই তুলে বলল, “ফেল করা খুব কঠিন কিছু না চাচা! আমার পড়তে ভালো লাগে না!”
“হ্যাঁ রে, এই সাবজেক্টগুলো ব্যাচে পড়তে হবে না?’
“পড়তে পারলে তো ভালোই হত, কিন্তু আব্বু দেবে না। সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো।“
“তাহলে কী করবি তুই?”
“কিছু করব না।“
আচমকা ছোট চাচার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “এক কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“নীরাদের স্যারকে বলে দিই তোকে পড়াতে? তাহলে আর এতগুলো সাবজেক্ট আলাদা করে ব্যাচে পড়তে যেতে হবে না।”
নীরা আপু যে স্যারের বাসায় ব্যাচে পড়তে যায়, সেই স্যার বাসাতেও পড়াতে আসে, টাকা কিছু বেশি লাগে। ছোট চাচা তার কথাই বলছে।
মীরা মাথা নেড়ে বলল, “অসম্ভব।“
“কেন, অসম্ভব কেন?”
“প্রথম কথা, আমাকে পড়াতে বললে স্যার যে এক্সট্রা টাকা চাইবে সেই টাকা কে দেবে? আব্বু দেবে না! দ্বিতীয় কথা, বড় চাচি জিনিসটা পছন্দ করবে না। বলবে নীরা আপুর সাথে আমার পাল্লাপাল্লি!”
“ওসব তুই আমার ওপর ছেড়ে দে!”
“তোমার ওপর ছেড়ে দেব? কিন্তু তুমি টাকা পাবে কোথায়?”
ছোট চাচা উত্তর না দিয়ে চলে গেল। কীভাবে কী করল মীরা জানে না তবে সত্যি সত্যি নীরা আপুর স্যার সপ্তাহে চারদিন আসা শুরু করল।
বড় চাচির মুখ ইদানিং গোমড়া থাকে, মেজাজ আগেই খারাপ ছিল, আজকাল মীরার আম্মুর সাথে সেই মেজাজ আকাশ স্পর্শ করেছে।
প্রথম এক সপ্তাহ ভালোই চলছিল। তারপর আচমকা একদিন গোলমাল তুঙ্গে উঠল।
রাতে খাবার সময় নীরা আপু বলল, “মাছটা কি পচা ছিল নাকি? কেমন গন্ধ গন্ধ লাগে!”
বড় চাচী গজগজ করতে করতে বলল, “বাজারের টাকা থেকে পয়সা সরাতে হলে তো পচা মাছই আনতে হবে! ভালো মাছ আর জুটবে কীভাবে?”
এ কথায় ছোট চাচা নিজের ভাতের প্লেট থেকে হাত সরিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, “তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও বড় ভাবী? বলতে চাইলে সরাসরি বলে ফেলো! ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলার দরকার নাই!”
বড় চাচী বলল, “মীরার স্যারের বেতন কে দিচ্ছে? তুমি দিচ্ছ, কোথা থেকে দিচ্ছ? তুমি কি চাকরি বাকরি কিছু কর? বাজারের টাকা থেকে না দিলে আর কোথা থেকে পাচ্ছ টাকা?”
“আমার অংশের টাকা থেকে আমি দিচ্ছি!”
“তোমার অংশ মানে? তোমার আবার কোন অংশ? কীসের অংশ?”
“উত্তরের জমি থেকে যে টাকা তোমরা পাও, সেই জমিটা আমার আম্মার অংশ। আমার নানিবাড়ি থেকে পাওয়া!”
“তোমার আম্মা মানে?”
“আমার আম্মা মানে, আমার আব্বার প্রথম স্ত্রী! সুফিয়া বেগম।“
টেবিলের ওপর একটা বাজ পড়লেও সবাই এত চমকে উঠত না যতটা এই কথায় উঠল। মীরা দেখল দাদি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছোট চাচার দিকে।
সেই দৃষ্টিতে রাজ্যের অভিমান। চোখ ভরে উঠেছে জলে।
না খেয়ে উঠে চলে গেলেন দাদা দাদি। ছোট চাচাও আর খেল না।
বাকিরা কোনো মতে খাওয়া শেষ করল থমথমে মুখে। সেই রাতে বাসার গুমোট ভাবটা আর কাটল না।
পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল মীরার। চোখটা খুলেই তার মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই।
অন্যান্য দিন ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ সিলিং এর দিকে চোখ মেলে রাজ্যের আকাশ পাতাল ভাবে মীরা। আজকে কী মনে করে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল বিছানা থেকে।
সদর দরজা খোলা, শুধু হালকা করে ভিজিয়ে রাখা। কে খোলা রেখেছে?
দোতলায় ছোট চাচার রুমে কেউ নেই, ছুটে ছাদে গেল মীরা। ছাদেও কেউ নেই।
ভয়ে মীরার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল।
আবার ছুটে ছোট চাচার রুমে গেল ও। ঠিক নেই, কিছু একটা ঠিক নেই।
সারাটা রুমে একবার চোখ বুলিয়ে মীরা বুঝতে পারল কী ঠিক নেই। এই রুমের এক কোণায় কাঠের আলনা আছে একটা।
সেই আলনায় সারা বছর ছড়িয়ে থাকে কাপড়চোপড়, এলোমেলো, অগোছালো। দাদির বকাবকি, চাচিদের গজগজ করে অসন্তোষ প্রকাশ কিছুতেই এই রুমের আলনায় ছড়িয়ে থাকা কাপড় বিন্যস্ত করতে পারেনি কখনো।
আজ সেই আলনা ফাঁকা। ঝুলছে না লুঙ্গি, গামছা, টি শার্ট।
ছুটে বাথরুমে গেল মীরা। যা ভেবেছিল ঠিক তাই।
বহুল ব্যবহারে জীর্ণ দাঁতগুলো সব এবড়ো খেবড়োভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া ছোট চাচার নেভি ব্লু টুথ ব্রাশটা নেই। আচমকাই কান্না পেয়ে গেল মীরার।
কোথায় চলে গেলে তুমি ছোট চাচা? তোমার তিথিমণির কথাও বুঝি মনে পড়ল না তোমার?
কী ভেবে ছোট চাচার ঘরে গিয়ে টেবিলে হাতড়াতে শুরু করল মীরা। সব নিয়ে গেছে ছোট চাচা, শুধু রেখে গেছে তার “তিথিডোর”।
“তিথিডোর” টা কেমন ফোলা ফোলা লাগল। বইটা ঝাঁকাতেই ভেতর থেকে টুপ করে পড়ল একটা চিঠি।
খুলে পড়তে শুরু করল মীরা।
“মীরু,
আমি চলে যাচ্ছি। আর ফিরব না। তিথিডোরটা রেখে গেলাম, ওটা তোর খুব প্রিয় ছিল তাই।
তোর স্যারের বেতন নিয়ে চিন্তা করিস না, ওটা আমি বিকাশে পাঠিয়ে দেব।
আমাকে খুঁজিস না। খুঁজলেও পাবি না।
পড়াশোনা করিস ঠিক মত। ফাঁকিবাজি করিস না।
দেখা হবে অন্য কোথাও।
ভালো থাকিস।
-ছোট চাচা।“
চিঠি হাতে নিয়ে ছোট চাচার ঘরে অনেকক্ষণ ধরে বিমূঢ়ের মত টেবিলের ওপরে হাত রেখে চেয়ারে বসে রইল মীরা।
ভাঙনের শুরু বুঝি এভাবেই হয়?
(পরের পর্ব পরশুদিন সন্ধ্যায় ইন শা আল্লাহ্‌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here