#নাটাই_ঘুড়ি
।।৯।।
মহাখালী গিয়ে ওভারব্রিজে উঠে রাস্তা পার হয়ে রেল লাইনের ওপাশ থেকে দেওয়ান বাসের দরজা দিয়ে ঢুকে কোনো মতে সিঁড়িতে নিজের শরীরটা রেখে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত। ফার্মগেট এলে কিছুটা ফাঁকা হয় বাস।
“মামা পিছের দিকে যান, পিছের দিকে যান, পিছে জায়গা আছে, পিছে জায়গা আছে” প্রতিদিনের এই বুলি শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে প্রায়। দেরি হয়ে গেছে ঘুম ভাঙতে, নাস্তাও করে আসা হয়নি।
প্রথম ক্লাসটা ধরতে পারলে হয় এখন। মুশফিকের মেজাজের পারদ ক্রমেই ওপরের দিকে চড়ছে।
পি কে স্যার দরজা বন্ধ করে দেন ঠিক নয়টা বেজে পাঁচ মিনিটে, ঘড়ির কাঁটা আটটা পেরিয়ে গেছে। দূরত্ব হয়ত খুব বেশি নয় কিন্তু এইটুকু পথ অতিক্রম করতে এক ঘন্টা সময় যথেষ্ট নয়।
বাসে গাদাগাদি ভিড়। বাতাস চলাচলের জায়গাটুকু নেই।
সবাই অতিষ্ঠ, বিরক্ত। ভাড়া চাইতে আসলেই কন্ডাক্টরের সাথে এক প্রস্থ তর্কাতর্কি বাধিয়ে দিচ্ছে কেউ কেউ।
রাস্তায় প্রাইভেট গাড়ি, সি এন জি আর আরো আরো বাসের ভিড়ে তাদের বাস সামনে এগোচ্ছে শামুকের গতিতে। সামনে থেকে পেছন থেকে ক্রমাগত বাজছে অসহিষ্ণু ড্রাইভারদের হর্ন।
“মামা ভাড়াটা?’
কণ্ডাক্টর এসে হাত পেতে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। চতুর্দিকে সহযাত্রীদের গায়ের চাপে পিষ্ট হতে হতে বিরক্ত মুখে উত্তর করল মুশফিক, “দিচ্ছি একটু পরে।“
কন্ডাক্টর তাকে অতিক্রম করে ভাড়া সংগ্রহ অভিযান সম্পন্ন করতে চলে গেল বাসের পেছনের দিকে। গায়ে গায়ে লেগে থাকা মানুষের ফাঁক ফোকর দিয়ে গলে যেতে যেতে এক হাতে টাকার বাণ্ডিল শক্ত করে ধরে রেখেও ভারসাম্য বজায় রাখতে তার নৈপুণ্য দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যেতে হয়।
এইসব ডামাডোলের মধ্যেই ফার্মগেট এসে পড়েছে! আহ কাঙ্খিত ফার্মগেট, সিট পাওয়ার ফার্মগেট, বসতে পারবার ফার্মগেট!
হুড়মুড় করে বাস থেকে নিচে নেমে গেল অফিসমুখী এক দঙ্গল মানুষ। আর কাছাকাছি ফাঁকা হয়ে যাওয়া একটা সিটে নিজের নিতম্ব স্থাপন করার দুর্লভ সুযোগ পেল মুশফিক।
কন্ডাক্টর বাসের পেছন দিক থেকে ভাড়া সংগ্রহ মিশন নিষ্পন্ন করে আবারও এসে দাঁড়িয়েছে মুশফিকের সামনে।
হাত বাড়িয়েছে আবার, “মামা ভাড়াটা?’
প্যান্টের ব্যাক পকেটে হাত ঢোকাল মুশফিক। প্রায় সাথে সাথেই জমে গেল বরফের মত।
মানিব্যাগ নেই!
পাগলের মত অন্য পকেটেও হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগল মানিব্যাগটা। আজকে বারোটায় ক্লাস নেই, নয়টার ক্লাস শেষ করে বই কিনতে নীলক্ষেত যাবে বলে ভেবে রেখেছিল।
বই কেনার টাকা ছিল মানিব্যাগে।
মুশফিকের রক্তশূন্য মুখ দেখে বোধ হয় কিছু অনুমান করে নিল কন্ডাক্টর। “সেই কালে ভাড়াটা দিয়ে দিলে তো আর এই কাজ হইত না! ভাড়া দেওয়ার জন্য মানিব্যাগ বের করতেন, খেয়াল খবর থাকত! এখন কি মাগনা নিয়ে যাব আপনারে?’
“না, মাগনা নিয়ে যেতে হবে না।“
যন্ত্রচালিতের মত উঠে দাঁড়াল মুশফিক। হয়ত এটা এমন কিছুই নয়, কিন্তু গতকাল রাত থেকে ঘটে চলা সব ঘটনার জের থেকে সবকিছু মিলিয়ে মন উঠে যাচ্ছে জগত সংসারের ওপর থেকে।
বাসটা তখন কাওরানবাজারে এসে থেমেছে। কন্ডাক্টরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টুক করে নেমে পড়ল সে বাস থেকে।
তার ছেড়ে যাওয়া সিটে চট করে বসে পড়ল পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন। এই পৃথিবীতে কোনো শূন্যতাই আসলে অপূর্ণ থাকে না।
ঘড়ির মিনিটের কাঁটা ছয়ের ওপরে, আটটা তিরিশ বেজে গেছে। নয়টা পাঁচের মধ্যে কোনো ভাবেই ক্লাসে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
কী করবে এখন মুশফিক?
বাসায় ফিরে যাবে?
কী লাভ তাতে? ওটা কি আদৌ তার বাসা?
তাছাড়া তিনটার ক্লাস করতে তো আবার আসতেই হবে!
অফিসগামী সব মানুষের মধ্য দিয়ে হাঁটতে শুরু করল মুশফিক। ঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পারলেও চলা থামাতে নেই।
সঠিক সময়ে যে গন্তব্য স্থলে পৌঁছাতে পারে না, তাদের নাম পৃথিবীর সফল মানুষদের তালিকায় কখনো থাকে না। কোনো হিসেবেই তারা জেতে না।
হেরে যাওয়া মানুষদের জন্য ইতিহাস কোনো জায়গা রাখে না। যেমন আজকের এটেণ্ড্যান্স খাতাতেও হয়ত মুশফিকের রোলের পাশে এবসেন্ট বসবে।
কিন্তু বাধা পাওয়ার পরও যে পথ চলা থামিয়ে দেয় না, প্রকৃতি চলার পথে তাদের জন্য চমক সাজিয়ে রাখে। অন্য কোনো না কোনো দিক দিয়ে ভরিয়ে দেয় তাদের অপূর্ণতা।
বাধা পাওয়ার পরেও থেমে না গিয়ে চলার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা, থেমে যাওয়া মানেই হেরে যাওয়া।
এইসব নানান দার্শনিক চিন্তা করতে করতে মুশফিক হাঁটতে থাকে। বাংলা মোটর মোড়ে বসানো বিশাল ধাতব কৃত্রিম ঘোড়ার গাড়ী দেখে শিল্পীর প্রশংসা করে মনে মনে।
গতিময়তাকে স্থির সময়ে ধরে রাখার দারুণ প্রচেষ্টা। আচ্ছা এই যে এত মানুষ হাঁটছে, চলছে, ছুটছে, কোনো ডাইনির জাদুর মায়ায় যদি আচমকাই এই শহর পরিণত হয় পাষাণপুরীতে?
সবাই যদি থেমে যায় আজ, এখনই, এই মুহূর্তে, যে যেখানে আছে সেভাবেই? কেমন হবে সেটা?
কবজি উলটে ঘড়ি দেখল, আটটা চল্লিশ বাজে। দার্শনিক চিন্তা আপাতত স্থগিত রেখে পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল মুশফিক। বিশ মিনিটে পৌঁছাতে পারবে কি?
জানা নেই। একবার চেষ্টা করে দেখা যাক!
শত চেষ্টা করেও কলা ভবনে আসতে আসতে মিনিটের কাঁটা দশের ঘর অতিক্রম করেই গেল। নয়টা বারো বাজে।
এখন ক্লাসে ঢোকার চেষ্টা করে অপমানিত হওয়ার কোনো অর্থ হয় না। নিজেকে কেমন বোকা বোকা মনে হচ্ছে মুশফিকের।
পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুকে বসা যায়। মুশফিক পাবলিক লাইব্রেরির গেট দিয়ে ঢুকেও কী মনে করে ভেতরে না গিয়ে বাইরে সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল।
সামনের ছাতিম গাছের দেয়াল ভেদ করে এক চিলতে রোদ এসে লুটোপুটি খাচ্ছে তার পায়ের কাছে। সকাল সাড়ে নয়টার রোদকে ঠিক মিষ্টি রোদ নামে আখ্যায়িত করা চলে না।
অথচ দুপুরের খর রোদও সে নয়। যেন সদ্য যৌবনের ছোঁয়া পাওয়া কিশোরী কোনো, প্রথম যৌবন যার শরীরে আসি আসি করছে, অথচ শৈশবের মিষ্টি মধুর রূপও তাকে পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি এখনও।
তুলনাটুকু মনে আসতেই আপন মনে হেসে উঠল মুশফিক। বেশ মজার তো, একদিন পকেটমার হয়েই সে রীতিমত দার্শনিক বনে গেল নাকি!
“এক্সকিউজ মী?’
সামনে এসে রোদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছেন এক সুবেশা তরুণী। তটস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াল মুশফিক।
“আমাকে বলছেন?”
‘আশে পাশে আর কাউকে তো দেখছি না”, তরুণির চাঁছা ছোলা উত্তর।
মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করল মুশফিক। উঠে দাঁড়ানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না।
মেয়েটা তো তার বয়সীই হবে। আসলে মফস্বলের গুডি গুডি বয় মুখচোরা ছেলেটা স্মার্ট হয়ে উঠতে পারেনি এখনো।
“জি বলুন আপু?’
“আপনার ব্লাড গ্রুপ কী?’
কিছুটা অবাক হলো মুশফিক।
“এবি নেগেটিভ! কিন্তু কেন?”
“শেষ কবে রক্ত দিয়েছেন?”
“দেইনি কখনো।“
মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে রইল বিচিত্র দৃষ্টিতে।
‘বয়স আঠারো হয়েছে তো, না?”
“জি হয়েছে, কিন্তু কেন?”
“তাহলে চলুন আমার সাথে!”
“কিন্তু কোথায়?’
সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত পায়ে নিচে নামছে মেয়েটি, নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ময়লাটে শার্ট আর লুঙ্গি পরা লোকটির দিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “চিন্তা করবেন না, ডোনার পাওয়া গেছে!”
মুশফিক, আজ সকালে পকেট মার না হলে যে ছেলেটি এতক্ষণে মনোযোগ দিয়ে বসে ক্লাসে লেকচারের প্রতিটি শব্দ নোট করার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকত, ভাগ্যের ফেরে পকেট মার হওয়ার ফলে কিছুক্ষণ পর তাকে দেখা গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্রান্সফিউশন ডিপার্টমেন্টের কাউন্টারের সামনে চোখ মুখ শক্ত করে তার রক্ত নিতে উদ্যত সিরিঞ্জটির দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে!
সে ঘুণাক্ষরেও জানত না এই রক্তদানের ফলে কি ভীষণ বদলে যাবে তার জীবনটা!
তবে কি সবই আসলে নিয়তির খেলা? সবই পূর্ব নির্ধারিত?
মানুষ কি শুধু খেলার পুতুল মাত্র?
সব প্রশ্নের কি উত্তর হয়!
(পরের পর্ব পরশু দিন সন্ধ্যায় ইন শা আল্লাহ্)