নানান বরণ মানুষ রে ভাই পর্ব-২০

0
771

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
২০ তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

খুব বিশ্রী পরিস্থিতি। রিয়া বাবার বাড়ি যাবেন,কিন্তু ওমর যাবেন না। “তোমার ভাইদের বদৌলতে আমরা পথের ফকির। সেইখানে উঠতে চাচ্ছো? ঘরে ঢুকতে দিবে তো? যেতে হলে তুমি যাও,আমি যাবো না।”

রিয়া নিজেও শংকিত, ভাই ভাবীরা তাঁকে আদৌ ঘরে ঢুকতে দিবেন কিনা।তাঁর আশংকা সত্যি হলো। ভাই -ভাবীরা ঘরের চৌকাঠ ও পার হতে দিলেন না।

“এটা আমারও বাসা। আমার বাবার তৈরি। এখানে আমাকে ঢুকতে দিবি না মানে?”

“তোমার ভাগ পাই পাই করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর কাগজপত্র আছে আমাদের কাছে।”

“মানলাম। কিন্তু মেয়েরা কি বাপের বাড়ি বেড়াতে আসে না? বিধবা বা ডিভোর্সি অনেক মেয়েতো বাপের বাড়িতেই থাকে।”

“এটা তোমার বাপের বাড়ি না। এটা আমাদের দুই ভাইয়ের বাড়ি।”

“তাহলে দুই ভাই এর কাছে হাত জোড় করছি,একটি মাত্র বোনকে একটু জায়গা দাও।”

“কোনো জায়গা নেই। তুমি আর তোমার স্বামী মিলে কম ভুগাওনি আমাদের দুই ভাইকে।কতো আজেবাজে কথা, হুমকি-ধামকি, কোট-কাচারি,কিচ্ছু ভুলিনি। ”

“তোমরাই তো আমাদের পথে বসিয়েছো। যা পেরেছো হাতিয়ে নিয়েছো। ব্যবসায় রীতিমতো হরিলুট করেছো তোমরা।”

“তাহলে সেই লুটেরাদের বাড়ি এসেছিস কেন?অনেক কথা হয়েছে। বিদায় হ।”

“আশ্চর্য! আমি তোদের বোন,একই মায়ের পেটের বোন। আমাকে তোরা বাড়িতে পর্যন্ত ঢুকতে দিচ্ছিস না?”

“তুই তো মায়ের পেটের বোন, তোর স্বামী যে তার আপন নানীর পেটের আপন মা’কে উপরে উঠানোর সব ব্যবস্থা করেছিল তোকে গুরু মেনে,তার কি?শোন্,এমনিতেই তোকে নিয়ে আমাদের লজ্জার শেষ নেই, নিজেদের আত্মীয়রা,শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা, পাড়া প্রতিবেশীরা এখনো তোর কেচ্ছা নিয়ে হরদম আলোচনা করে,লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়,এখন বাচ্চাগুলো বড় হয়েছে, তারা সব জানে,বুঝে,তোকে ঘেন্না করে। মাফ কর ভাই, আর যা এখান থেকে।”

“তোদের পায়ে ধরি।যাওয়ার জায়গা নেই আমার।”
“না,এখানে জায়গা হবে না। আত্মীয়-স্বজন সবাই ত্যাগ করবে,পাড়া প্রতিবেশীরা একঘরে করে দেবে।আমাদের ছেলেমেয়েদের সামনে তোর মতো একটা লোভী,নিষ্ঠুর চরিত্র ঘুরে বেড়াক,তা আমরা চাই না।”

” তাদের সামনে তো জলজ্ব্যান্ত ঠগ-জোচ্চর আর খুনিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোরা আর তোদের বৌরা মিলে আমার বাপ-মাকে খুন করেছিস।তিলে তিলে মেরেছিস তাদের। আমি কেস করবো তোদের চারটার নামে।”

এবারে বড় ভাই-এর বৌ অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। “নিজে যেমন, অন্যকেও ভাবে তেমন। যা,মামলা করলে কর্। তোর মুরোদ দেখি।”

রিয়া বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। দুই ভাই তাঁর ছোট। সুসময়ে দুই ভাই ই আপা ছাড়া কিছু বুৃঝতো না। বৌ দুটা হাত কচলাতো। এখন সেই বৌ তাঁকে তুই -তোকারি করছে,কি বিশ্রী ভাষায় ও ভঙ্গিতে কথা বলছে। পাপের প্রায়শ্চিত্ত বোধ হয় জীবন দিয়ে করতে হবে।

আটটা বাসায় ঘুরলেন রিয়া, কোথাও আশ্রয় মিললো না।

ওমর খান গেলেন তাঁর ইয়ার দোস্তদের বাসায়। আশ্রয় নেই, আশ্রয় নেই, নিজের মা’কে সম্পত্তির জন্য খুন করতে চাওয়া জেল খাটা দাগী আসামির কোথাও আশ্রয় নেই। এক রাতের জন্যও না। বন্ধুরা চাইলেও তাদের স্ত্রীরা একেবারে নারাজ। দুই তিনজন বন্ধু দয়া করে কিছু টাকা দিলেন। ওমর খান অনেক অনুনয় করলেন অনেককে, সাময়িক আশ্রয়ের জন্য আর একটা ছোট্ট ব্যবসার মূলধনের জন্য। তাঁর কাকুতি মিনতিতে কেউ সাড়া দিলেন না।

চারিদিকে অকূল পাথার। ওমর-রিয়ার পাগলের মতো অবস্থা। যার যার গ্রামের বাড়িতে যাবেন? সবাই তাদের কুকর্ম সম্পর্কে জানে। তাছাড়া গ্রামের বিষয় সম্পত্তিও তাদের নামে না। কে উঠতে দেবে নিজের বাসায়? শেষ পর্যন্ত রিয়ার মনে পড়লো দূর সম্পর্কের এক নিঃসন্তান,বিধবা ফুপুর কথা। গ্রামের বাড়িতে একাই থাকতেন। নিঃসঙ্গতা কাটাতে কারোর বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে গেলে কেউ খুশি হতো না, কেউ সুকৌশলে ঘরের কাজে লাগিয়ে দিতো। বাসায় কাজের লোক না থাকলেই রিয়ার মা তাঁর এই দূর সম্পর্কীয়া স্বচ্ছল ননদিনীকে ডেকে পাঠাতেন। তখন মোটামুটি মধুর ব্যবহার। নতুন কাজের লোক এলে আদর শেষ। “এবারে তোমার বাড়ি যাওয়া দরকার, বানু। গ্রামের মানুষ হয় হাড় শয়তান।বিধবা মানুষের বাড়ি এতো দিন ফাঁকা দেখলে দেখবে দখল নিয়ে বসে আছে। উল্টে মেরে ধরে তোমাকেই বাড়িছাড়া করবে। ” ফুপু বুঝতেন সবই কিন্তু এমন ভাব করতেন যে রিয়ার মায়ের মতো মঙ্গলকামী আর হয় না। রিয়া উনাকে গৃহকর্মী হিসাবেই ট্রিট করতেন।ওখানে যাওয়া যায়। তবে বুড়ি বেঁচে আছে কিনা, কে জানে?

বানু বেঁচে আছেন।এখনো একাই থাকেন বেশ বড়সড় বাড়িতে। জমির ধান,পান, তরিতরকারি, ডাব,নারকেল, পুকুরের মাছ ভাশুরের ছেলে তাঁর বাড়িতে সময়মতো ও প্রাপ্যমতো পৌঁছে দেয়। বাড়তি চাল,মাছ,পান,নারিকেল বিক্রি করে চাচীর হাতে নগদ টাকা তুলে দেয়। এই শরীরে ও বয়সে বানুর পক্ষে গাই পালা সম্ভব না। ভাশুরপো সিরাজ চাচীর গাই গরুকে নিজের বাড়িতে রাখে, যত্ন করে, চাচীর যতোটুকু লাগবে সেটুকু তাঁকে দিয়ে বাকিটা বিক্রি করে টাকাটা বানুর হাতে তুলে দেয়।

বানুর বাড়িতে আশ্রয় মিললো। এখানে ওমর-রিয়ার বিষয়ে কেউ কিছু জানে না। বানুর বাড়ি রিয়ার দাদার বাড়ি থেকে অনেক দূরের এক গ্রামে। তাঁর যে এতো স্বচ্ছল অবস্থা, রিয়া ভাবতেও পারেনি। আর কোনো ভাশুরপো যে চাচীর এতো খেয়াল রাখতে পারে,তা সিরাজকে না দেখলে রিয়া জানতেন না। অবশ্য চাচী যেন সব সহায় সম্পত্তি সিরাজের নামে লিখে দেয়, এই আশা ও বিশ্বাসেও সিরাজ আর তার বৌ বানুকে খাতিরদারি করতে পারে। অকারণে মানুষ মানুষের জন্য করেনা।পিছনে বিরাট স্বার্থ থাকে।
না,না,সবাই এমন নয়।রেখার চেহারা মনের পর্দায় ভেসে উঠলো রিয়ার। অত্যাচারী শাশুড়িকে কি যত্নেই না রেখেছিলেন। আর তাঁর পাঁচ সন্তানকে?পাঁচটা রত্ন তৈরি করেছেন রেখা রিয়ার সন্তানদের।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here