# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
২৫ তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
” আসসালামু আলাইকুম। মুকুলের কাছে আপনার ঠিকানা দিয়ে গেছেন।
জরুরি কারণে আপনাকে পত্র দেওয়া। আশা করি, আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত করেছেন। আপনি যদি মহান আল্লাহ পাকের হেদায়েত প্রাপ্ত হয়ে থাকেন, আপনার নিয়ত যদি খাঁটি হয়, পরিশ্রম করার ইচ্ছা যদি আপনার থাকে, আশা ও দোয়া করি, আবার আপনি স্বাবলম্বী হয়ে উঠবেন। আপনাকে আবার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে আপনার পাঁচ সন্তানের জন্য। আমি সম্ভবত বেশিদিন ওদের আগলে রাখতে পারবো না। ওদের নিরাপত্তা নিয়েও আমি খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব, আপনারা আপনাদের সন্তানদের কাছে নিয়ে যান। আদর -যত্নের সাথে তাদের প্রতিপালন করেন। ওদের পাঁচজনকে ছেড়ে আমার বেঁচে থাকা খুব কঠিন ও অর্থহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু আমি যা লিখছি,ওদের মঙ্গলের জন্য।
এই বাড়ি আমার না। আমি একসময় এই বাড়ির দাসী ও পরবর্তীতে কেয়ারটেকার ছিলাম মাত্র। এই বাড়ি যেমন আমাকে কোনোদিন আপন করেনি,আমিও বাড়িটিকে তাই আপন ভাবতে পারিনা। বাড়িটা থেকে আমি নিস্কৃতি চাই।
পলাশের কোনো একটা ব্যবস্থা করে আমি গ্রামে চলে যেতে চাই। পলাশের কোনো দায়ভার আপনি নিন,তা আমি চাইনা। পলাশের জন্ম হয়েছে দুঃখ, কষ্ট পাওয়ার জন্য। এই পৃথিবী একজন স্বাভাবিক মানুষের জন্য ই বড় কঠিন জায়গা, সেখানে আপাদমস্তক প্রতিবন্ধী এক অসহায় ছেলে কি করে টিকে থাকবে?আজ তার এই অবস্থা আপনাদের কৃপায়। তাই আমার অনুরোধ, কখনো পলাশের দায়িত্ব নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনাদের দয়া, করুণায় পলাশের বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়।
বাকি রইলো শিমুল। ওর নিজের ব্যবস্থা ও নিজেই করে নিতে পারবে। আমার হতভাগ্য শিমুল -পলাশকে জন্ম হতে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন, ওরা আমৃত্যু আপনাদের থেকে দূরেই থাকুক।
রেখা।
আদরের মৌরী মামনি,
আমার বুক ভরা ভালোবাসা, আদর,দোয়া তোমার জন্য। সবসময় আমি আল্লাহকে বলি,আল্লাহ যেন আমার মৌরীসোনাকে খুব ভালো রাখেন। তোমার মধ্যে আমি আমার আম্মার ছায়া দেখতে পাই যা আমি আশা করেছিলাম অন্য একজনের মধ্যে। মাগো,তুমি যেমন আছো তেমনই থেকো সারাজীবন। যদি ঝড় আসে জীবনে (আল্লাহ না করেন), ধৈর্য্যের সাথে তা মোকাবিলা কোরো মা। খুব ভালো করে লেখাপড়া করে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হও। নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলে সমূহ বিপদ। আমি যদি লেখাপড়া করতাম, আমার যদি নিজের উপরে ভরসা থাকতো,তাহলে আমার এবং তোমার আপা-ভাইয়ার জীবন হয়তো অন্যরকম হতো। দোয়া করি,উচ্চ শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত হও মামনি।তবে সেই লেখাপড়ার মর্যাদা রেখো, এটা তোমার কাছে এই অভাগা মায়ের দাবী। পড়াশোনা মানুষকে নিরহংকার, বিনয়ী,সৎ,সত্যবাদী, দায়িত্বশীল, আত্মপ্রত্যয়ী হিসাবে গড়ে তোলে। সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ আত্মমর্যাদার বিষয়ে যেমন সচেতন, ঠিক তেমনই সচেতন অন্যকে মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে। সব ভাই বোনকে দেখে রেখো মৌরী। পলাশের জন্য একটা হোম পেয়েছি, ওকে সামনের রবি বারে দিয়ে আসবো।ওর সমস্ত দায়িত্ব আমি তোমার উপরে ন্যস্ত করলাম। ওকে মাঝে মাঝে দেখতে যেও, টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা কোরো না, এক কালীন টাকা আমি হোমকে দিয়ে দিয়েছি বেশ কিছু গয়না আর আমার গ্রামের বাড়ির জমি-জমা বিক্রি করে। মনে হয় না পলাশ খুব বেশি দিন বাঁচবে,ডাক্তার সে রকমই বলেছেন, পলাশ যদি চলে যায়ও, তারপরেও অনেক টাকা থেকে যাবে হোমে,অন্য পলাশদের জন্য। পলাশের হোমের ঠিকানা আলাদা লিখে দিলাম।আর কেউ যেন জানতে না পারে।বিশেষ করে তোমার আপা।
মামনি, তোমার আব্বাকে তিন মাস আগে একটা চিঠি দিয়েছি।এরপরে বেশ কয়েকবার তাঁর ও তোমার মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে। তোমার বাবা ও মা শীঘ্রই তোমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। সময় ও অভিজ্ঞতার সাথে সাথে মানুষের পরিবর্তন হয়।উনারাও পরিবর্তিত হয়েছেন। তাঁদের প্রতি তোমার ক্ষোভ জমা থাকলে তা দূর করে দাও। মনের যত্ন নিতে হয় রে মা। রাগ,ক্ষোভ, ঘৃণা, বিদ্বেষ বড় খারাপ জিনিস। এমন যদি হতো এগুলো থেকে কোনো লাভ হচ্ছে, তাহলে একটা কথা ছিলো। কিন্তু তা তো নয় মা। সুতরাং মনে কখনো নেতিবাচক অনুভূতিগুলোকে ঠাঁই দিও না। এসব কথা আমি আমার সাত ছেলেমেয়েকেই ছোটবেলা থেকে বারবার বুঝিয়েছি গল্পের ছলে। সবাই শিক্ষা নিয়েছে আমি যতোটুকু বুঝি,শুধু একজন ছাড়া।
আমি চিরতরে গ্রামে চলে যাবো মা।তোমার ইন্টারমেডিয়েট ও তোমার বোনের বিসিএস পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। খুব শীঘ্রই তোমার রেজাল্ট দিবে।ইনশাআল্লাহ খুব ভালো ফল হবে।
আমি ভয়ংকর পাপ করেছি মৌরী। ভয়াবহ সত্যগুলোকে গোপন করেছি। কি তা জানতে চেও না।তুমি বুদ্ধিমতী। আস্তে আস্তে হয়তো বুঝতে পারবে। না পারলে আরও ভালো। এতো কঠিন পাপের ভার আর বহন করতে পারছি না। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও।
নিজের ও ভাইবোনগুলোর যত্ন নিও আম্মু, শারীরিক ও মানসিক। আবারও লিখছি,ঝড় আসলে ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করবে,ভেঙে পড়বে না।
তোমার আপার মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল না। তাকে মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু সফল হইনি। সে আমার সাথে প্রতিবারই ভয়ংকর রাগারাগি করেছে। গত এক বছর থেকে তাই আর চেষ্টা করিনা। তোমরা ওর থেকে দূরে থেকো মামনি, যতো দূরে সম্ভব। পলাশের ঠিকানা খবরদার ওকে দিবে না। মুকুল, মিথুন, মুমু,মিতুল, তুমি…. সবাই তোমরা তোমাদের আপার থেকে অনেক দূরে থেকো। ওকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। ও নিজেরটা গুছিয়ে নিবে।
অনেক ভালোবাসা মা গো। তোমাদের সব ভাইবোনের জীবন সুন্দর হোক।আল্লাহ ইচ্ছা করলে কি না পারেন?হয়তো পলাশকেও সুস্থ করে দিতে পারেন।
তোমার মা।
রবিবার কাক ডাকা ভোরে রেখা পলাশকে ঘুম থেকে উঠালেন। মুকুল ঘুম জড়িত গলায় জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে মা? ভাইয়াকে এতো তাড়াতাড়ি উঠাচ্ছো কেন? কাল রাতে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।আরেকটু ঘুমাবো মা।”
“তুই ঘুমা বাবা। পলাশকে একটা কাজে উঠিয়েছি। ”
রেখা মুকুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম মমতায়।
হোমে পলাশকে রেখে আসার সময় সে হতভম্ব। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। রেখা সে দৃষ্টি সহ্য করতে পারলেন না।দ্রুত বের হয়ে এলেন হোম থেকে। আর ফিরে দেখা নয়।
বাসায় এসে পাখিকে বললেন,”মেজ আপাকে ঘুম থেকে তুলে এই খামটা দাও।”
চিঠিটা পড়ে হৃদয়ঙ্গম করতে মৌরীর সময় লাগলো কিছুটা। হোমের ঠিকানা চিরদিনের জন্য মাথায় ঢুকিয়ে চিরকুটটা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেললো সে। চিঠিটা লুকিয়ে রাখলো খুব গোপন একটা জায়গায়। মা কি এতোক্ষণে গ্রামে রওনা হয়ে গেছেন?
মায়ের ঘরে ঢুকলো মৌরী।
রেখা ফ্যান থেকে ঝুলছেন।
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপরে মৌরীর বুকফাটা চিৎকারে জেগে উঠলো খান বাড়ির সবাই, ” মা…… “।
চলবে।