নানান বরণ মানুষ রে ভাই পর্ব-৩৩

0
1140

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
৩৩ তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

নাতাশাকে বাসায় পৌঁছে দিতে গেলাম আমি আর মেজ আপা। দরজা খুললো পাখি। বাবুনির জন্ম থেকে সে এই বাড়ি তে আছে।

“কেমন আছেন মেজ খালা,ছোট খালা? আসো নাতাশা মনি। ”
“ভালো আছি পাখি। তুমি কেমন আছ? সবাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে? ”
“দাদা-দাদী ঘুমিয়ে পড়েছেন। অসুস্থ তো! বাকিরা জেগে আছে।”
“তাহলে দুলাভাই -রিংকি আপাকে ডাকো। মেয়েকে তাঁদের কাছে বুঝিয়ে দিই।”

পাখি খুব নিচু গলায় বললো,” উনাদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার চাইতে আমার কাছে বুঝিয়ে দেন। নাতাশা মনি বেশি ভালো থাকবে। ”

মেজ আপা পাখির হাত জড়িয়ে ধরে বললো,”পাখি,তুমি তো বাবুনিকে জন্ম থেকেই দেখে আসছো। জানি,তুমি ওকে অনেক মায়া করো। তুমি ওকে আগলে রেখো,পাখি।”

“খালা, এখানে আমি আর কয়দিন , বলেন? বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দেয় খালি। খুব বেশি হলে হয়তো আর এক বছর।”

” ঠিক আছে পাখি,তুমি বাবুনিকে ভেতরে নিয়ে যাও। ও ঘুমে ঢুলে পড়ছে।বাসা থেকে খেয়ে এসেছে,দাঁত ব্রাশ করে হাতমুখ ধুয়ে দিয়েছি। আর দুলাভাইকে একটু ডেকে দাও।”

আমাদের বাবুনি ভালো নেই। এই বাড়িতে তার খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হয়না, বড় ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করা হয়েছে, কিন্তু আদরের অভাব। শিশুরা আদর ভালোবাসা খুব ভালো বুঝে। দুলাভাইএর বিষ্ময়কর পরিবর্তন হয়েছে। তাঁর ব্যবসার দারুণ উন্নতি হয়েছে। প্রায়ই বিদেশ যান। বৌ আর জমজ ছেলেদের নিয়ে। অবসরে দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় যান, বিভিন্ন পার্টিতে অ্যাটেন্ড করেন, বড় বড় রেস্তোরাঁয় যান, সব জায়গায় সঙ্গী রিংকি আপা, তাঁদের দুই ছেলে, প্রায় সময় রিংকি আপার পরিবারের কেউ। আমাদের বাবুনিকে কোথাও নেওয়া হয় না।

বাবুনিকে আমরা কখনো কে আদর করে, কে করেনা এসব নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করি না। আব্বুর হাজার নিষেধ সত্ত্বেও আম্মু করেন।

“বাবু সোনা,আমার জানপাখি, আব্বু কেমন আদর করে তোমাকে? অল্প না বেশি? তোমাকে বেশি আদর করে নাকি রেহান আর রাইয়ানকে? ওদের বেশি আদর করে?তোমাকে কি আব্বু মারে বা বকে? ও, মারে না,বকে না,শুধু গম্ভীর হয়ে থাকে। তুমি বলো না কেন,তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে? ভয় লাগে! কেন ভয় লাগে সোনা? ”

” বাবুনি, তোমাকে না বলেছিলাম আব্বুকে বলবে তোমার প্লেনে চড়তে ইচ্ছে করে?বলো নি? বলেছো? তাহলে আব্বু এবারে তোমাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে গেলো না কেন?”

” তুমি তো সব মাছ বাছতে পারো না। তোমার পছন্দের ইলিশ আর কই মাছ একাই বেছে খাও? বেশি কাঁটা হলে কেউ বেছে দেয় না? দাদী নইলে পাখি আপু বেছে দেয়? আহা রে আমার সোনা। তোকে যদি আমার কাছে রাখতে পারতাম! ”

আমরা বাবুনিকে আমাদের কাছে রাখতে চেয়েছি অনেকবার। বড় দুলাভাই জবাব দিয়েছেন, “তোমাদের ওখানে কে পালবে নাতাশাকে?তোমাদের আব্বা-আম্মা? উনারা বাচ্চা পালতে জানেন? নিজেদের মতোই আরেকটা অমানুষ তৈরি করবেন। আর ছোট বেলায় দেখাশোনা করলেন না,এখন এতো দরদ?”

মেজো আপা বলেছিলো,”আমি নাতাশাকে আমার কাছে রাখবো। ”

“আমি বেঁচে থাকতে তোমার কাছে কেন?আর এখানে কি তোমার বোনঝির অসুবিধা হচ্ছে কোনো? কেউ মারে-ধরে? তোমাদের কাছে নালিশ করে নাকি? ”

কেন দুলাভাইএর এমন আচরণ? বড় আপার কাছ থেকে অনেক বড় আঘাত পেয়েছেন বলে, বাবুনির চেহারায় বড় আপার ছাপ খুব প্রকট বলে, নাকি রিংকি আপার হাত আছে এতে?

আগে এই বাড়িতে আমাদের অবারিত দ্বার ছিল। যখন তখন এসে পুরো বাড়ির যেখানে সেখানে যাওয়ার অধিকার ছিল আমাদের দুই বোনের। এমনকি তাঁর দ্বিতীয় বিয়ের পরও কিছুদিন পর্যন্ত। আর এখন? বাইরের ঘরে আমরা দুই বোন আড়স্ট হয়ে বসে আছি।

বড় দুলাভাই আসলেন। কোলে জমজদের একজন,রেহান। আমরা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। আমি হাত বাড়িয়ে রেহানকে কোলে নিতে গেলাম।সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বাপের গলা জড়িয়ে ধরলো।

দুলাভাই নিরুত্তাপ গলায় বললেন,”কেমন আছো তোমরা?”

“ভালো। দুলাভাই , আমি হোষ্টেল থেকে চলে এসেছি। বাসাতেই থাকবো।”
“ভালো কথা।”
” আপনারা ভালো আছেন?রিংকি আপা কোথায়?”
“রাইয়ানকে ঘুম পাড়াচ্ছে।”
মেজ আপা ইতস্তত করে বললো,”দুলাভাই, বাবুনি একা স্কুলে যায়,এটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না।”

“একা যায় মানে? ও গাড়িতে স্কুলে যায়। ”
“সেটা তো জানি। ড্রাইভার সাহেবের সাথে একা ছাড়া ঠিক না,দুলাভাই। ইদানিং যা সব হচ্ছে। ”

” কে যাবে ওর সাথে? আমি বিজি,আব্বা- মা অসুস্থ। ”

“রিংকি আপা?”

“রিংকি কেন যাবে?তার নিজের দুই ছেলে আছে। তাদের দেখভাল করতে হয়। নিজের মা বাচ্চা ফেলে চলে যায়, আর সৎ মায়ের দায় পড়েছে পরের বাচ্চাকে পালতে।”

“বাবুনিকে আমাদের কাছে দিয়ে দেন দুলাভাই। ”

” ও যেখানে আছে,সেখানেই থাকবে। মন্দ নেই এখানে।”

“আপনি নিজেও দেখবেন না, আমাদের কাছেও দিবেন না,এটা কেমন কথা?”

দুলাভাই ঠান্ডা গলায় বললেন,”মাইন্ড ইয়োর ল্যাংগুয়েজ। খাওয়াচ্ছি, পরাচ্ছি, ভালো স্কুলে ভর্তি করেছি, মান্থলি পঁচিশ হাজার বেতন, টিউটর দিয়েছি, তারপরও বলছো দেখছি না?”

“দুলাভাই, আপনি ভালোই জানেন,এটুকুই একটা বাচ্চার জন্য সাফিসিয়েন্ট না। তার প্রচুর আদর ভালোবাসা দরকার। খালাম্মা-খালু অসুস্থ। তাঁরা ইচ্ছে করলেও আগের মতো বাবুনিকে দেখাশোনা করতে পারবেন না। পাখি ব্যস্ত থাকে বিভিন্ন কাজে। সেও বাবুনিকে সময় দিতে পারেনা।সাড়ে পাঁচ বছরের বাচ্চা সারাদিন থাকে একা। রাতে ঘুমায়ও একা।ফ্লোরে আগে পাখি থাকতো,এখন তাও থাকে না। খালাম্মার কাছে রাতে থাকতে হয়। আপনাদের অন্য কোনো মেইডকে বাবুনির ঘরে দিলেই পারেন। কিন্তু দিচ্ছেন না। আপনার হাতে সময় নেই, ব্যস্ত মানুষ, মানি। কিন্তু রিংকি আপা আর ছেলেদের জন্য তো আপনার হাতে মেলা সময়। এই যে,একজনকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন। প্রায়ই স্ত্রী -পুত্র নিয়ে বেড়াতে যান।শুধু বাবুনির জন্য আপনার সময় নেই। ”

“প্রস্টিটিউটের বাচ্চার জন্য এর বেশি আমার করার কিছু নেই। ”

“তাহলে প্রস্টিটিউটের বাচ্চাটাকে আমাদের কাছে দিয়ে দিচ্ছেন না কেন?কেন একটা পতিতার বাচ্চাকে রেখে নিজের ঘর দুয়ার অপবিত্র করছেন?মেয়েকে দিয়ে দেন আমাদের কাছে। ” মেজ আপা ভীষণ রেগে গেছে। আমার ভয় হচ্ছে, দুলাভাই আমাদের বাসায় বাবুনির আসা চিরতরে বন্ধ করে দেন কিনা।

দুলাভাই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,”রাত পৌণে বারোটা বাজে। উঠি?”

আমাদের চলে যাওয়ার জন্য স্পষ্ট ইঙ্গিত। এক গ্লাস পানি খাওয়ার অফারও কেউ দেয় নি আমাদের।

আমি মিনতি করে বললাম,” দুলাভাই, কয়েকটা দিন বাবুনিকে আমার কাছে রাখি? ”

“তোমার কাছে রাখা মানে তোমার মায়ের কাছে রাখা। মেয়েকে নষ্ট করে কি এখন মেয়ের মেয়েকে নষ্ট করার ইচ্ছা? নষ্ট তিন প্রজন্ম, মা,তার মেয়ে,তার মেয়ে।”

আমি স্থির গলায় বললাম, ” আমাদের মা যেমনই হোক, অন্যের মুখ থেকে আমরা তাঁর নামে কোন খারাপ কথা শুনতে চাই না।”

দুলাভাই বললেন,”অফকোর্স আমি বলতে পারি। আমার লাইফ হেল করে ছেড়েছে তোমার মা। আমাদের পুরো পরিবারকে বারবার অপমান আর লজ্জার মধ্যে ফেলেছে তোমার মা। দ্য বিচ।”

আমরা দুই বোন স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

মেজ আপা বললো,” বিরাট পরিবর্তন হয়েছে আপনার। চলি। আপনার মুখ দেখার এতোটুকু ইচ্ছে আর অবশিষ্ট নেই। বাবুনির জন্য বাধ্য হয়ে আসতে হয়,আসতে হবে। তবে চেষ্টা করবো, আপনার চেহারা যেন এ জীবনে আমাকে দেখতে না হয়। চল্ বুবলি।”

ফেরার সময় দুই বোন নীরবে চোখের পানিতে বুক ভাসাতে ভাসাতে আসলাম। বাবুনির জন্য কলিজা ফেটে যাচ্ছিলো। নিষ্পাপ বাচ্চাটা কাউকে কোনো নালিশ করে না। কিন্তু তার প্রতি নিত্যদিনের অনাদর, বৈষম্য সবই বুঝে সে। দিনের পর দিন কি কষ্ট,অবহেলা আর একাকীত্বের মধ্যে দিন কাটে আমাদের ছোট্ট পাখিটার!

হঠাৎ ধ্বক করে উঠলো বুকের ভেতর। বাবুনির কেমন লাগে অনুভব করে আমার এতো কষ্ট হচ্ছে, আর শিমুল? সে বাবুনির থেকেও ছোট ছিল,তার দিনগুলো কাটতো দফায় দফায় মার খেয়ে, অশ্রাব্য গালিগালাজ, বকাঝকা হজম করে, মায়ের আর ভাইয়ের অসহনীয় যন্ত্রণা দেখে, বলতে গেলে অনাহারে-অর্ধাহারে। তীব্র ভয়,লজ্জা,অপমান, কষ্ট নিত্যসঙ্গী ছিল তার।
আহা রে! কেমন লাগতো শিমুলের, কেমন লাগতো রেখার?

আমাকে নামিয়ে দিয়ে মেজ আপা তার বাসায় চলে গেলো। আম্মু দরজা খুললেন। বললেন,”কি রে, তোকে দেখতে এমন লাগছে কেন?কি হয়েছে? ফিরে আসতে এতো দেরি করলি কেন? নীতু বাসায় চলে গেছে? বাবুসোনা ঠিকঠাক আছে তো?ওর বাপ জেগেছিল? ”

আম্মুকে সত্যটা বলা যাবে না।আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। কিন্তু কান্নাটাও চেপে রাখতে পারছি না। না দেখা রেখার কষ্ট, শিশু শিমুলের কষ্ট, বাবুনির কষ্ট সব কষ্ট এক হয়ে আমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। আম্মু স্হির দাঁড়িয়ে রইলেন। আব্বু উৎকন্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে মা?কি সমস্যা? ”
আম্মু ঠান্ডা গলায় বললেন,”পৃথিবী খুব কঠিন জায়গা। এখানে নরমদের কোনো জায়গা নেই। অল্পে ভেঙে পড়ো না। কঠিন হতে শেখো। বাবুর বাবা কি তোমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে? ”

আমি সবেগে মাথা নাড়ালাম, “না,না, উনারা কেউ কিছু বলেন নি। আমার কেমন যেন লাগছে। খুব মন খারাপ লাগছে আম্মু।”

আম্মু তাঁর বিখ্যাত ঠান্ডা গলাতে বললেন, ” আমাকে বোকা ভেবো না বুবলি। কান্নাকাটি করে নিজেকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলা কাজের কথা নয়। এখন হাতমুখ ধুয়ে এক গ্লাস দুধ খাও,মা। তারপর ঘুমাও। আরেকজনও নিশ্চয় কাঁদতে কাঁদতে গেছে? চোখের পানি কোনো সমস্যার সমাধান করে না। সমাধানের অনেক রাস্তা আছে।”

শেষ কথাটা আম্মু এমন হিমশীতল গলায় বললেন যে আমি আপাদমস্তক কেঁপে উঠলাম। আম্মু আবারও মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে খুনের পথে পা বাড়াচ্ছেন না তো? আব্বুরও চোখে মুখে গভীর দুশ্চিন্তা।

আমাকে শক্ত হতে হবে। কান্নাকাটি করে বা সমস্যার কথা তুলে আম্মুকে আরও অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে না।

রাতে ঘুম আসছিলো না। বাবুনি কি নিশ্চিন্তে আরাম করে ঘুমাতে পারছে?ঠান্ডা বা গরম লাগছে না তো? ভয়ের কোন স্বপ্ন যেন না দেখে,আল্লাহ।আমরা চলে আসার পরে কি দুলাভাই বা তার বৌ বাবুনিকে বকাঝকা করেছে?
আমি খালা হয়ে এতো দুশ্চিন্তা করছি,কষ্ট পাচ্ছি, ওদিকে বাবুনির মা কেমন নিশ্চিন্তে সুখে শান্তিতে দিন গুজরান করছে। পৃথিবীর জঘন্যতম মহিলা। সামনে থাকলে মুখে থুথু দিতাম। তোর রক্তে ফূর্তির নেশা,তুই সারাজীবন ফূর্তি করে বেড়াতি, একটা নিষ্পাপ প্রাণকে পৃথিবীতে এনে এমন কঠিন অবস্থায় ফেললি কেন?

মতুন একটা সকাল শুরু হলো। আব্বু-আম্মু দুজনেই অফিসের জন্য প্রস্তুত। আম্মুর মধ্যে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। বাসায় কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের সাথে আম্মু তেমন একটা রাগারাগি বর্তমানে করেন না। আগে তো একেকজন মার খেতে খেতে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়তো।আম্মুকে তখন কি যে ভয়ংকর লাগতো! চেহারা বিকৃত হয়ে যেত, ঠোঁটের কোণে কষ জমতো, সারা শরীর রাগে থরথর করে কাঁপতো । আব্বু বাসায় থাকলে আম্মুকে ছাড়ানোর প্রবল চেষ্টা করতেন। আম্মুর শরীরে যেন অসুর ভর করতো। আমরা তখন ভয়ে আর এই মায়ের মেয়ে হওয়ার লজ্জায় ঘরের এক কোণে বসে কাঁপতাম। দাদী বিড়বিড় করে বলতেন,”ডাইনি! রাক্ষসী! অসভ্য মেয়ে মানুষ। ”

মেজো আপা একদিন এমন এক ঝড়ের পরে সোজা মেয়েটার কাছে যেয়ে বলেছিল, “এই মেয়ে! দিনের পর দিন মার খেয়েও এখানে পড়ে থাকো কেন?অন্য কোনো বাড়িতে কাজ নিতে পারো না? আমি তোমাকে দুই মাসের বেতন দিচ্ছি, তুমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। তোমার বাড়ির ঠিকানা বলো।আমি তোমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো। বাড়ি যেয়ে তোমার আব্বা-আম্মাকে এই মারের দাগ দেখাবে। বলবে,থানায় যেয়ে ইনার বিরুদ্ধে মামলা করতে। গ্যাঁট মেরে বসে আছ কেন? উঠো।”

মেজ আপার কি অবস্থা হবে ভেবে আমি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিলাম। আব্বু এসে তাড়াতাড়ি মেজ আপাকে আম্মুর থেকে দূরে সরিয়ে নিতে গেলেন। তখন স্কুল পড়ুয়া মেজো আপা ঝটকা মেরে আব্বুর হাত ছাড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিলো,”লজ্জা হয় না আব্বু তোমার? প্রতিদিন ঘরের মধ্যে এতো অশান্তি, চিৎকার, গন্ডোগোল। কাজ করতে আসা মেয়েগুলো জন্তুর মতো মার খায়, আর তুমি কিছুই করতে পারো না? এই বাসায় এখন থেকে কাজের জন্য কোনো মানুষ আনা হবে না। আমি যা পারবো,করবো, বাকী কাজ পড়ে থাকবে। কি জঘন্য মানুষ আমরা,ছি! ”

আসলেও আমাদের জীবনটা কষ্টে এবং অস্বাভাবিক ভাবে কেটেছে। ঐদিন মেজ আপাকে এমন মেরেছিলেন আম্মু,আমার মনে হচ্ছিল আম্মু মরে যাক। আমি আর বড় আপা হাউমাউ করে কাঁদছিলাম, আব্বু মেজ আপাকে রক্ষা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন, দাদী চিৎকার করে আম্মুকে শাপশাপান্ত করছিলেন। ভাগ্য, ঐ সময়ে বড় মামা এসেছিলেন। তিনি সজোরে ধাক্কা ও হ্যাঁচকা টান দিয়ে আপাকে উদ্ধার করেন। ঐদিন মা আর মামার মধ্যে প্রচন্ড ঝগড়া হয়েছিল। মেজো আপা এর মধ্যেও ঠোঁটের রক্ত মুছে বলেছিল, “দেখো মামা, তুমি ইনাকে ছাড়াতে পারলে, কিন্তু ওই যে উনি, যাকে আমরা আব্বু বলে ডাকি, তিনি কখনো তাঁর বৌ কে ধাক্কা দিতে পারেন না, জোরে টান মেরে সরাতে পারেন না, বৌএর যদি ব্যথা লাগে! কাজের মেয়েরা বা নিজের মেয়েরা মার খেতে খেতে মরুক,তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না, বৌয়ের গায়ে আঁচ না লাগলেই উনি খুশি।”
সেদিন আমি অসংখ্যবার আম্মুর মৃত্যু কামনা করেছিলাম। সত্যি, ভীষণ অস্বাভাবিক আর অগোছালো জীবন ছিল আমাদের।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here