নানান বরণ মানুষ রে ভাই পর্ব-৩৬ শেষ পর্ব

0
2244

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
৩৬ তম পর্ব (শেষ পর্ব)
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

আমি আবার খালা হতে যাচ্ছি। মিষ্টি নিয়ে মেজ আপার শ্বশুর-শাশুড়ি, মেজ দুলাভাই আর আপা এসেছেন। খালাম্মা, খালু মহা উচ্ছ্বসিত। আপা লজ্জায় লাল। ময়না খালা আম্মুর নির্দেশ মতো নানারকম রান্নাবান্না করছেন।

ঘরে এতো ভালো ভালো রান্না হচ্ছে। আমার মনটা পড়ে আছে বাবুনির কাছে। আজ ছুটির দিন। আজকে বাবুনির আসার কথা আমাদের বাসায়। কিন্তু সকালে ওর বাবা ফোন করে বললেন,আমরা যেন আজ বাবুনিকে আনতে না যাই, আজ তিনি মেয়েকে পাঠাবেন না। কেন পাঠাবেন না,তার উত্তর দিতে তিনি অনিচ্ছুক। আমাদের ব্যাখা দিতে তিনি রাজি না। কোর্ট তো আর এমন অর্ডার দেয়নি যে সপ্তাহে একদিন নানার বাড়িতে বাবুনিকে পাঠাতেই হবে।

আম্মু বিস্তর চেঁচামেচি, হৈ চৈ করেছিলেন। সেই সাথে দুলাভাই এর উদ্দেশ্যে বিস্তর গালাগালি। আমার নিজেরও খুব খারাপ লাগছিল বাবুনির জন্য। দুলাভাই আমাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য ইচ্ছা করে এমন করছেন। খুব খারাপ করছেন। বড়দের কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি খেলার ফল ভোগ করছে অসহায় বাবুনি। দুনিয়ার উপরে রাগটা আম্মুর উপরে ঝেড়েছিলাম, “আম্মু,পরের ছেলেকে গালাগালি কেন করছো? নিজের মেয়েকে গালাগালি করো। আজকের এই অবস্থার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী তোমার মেয়ে। ওকে আপা বলতেও ঘেন্না লাগে আমার। কেন তুই বাচ্চা নিলি, কেন তুই বাচ্চাটা ফেলে চলে গেলি?”

আম্মু সপাটে জবাব দিলেন, ” ও কখোনোই বাচ্চা চায়নি। প্রথম বার আমি ওর অ্যাবরশন করালাম।দ্বিতীয় বার কনসিভ করার পরও ও অ্যাবরশন করাতে চেয়েছিল। শয়তানগুলোর বাধায় ও পারে নি।”

“ও বিয়ে করলো কেন? ওর মতো মেয়ের তো বিয়েই করা উচিত না। এখন যেমন আজ এর সাথে, কাল ওর সাথে লিভ টুগেদার করে বেড়াচ্ছে, তাই-ই করতো নিজের ফিজিকাল আর্জ পূরণের জন্য। ওদের চাপে ও বাবুনিকে অ্যাবর্ট করতে পারে নি এটা হাস্যকর কথা। ওর মতো মেয়ে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। নিজের স্বার্থের জন্য ও আমাদের হাসতে হাসতে খুন করতে পারে। ও বাবুনিকে শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলে নি কারণ ওর মনে হয়েছিল হোক একটা বাচ্চা। ওই হোক পর্যন্ত ই, ডিম পেড়ে সে কোকিল মায়ের মতো উড়ে গেছে। বাবুনি মরলেও ওর কিচ্ছু এসে যাবে না।”

এই পর্যায়ে আম্মু কষে আমাকে চড় মারলেন।

“মেরে আমাকে চুপ করাতে পারবে না আম্মু। তোমার হাতে মার খেতে খেতে আমি অভ্যস্ত। মেরে তো হাসপাতালেও পাঠিয়ে দিয়েছিলে। কাজেই তোমার মার আমার ভয় লাগে না। তাছাড়া জীবনের প্রতি কোনো মায়াও আমার নেই । অতএব, মেরে আমাকে তুমি লাশও বানিয়ে দিতে পারো,যেটা গতবারে চেয়েছিলে কিন্তু পারো নি। বাবুনির এই দুর্গতির জন্য দায়ী আমরা। অন্যকে গালি না দিয়ে আমাদের দাও।”

পরিস্থিতি ভীষণ থমথমে ছিলো। মেজ আপারা সদলবলে এসে এই মহা সুখবর দেওয়ার পরে সব স্বাভাবিক হয়ে আসলো।

“বাবুনিকে এখনো আনোনি আব্বু? ”

“আদিব বাবুনিকে আজ পাঠাবে না, সকালে ফোন করে বলে দিয়েছে। ”

“কেন?কোনো প্রোগ্রাম উনাদের বাড়িতে?”

অবশেষে ভয়ংকর সত্যটা চলে আসলো আমাদের সামনে। বাবুনি গতকাল স্কুল হতে আর ফিরে আসে নি। ড্রাইভারও না। গাড়িটাও পাওয়া যায়নি। পুলিশ তোলপাড় চালিয়ে খুঁজছে। স্কুলের সিসি ক্যামেরায় দেখা গেছে, ড্রাইভার আলম বাবুনিকে স্কুলের গেট থেকে তুলে নিয়েছে,রোজ যেমন নেয়। বাবুনি গাড়িতেও উঠেছে, সিসি ক্যামেরা আর প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে। তারপরে আর বাবুনি, ড্রাইভার, গাড়ির কোনো খোঁজ নেই। আর আমরা, তার নানার বাড়ির সদস্যরা জানলাম চব্বিশ ঘন্টা পর।

মেজ আপা ঝাঁপিয়ে পড়লো বড় দুলাভাই এর উপরে। ” বলেন, কি করেছেন আমাদের বাবুকে?কেন ঘটনা এখন জানলাম আমরা? মেরে ফেলেছেন?গুম করে ফেলেছেন আমার বাবুকে? আপনি মানুষ না, পিশাচ,পিশাচ। আপনাকে আমি ছাড়বো না। ”

মেজ দুলাভাই আর তাঁর বাবা-মা আপাকে সামলানোর চেষ্টা করছেন। আব্বু বসে আছেন মাথায় হাত দিয়ে। ড্রইং রুমের সোফায়। আম্মু আব্বুকে বললেন,”উঠো।থানায় যাবো। সব কটার নামে মামলা করবো। বাপ বাপ করে আমার নাতনিকে বের করে দিবে। এটা এদেরই কাজ। লুকিয়ে রেখেছে কোথাও আমার সোনামনিটাকে।”

রিংকি আপা ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন,”যান,যান,মামলা করে আসেন। কতো অভদ্র! আমরাওতো মামলা করেছি,কিন্তু এদের নাম তো দিইনি। মাথাতেও আসেনি। উন্মাদ মহিলা একটা।”

আর সহ্য হলোনা। দুলাভাই এর দ্বিতীয় স্ত্রীকে ধরলাম এবার,” মুখ সামলে কথা বলেন। আপনার অনেক অন্যায় সহ্য করেছি বহুদিন। বলেন, বাবুনির সাথে কি করেছেন আপনারা? ”

“পাগল হয়েছো নাকি? আমরা ওর সাথে কি করবো?তোমাদেরও তো সন্দেহ করা যায়। ওকে চুরি করে লুকিয়ে রেখেছো কোথাও। ”

গত রাতেই থানায় ড্রাইভারকে আসামী করে বাবুনির মিসিং রিপোর্ট করা হয়েছে।

বাবুনির দাদা-দাদি দুজনেই বিছানায় পড়া। টেনশনে আর কান্নাকাটি করে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিথি ভাবী, তার স্বামী রাজন ভাই, দুই বাচ্চা পরশু দিনের আগের দিন মালয়েশিয়া বেড়াতে গেছেন। কয়েকদিন ঘুরে বেড়ানোর কথা ছিলো, বাবুনির কথা শুনে তাঁরা আজকেই রওনা হতে চেয়েছিলেন। প্লেনের টিকেট পাওয়া যায় নি। কাল ভোরে রওনা হবেন। বাবুনির ফুপা-ফুপুরা চলে এসেছেন। বাড়ি গমগম করছে মানুষে।

বড় দুলাভাই স্পষ্ট ভাবে আব্বু-আম্মু-মেজ আপাকে বলেছেন, “খবরদার সিন ক্রিয়েট করবেন না। আপনাদের খবর দিতে হবে কেন? আপনারা কি ওর গার্জিয়ান? ”

“তুই সকালে ফোন করে বললি,বাবুনি আসতে পারবে না।কেন আসতে পারবে না জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তোকে। তখন সত্যিটা বললি না কেন শয়তান?”

“চুপ! মুখ সামলে কথা বলবেন। নস্টা মহিলার নষ্টা মা। আমার মেয়ের উপরে কি অধিকার আছে তোমাদের? গলা ফুলিয়ে কথা বলো,লজ্জা করে না তোমাদের? ”

এতো সব হইচইএর মধ্যে আমরা আমাদের বাবুনিকে পেয়ে গেলাম। এ দেশের পুলিশ খুবই করিৎকর্মা। তারা বাবুনিকে খুঁজে বের করলো। গাড়িটাও পেলো। তবে ড্রাইভারকে পাওয়া গেলো না।

আমাদের বাবুনি শুয়ে আছে। ছোট্ট শরীরটার গলা পর্যন্ত চাদর দিয়ে ঢাকা। মাথায় থোকা থোকা চুল। গালে, চিবুকে কালশিটে। ঠোঁট নীল। ঠোঁটের কোণে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। ভীষণ ধকল গেছে ওর উপর দিয়ে, ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা।

আম্মুকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। খিঁচুনি উঠে গিয়েছিল আম্মুর।নাক মুখ দিয়ে ফেনা। দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে আম্মুকে। মেজ খালা,সেজ খালা, বড় মামা, বড় মামী হাসপাতালে আছেন। এই প্রথম হাসপাতালে আম্মুর সাথে আব্বু নেই। আব্বু বাবুনির কাছে।

সব ফর্মালিটিজ শেষ করে অবশেষে সন্ধ্যায় বাবুসোনা নিজেদের বাসায় ফিরে এলো। কে যেন কাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল, “নাতাশা মনির মাকে খবর দেওয়া হয়েছে? আরে, সৎ মা না, ওর নিজের মায়ের কথা বলছি।”

বড় দুলাভাইকে চেনা যাচ্ছে না। মেয়েকে বুকে আঁকড়ে বসে আছেন। কেউ বাবুনিকে সরাতে গেলে আরও বেশি করে ওকে জাপটে ধরছেন। বারবার চুমা খাচ্ছেন মেয়ের মাথায়,কপালে, চোখে,নাকে,গালে। আমার শুধু বাবুনির জন্মের দিন আর তারপরের কয়েকটা মাসের স্মৃতি মনে পড়ছিল। ছোট্ট টুকটুকে বাবুনি, এভাবেই প্যাঁচানো থাকতো তোয়ালে দিয়ে। দুলাভাই এভাবেই মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখতেন, একটু পরপর এমন করেই চুমু খেতেন। মেয়েটা তিন, সাড়ে তিন বছর বছর পরে আবার বাবার এমন আদর পেলো।

মেজো আপা আর আমিও বাবুনিকে জাপটে ধরে রাখলাম বুকে। অনেক ক্ষণ। অনেক আদর করলাম আমাদের ছোট্ট পরীকে। তবু মন এতোটুকু ভরলো না।

রাত নয়টায় আমাদের জানপাখিটাকে নিয়ে বিরাট এক গাড়ি বহর চললো বনানীর দিকে। আল্লাহ হাফেজ লক্ষী মামনিটা, বাবুই পাখিটা, আর কখনো তোর সাথে আমাদের দেখা হবে না। আমাদের ক্ষমা করে দিস রে মা।

আগেই বলেছিলাম, ড্রাইভারটাকে আমার একদমই ভালো লাগতো না।আমি ভয় পেতাম, ভয়ের কথা জানিয়েছিলাম দুলাভাই, খালাম্মাকে।আমার আশংকাই সত্যি হলো শেষ পর্যন্ত।

বাবুনির ছোট্ট শরীরটা ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিল অমানুষটা। রক্তক্ষরণ হয়েছিল প্রচুর। সিগারেটের ছ্যাঁকা সারা শরীর জুড়ে।

পৃথিবীতে অনেক বিচিত্র, রহস্যময় ঘটনা ঘটে। যখন বাবুনি শেষ বারের মতো পৃথিবীটা দেখছিল ঘোলা চোখে, তখন তার থেকে অনেক অনেক দূরে ইংল্যান্ডের একটা শহরে রীতু নামের এক বাংলাদেশী ডাক্তারকে তার প্রেমিক গলায় স্কার্ফ পেঁচিয়ে মেরে লাশ গুম করার চেষ্টা করছিল। আমাদের বাসার ল্যান্ড ফোনে দুইদিন পরে ফোনটা এসেছিল। আম্মু হাসপাতালে, আব্বু আর আমি বাসায় এসেছিলাম আম্মুর দরকারী কিছু রিপোর্ট নিতে। ঐ সময়ে ফোন করেছিল বাবুনির মায়ের এক বন্ধু, রীতু খুন হয়েছে, খুনীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, রীতুর লাশ তারা কি দেশে পাঠাবে বা আমরা কি কেউ যাবো? আব্বু স্থির গলায় বললেন, ভিকটিমের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা লাশ নিয়ে যা খুশি করুক। খুন হয়েছে বাঙালি, খুন করেছেও বাঙালি। স্হানীয় বাঙালি আর ভারতীয় কয়েকজনের উদ্যোগে রীতু ইংল্যান্ডের মাটিতে সমাহিত হলো।

আমি শুধু ছোট মামাকে ব্যাপারটা জানিয়েছিলাম যেন মামা আর সবাইকে জানানোর উদ্যোগ নেন। সবাই জানলো, মেজ আপা-দুলাভাই -খালাম্মা-খালু, বড় দুলাভাই, বাবুনির দাদার বাড়ির সব সদস্য, আমার মামারা-খালারা-চাচারা-ফুপুরা,সবাই।

আমাদের আম্মু জানলেন কিনা বুঝতে পারলাম না। তিনি আবারও মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন। হাসপাতালে আব্বু আম্মুর দুই কাঁধে হাত রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললেন,”শিমুল, আমাদের রীতু আর নেই। ”
আম্মু বললেন,”আচ্ছা। ”

“শিমুল, আমাদের রীতু নেই। আমাদের রীতু। আমাদের প্রথম সন্তান। আমাদের রীতু মরে গেছে। ওকে একজন মেরে ফেলেছে। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো? ”

আম্মু উত্তর দিলেন না। একটু হাসলেন।
বাবুনি মারা যাওয়ার পরে আব্বু এই প্রথম হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন। বুক ভাঙা কান্না। আম্মু ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আব্বুর গায়ে হাত বুলাতে লাগলেন।

আমার বুকের মধ্যে তুষের আগুন। কষ্টের অবর্ণনীয় ভার। আল্লাহ, আপনি আমাকে কেন এমন নিয়তি দিয়ে পাঠালেন? মাঝেমধ্যে ভয় হয়, আমিও কি আম্মুর মতো পাগল হয়ে যাবো? আমারও খুন করতে প্রবল ইচ্ছা হচ্ছে। ড্রাইভারটার হদিস পাওয়া গেলে যে ভাবে হোক,আমি নিজের হাতে তাকে খুন করবো।

ড্রাইভারের হদিস পাওয়া গেলো। মৃত, অর্ধগলিত অবস্থায়। মামলার মোড় ঘুরে গেলো। আমাদের বাবুনি এখন সারা দেশের অতি পরিচিত প্রিয় মুখ। পুলিশ প্রশাসন প্রচন্ড চাপের মধ্যে। এর মধ্যে ড্রাইভারের লাশ পাওয়া গেলে আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে গেলাম। জানা গেলো, ড্রাইভার সাহেবের মৃত্যু বাবুনির অনেক আগেই হয়েছে।

কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে যখন সাপ বের হয়ে গেলো, তখন সারা পৃথিবী আমাদের কাছে ওলট পালট হয়ে গেলো। প্রথমে সন্দেহ করেছিলাম ড্রাইভার সাহেবকে, রিংকি ভাবীর হাত থাকার খুব সম্ভাবনা, বড় দুলাভাইকেও সন্দেহ করেছি মাঝে মধ্যে, কিন্তু তার কথা কখনো ভাবিনি।
বাবুনির চাচা, তিথি ভাবীর স্বামী। দুলাভাই বড়লোক হওয়ার নেশায় বড় ভাইকে ব্যবসায় ডুবিয়েছিলেন, যৌথ ব্যবসার অনেক কিছু নিজের করে নিয়ে ভাইকে আলাদা করে দিয়েছিলেন, দুলাভাই এর ব্যবসা যতো ফুলে ফেঁপে উঠছিল, ভাইয়ের ব্যবসা ততো লস খাচ্ছিলো, তার উপরে বাবুনির প্রতি সবার অনাদর দেখে খালু তাঁর সম্পত্তির একটা বড় অংশ বাবুনির নামে করে দিবেন ঘোষণা দিয়েছিলেন, এগুলো হলো খুনের মোটিভ। ভাড়াটে খুনী তাঁর ইন্সট্রাকশন মতো কাজ করেনি। বাবুনিকে গাড়ি থেকে বের করে নেওয়ার সময় ড্রাইভার সাহেব প্রাণপণ বাধা দিয়েছিলেন। খুনি ড্রাইভারকে মেরে ফেলে। এটা খুনির প্রথম ভুল। কথা ছিল, বাবুনিকে কিডন্যাপ করে মোটা অংকের মুক্তিপণ চাওয়া হবে। শর্ত পূরণ হলে বাবুনিকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু বিকৃতমস্তিষ্ক খুনি সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী পুতুলের মতো শিশুকে দেখে লোভ সামলাতে পারলো না। অসহায় বাচ্চাটার তীব্র যন্ত্রণা আর কান্না তাকে আরও উৎসাহিত , আনন্দিত করেছিলো। উপর্যুপরি ধর্ষণের জন্য শরীরের ভিতরে ও বাইরে অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে বাবুনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

দুলাভাইএর ভাই তাঁর স্টেটমেন্টে এও জানালেন, কিডন্যাপ করার জন্য নাতাশাকে বেছে নেওয়ার কারণ, তিনি জানতেন, আচরণে দুলাভাই মেয়ের প্রতি যতো কঠোরই ছিলেন না কেন, আসলে এই মেয়েকেই তিনি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। কাজেই যতো মুক্তিপণই চাওয়া হোক না, দুলাভাই চোখ বন্ধ করে তা দিয়ে দিতেন।

আমি যে মনে মনে কতোবার শয়তানটাকে কেটে টুকরো টুকরো করি! আর চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে ড্রাইভার সাহেবের আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি যাঁকে আমি প্রথম থেকেই ভীষণ অপছন্দ করতাম, যিনি আমার বাবুনিকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণে লড়াই করেছিলেন, পেটে ছুরি ঢুকে যাওয়ার পরেও যিনি বাবুনিকে রক্ষা করার চেষ্টা করে গেছেন।

বাবুনির মায়ের জন্য কোনো প্রার্থনা মনে আসে না। তবে ওর কিশোরী মুখটা ভারী মনে পড়ে, ফ্রক পরা, দুই দিকে বেণি করা, বারান্দায় চক দিয়ে দাগ কেটে কিৎকিৎ খেলা নিষ্পাপ এক কিশোরী।

নাতনির ভয়ংকর মৃত্যু, তাও নিজেদের বড় ছেলের কারণে, বড় দুলাভাইএর বাবা-মা শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। অসুস্থ শরীর এতো বড় ধাক্কা সইতে পারে নি। বাবুনির মৃত্যুর দুইমাস পরে খালাম্মা আর সাড়ে চার মাসের মাথায় খালু মৃত্যুবরণ করেন।

রিংকি ভাবী মাঝেমধ্যে দেখা করেন আমার আর মেজ আপার সাথে। বিয়ের পরে প্রথম দিকে তেমন বুঝতে পারেন নি, যতো দিন গেছে,উপলব্ধি করেছেন দুলাভাই আদৌ তাঁকে ভালোবাসেন না। তিনি দুলাভাই এর একটা অভ্যাস মাত্র। কেন তাহলে দুলাভাই বিয়ে করেছিলেন তাঁকে? শুধুই নিজের দরকার মেটানোর জন্য? নাতাশার মা হিসাবেও আনেন নি, নাতাশাকে আদর করা,ওর দিকে রিংকি আপার খেয়াল করা দুলাভাই পছন্দ করতেন না। বলতেন,মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি হলে সেই মাসীকে ডাইনি বলে। জমজদের প্রতিও দুলাভাইএর তেমন টান ছিল না, তিনি রিংকি ভাবী আর জমজ ছেলেদের ব্যবহার করে দুনিয়াকে বুঝাতে চাইতেন, স্ত্রী -পুত্র নিয়ে তিনি ভালো আছেন, খুব ভালো আছেন,রীতুর প্রতারণা,বেহায়াপনা তাঁর জীবনে কোনো ছন্দ পতন আনে নি। নাতাশা ঘুমিয়ে পড়লে দুলাভাই ওর ঘরে যেয়ে ওর বিছানায় চুপ করে বসে থাকতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, কপালে আলতো চুমু খেতেন। নাতাশা ও তার মায়ের মৃত্যুর পরে দুলাভাই রিংকি আপাকে সহ্য ই করতে
পারেন না, বাচ্চা দুটার দিকে ফিরেও তাকান না। কি আজব মানুষ!

রিংকি আপা শিক্ষিত মেয়ে।কি দরকার তাঁর এমন সংসার করার? ডিভোর্স দিয়ে তিনি বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা থাকলেই তো পারেন। না,রিংকি আপা পারবেন না সেটা। যতো যাই হোক, এখানে একটা সিকিওরড লাইফ।

তিথি ভাবীর সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে। কি সুখী,প্রেমময়ী স্ত্রী ছিলেন তিনি! এখন খুনী স্বামীর জন্য তাঁর প্রবল ঘৃণা। ঘৃণা দেবরের প্রতিও। বাচ্চাদের নিয়ে বাপের বাড়ি উঠেছেন। স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছেন। স্কুলে স্কুলে টিফিন বিক্রি করে, মহিলাদের আধুনিক রান্না শিখিয়ে অর্থ উপার্জন করার চেষ্টা করছেন তিনি।

আব্বু বুড়িয়ে গেছেন। যা বয়স তার থেকেও আরও অনেক বয়স্ক দেখায়। মেজ আপা একদিন বলেছিল , “আব্বু, তুমি আমাদের সাথে অনেক কিছু শেয়ার করতে পারতে। আমাদের ছোট বেলা থেকেই তুমি সবকিছু অন্য ভাবে হ্যান্ডেল করতে পারতে। তাহলে আমাদের সবার জীবন এমন তছনছ হয়ে যেতো না। সবচেয়ে ভালো হতো,আমাদের জন্ম যদি না হতো। আম্মুর পক্ষে সন্তান লালন-পালন যে সম্ভব ছিলো না,এটা তোমার বুঝা উচিৎ ছিল। কিংবা, আম্মুর প্রতি তুমি যেমন কেয়ারিং ছিলে, অতোটা না হলেও কিছুটা কেয়ারিং আমাদের তিন বোনের প্রতি তোমার হওয়া উচিৎ ছিলো আব্বু।”

মেজ আপার এই বিশাল পেট হয়েছে। ওকে দুলাভাই, খালাম্মা-খালু খুব আদর যত্নে রাখেন।

আম্মুকে তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। তিন মাস পরে যখন বাসায় আসলেন, তখনও আম্মু অনেকটাই অসংলগ্ন। ময়না খালাই আমাদের সংসার চালান, চালাচ্ছেন চৌদ্দ বছর ধরে। রিয়া নানী এনে দিয়েছিলেন, তাঁর অনেক দূর সম্পর্কের ভাই ঝি।

আমাদের নানু মানে রিয়া নানু চলে গেলেন এক সন্ধ্যায়। আম্মু এবং সব মামা-খালারা উপস্থিত ছিলেন নানুর মৃত্যু শয্যায়। আম্মু নানুর মাথা কোলে নিয়ে বসেছিলেন দুপুর থেকেই। হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন নানুর চোখে মুখে। দোয়া পড়ে ফু দিচ্ছিলেন নানুর শরীরে। নানুর শেষ সময়টাতে ব্যাকুল হয়ে আম্মু বলতে লাগলেন,”কষ্ট হচ্ছে আম্মা? খুব কষ্ট হচ্ছে? আল্লাহ তোমাকে মাফ করে দিবেন,আম্মা। আল্লাহ, তুমি আমার আম্মাকে মাফ করে দাও। সবকিছু তার জন্য সহজ করে দাও। আম্মা,আবার দেখা হবে তোমার সাথে।” আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ, আমার নানু, আমাদের আরও একা করে দিয়ে চলে গেলেন। কতো মধুর স্মৃতি তাঁর সাথে। নানুর পেটে বসে খেলা করা, বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা, রূপকথার গল্প শোনা, মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া, “বুবুসোনা” বলে ডাক।

আমার এমএসসির রেজাল্ট আউট হলো।অনার্সের মতোই গৌরবময়। আবারও রেকর্ড ব্রেক করা নম্বর। আম্মু আমাকে চুমু খেয়ে বললেন,”আমার মেয়ে বলে কথা। এমন রেজাল্টই তার জন্য স্বাভাবিক।” আমি আম্মুর চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” তুমি খুশি হয়েছো আম্মু?”

“খুব। ”
“আমাকে নিয়ে গর্ব হয় তোমার?”
“অবশ্যই হয়। কেন হবেনা? মাইক্রোবায়োলজি খুবই ভালো সাবজেক্ট। আমি চাই, তুই ইউ এস এ তে যা, পিএইচডি কর্। ”
“মেডিকেলে চান্স পাই নি বলে এতো রেগে গিয়েছিলে কেন মা?খুব জানতে ইচ্ছা হয়।”

“আমি জীবনে কোনো পরীক্ষায় হারিনি। আমার মেয়ে কেন হারবে? ”

হায় রে আমার হতভাগিনী মা। তুমি জয়ের সংজ্ঞা ই জানো না। এটাও জানো না,তোমার মতো জীবন যুদ্ধে পরাজিত মানুষ খুব কমই আছে।

আমার বড় জানতে ইচ্ছা করে, আম্মুর কি বাবুনি, তার মা, আম্মুর নিজের মা আর ভাইএর কথা মনে আছে? কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ভয় হয়। লাভই বা কি জিজ্ঞেস করে।

সেদিন ভোর রাত হতে ভীষণ ঝড় বৃষ্টি। সকালে আম্মু বললেন, “আমার মনটা বড় খারাপ। রাতে কি একটা স্বপ্ন দেখেছি, মনে করতে পারছি না। নীতু আর জামাইকে ডাক্। তোর মামা -খালাদের সবাইকে ডাক্।আজ একসাথে খাই। ময়না, বৃষ্টির দিন। খিচুড়ি আর গরুর গোশত করো।”

আব্বু আমতা আমতা করে বললেন,” এতো ঝড়ের মধ্যে আসতে বলা মানে ওদের বিপদে ফেলা না? ”

“বিপদের কি আছে? পায়ে হেঁটে তো আসতে হবে না। সবারই গাড়ি আছে। বাসাও কারোর আহামরি দূরে না। খবর দাও। সবাই একসাথে খাবো।”

সবাই এলো। আম্মু খুব খুশি। এতো হাসিখুশি আম্মুকে আমি কি দেখেছি কখনো?আমার মনে পড়ছে না। আমরাও খুব সুখী মানুষের অভিনয় করে যাচ্ছি বুকে বেদনার পাহাড় নিয়ে। গত সাড়ে সাত মাস ধরে বাবুনিকে দেখিনা। এই বাসায় ওর জন্য জামাকাপড়, স্যান্ডেল, জুতো, টুথ ব্রাশ সব মজুদ করে রাখা হতো। সেগুলো আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। ঘরের দরজা বন্ধ করে ওর ফ্রকগুলো বুকে চেপে ধরি, কষ্টে দমবন্ধ হয়ে আসে। মেজ আপারও একই দশা। মামা-খালারাও কেউ ভালো নেই। তবু আমরা আম্মুর সামনে মজার মজার কথা বলি, হাসাহাসি করি, ভাব দেখাই যেন আমাদের পৃথিবীতে দুঃখ বলে কিছু নেই।

দুপুরে আম্মু বলতে গেলে কিছুই খেতে পারলেন না। মেজ খালা ভাতের সাথে খাওয়ার মতো অনেক তরকারি রান্না করে নিয়ে এসেছেন, কিছু আম্মুর জন্য, কিছুটা মেজ আপার জন্য। খালা বললেন,”আপা,তুমি খিচুড়ি খোতে পারছো না। গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে বোধ হয়। ময়না চট করে ভাত রেঁধে ফেলুক,তুমি ভাত তরকারি খাও।তোমার ফেভারিট আইটেম আছে কয়েকটা।”

আম্মু ভাতও খেতে পারলেন না। শরীর খারাপ লাগছে। শুলে নাকি ঠিক হয়ে যাবে।
আম্মু শুলেন। আমরাও তাঁর রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গল্প গুজব করতে লাগলাম। মেজ দুলাভাই আম্মুর প্রেশার মেপে দিলেন,পালস দেখে দিলেন। পালসটা একটু দ্রুত, প্রেশারটাও কম। মেজ দুলাভাই বললেন, ” মা,আপনি কিছু খান। তারপরে ঘুমান। আমরা আপাতত এই ঘর থেকে যাই। আপনি খেয়ে নিয়ে ঘুমান। সন্ধ্যায় আড্ডা দেওয়া যাবে।”

আম্মু বললেন,”দূর বোকা। তোমরা আমার চারপাশে আছো বলেইতো ভালো লাগছে। ভুল হয়ে গেলো। আদিব আর তার বউকে ডাকা উচিৎ ছিলো। আদিবের সাথে খুবই অন্যায় করেছি আমি। ওর জীবনটাকে আমিই ছারখার করে দিয়েছি।”

কথাটা সত্য। তবে আম্মু স্বাভাবিক, সুস্থ মানুষ হলেতো নিশ্চয় এমন করতেন না।

“রীতুকে তোমরা সবাই ঘেন্না করো জানি। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওর নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য ও আমি দায়ী। মরা মানুষের উপরে রাগ রেখোনা। ওকে তোমরা মাফ করে দিও। আমার অভাগা মেয়েটার জন্য দোয়া কোরো তোমরা।”

একদম স্বাভাবিক কথাবার্তা। আমরা বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।আম্মু বলে চললেন,” মেয়ে তিনটার জন্য কিছু করিনি আমি,শুধু ওদেরকে কষ্ট দেয়া ছাড়া। আমার সাত জন্মের ভাগ্য, নীতু আর বুবলী এতো ভালো মানুষ হয়েছে। কিন্তু সবাই কি এক রকম হয়? হয় না। রীতুটা মানুষই হতে পারলো না।”

আব্বু বললেন,”এসব কথা থাক। তোমাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে, তুমি ঘুমাও।”

বাইরে উথাল পাথাল ঝড়। তুমুল বৃষ্টি। আকাশ গাঢ় অন্ধকার।

আম্মু হঠাৎ অস্হির হয়ে গেলেন। ক্রমাগত বলতে লাগলেন, “আদিবকে আসতে বলো। আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইবো।রীতুর হয়েও মাফ চাইবো। বেয়াই-বেয়ান তো ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দিলেন না। আদিবকে ডাকো।”

মেজ দুলাভাই চাপা স্বরে বললেন,”অ্যাম্বুলেন্স কল করি। কন্ডিশন সুবিধার ঠেকছে না।”

মেজ আপা আম্মুকে জড়িয়ে ধরলো। “আম্মু,আম্মু, কি হয়েছে তোমার? কষ্ট হচ্ছে? কি কষ্ট হচ্ছে? ”

“নীতু,আমার মা,আমার মামনি,নিজের যত্ন নিস। বাচ্চা হবে তোর, অথচ মায়ের কাছ থেকে এতোটুকু যত্ন আত্তি পেলি না। কি খেতে ইচ্ছা করে তোর? আমার এই মেয়েটা না দেখতে,শুনতে,কাজে কর্মে একদম মায়ের মতোন।তাই না মুকুল, মিথুন? ”

“আপা, একটু চুপ করো তো। একটানা কথা বোলো না। তুমি হাঁপাচ্ছো। চুপ করো আপা,প্লিজ। ”

” মৌরী, মিতুল, তোরা তোদের দুলাভাইকে দেখে শুনে রাখতে পারবি না? ওর যে কি হবে,ভাবলেই আমি টেনশনে মরে যাই।”

“টেনশনের কিচ্ছু নেই। তোমার বরকে তুমিই দেখেশুনে রাখবে।”

মেজ দুলাভাই অ্যাম্বুলেন্সের জন্য প্রাণ পণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নেটওয়ার্ক নেই। রাস্তায় নাকি কোমর সমান পানি জমেছে। গাড়ি নামানোর উপায় নেই।

“বুবলি মা, আমার কাছে আয় তো। কাঁদছিস কেন?আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাক্। আমার বুবলি সোনা। ”

আম্মু কেমন যেন করছেন। চারদিকে তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছেন।

“মা কোথায়, মা? ও মৌরি, আমাদের মা কোথায়? ও মা,কোথায় তুমি? তুমি কেন আমার উপরে রাগ করলে বলো?কি করেছি আমি?”

আম্মু নেতিয়ে পড়লেন। মেজ দুলাভাই আম্মুর পালস ধরে বসে আছেন।
অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করা গেছে। আসতে মিনিট পনেরো তো লাগবেই। আর অ্যাম্বুলেন্সের ইঞ্জিনের ভেতরে পানি ঢুকে গেলে কি হবে, সেটাতো ভাবতেই পারছি না।

আম্মু ঝিমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ চমকে চোখ মেলে মেজ আপাকে খুঁজলেন।

“নীতু সোনা,আমার একটা কথা রাখবি? মেয়ে হলে নাম রাখবি নাতাশা আর ছেলে হলে পলাশ।” আম্মুর চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় পানি গড়াতে থাকলো। আব্বুকে শক্ত করে ধরে আছেন ছোট মামা, মামী -খালারা আকুল হয়ে কাঁদছেন, মেজ আপা থরথর করে কাঁপছে, ছোট খালা জাপটে ধরেছে মেজ আপাকে, বড় মামা ব্যাকুল গলায় ডাকছেন,”আপা,আপা,একটাবার তাকাও আপা।” আম্মু আবার চোখ মেলে চারদিকে তাকালেন,বিড়বিড় করে বললেন,”মা আর পলাশ তো এলো না।”
এটাই আম্মুর শেষ কথা।

আম্মুর গ্রামে এই প্রথম এসেছি। আম্মুকে শোয়ানো হলো তাঁর মা ও ভাইয়ের পাশে। এই রকমই নির্দেশ আম্মু দিয়ে গিয়েছিলেন আব্বুকে। অতীতের সবই মনে ছিল তাঁর।

কবরস্থানটা ভারী মায়াময়। ছায়া ঘেরা। অনেক অনেক ফুলের গাছ। এখন দুপুর। ঘন্টা কয়েক আগে বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে। বাতাস ঠান্ডা। আকাশ জুড়ে বিরাট এক রংধনু। বৃষ্টি ধোয়া গাছের পাতা আর লম্বা ঘন ঘাসগুলোকে ভারি সুন্দর লাগছে। বুনো ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ। কি একটা পাখি দারুণ মিষ্টি করে ডাকছে। আম্মুর নানা-নানি, আমার নানী আর পলাশ মামার কবর সুন্দর করে বাঁধানো। ঝকঝকে পরিষ্কার। বড় মামা, ছোট মামা প্রায়ই আসেন এখানে রেখা ও পলাশের কবর জিয়ারত করতে। খালারাও প্রায়ই আসেন তাঁদের প্রাণপ্রিয় মা আর বড় ভাইয়ার কবর দেখতে। আম্মুই শুধু আসতেন না।আজ মান অভিমান ভুলে এলেন ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরটাকে চির বিশ্রাম দিতে।

পরিশিষ্ট ঃ মেজ আপার মেয়ে হয়েছে। নাম, নাতাশা। বাবুনির সাথে চেহারাতে বেশ মিল। ছোট মামা খান বাড়ির দলিল তুলে দিয়েছিলেন আব্বুর হাতে। আব্বু, মেজ আপা, আমি, আমরা কেউ রাজি হইনি বাড়িটা নিতে।ওটা নানুর বাড়ি হিসাবে জানতাম, নানুর বাড়িই থাক্। আম্মু মারা যাওয়ার দেড় বছর পরে আব্বুও মারা যান। দুজনে পাশাপাশি থাকতে পারেন নি।আব্বুর কবর হয়েছে দাদীর পাশে। আমি চলে এসেছি আমেরিকা য় আম্মুর স্বপ্ন পূরণ করতে। আম্মু চলে যাওয়ার পর হতে বড় দুলাভাই আমাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। রিংকি আপার সাথে তাঁর সম্পর্কের উন্নতি অবনতি কিছুই হয়নি। দুলাভাই এর ভাই আর ভাড়াটে খুনীর ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কার্যকর কবে হবে কে জানে?

সব ভুলে থাকতে আমি সারাদিন শুধু খাটি আর খাটি, তবু রাতে ঘুম আসে না। কান্নাও আসে না। শুধু অনেকগুলো মুখ মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। মাঝে মধ্যে তন্দ্রা মতো হয়, আবার কেটে যায়। উঠি,পানি খাই, রাতের আকাশ দেখি। একসময় তারারা মিলিয়ে যায়। আঁধারের শেষে ভোর আসে কিন্তু সেই ভোর আমার মনে এতোটুকু আলো ফেলতে পারে না। আমি হাসতে পারিনা, বন্ধুত্ব করতে চাই না,কারোর সাথে কথাও বলতে ইচ্ছা করে না। আমি শুধু একটা যন্ত্রের মতো খেটে যেতে পারি আম্মুর স্বপ্ন পূরণের জন্য।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here