না_চাইলেও_তুমি_আমার পর্বঃ ১৬

0
3483

না_চাইলেও_তুমি_আমার
পর্বঃ ১৬
জাহান আরা

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে চন্দ্র,সন্ধ্যার আকাশ,রাস্তায় লোক চলাচল,কিছু ভালো লাগছে না।শিউলির মনমাতানো ঘ্রাণ আজ মন কেঁড়ে নিচ্ছে না।মন খারাপ হলে বুঝি সবই এরকম বিবর্ণ মনে হয় মানুষের।

বারবার মাথায় ঘুরছে মারিয়া আর নিষাদের বিষয়। কি অদ্ভুত ভাগ্য,নিজের স্বামী অথচ কতো বাঁধা তার হতে।চাইলেই তার পাশে দাঁড়ানো যায় না,যায় না একটু কথা বলা।
চন্দ্রর খুব অস্থির লাগছে,গতরাতেই তো দুজন একসাথে ছিলো।
হঠাৎ গতরাতের কথা ভাবতেই চন্দ্রর মনে পড়ে গেলো আসলে কি ঘটেছে।নিষাদ যা বলেছে মোটেও তা হয় নি।
ছি,রাতে কি সব বলেছে সে নির্লজ্জের মতো। আর নিষাদ কেমন করে মিথ্যা কথা বলে তাকে লজ্জা দিয়েছে আরো।ভাবতেই চন্দ্র লজ্জায় লাল হয়ে যায়।

রাস্তায় গাড়ির হর্ণ শুনে চন্দ্র তাকায় রাস্তার দিকে,নিষাদের গাড়ি চোখে পড়তেই বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়। মুহূর্তেই যেনো ভুলে যায় সব রাগ অভিমান।

“আপনি ফিরে আসার আনন্দে ভুলে যাই সব
গত হওয়া দিনের স্মৃতি, ধুলোপড়া খাম,
বিকেলের দামে কেনা গোধূলি আকাশ
আর কোথায় কে কখন কাহারে ভালবাসিলাম।”

আপন মনেই কবিতা আওড়ায় চন্দ্র,কেমন যেনো লজ্জা মিশ্রিত আনন্দ হচ্ছে তার এখন।তাহলে নিষাদ বুঝতে পেরেছে চন্দ্র রাগ করেছে যে।
ভাবতে ভাবতেই তার রুমের দরজায় নক হয়,চন্দ্র গিয়ে দরজা খুলে দিতেই নিষাদ ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।নিষাদের হাতে চন্দ্রর লাগেজ।এই লাগেজ নিষাদের রুমে ফেলে এসেছে চন্দ্র।

চন্দ্র বুঝতে পারছে না তার কেমন অনুভূতি হচ্ছে এখন,নিষাদের দিকে তাকাতে ও পারছে না।

নিষাদ চন্দ্র কে বুকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে,চন্দ্র বাঁধা দেয় না,সরে যাওয়ার ও চেষ্টা করে না।অশান্ত বুক শান্ত হয়ে যায় দুজনের।চন্দ্রর কপালে চুমু খায় নিষাদ,নিষাদ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চন্দ্র।
জীবনের সব সুখ,সব শান্তি,সব নির্ভরতা এখানেই তার।নিষাদের শরীরের ঘ্রাণ নাকে আসতেই চন্দ্রর কেমন যেনো অস্থির লাগে,হার্টবিট বেড়ে যায়।

বাহিরে কেউ দরজা নক করছে,নিষাদ চন্দ্রকে ছেড়ে দরজা খুলতে চায়,কিন্তু চন্দ্র শক্ত করে ধরে রাখে।ভালো লাগাতে বুক ভরে যায় নিষাদের।
মনে হয় সবই তো আছে তার,চন্দ্র তাকে জড়িয়ে ধরে আছে আর কি চাওয়ার আছে তার জীবনে।

আমির অনেকক্ষণ ধরে চন্দ্রর দরজায় নক করছে কিন্তু চন্দ্র দরজা খুলছে না।এবার বাহির থেকে ডাক দেয় আমির চন্দ্র কে।ভাইয়ের গলার স্বর শুনে চন্দ্র কেঁপে উঠে।
ভাইয়া এসেছে!
ফ্যাকাসে মুখে তাকায় নিষাদের দিকে,নিষাদের চোখে নির্ভরতার,নিশ্চয়তার চিহ্ন দেখে চন্দ্র।
খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আবার চন্দ্রকে,সব ভুলে যেতে চায় নিষাদ এখন।

আমিরের খুব চিন্তা হচ্ছে,চন্দ্রর কি বেশি শরীর খারাপ লাগছে!কি হয়েছে একবার দেখতে এসেছে আমির,কিন্তু চন্দ্র দরজা খুলছে না এখনো। আমিরের ভয় লাগছে কেনো যেনো।আমিরের অনবরত ডাকাডাকি শুনে নিষাদ নিশান কে কল দেয়।

নিশান ড্রয়িং রুমে বসে আছে,কথা বলছে সবার সাথে।নিষাদের কল পেয়ে এক্সিউজ মি বলে উঠে আসে।

তারপর জিজ্ঞেস করে,”কি রে,কি হয়েছে,কই তুই?”

“ভাইয়া,আমি তো চন্দ্রর রুমে,বাহিরে শালাবাবু দাঁড়িয়ে দরজা নক করে যাচ্ছে,দরজা খুলতে পারছি না,বের ও হতে পারছি না,বের হলে তো শালাবাবু দেখে ফেলবে,কি করবো এখন?”

নিশান ভেঙচি দিয়ে বলে,”কেনো,তুমি এখনই রুমে ঢুকে গেলে কেনো,রাতে যাওয়া যেতো না সবাই ঘুমালে?”

নিশানের কথা শুনে নিষাদ আসহায় সুরে জবাব দেয়,”আমার বৌ রাগ করছে এখন,আমি এখন রাগ ভাঙ্গাবো না রাতের জন্য রেখে দিবো না-কি!
আর আমি তো এখনো তোমার মতো লাইসেন্স পাই নি যে যখন তখন আসতে পারবো,তাই আমার জন্য রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা খুবই কঠিন,শুভস্য শীঘ্রম জানো না তুমি?”

“বুঝছি ভাই,আমি তর্কে যেতে চাই না,আমি আমিরকে সরিয়ে আনার ব্যবস্থা করছি,তুই বের হয়ে আয় তাড়াতাড়ি।”

নিষাদ ফোন রেখে দেয়,চন্দ্র কপালে,গালে,চিবুকে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলে,”আসি বউ এখন।”

চন্দ্র ছাড়ে না,খামছে ধরে রাখে পাঞ্জাবি।

নিষাদ জিজ্ঞেস করে,”ছাড়বে না?বাহিরে ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু।”

চন্দ্র আস্তে বলে,”এখনো একটা চুমু বাকি আছে।”

২ সেকেন্ড লাগে নিষাদের বুঝতে,তারপর বুঝতেই চন্দ্রর ঠোঁট টেনে নেয়,আজ চন্দ্র কিছুতেই বাঁধা দিচ্ছে না আর,নিজেকে বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আজ নিষাদের কাছে,আরো বেশি কিছু পেতে ইচ্ছে করছে।নিজেও নিষাদের কপালে চুমু খায়।

দরজা খুলে নিষাদ বের হয়ে যায়,ভীষণ আনন্দ হচ্ছে তার এখন,চন্দ্র ও বের হয়ে যায় পিছুপিছু। আমির নিশানের সাথে কথা বলছে,নিশান এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যেনো চন্দ্রর রুমের দরজা তার বরাবর থাকে আর আমিরের পিছনে।

চন্দ্র এসে আমিরের পাশে দাঁড়ায়,চন্দ্রকে দেখেই আমির জিজ্ঞেস করে,”কিরে,কতোক্ষণ ধরে ডেকেছি,দরজা খুললি না কেনো?”

“ওয়াশরুমে ছিলাম।”

নিজের বলা মিথ্যা তে চন্দ্র নিজেই অবাক হয়ে যায়,কেমন সহজভাবেই ভাইয়াকে মিথ্যা বললো সে।একটুও মুখে আটকায় নি।নিশান মুচকি হাসছে চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে।

“শরীর কেমন এখন তোর?”

“এখন ঠিক আছি ভাইয়া।”

“আচ্ছা,যা তাহলে,আমি তো চিন্তায় ছিলাম এতোক্ষণ আরো।”

চন্দ্র চলে যায়,রাত্রির রুমে ঢুকতেই দেখে বান্ধবীরা সবাই রাত্রিকে ঘিরে বসে আছে।রুমে মোমবাতি জ্বলছে,লাইট অফ করা।
রাত্রি হাত নেড়ে নেড়ে কি যেনো বলছে।চন্দ্র গিয়ে পাশে বসে,রাত্রি তাদের ছোট বেলার গল্প করছে।

লাইটের কথা জিজ্ঞেস করতেই রাত্রি জবাব দেয়,আজকে লাইট অফ রাখবে,মোমবাতি জ্বালিয়ে রাত কাটাবে।
চন্দ্র হেসে জিজ্ঞেস করে,”দুলাভাইয়ের জন্য রোমান্টিক পরিবেশ করে রাখছিস না-কি?”

রাত্রি জবাব দেয় না,হেসে দেয়।

নিষাদ ছাদে দাঁড়িয়ে আছে,মনটা ফুরফুরে আজ খুব,সব খারাপ কিছুরই ভালো দিক আছে,এই যেমন মারিয়া এরকম করাতে নিষাদ বুঝতে পেরেছে চন্দ্র যে তাকে ভীষণ ভালোবাসে।

নিষাদ ছাদের দিকে গেছে দেখে নিশান ও ছাদে যায়।নিশানের মুখে ফ্ল্যাশ লাইটের আলো পড়তেই নিশান চমকে উঠে হেসে দেয় হাহা করে।
বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে নিষাদ।

নিশান তখনই একটা ছবি তুলে নেয় নিষাদের,তারপর নিষাদকে দেখাতেই নিষাদ দেখে সারা মুখে লিপস্টিক এর ছড়াছড়ি।
হেসে দিয়ে মুখ মুছে নেয়।

একটু পরেই নিশান,নিষাদ আসে রাত্রির রুমে,নিষাদ রাত্রির দিকে তাকিয়ে আছে,এতোগুলা মেয়ের সামনে চন্দ্রর দিকে তাকায় না আর।
মারিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিষাদ কে দেখছে।

সিমি বলে উঠে,”দুলাভাই চলেন,লুডু খেলবো।”

নিশান নিষাদের দিকে তাকায়,নিষাদ কে জিজ্ঞেস করে,”কি রে,খেলবি?’

নিষাদ চন্দ্রর দিকে তাকায়।চন্দ্রর মুখে অসন্তোষের চাপ,”না ভাইয়া,আমার খেলতে ইচ্ছে করছে না,তোমরা খেলো,আমি বরং দেখি।”

নিশান রাজী হয় খেলতে।রাত্রি,নিশান,সিমি,মারিয়া খেলতে বসে বিছানার মাঝখানে।নিশান আর রাত্রির মাঝখানে একটু পিছিয়ে বসে চন্দ্র আর নিষাদ,চন্দ্র নিশানের পাশে আর নিষাদ চন্দ্রর পরে রাত্রির পাশে।রাত্রির পরে মারিয়া,লিপি,সিমি,ইতু।

খেলা বেশ জমে উঠেছে,নিশানের ৩টা গুটি রাত্রি কেটে দিয়েছে পরপর,মারিয়া কেটেছে রাত্রির ১টা,সিমি এখনো গুটি উঠাতেই পারছে না,৬ পড়ছে না তার।
টানটান উত্তেজনার মধ্যে খেলা হচ্ছে,নিশান আর মারিয়া একদলে,সিমি আর রাত্রি একদলে।বাজী ধরা হয়েছে,যদি রাত্রিরা হেরে যায় তবে সবাইকে আইসক্রিম খাওয়াবে রাত্রি আর যদি নিশানেরা হেরে যায় তবে খেলা শেষে সবাইকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে নিশান,ফুসকা,আইসক্রিম,চকোলেট,যার যা ইচ্ছে তাই খাওয়াতে হবে,এবং আনলিমিটেড।

চন্দ্র ভীষণ মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখছে,সবার মনোযোগ খেলার মধ্যে।একটু পরেই চন্দ্র চমকে উঠে কারো স্পর্শ পেতেই,নিষাদ চন্দ্রর কোমর জড়িয়ে ধরেছে বাম হাত দিয়ে।শ্বাস আটকে বসে থাকে চন্দ্র,নিষাদের হাত পিঠের দিকে উঠতে থাকে।
ভীত চোখে চন্দ্র সবার দিকে তাকায়,চন্দ্রর মনে হয় যেনো সবাই দেখছে নিষাদের হাত চন্দ্রর শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে,কিন্তু না সবাই খেলায় মনোযোগ দিয়ে বসে আছে।চন্দ্র একনজর নিষাদের দিকে তাকায়,কেমন মনোযোগ দিয়ে ডান হাত গালের নিচে দিয়ে খেলা দেখছে।

অবাক হয় চন্দ্র,চেহারা কিভাবে এরকম নির্বিকার রাখতে পারছে নিষাদ।চন্দ্র বারবার শিউরে উঠছে,নিষাদের অবাধ্য হাত কোনো বাঁধা মানছে না,দুষ্টুমি করে যাচ্ছে।একপর্যায়ে চন্দ্র নিষাদের হাত ধরে ফেলে এতো আদর নিতে পারছে না চন্দ্র।

নিষাদ হাত সরিয়ে নিয়ে কোমরে রাখে আবার,চন্দ্র স্থির হতে সময় নেয়।আবার সবার দিকে তাকায়,না কেউ খেয়াল করে নি কি হয়েছিলো এতোক্ষণ,নিষাদের দিকে তাকায় আবার,নিষাদ আগের মতোই নির্বিকার।

নিশানদের দল হেরে যায়,রাত্রি আর সিমি এতো জোরে লাফ দিয়ে উঠে চিৎকার করে যে মোমবাতি নিভে যায়।রুম অন্ধকার হয়ে যেতেই নিষাদ চন্দ্র কে হুট করে জড়িয়ে ধরে,অন্ধকারেই চুমু খায় চন্দ্রর গলায়।তার পর ছেড়ে দিয়ে দূরত্ব রেখে বসে।
রাত্রি লাইট অন করে,সবাই উঠে যায় বাহিরে যাওয়ার জন্য রেডি হতে।

চন্দ্রর মন আজ খুব খুশি,কেমন হালকা লাগছে নিজেকে,ইচ্ছে করছে ডানা লাগিয়ে আকাশে উড়তে,এতো বেশি ভালো লাগছে কেনো বুঝতে পারছে না চন্দ্র।প্রিয় সাদা জামাটা পরলো,সাথে নীল ওড়না,ঠোঁটে খয়েরি রঙের লিপস্টিক,খোলা চুল।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারকয়েক নিজেকে দেখে চন্দ্র,খুব পছন্দ হচ্ছে আজকের সাজ।

মায়ের ছবিখানা নিয়ে বিছানায় পা ভাঁজ করে বসে,তারপর অসংখ্য চুমু খায় মায়ের ছবিতে।মায়ের দিকে তাকাতেই চন্দ্রর মনে হয় মা যেনো আজ ভীষণ খুশি চন্দ্রর খুশিতে।

আমির রুমে আসে,চন্দ্রর কপালে হাত রাখে,তারপর জিজ্ঞেস করে,”শরীর ভালো আছে তো তোর,বাহিরে যাচ্ছিস,খারাপ লাগলে যাস না,তোকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়।”

চন্দ্র হেসে জবাব দেয়,”আমি ভালো আছি এখন ভাইয়া,কিছু হবে না।তাছাড়া আপা,দুলাভাই তো আছেই।”

“হ্যাঁ,ওরা আছে বলেই তো আমি নিশ্চিন্ত।যা তাহলে,নিজের খেয়াল রাখিস।”

চন্দ্র হেসে ফেলে আমিরের কথা শুনে,তারপর জিজ্ঞেস করে,”এমনভাবে বলছো যেনো আমি আজীবনের জন্য চলে যাচ্ছি।”

আমিরের চোখে পানি এসে যায়,চন্দ্রর কাঁধে হাত রেখে বলে,”রাত্রিকে তো বিয়ে দিয়েই দিলাম,বাকি আছিস তুই,তোকে সুপাত্রে হস্তান্তর না করা পর্যন্ত যে আমার দায়িত্ব শেষ হবে না চন্দ্র,মা কে তো আমি কথা দিয়েছি”

চন্দ্রর কেমন অপরাধী লাগে শুনে,সুপাত্রের কথা শুনে,নিজের বর তো চন্দ্র নিজেই বানিয়ে নিয়েছে সবার অজান্তে।

রাত্রি এসে ডাকাডাকি শুরু করে চন্দ্রকে বের হতে,চন্দ্র বের হয়ে যায়।লিফটে ঢুকে অবাক হয়ে যায় এটা দেখে যে নিষাদ ও সাদা শার্ট পরেছে,কাকতালীয় ভাবে দুজনের ড্রেসের কালার মিলে যাবে দুজনের কেউই ভাবে নি।

চলবে….???

(কবিতা সালমান হাবিব ভাইয়ার লিখা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here