না_চাইলেও_তুমি_আমার
পর্বঃ২৮(শেষ পর্ব)
জাহান আরা
শীতের সকাল,চারদিকে ঘন কুয়াশার আস্তরণ।সূর্য উঠেছে অনেক আগেই কিন্তু কুয়াশার প্রকোপে রোদ বুঝা যাচ্ছে না।হাড় কাঁপানো শীতে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে কম,অথচ নিষাদ দাঁড়িয়ে আছে পাতলা একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে।বুকের ভিতর যে আগুন জ্বলছে সেই আগুনের তাপে বাহিরের ঠান্ডা অনুভব করতে পারছে না।
রাগে,ক্রোধে ফেটে পড়ে আমির,আর দশ মিনিট আগে কেনো বের হলো না বাসা থেকে চন্দ্রকে নিয়ে তার জন্য নিজের উপর নিজের খুব রাগ উঠে।গতকালই মাইনুল সাহেব আর সে ঠিক করেছে চন্দ্রকে এখান থেকে লুকিয়ে ফেলবে,এখনই বের হওয়ার কথা ছিলো তাদের।তার আগেই এরা এসে উপস্থিত।দশজন পুলিশ নিয়ে নিশান দাঁড়িয়ে আছে,সাথে আছে হাসনাত সাহেব ও নিষাদ।
মুচকি হেসে হাসনাত সাহেব মাইনুল সাহেবের দিকে এগিয়ে গেলেন,তারপর বেয়াই মশায় বলে কোলাকুলি করলেন।
কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে মাইনুল সাহেব।হাসনাত সাহেব হাসিমুখে বলেন,”বুঝলেন বেয়াই সাহেব,আপনার হচ্ছে রাজ কপাল,২মেয়ে এক ঘরে,একসাথে থাকবে,একে অন্যকে দেখে শুনে রাখবে,হাউ সুইট,তা কই,আমার ছোট বউ কই,তাকে দেখছি না কেনো,ডাকুন না তাকে।”
হাসনাত সাহেবের মিষ্টি কথা মাইনুল সাহেব কে টলাতে পারে না,চোখেমুখে হিংস্র ভাব ফুটে উঠে মাইনুল সাহেবের।
গমগমে গলায় বলে,”আমার মেয়েকে আমি কিছুতেই আপনার ছেলের কাছে বিয়ে দিবো না।”
“আহা বেয়াই সাহেব,রাগ করছেন কেনো,বিয়ে না দেয়ার কি আছে,ওদের তো বিয়ে হয়েই গেছে,আইনত ওরা এখন স্বামী স্ত্রী,আপনি চাইলেই ওদের আলাদা করতে পারেন না।”
“আমি মানি না এই বিয়ে,এটা বিয়ে হতেই পারে না।আপনার ছেলে জোর করে আমার মেয়েকে বিয়ে করেছে।”
“দেখো দেখি কান্ড,আমার ছেলের কাছে বিয়ের সব ডকুমেন্টস আছে,সবই অরিজিনাল হেহে,আপনি চাইলে দেখে নিতে পারেন,তা চন্দ্র কই,ডাকেন ওকে।”
“চন্দ্র এখানে নেই।আপনারা আসতে পারেন “আমিরের কথা শুনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিষাদ,গতরাতে চন্দ্রকে দেয়া চড়ের কথা ভুলতে পারে নি নিষাদ।
পকেট থেকে ওয়ারেন্ট পেপার বের করে নিশান আমিরের সামনে ধরে,তারপর হেসে বলে,” ভাইজান,আপনার ভগ্নীপতি আর তালুই মশাই মামলা করেছে আপনাদের নামে,আপনারা ওনাদের ছোট বউ কে জোর করে আটকে রেখেছেন,এই যে আপনাদের এরেস্ট ওয়ারেন্ট আর সার্চ ওয়ারেন্ট।”
আমিরের চোখ ছোট ছোট হয়ে যায়।নিশানের দুই চোখ সুরমাকে খোঁজে,একটু পর সুরমাকে দেখে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে।
কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটে উঠে নিশানের ঠোঁটে,ভোর রাতে সুরমা টেক্সট করে না জানালে কখনোই জানতো না কেউ চন্দ্রকে সকালে অন্য কোথাও নিয়ে যাবার কথা।
কলিং বেল বেজে উঠতেই নিষাদ দরজা খুলে দেয়।শামসুদ্দিন সাহেব দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাহিরে,তাকে ভিতরে আসতে জায়গা করে দেয় অন্যরা।
মুচকি হেসে শামসুদ্দিন সাহেব তাকায় মাইনুল সাহেবের দিকে।কেঁপে উঠে মাইনুল সাহেব।
শান্তস্বরে শামসুদ্দিন সাহেব জিজ্ঞেস করে,”কেমন আছো মাইনুল?”
কথা বের হয় না মাইনুল সাহেবের মুখ থেকে।টলতে টলতে গিয়ে সোফায় বসে পড়ে মাইনুল সাহেব।নিশান সব রুম চেক করে একরুমে তালা লাগানো দেখতে পায়।চাবির অপেক্ষা করে না আর,তালা ভাঙার যন্ত্রপাতি সাথে করেই নিয়ে এসেছে নিশান।
দরজা খুলে দেয় নিশান,নিষাদের দিকে ইশারা করে।
বুকের ভিতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে গলায় এসে আটকে থাকে।নিষাদ কে দেখে চন্দ্র থমকে যায়,এই জীবনে আবার দেখা হবে সেই আশা চন্দ্রর একেবারে নিভে গেছে।
বৃষ্টির অপেক্ষায় যেভাবে চাতক পাখি তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে তেমনি দুজন তাকায় দুজনের দিকে,সময় থেমে যায়,পৃথিবীর সমস্ত ব্যস্ততা থেমে যায় মুহূর্তের জন্য,তারপর দুজন ছুটে যায় দুজনের দিকে।
কান্নায় ভেঙে পড়ে দুজন একে অন্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
শামসুদ্দিন সাহেব নিজের চোখ মুছেন,হাসনাত সাহেবের চোখ টলমল হয়ে উঠে।পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য ভালোবাসার মানুষকে বুকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য,এই সুখ অপার্থিব,ভালোবাসা স্বর্গীয় তা বোধহয় এইজন্য বলে,ভালোবাসার মানুষ কে বুকে জড়িয়ে ধরলে যে শান্তি পাওয়া যায় তা পৃথিবীর আর কিছুতে নেই,এজন্যই যুগ যুগ ধরে চলছে এই ভালোবাসা।
ভালোবেসে কেউ হেরে যায় কেউ আবার জিতে যায়।হেরে গিয়েও মানুষ আবার ভালোবাসে,এই স্বর্গীয় সুখের আশায়।
নিষাদ চন্দ্রর হাত শক্ত করে ধরে রুম থেকে বের হয়ে আসে,শামসুদ্দিন সাহেব কোটের পকেট থেকে একটা স্ট্যাম্প বের করে নিষাদের হাতে দেন।
প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় নিষাদ তার দিকে,মুচকি হেসে শামসুদ্দিন সাহেব বলেন,”আমার যা কিছু আছে সবই তো আমার মেয়ের জন্য,আমার একমাত্র মেয়েটা তো তোমার অর্ধাঙ্গিনী,তাই আমার কোম্পানি,জায়গাজমি,টাকা পয়সা সব কিছুর মালিক তোমরা ২জন,তোমাকে আমার আগে থেকেই পছন্দ ছিলো নিষাদ,নিজের মেয়েকে কখনো খুঁজে পাবো তা আমি ভাবতেও পারি নি,আগে থেকেই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম আমার সব কিছু তোমাকে দিয়ে যাবো।এখন যখন আমার মেয়েকে পেয়েছি তাই সব কিছু তোমাদের দুজনের অর্ধেক অর্ধেক করে।”
সবাই অবাক হয়ে তাকায় শামসুদ্দিন সাহেবের দিকে,সবচেয়ে বেশি অবাক হয় চন্দ্র,চন্দ্র বুঝতে পারে না কি বলছে এসব তিনি।
মাইনুল সাহেবের চোয়াল ঝুলে পড়ে,আমির অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে।
শামসুদ্দিন সাহেব মাইনুল সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”মাইনুল,তুমি কি স্বীকার করবে চন্দ্র আমার মেয়ে যে,না-কি ডিএনএ টেস্ট করবো?
মাইনুল সাহেব জবাব দিতে পারে না। অনেক বছর ধরে এই সত্য টা তিনি বুকের ভিতর মাটিচাপা দিয়ে রেখেছেন।রাত্রির জন্মের পর একমুহূর্তের জন্য ও রাশেদা তার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে দেয় নি তাকে,রাশেদাকে ধরে নিয়ে আসার পরেই যখন জানতে পারেন তিনি রাশেদা প্রেগন্যান্ট,তখনই বুঝে যান কে করেছে এই কাজ,তবু ঘৃণা করতে পারেন নি তিনি চন্দ্রকে,কাউকে বুঝতেই দেন নি,জন্মদাতা যেই হোক চন্দ্রর,মা তো রাশেদা ছিলো,রাশেদার শরীরের রক্ত থেকে চন্দ্রর জন্ম,কিভাবে চন্দ্রকে অবহেলা করতে পারতেন তিনি তাহলে?
তিনিও তো ভালোবেসেছেন রাশেদা কে।
আমির মাইনুল সাহেবের হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে,”উনি কি সত্যি কথা বলেছেন বাবা?”
মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করেন মাইনুল সাহেব,এই সত্যি একদিন প্রকাশ হতোই।
চন্দ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে মাইনুল সাহেবের দিকে।মাইনুল সাহেব ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে।
শামসুদ্দিন সাহেব আবার জিজ্ঞেস করে,”রাশেদা কিভাবে মারা গিয়েছিলো মাইনুল?”
চমকে উঠে মাইনুল সাহেব এই প্রশ্ন শুনে,তারপর শান্ত স্বরে জবাব দেন,”রাশেদা অসুস্থ ছিলো তাই মারা গেছে।”
“তোমার পতন চলে এসেছে মাইনুল,আর কতো মিথ্যা বলবে,রাশেদা কে ভালোবাসতে না তুমি,তবে কিভাবে আজ তার মৃত্যু নিয়ে মিথ্যে বলছো?
নিজের মৃত্যুর ভয়ে না-কি?”
“মৃত্যু কে আমি ভয় পাই না,মৃত্যু হলে বরং আমি রাশেদার কাছে যেতে পারবো।”
“তবে স্বীকার করে নাও,রাশেদা কে যে তুমি বালিশ চাপা দিয়ে খুন করেছো।”
“না আমি বালিশ চাপা দিয়ে খুন করি নি।”
“করেছো।”
“না করি নি।”
“করেছো মাইনুল।”
“না,আমি বালিশ চাপা দিয়ে খুন করি নি,আমি ওকে সায়ানাইড দিয়ে খুন করেছি।”
মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলে মাইনুল সাহেব সবার দিকে তাকায়।
বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছে সবাই,সবার মুখের দিকে তাকিয়ে মাইনুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।এখন আর কথা ফিরিয়ে নিতে পারবেন না তিনি।
সত্যি কথা বলে ফেলেছেন।
পরাজয় আজ তার সবদিক থেকে,মাইনুলের দিকে তাকিয়ে বলেন,”তুই এখনো সেই আগের মতোই বুদ্ধিমান,সত্যি কথা আদায় করে নিতে জানিস কৌশলে।”
চন্দ্রর বুকের ভিতর কেমন মোচড়াচ্ছে।বাবা তার মা’কে খুন করে ফেললো,শুধুমাত্র ভালোবাসার অপরাধে?
মানুষ এতোটা নিকৃষ্ট হতে পারে কিভাবে?
নিশান এগিয়ে গিয়ে আমির আর মাইনুল সাহেবের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন,তারপর বের করে নিয়ে চলেন নিচের দিকে,একে একে সবাই নিচে নেমে আসে সুরমা ছাড়া।
চন্দ্র আর নিষাদ সবার পিছনে।
★
আমির কে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ২ দিন পরেই,জেল থেকে বাসায় ফিরার পথেই কয়েকজন অচেনা ছেলে অহেতুক পিটিয়ে আমিরের হাত ভেঙে দিয়েছে।
মারিয়া কে কঠিন শাস্তি দিবে বলে নিষাদ ঠিক করে,কিন্তু চন্দ্র বাদ সাঁধে,কোমল গলায় বলে,”এই যে আমরা একে অন্যকে পেলাম,একইসাথে আজীবন থাকবো,এর চাইতে বড় মানসিক শাস্তি আর মারিয়ার জন্য কি হতে পারে?”
মাইনুল সাহেবের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে,মাঝেমাঝে মাইনুল সাহেব গিয়ে দেখা করে আসেন।কেউ কারো সাথে কথা বলেন না,অপলকভাবে তাকিয়ে থাকেন একে অন্যের দিকে।
একজনের চোখে থাকে অপরাধবোধ,আরেকজনের চোখে তীব্র ঘৃণা,আরেকজনের চোখে হারানোর ব্যথা।
রাত্রি আর চন্দ্র একে অন্যের সাথে কথা বলে না।রাত্রি সবকিছুর জন্য চন্দ্রকে দায়ী করে।চন্দ্র সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় না,চন্দ্র নিজেও বুঝে বাবার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যে সন্তানদের মধ্যে প্রকাশ পায়,মাইনুল সাহেবের থাকা নিষ্ঠুরতা,রাত্রি,আমিরের মধ্যে কিছুটা থাকবেই সেটা বৈচিত্র্য নয়।
চন্দ্র আর নিষাদ নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকে।
আমির প্রতিদিন চন্দ্রদের ফ্ল্যাটের বাহিরে রাস্তার উল্টোপাশে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।
সুরমার সাথে এখন আমিরের সম্পর্ক ভালোর দিকে,আমির নিজেকে শোধরাবার চেষ্টা করছে।
হাসনাত সাহেব আর মনোয়ারা বেগমের সময় সবচেয়ে ভালো কাটছে।দুজন প্রতিদিন ঝগড়া করে একদিন নিষাদের ফ্ল্যাটে এসে আস্তানা গাঁড়ে আবার নিজেদের বাসায় ফিরে যায়।
২মাস পরে একদিন চন্দ্রকে নিয়ে নিষাদ থানায় যায়,তাদের নতুন সদস্য আসার খবর জানাতে নিশানকে।সেখান থেকে মাইনুল সাহেব কে দেখতে যায় ২জনেই,শামসুদ্দিন সাহেব কে ও দেখতে পায় মাইনুল সাহেবের সেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
দূর থেকেই চন্দ্র ডাকে “বাবা” বলে।
মাইনুল সাহেব,শামসুদ্দিন সাহেব দুজনেই তাকায় চন্দ্রর দিকে।
কাকে ডেকেছে চন্দ্র বাবা বলে?
(সমাপ্তি)
(এই যে হ্যাপি এন্ডিং দিলাম,সবাই খুশি তো,যার যার মতামত জানিয়ে যান এবার)