না_চাইলেও_তুমি_আমার
পর্বঃ ০৭
জাহান আরা
টেবিলের উপর রাখা ফোন টা বেজে উঠতেই রাত্রি চমকে উঠে।নিশান কল দিয়েছে রাত্রি বুঝে গেছে।বাবা ভাইয়ার সামনে ফোন নিয়ে উঠে যেতে কেমন জড়তা কাজ করছে রাত্রির মাঝে,কি মনে করবে সবাই ফোন নিয়ে সরে গেলে এখন?
আবার সবার সামনে রিসিভ করে কথাও বলা যাবে না।কেমন দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায় রাত্রি।
২দিন পরে বিয়ে অথচ এখনো বাবা ভাইয়া কে এতো ভয় করে কেনো তাই বুঝে উঠতে পারছে না রাত্রি।
আমির চন্দ্রর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাত্রির দিকে তাকায়। তারপর শীতল কণ্ঠে বলে,”কল রিসিভ কর”
রাত্রির ভীষণ ভয় ও লজ্জা করছে।কিন্তু জানে উপায় নাই।ভাইয়া যা বলেছে তাই হবে।তার কোনো নড়চড় হবে না।
রাত্রি ফোন রিসিভ করে।
“সারপ্রাইজ টা কেমন লাগলো আমার বউয়ের?”
“এসব আপনি পাঠিয়েছেন,ফুল,পায়েল,চিরকুট?”
“আমি নয়তো কে পাঠাবে বলো?”
রাত্রির মুখে হাসি ফুটে উঠে,এতোক্ষণ ধরে থমকে থাকা পরিস্থিতি এবার শিথিল হবে।
“শুনো,পায়েল কিন্তু তোমার জন্য না,পায়েল টা চন্দ্রর জন্য পাঠিয়েছি,তোমার জোড়া আমার কাছে,আমি নিজ হাতে পরিয়ে দিবো সেটা তোমাকে বাসর ঘরে।”
রাত্রি লজ্জায় লাল হয়ে উঠে।
তারপর উঠে সুরমা কে কানেকানে বলে রুমে চলে গেলো।
সুরমা উঠে আমিরকে কানেকানে বললো।
মুহূর্তেই আমিরের মুখ হাসিহাসি হয়ে যায়। পায়েল চন্দ্রর হাতে দিয়ে রুমে চলে যায় আমির।
কি হলো এতোক্ষন আর এখন কি হচ্ছে কিছুই চন্দ্রর মাথায় ঢুকে না।
চন্দ্র রাত্রির রুমে যায়,রাত্রি ড্রেসিং টেবিলের উপর উঠে বসে ফোনে কথা বলছে।চন্দ্রকে ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারলো চন্দ্র এখনো কিছু বুঝতে পারছে না।
কল মিউট করে চন্দ্রকে কাছে ডাকলো।
চন্দ্র ধীরপায়ে রাত্রির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। চন্দ্রকে কেমন ভীতু দেখাচ্ছে হঠাৎ করে।
“পায়েল পায়ে দিলি না যে?”
“কার পায়েল,কে দিয়েছে কাকে আপা?”
“আরে পাগল,তোর দুলাভাই পাঠিয়েছে এটা,সারপ্রাইজ দিতে।”
“ওহ আচ্ছা।” চন্দ্র যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচে রাত্রির কথা শুনে। নিজের রুমে চলে যায় চন্দ্র। বিছানায় এসে বসতেই চন্দ্রর আবার মনে পড়ে,নিশান ভাইয়া হলে তো বউ লিখতো না,এখনো তো তাদের বিয়ে হয় নি।
তাছাড়া আপার প্রিয় ফুল গোলাপ,জারবেরা না।
তাহলে?
এটা নিষাদ ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারে না,নিশ্চয়ই নিশান ভাইকে কোনোভাবে হাত করে নিয়েছে নিষাদ,চন্দ্র বুঝতে পারে।
চন্দ্রর মাথায় কিছু ঢুকছে না। ভাগ্য তাকে নিয়ে এক কঠিন খেলা খেলছে,সেই খেলায় চন্দ্রর কিছু করার নেই মেনে নেওয়া ছাড়া।
মায়ের ছবি বের করে চন্দ্র বারান্দায় গিয়ে বসে।মা’কে জিজ্ঞেস করে,”আচ্ছা মা,আমাকে নিয়ে ভাগ্য এতো খেলছে কেনো? আমি তো জীবনে কিছুই পেলাম না মা,আর কতো কাঁদতে হবে আমাকে বলো?আমার কিছু ভালো লাগছে না মা,আমাকে নিয়ে যাও তুমি তোমার কাছে,এই পৃথিবীতে অনেক কষ্ট মা,কেউ নেই আমার যাকে আমি মনের কথা বলবো।”
ছবির মানুষটি কোনো জবাব দিতে পারে না,চন্দ্রর মনে হয় মা যেনো অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চন্দ্রর দিকে।
মায়ের ছবি রেখে দিয়ে ফুলগাছের দিকে নজর দেয় চন্দ্র,আপাতত মন ভালো রাখতে হলে অন্য কাজে ব্যস্ত হতে হবে।
★
আজ রাত্রি গায়ে হলুদ,সন্ধ্যা হতেই চন্দ্র,রাত্রি,সুরমা,রাত্রির বান্ধবী,চন্দ্রর বান্ধবী,কাজিনরা মিলে পার্লারের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
হলুদ শাড়ি পরে,আর্টিফিশিয়াল ফ্লাওয়ার দিয়ে সেজে উঠে সবাই,মেকাপের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে সবার আসল চেহারা।
চন্দ্র বসে বসে তামাশা দেখছে।বুঝতে পারছে না চন্দ্র,হলুদ হবে রাত্রির,বাকিরা এতো সাজছে কেনো!
রাত্রির চাপাচাপিতে চন্দ্রকে পার্লারে আসতে হয়েছে।রাত্রির সাজ সুন্দর হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য।
প্রত্যেকে ঘষামাজা করে নিজের রূপ বদলে ফেলেছে,কেমন প্রাণবন্ত,উচ্ছ্বসিত লাগছে সবাইকে।
সবার চাইতে বেশী একসাইডেট দেখাচ্ছে মারিয়া কে।
সিমি,মারিয়া,লিপি,ইতু নিজেদের সাজগোজ শেষ করে চন্দ্রর কাছে এসে বসে।
“দেখ তো চন্দ্র,আমাকে কেমন লাগছে?”
মারিয়ার প্রশ্ন শুনে চন্দ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে মারিয়া কে,তারপর বলে,”তোকে শ্যাওড়া গাছের সেই শাকচুন্নীর মতো লাগছে,এখন শুধু তোর নাকি সুরে কথা বলা বাকি আছে”
চন্দ্রর কথা শুনে সবাই হেসে উঠে।
“শুন,শাকচুন্নীর মতো লাগুক আর যেমনই লাগুক,নিজের বিয়েতে তো আর গায়ে হলুদ হবে না,তাই রাত্রিপুর হলুদে শখ মিটিয়ে নিচ্ছি সেজেগুজে।”
“ওয়েট,ওয়েট,ওয়েট মারিয়া।কি বললি তুই সবে মাত্র?
তোর বিয়েতে গায়ে হলুদ হবে না?
হোয়াট দ্যা ফুসকা?
তোর বিয়ে কয়বার হবে,একবার তো হলোই।”
সিমির কথা শুনে মারিয়া আবার ও হেসে দেয়।তারপর বলে,”ওটা কি বিয়ে না-কি?
ওটা একটা এক্সিডেন্ট জাস্ট,আমি তো শাহেদ কে ডিভোর্স দিবো,বিয়ে হবে নিষাদের সাথে,কোনো আয়োজন ছাড়াই বিয়ে হবে কাজী অফিসে গিয়ে যেমন টা হতে গিয়ে ও হয় নি সেদিন”
মারিয়ার কথা শুনে চন্দ্রর বুক কেঁপে উঠে,তবুও তাকায় না মারিয়ার দিকে,চন্দ্রর ভয় হয় তাকালেই মারিয়া বুঝে যাবে চন্দ্রকেই বিয়ে করেছে নিষাদ।
“পাগলের সুখ মনে মনে,দিনদুপুরে তারা গুনে, তোর ও তেমন অবস্থা,নিষাদ ভাই তোকে বিয়ে করতে বসে আছে যেনো?
এসব দিবা স্বপ্ন বাদ দিয়ে নিজের জামাইয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা কর,নিষাদ ভাই এখন বিবাহিত।”
ইতুর কথা শুনে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় মারিয়া ইতুর দিকে,তারপর বলে,”শুন ইতু,নিষাদ আমাকে কতোটা ভালোবাসে তা অন্তত তোরা ৪জন ভালো করে জানিস,আমি বললে নিষাদ এখনই তার বউকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে।এরকম হাজারটা ডিভোর্স দিতে পারে নিষাদ মারিয়ার জন্য,নিষাদের সাথে আমার দুপুরেও কথা হয়েছে । আমাদের সব সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে।”
কথাটা শেষ করে মারিয়া ৪ বান্ধবীর দিকে তাকায়।সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে শুনছে।
চন্দ্র বুঝতে পারছে না তার কেমন লাগছে।তার তো খুশী হওয়ার কথা এখন,নিষাদ যদি মারিয়া কে বিয়ে করে তবে তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে।চন্দ্রকে স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে হলো না,কেউ জানবে ও না এই দুর্ঘটনার কথা,চন্দ্রকে মানসিকভাবে এরকম কষ্ট পেতেও হবে না,সারাদিন ভয়ে ও থাকতে হবে না ”
কিন্তু তবুও কেনো চন্দ্র খুশি হতে পারছে না!
সে-তো এরকমই চেয়েছিলো,নিষাদ মারিয়ার,সেটা তো জানা কথা-ই তবু কেনো মন মানতে চাচ্ছে না?
ছিঃ
এতো বেহায়া মন কেনো আমার?
আমাকে তো সে ভালোবেসে বিয়ে করে নি তবে কেনো মনের মধ্যে তার জন্য দুর্বলতা রয়েছে।
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে চন্দ্র কিন্তু উত্তর পায় না।
সেদিন ফুল পাঠানোর পরেও তো চন্দ্র মনে মনে নিষাদ কে অনেক গালাগাল দিয়েছে,তবে আজ মারিয়ার থেকে এসব শোনার পর কেনো মেনে নিতে পারছে না চন্দ্র?
আর ভাবতে পারছে না চন্দ্র,নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
চন্দ্র নিজেই বুঝতে পারছে না চন্দ্র কি চায় আসলে।
আপার বিয়ের পরপরই সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে হবে,নয়তো আমি পাগল হয়ে যাবো খুব শীঘ্রই। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় চন্দ্র।
সাইক্রিয়াটিস্টের কথা ভাবতেই চন্দ্রর মিসির আলির কথা মনে পড়ে। যদি সত্যি মিসির আলি থাকতো তবে চন্দ্র মাঝরাতে তার বাসায় চলে যেতো।
কল্পনায় চন্দ্র দেখতে পায়,রাতের ১টা বাজে চন্দ্র মিসির আলির বাসায় গিয়ে কলিং বেল টিপছে।মিসির আলি নিজে উঠে দরজা খুলে দিলেন।
বাহিরে জোর বৃষ্টি নেমেছে,চন্দ্র খানিকটা ভিজে গেছে।
এতোরাতে এরকম রূপবতী একটা মেয়ে বাসায় এসেছে,মিসির আলির মাঝে কোনো চিন্তার চাপ নেই,যেনো তিনি জানতেন চন্দ্র আসবে।
চন্দ্র সোফায় বসতে বসতে বললো,”স্যার বাহিরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে,এই বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি হলে ভীষণ ভালো হতো,খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা,সাথে ঝুরিঝুরি করে আলু ভাজা।”
মিসির আলি জবাব দিলেন,”এখন তো দিন না,রাত।তুমি যদি রান্না করতে পারো তো করো,জসু ঘুমাচ্ছে ওকে এখন ডাকা যাবে না।
খিচুড়ি বসানোর আগে আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দিও,তারপর খিচুড়ি বসিয়ে দিয়ে তোমার সমস্যার কথা বলবে চন্দ্র”
ভাবতে ভাবতে চন্দ্র খিলখিল করে হেসে উঠে।
সিমি,ইতু,লিপি,মারিয়া ভূত দেখার মতো অবাক হয়ে চন্দ্রকে দেখতে লাগে,আশেপাশের সবাই চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে থাকে।
চন্দ্র অপ্রকৃতস্থর মতো হেসেই যাচ্ছে।
চন্দ্রর হাসি থামছে না কিছুতে,রাত্রি এসে চন্দ্রকে ডাকছে,কিন্তু চন্দ্র হেসেই যাচ্ছে।রাত্রির ভয় হতে লাগে।চন্দ্র এরকম অস্বাভাবিক আচরণ করছে কেনো?
হাসার পর চন্দ্র কান্না শুরু করে,কাঁদতে কাঁদতে সেন্সলেস হয়ে পড়ে যায়।
হঠাৎ করে এতোকিছু হয়ে গেলো যে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো,চন্দ্র ফ্লোরে পড়ে গেছে কেউ যেনো দেখেই নি।
সবার আগে মারিয়ার খেয়াল হয় চন্দ্র অজ্ঞান হয়ে গেছে,মারিয়ার চিৎকারে সবার খেয়াল হয়।রাত্রি আমির কে,নিশান কে কল দিয়ে জানায় চন্দ্রর কথা।
আমির ছাদে স্টেজ সাজাচ্ছে,রাত্রির কল পেয়ে দৌড়ে নেমে আসে। লিফটে উঠতেই আমিরের মনে হয়, লিফট যেনো আজকে খুব দেরি করছে নিচে নামতে।
নিশান হলুদের অনুষ্ঠান ফেলে রেখে বাইক নিয়ে বের হয়ে যায়।সারা মুখে হলুদ মাখা,মুখ ধোঁয়ার কথা ও মনে থাকে না নিশানের।
চলবে….???