নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা ||শেষ পর্ব||

#নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||শেষ পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিবেদিতা মাথা নত করে ফেলে। মালিহার কথা যে মিথ্যে নয়। সে সত্যিই আভাস করতে পারে আবরাহামের অনুভূতি অনেকটাই।

ফোঁস করে এক শ্বাস ফেলে শক্ত চোখে তাকায় মালিহার দিকে।
“হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারি আবরাহামের অনুভূতি। না বুঝার স্থান নেই। সব জেনেও আমি চুপ থাকি। কেন থাকবো না? সারাটা সময় আমি পুড়ি, এই মানুষটার সাথে থেকে যদি ক্ষণিকের স্বস্তি পাই এসব থেকে ক্ষতি কী? তুই তো কবিরকে নিয়ে ব্যস্ত, কিছুদিন পর তোদের বিয়ে, বাবা-মা এমনিতেই চিন্তিত, আর সবকিছু তো তাদের বলাও যায় না।

সারাদিন আমার বিভীষিকাময়, বিষাদময় কাটে। অফিসে থাকলে কাজের চাপ, বাসায় গেলে দাদীর চাপা গালাগাল, ঘুমাতে গেলে আরাধ্যের স্মৃতি পোড়ায় আর ভাবায় আমি কি ঠিক করছি না কি আত্মসম্মান চুলোয় দিয়ে আরাধ্যের কাছে ফিরা যাওয়া উচিত। তুই বুঝিস কতোটা লাগে?

মনে হয় মরে যাই। তুই জানিস এই অবধি আমি কয়বার সুইসাইড করতে যেয়েও ফিরে এসেছি? না, জানিস না। তুই তোর জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আমি কিন্তু তোকে সত্যিই দোষারোপ করছি না। আমি জানি তোর নিজের একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে, আমি বুঝি। তাই আমি তোর নিকট যাইও না নিজের সমস্যার ঝুলি নিয়ে।

আমি শুধু নিজের অবস্থা জাহির করছি। আমার একটু স্বস্তি চাই, একটু ভালো সময় কাটাতে চাই, ভালো সঙ্গ চাই। ক্ষতি কী আবরাহামের থেকে তা পেলে? আর আবরাহামের অনুভূতির আভাস পাই আমি, বাস্তবতা তো জানি না। সে তো বলেনি সে আমায় পছন্দ করে বা ভালোবাসে। বললে আমি অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতাম।

তার তরফ থেকে যা-ই হোক, আমার তরফ থেকে শুধুই বন্ধুত্ব। তার সাথে ঘুরতে গেলে বা কথা বললে আমি আমার এই যন্ত্রণাদায়ক জীবন থেকে একটু বিরতি পাই, একটু শান্তি পাই। যা আমার দরকার বর্তমানে। এর জন্য যদি আমি স্বার্থপর হই, ইট’স ফাইন। আই ডোন্ট কেয়ার। ভালো থাকার অধিকারী আমিও।”

মালিহা শোকাহত হয় নিবেদিতার কথা শুনে। কারণ বাস্তবতা এটাই এই ক’টা দিন সে নিজেও স্বার্থপর হয়ে উঠেছিল। নিজের বিয়ের পরিকল্পনা নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে নিবেদিতার মন্দ অবস্থার কথা ভুলেই বসেছিল।

নিজেকে সামলে রেখে সে আরেকদফা প্রশ্ন করে,
“এগুলো ভিত্তিহীন কথাবার্তা। তুই আরাধ্যকে তালাক দিবি, তোর জীবনটা কি এমন ভাবেই পড়ে থাকবে? আবরাহাম স্যারকে জীবনে জড়াতে সমস্যা কোথায়?”

“আরাধ্য ভুল করেছে, আমি জানি। কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসি, আমার পক্ষে ওর জায়গা কাউকে দেওয়া সম্ভব নয়। আবরাহাম কেউ নয়। এট লিস্ট এই ক্ষণে তো আমার তা মনেই হচ্ছে না। আমি…”

বলতে বলতেই নিবেদিতার চোখের সম্মুখে অন্ধকার ছেয়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে চেয়ারেই গা এলিয়ে ফেলে সে।

মালিহা আঁতকে উঠে। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে উত্তেজিত ভঙ্গিমায় ডাকতে শুরু করে,
“নিবেদিতা! নিবেদিতা! বোন আমার উঠ! কী হলো তোর হঠাৎ করে! নিবেদিতা! হেল্প! হেল্প! কে কোথায় আছো তাড়াতাড়ি আসো!”

নিবেদিতার কক্ষ থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে আবরাহাম সহ অন্যান্য কর্মচারীরা আসে। আবরাহাম তো নিবেদিতাকে অজ্ঞান দেখে ত্রাসিত হয়ে পড়ে। তাড়াতাড়ি নিবেদিতাকে কোলে তুলে মালিহাকে নিয়ে নিজের ফ্যামিলির ডক্টোরের উদ্দেশ্যে।

ডাক্তার নাদিম চেকআপ করে বলেন,
“তেমন বিশেষ কিছু তো মনে হচ্ছে না। দুর্বলতা ও স্ট্রেসের জন্য জ্ঞান হারিয়েছে। একটু পরই জ্ঞান ফিরে যাবে। স্যালাইন দিয়েছি আমি। রাত পর্যন্ত হয়তো থাকা লাগবে। একটু বাদেই জ্ঞান ফিরে যাবে।”

“ডক্টোর, কিন্তু ও এ নিয়ে এই মাসেই দু’বার জ্ঞান হারালো। কোনো সমস্যা না কি আবার?” মালিহা জানায়।

“স্ট্রেঞ্জ। আচ্ছা, আমি কিছু পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছি। রিপোর্ট আসলে জানাচ্ছি।”

“থ্যাংক ইউ আঙ্কেল।”

ডাক্তার নাদিম চলে যান। আরাধ্য ও মালিহা নিবেদিতাকে রাখা কেবিনেই বসে থাকে। নিবেদিতার জ্ঞান ফিরেছে। তবে স্যালাইন চলছে বলে অনেক বলার পরও তাকে ছাড়া হয় না।

প্রায় ঘণ্টা খাণেক পর একজন নার্স এসে জানান,
“আপনাদের নাদিম স্যার ডেকেছেন। উনার কেবিনে যেতে বলেছেন।”

নার্সকে নিবেদিতার পাশে রেখে মালিহা ও আবরাহাম যায় ডাক্তারের কেবিনে। তারা ভিতরে ঢুকতেই ডাক্তার নাদিম বলে উঠেন,
“অভিনন্দন আবরাহাম, তোমাদের পেশেন্ট তো মা হতে চলেছে। ষষ্ঠ সপ্তাহ চলছে প্রেগ্ন্যাসির।”

মালিহা ও আবরাহাম দুজনেই স্তব্ধ। আবরাহামের মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়েছে। তার ভালোবাসার নৌকা যে পাড়ে আসার আগেই ডুবে যাচ্ছে। মালিহা ভিতরে ভিতরে খুশি হলেও আরাধ্য ও নিবেদিতার সম্পর্কের দশা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় খুশি হতে পারলো না।

রিপোর্ট নিয়ে আবরাহাম ও মালিহা নিবেদিতার কাছে আসতেই সে জিজ্ঞেস করে,
“কী হলো কী রিপোর্ট এসেছে? আপনাদের কেমন যেন শকড্ শকড্ দেখাচ্ছে। বড়ো কোনো রোগ হয়েছে না কি আমার?”

“তুই প্রেগন্যান্ট।” এক নিঃশ্বাসে জবাব দিল মালিহা।

“হোয়াট? আমি প্রেগন্যান্ট?” খুশির আভা দেখা দেয় নিবেদিতার চোখে-মুখে। পরক্ষণেই চিন্তিত হয়ে পড়ে। মনে পড়ে যায় নিজের পরিস্থিতির কথা।

মালিহা বুঝতে পেরে নিবেদিতা হাত দু’হাতে চেপে ধরে শুধায়,
“চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ ভরসা।”

চোখ থেকে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে রমণীর।
“আমি কী করবো দোস্ত? একদিকে আমার বাচ্চা আর আরাধ্যের আকুতি, অপরদিকে আমার আত্মসম্মানবোধ, যন্ত্রণা ও তালাক নেওয়ার সিদ্ধান্ত। আমার বাচ্চাটা বাবা ছাড়া বড়ো হবে না কি আমাকে অসম্মানিত হতে দেখে বড়ো হবে, এই চিন্তাই আমাকে খেয়ে ফেলছে এখন।”

এই রমণীর দুঃখমোচন কী করে করবে জানা নেই মালিহার। সে শুধুই মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

আবরাহাম নিবেদিতার পাশে এসে বসে।
“আমি ছোটো থাকতে মম-ড্যাডের তালাক হয়। আইন অনুযায়ী আমি মমের সাথে বিদেশ চলে যাই। মমের নতুন বয়ফ্রেন্ড আমাকে খুব আদর করতো, একদম ড্যাডের মতো, হয়তো ড্যাডের চেয়েও বেশি। কিন্তু বিয়ের কয়েকদিম পেড়িয়ে যেতেই বুঝতে পারলাম সবই ছিল লোক দেখানো। হি ইউসড টু টর্চার মি সো হার্ড।

ছোটো থেকে ছোটো ভুলে বেল্ট দিয়ে পেটানো থেকে শুরু করে গরম ইস্ত্রি হাতে রাখা অবধি। প্রথম প্রথম মম বুঝতে পারতো না। পরে একদিন বুঝতে পেরে খুব কথা কাটাকাটি হয় সেই লোকটার সাথে। তিনি এতোই মমতাময়ী মা ছিলেন সংসার বাঁচাতে আমায় বাবার কাছে পাঠিয়ে দেন। তারপরও সংসার টিকেনি, লোকটা তাকে ছেড়ে দেয়।

আমার পরের কথাটা কেমন লাগবে তোমার জানি না। হয়তো খারাপই লাগবে। তবে আমি বলবো নিজের সম্পর্ককে একটা সুযোগ দাও। নিজের বাচ্চার জন্যই বাস্তবতা এটাই তোমার সন্তানকে কেউ নিজের সন্তানের মতোন দেখবে না। যদি দেখেও থাকে, তবে তা শুধুই লোক দেখানো। সামনে মুখোশ খোলা বাকি। আমি এই বিষয়ে নিজেকেও বিশ্বাস করি না, হয়তো আমিও বদলে যাবো। আমার মতো কষ্ট তোমার সন্তানকে পেতে দিয়ো না। ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হওয়া খুবই কষ্টের। যদি আরাধ্য সত্যিই অনুতপ্ত হয়ে থাকে, তবে প্লিজ তাকে শেষবারের মতোন একটা সুযোগ দিয়ো।”

কথাগুলো বলে আবরাহাম কেবিন ছেড়ে বের হয়ে গেল। নিবেদিতাকে আসলেই অনেকটা ভাবালো আরাধ্যের কথাগুলো।

যেহেতু বেশ রাত পর্যন্ত নিবেদিতাকে হাসপাতালে থাকতে হবে। তাই নিবেদিতার অজান্তেই তার বাবা-মাকে কল করে জানায় সে বিষয়টি।

রোদ্দুর সোহরাব ও নাদিয়া খানোমের মাথায় যেন বাজ পড়ে। সেখানে উপস্থিত আরাধ্য আতঙ্কিত। সে এতদিন অনুতাপের আগুন্দ পুড়ে ছাই হয়ে ক্ষমা চাইতে এসেছিল। সবাই আরাধ্যের গাড়িতে চড়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

আরাধ্য উদ্বিগ্ন কণ্ঠে নিবেদিতার মাথা বুকে মিশিয়ে শুধায়,
“নিবেদিতা তুমি ঠিক আছো তো? নিজের একদম খেয়াল রাখো না তুমি। আমি জানি আমি ভুল করেছি, তোমায় কষ্ট দিয়েছি যেভাবে বাবা দিতো মাকে। আমি সরি। আমার ভুলের মাশুল তুমি দিয়ো না প্লিজ। তুমি নিজের খেয়াল রাখো। তোমার কিছু হলে তো পাগল হয়ে যাবো আমি।”

আজ প্রথম নিবেদিতার আরাধ্যের কণ্ঠে অনুতাপের স্পর্শ বোধ হচ্ছে। তবে কোথাও একটা ভয় সত্যিই কি তা হচ্ছে না কি সবটাই ভ্রান্তি? কারণ আগে তো বহুবার এই মানুষটার মায়াবী মুখশ্রী দেখে মিথ্যেকে সত্য ভেবেছে সে।

সে কোনো কিছু না ভেবে-চিন্তেই আরাধ্যের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে উঠে,
“আমি প্রেগন্যান্ট। তুমি বাবা হতে চলেছো আরাধ্য।”

আরাধ্য তো বেজায় খুশি। নিজের উৎফুল্লতা প্রকাশ করার ভাষা পাচ্ছে না সে৷ এতোটাই আনন্দিত সে, যে তার বিশ্বাসই হচ্ছে না এই সুসংবাদটি সত্য।

যুবক ঠিক-বেঠিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে কেবিন ভর্তি গুরুজনদের সম্মুখেই প্রেয়সীর গোটা মুখশ্রী চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। নিবেদিতা একহাত দিয়ে অনবরত ধাক্কা দিচ্ছে যুবককে। কিন্তু হায় অসুস্থতা! গায়ে জোর নেই, ধাক্কাটা বাতাস হয়েই বিফলে যাচ্ছে।

লজ্জায় মাথা নত করে ফেলেন মোকশেদা বেগম, নাদিয়া খানোম ও রোদ্দুর সোহরাব। শান্ত ও মালিহা মুখ চেপে মিটিমিটি হাসছেন।

আরাধ্য, মোকশেদা বেগম ও নাদিয়া খানোম কেবিন থেকে বের হলে ফাঁকা পেয়ে মেয়ের পাশে বসেন রোদ্দুর সোহরাব। নিবেদিতা চোখ বুজে শুয়ে তখন। তার মাথায় হাজারো দুশ্চিন্তা কাজ করছে।

“তোর মনে এখন শত দ্বিধা তাই না রে মা?”

নিবেদিতা কিছুই লুকায় না। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়।
“বাবা আমি তো সিঙ্গেল মাদার হয়েও বাচ্চাটাকে বড় করতে পারি। আরাধ্যের কাছে ফিরা কি জরুরি?”

“শোন মা, তুই এখন তালাক নিতেই পারিস। তবে তোর চিন্তা-ভাবনা ভুল, সিঙ্গেল মাদার হওয়া এতো সহজ না। এখন বয়স কম, যৌবন ফুড়ায়নি, মনের আবেগ কমেনি, না উঠে গেছে ভালোবাসা থেকে বিশ্বাস। কেউই একা বাঁচতে পারে না, সবার সঙ্গী চাই। ভালো আর না বাসলেও প্রেমে কিন্তু ঠিকই পড়বি আবার তালাকের পর, হয়তো সংসারও হবে। কিন্তু কী হবে না জানিস? তোর সন্তানের একটা বাবা পাওয়া হবে না। কারণ এক গাছের বীজ কোনোদিনই আরেক গাছের চাড়া হয় না। আর না এক গাছের ডাল আরেক গাছে লাগে। আর ছেলেটা আসলেই অনুতপ্ত। অনেক কেঁদেছে বাড়িতে এসেছে তোর জন্য। এখন সুযোগ দিবি কি না তোর বিষয়।”

অবশেষে নিবেদিতাকে রিলিজ করা হয়। আরাধ্যের মা প্রস্তাব রাখে তাদের সাথে ফিরার।

“না, মা। দুঃখিত, আমি কিছুই এখনও ভুলিনি। আমি তার সাথে যেতে পারবো না। আমি নিজ বাড়িতেই ফিরবো, তবে কেউ চাইলে আমার সাথে থাকতে পারে।”

নিবেদিতার ঈঙ্গিত আর কারো বুঝতে বাকি রয় না। সেদিন মোকশেদা বেগম ও আরাধ্য চলেন রোদ্দুর সোহরাবের বাড়িতেই। যদিও আরাধ্য নিবেদিতার রুমে জায়গা পায়নি রাতে, ড্রইংরুমেই শুতে হয়।

___

আবরাহামের ব্যথিত হৃদয়। ক্লাবে যেয়ে গোগ্রাসে মদ গিলে সে। নেশায় বুদ হয়ে বাড়ি ফিরে। নিজের রুমে ঢুকে দেখতে পায় এক শাড়ি পরা রমণী তার ঘরে ঘুরঘুর করছে। আবরাহাম নেশাগ্রস্ত চোখে নিবেদিতাকেই যেন দেখছে সেই নারীর মাঝে।

কিছু না ভেবেই সে জড়িয়ে ধরে সেই নারীকে। আবরাহামের আকস্মাৎ স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠে সুখ। তার থেকে আসা অন্যরকম গন্ধে গা গুলিয়ে আসে কিশোরীর। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে।

সুখ এসেছিল আবরাহামের জন্য নিজ হাতে তার প্রিয় চিজ কেক বানিয়ে। এই কয়েকদিনে আবরাহামের সাথে বন্ধুত্ব বেশ গাঢ় হয়েছে তার। যখন তখন তার বাড়িতে এসে পড়ে, বিশেষ করে রাতে। মা-বাবা তার প্রতি উদাসীন থাকায় এদিকটায় বেশ ভালোই লাভ হয়েছে তার।

সুখ যতো নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে ততোই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে তাকে আবরাহাম। বিড়বিড়াচ্ছে,
“চলেই যখন যাবে কেন এলে জীবনে? কেন-ই বা সারা দুনিয়ার নারী ছেড়ে প্রেমে পড়লাম এক বিবাহিত মেয়ের? আমাকে প্লিজ ছেড়ে যেয়ো না নিবেদিতা, প্লিজ ছেড়ে যেয়ো না নিবেদিতা। আমাকে নিজের করে নেও। একান্ত নিজের।”

‘নিবেদিতা’ নামটি শ্রবণগত হতেই দেহে শীতল শিহরণ বয়ে যায় সুখের। তবে কি সে হারিয়ে ফেলবে আবরাহামকে?

মনে মনে বলে,
“আপনাকে যেকোনো মূল্যে আমার চাই। আপনার থেকে আপনার ভালোবাসা ছিনিয়ে হলেও মিস্টার আবরাহাম।”

আর কোনো বাধা দেয় না সুখ আবরাহামকে। কাছে আসার চেষ্টা করে বটে। সে জানে এই যুবক কখনোই এই ভুল সম্পাদনের পর তাকে একা ছাড়বে না। অতঃপর এক হেমলকের মতোন মোহনীয় তবে বিষাক্ত রাত কাটে আবরাহাম ও সুখের।

ভোরবেলা একফালি আলোর আগমণে ঘুম ভাঙে আরাধ্যের। বহুদিন পর এতো ড্রিংক করায় তার মাথা ধরে গিয়েছে পুরোপুরি। নিজের পাশে তাকাতেই সুখকে চাদর জড়ানো দশায় আবিষ্কার করে। সে প্রথমে চমকিত হলেও পরক্ষণেই আবছা আবছা মনে পড়ে যায় রাতের ঘটনা।

নিজের কর্মে নিজেই অনুতপ্ত হয়। আক্রোশে বেডের সাইড টেবিলে থাকা ল্যাম্পটা মেঝেতে আছাড় দিয়ে “ড্যাম ইট” বলে চেঁচিয়ে উঠে।

ঘুম ভেঙে যায় সুখের। সে আবরাহামের রক্তচক্ষু ও রাগ দেখে নিজেও ভয় পেয়ে যায়। গা ঢেকে গুটিসুটি দিয়ে বসে কাঁদতে কাঁদতে শুধায়,
“আমি সরি আবরাহাম। বিশ্বাস করেন আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু আপনাকে আটকাতে পারিনি। আমি তো নিজে কলঙ্কিনী হলামই নিজের বাবা-মায়ের মতোন, আপনাকেও কলঙ্কিত করলাম। এখন সমাজ আমায় আরও ঘৃণ্য দৃষ্টিতে দেখবে, দুশ্চরিত্রা মেয়ের সাথে দুশ্চরিত্রাও বলবে।”

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে সুখ। কাঁদতে কাঁদতে শ্বাসরোধ হওয়ার উপক্রম। আবরাহামের খারাপ লাগে। খুব বড়ো একখান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে।

“কেউ তোমাকে খারাপ বলবে। আমাদের আজ এই ঘরে বিয়ে হবে। তুমি প্লিজ শান্ত হও। আর আমাকে ক্ষমা কোরো নিজের কুকর্মের জন্য।”

আবরাহাম সুখকে বিছানায় শুয়িয়ে নিজে ওয়াশরুমে চলে যায় জামা-কাপড় নিয়ে। সে চলে যেতেই সুখের মুখশ্রীতে কান্নামাখা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে। বিড়বিড়ায়,
“লাভ ইজ আ গেম, উই নিড টু উইন ইট এট এনি কস্ট।”

সুখের স্বপ্ন পূরণ করে সেদিনই বিয়ে হয়ে যায় আবরাহাম ও সুখের। হয়তো সব শেষে জীবনের এই অধ্যায়ে দুঃখমাখা সুখ থেকে সুখিনী হয়ে উঠবে।

___

আরাধ্য সকালে ঘুম থেকে উঠে বেডের বামসাইড খালি পায়। কেমন যেন শূণ্যতা বোধ হয় তার। তবুও চিন্তা হয় না তার। কারণ প্রেগন্যান্সির খবর জানার পরবর্তী এই একমাসে নিবেদিতা উদাসীন থাকলেও তার প্রতি রাগও দেখায়নি, বরং আগের মতোই সংসার করেছে।

এর মানে তার নিকট নিবেদিতা নিশ্চয়ই তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। কিন্তু সারা ঘর খুঁজেও যখন নিবেদিতাকে না পায় তখন তার দুশ্চিন্তা হতে শুরু করে। এমন সময় সেই প্রথমবারের মতোন একই স্থানে একই ধরনের চিরকুট চোখে পড়ে।

বিচলিত হয় সে। দ্রুতো যেয়ে চিরকুটটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে।

‘প্রিয় আরাধ্য,
তুমি এই একটা মাস আমায় যেমন ভাবে চেয়েছিলাম তেমন ভাবেই ট্রিট করেছে। এবার তোমাকে রাজা বানিয়ে আমি চাকরানী নয় রাজরানীই হয়েছি। সবই ঠিক চলছে, তবুও আমি তোমায় পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি যে বারবার মিথ্যে ক্ষমা দেখিয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিলে। মনে হচ্ছে বাচ্চাট হলেই তুমি আবার বদলে যাবে, সবটাই অভিনয় আমাকে ফিরে পেতে। তাই তোমার ভালোবাসার একটা পরীক্ষা নিতে চাই। আমি দূরে চলে যাচ্ছি, বিলিন হয়ে যাচ্ছি তোমার শহর থেকে। ফিরে আসবো, কিন্তু কোন বছরে ফিরবো তার ঠিক-ঠিকানা নেই। দেখি তোমার ভালোবাসার গভীরত্ব কতটুকু? কতটুকু অপেক্ষা করতে পারো আমায় নিয়ে। কত জোর তোমার নিবেদিত প্রেম আরাধনায়।
ইতি,
নিবেদিতা’

আরাধ্যের মুখে চিন্তার জায়গায় হাসি খেলা করে। আনমনেই শুধায়,
“তোমার জন্য তো আমি মৃত্যুর আগ অবধি অপেক্ষা করতে প্রস্তুত। এ আর এমন কী? আমার নিবেদিতাল প্রেম আরাধনা ভাঙা এত সহজ নয় প্রিয়তমা।”

এদিকে কক্সবাজারের উত্তাল ঢেউয়ের পা ভিজিয়ে হাঁটছে নিবেদিতা। তার মুখে শান্তির হাসি।

সমুদ্রের উথালপাতাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে সে শুধায়,
“তিনমাস পরই ফিরে যাবো তোমার নিকট আরাধ্য এই ডিলটা কমপ্লিট করে। তুমি চিন্তায় চিন্তায় শেষ হবে, ধৈর্য্য খুয়াবে। এই তিন মাসে তুমি যদি খোলস পড়ে থাকো তা অনেকটাই ভাঙবে, আর এরপরের দুই মাস তোমার সাথে থেকে পর্যবেক্ষণ করবো। যদি মনে হয় তুমি সত্যিই বদলেছে, তাহলে তো হলো। আর তা নাহলে আমাদের পথ ভিন্ন। আর তোমার দিকে নজর রাখার জন্য তো মালিহা আছেই। মালিহা আর আবরাহাম স্যার ছাড়া কেউ জানে না আমি কোথায়। তবে আমার মন বলছে তুমি আমারই থাকবে, আমার সাথে থাকবে আমার চিরচেনা আরাধ্য হয়ে।”

নিবেদিতা আর আট-দশটা নারীর মতো মোটেও আবেগে ভেসে সব ভুলে যাওয়া বা মান-অভিমানে অন্ধ হওয়া কোনো নারী নয়। ভীষণ বিচক্ষণ বটে। আরাধ্য এই একমাস তাকে স্বপ্নের মতোন রেখেছে। তবে এই আচারণের সত্যতা কতোটুকু তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মোটেও চায় না আরাধ্য ভাবুক সন্তানের জন্য দুর্বল হয়ে ফিরে এসেছে সে। আবার এটাও চায় না তার সন্তান পিতৃহারা হয়ে বড়ো হোক।

তাই এই ব্যবস্থা নিয়েছে। কারণ সে জানে যে মানুষটা অপেক্ষা করার সে সারাজীবনই করবে, আর যে করার নয় সে এক সপ্তাহতেই ক্লান্ত হয়ে যাবে। ভাববে তার আর আসার নয়, নতুন মানুষ খোঁজার সময়। তাছাড়া আরাধ্য অভিনয় করে থাকলেও তা আর ধরে রাখতে পারবে না। অভিনয় তো।মানুষ সকল হালে করতে পারে না।

তাছাড়া রমণীর নিজেকেও কিছুটা প্রস্তুত করা প্রয়োজন। এভাবে সে নিজেও কিছুটা সময় একাকি কাটিয়ে, উপভোগ করে ফিরে যেয়ে নিজের সম্পর্ককে গড়ে তুলতে পারবে।

___

নিবেদিতার ডেলিভারি আজ। অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে অপেক্ষা করছে সবাই। আরাধ্য তো নিবেদিতার চিন্তায় গোটা করিডোরে পায়চারী করছে। অবশেষে অপেক্ষার অবশান ঘটিয়ে নার্স একজন অনিন্দ্য মায়াবী শিশুকে নিয়ে বের হলো। ছেলে হয়েছে নিবেদিতার।

আরাধ্য অনতিবিলম্বে আজান দিল ছেলের কানে। দাদী, নানা ও নানী ব্যস্ত হয়ে পড়লো নাতির আগমনে সুসংবাদ বিলানোতে।

নিবেদিতার কেবিনে দেওয়া হলে আরাধ্যকে ছেলে সহ একাই পাঠান গুরুজনেরা। নিবেদিতা ক্লান্ত মুখখানা হাজারো চুমু খায় আরাধ্য। নিবেদিতাও আনন্দে কাঁদছে।

আরাধ্য ছেলেকে নিবেদিতার কোলে দিয়ে তার কানে কানে ফিসফিসায়,
“আমাদের নিবেদিত প্রেম আরাধনার প্রতীক।”

__সমাপ্ত__

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here