নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা ||৭ম পর্ব||

#নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||৭ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিবেদিতা ফ্লাইটে বসে আছে, তার মুখশ্রী ম্লান। পাশে জানালার সাথে গা ঠেকিয়ে বসে আছে মালিহা। তার চোখ-মুখ বিক্ষুব্ধ। রাগে ফোঁপাচ্ছে সে।

মিনমিনে সুরে শুধায় সে,
“আমি তোকে আগেই বলেছিলাম ঐ নমুনা রে একটুও সুবিধার লাগে না। হুদ্দা সেলফ্ সেন্টার্ড একটা পোলা! তাও তুমি মিঠা কথায় চিড়া ভিজায় ফেলসো! এখন ভুগো! তোকে ওর ফ্রাস্টেশন, রাগ বের করার গোলাম পাইসে ও।”

“হয়তো আমারই ভুল ছিল। মানুষটিকে ভুল চিনেছি।”
নিবেদিতার চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

“এখন কাঁদিস না পাখি। ল্যান্ড করে নেই, এই ছেলে রে এবার শায়েস্তা করে ছাড়বো। তুই আমার কথা শুনলে এমন হতো না। দেখিস না আমার কালাচাঁদটা আমাকে কত ভালোবাসে, সমীহা করে। ছেলেদের ইগো এমনিতেই বেশি থাকে, তার উপর সুন্দর আর সাক্সেসফুল হইলে তো কাউ রে চিনেই না।”

“কোনো শায়েস্তা করা লাগবে না। আমি ওর সাথে থাকতে চাই না। ট্রিপ থেকে এসেই বাবার সাথে কথা বলবো।

কেনোনা, যেসব জিনিস ক্ষণিকের স্বস্তি দিয়ে সারা বছর অন্তর পুড়ায়, তাদের দূরে সরানোই উচিত। তা ভালোবাসাই হোক না কেন।”

নিবেদিতা ও মালিহা বিজনেস ট্রিপের জন্য আবরাহামের সাথে কক্সবাজারে যাচ্ছে। এয়ারপোর্টেই ব্যাগপত্র নিয়ে এসেছিল সে। কাল রাতেই আরাধ্যকে ট্রিপের বিষয়ে বলতে, তবে সে-ই সুযোগ দেয়নি। বিনিময়ে এখন বিনাকারণেই দুশ্চিন্তায় ভুগছে সে।

রমণী মনে মনে বলছে,
“তোমার সাথে আমার প্রেমের কথা তো এমনটা ছিল না। কথা ছিল, আমি গৌধূলি শাড়ি-চুড়ি পরে থাকবো, তুমি চা করে আনবে। আমি রিনরিনে কণ্ঠে রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহের কবিতা আবৃতি করবো, আর তুমি তা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখবে। কিন্তু বিয়ের পর হলো কী? তুমি আমার বই পড়াতেই অঘোষিত ভাবে বিরতি লাগালে।

আমার ভাবুক কথাগুলো আগে তোমার মন ভুলাতো, আজ তোমার বিরক্ত লাগে। আগের যে আমিটা তোমায় মোহিত করতো তা-ই এখন বিরক্তির কারণ। তোমার কারণে আমি আমার আমিটাকেই হারিয়ে ফেলেছি আরাধ্য। অথচ, এর বিনিময়ে আমার নিবেদিত প্রেম আরাধক অসফল। তুমি তো আমাকে টাকায় কেনা পুতুল মনে করো, যে তুমি যেভাবে চাবি দিবে সেভাবেই ঘুরবে।”

নিবেদিতা ডুব দেয় অতীতে। সেই আঁধার কালো দিনটিতে যেদিন এই বই পড়ার জন্যই ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছিল তাকে।

অতীত,
বিয়ের তখন সাড়ে ছয়মাস। নিয়মমাফিকই নিবেদিতা বিকেল বেলা বই নিয়ে বসে। কালজয়ী বই ‘দেবদাস’ এর মাঝে ডুবে সে।

একটু বাদেই বেল বেজে উঠে দরজার। মোকশেদা বেগম সেখানে থাকায় আর নিবেদিতা যায় না। একটু বাদেই আরাধ্য ঘরে ঢুকে।

“অফিস কেমন কাটলো আমার প্রিয়তমের?”

বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আলমারি থেকে কাপড়, তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে আরাধ্য। নিবেদতা একটু ব্যথিত হলেও এমন আচারণে, মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করে না। বইয়ে ধ্যান দেয়

আরাধ্য কাপড় মেলে দিতে বারন্দায় গেলে কফি নিয়ে বারান্দায় চলে। এগিয়ে দিয়ে শুধায়,
“কফিটা কিন্তু তোমার দেওয়ার কথা ছিল।”

“আর তোমার সারাদিন বই পড়ার?” ক্ষুব্ধ কণ্ঠ আরাধ্য।

নিবেদিতা অবাক হয়। কিছু বলবে তার আগেই বেল বেজে উঠে। মোকশেদা বেগম চেঁচিয়ে উঠে,
“পার্সেল এসেছে তোদের।”

আরাধ্য ও নিবেদিতা দুজনেই বসার ঘরে যায়। নিবেদিতা দেখে তার অর্ডারকৃত বই দুটো এসেছে। কিন্তু হাতে তার তখন টাকা নেই। অগত্যা আরাধ্যের কাছে টাকা চায় সে।

“তোমার এসব ফালতু খরচের জন্য টাকা নেই আমার। এত কীসের বই, হ্যাঁ? কোথায় আর আট-দশটা বউয়ের মতো ঘরের এই ওই কাজ করবে তা না করে যখনই আসি বই নিয়ে থাকো। যত্তসব বিয়ে করে কপাল পুড়েছে আমার!”

আরাধ্য মুখ ঝামেলা দিয়ে চলে যায়। নিবেদিতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। একজন অপরিচিত মানুষ ও নবপরিচিত মানুষের সামনে এমন আচারণ কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।

নোনাজল টইটম্বুর চোখজোড়া তুলে কুরিয়ারবয়ের দিকে তাকায় সে। ছেলেটা নিজেও লজ্জিত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে। মোকশেদা বেগম নীরবে স্থান ত্যাগ করেছেন আগেই।

“দুঃখিত, ভাইয়া। বইটা আমি নিব না। অর্ডারটা ক্যান্সাল করে দিন।”

সেদিনের পর নিবেদিতা আর কোনোদিন কোনো বই কিনা তো দূরে থাক স্পর্শও করেনি। এমন কী নিজের প্রয়োজনের জন্য কখনো নিজের স্বামী তথা আরাধ্য নামক মানুষের কাছেও চায়নি।

___

আরাধ্য পাগল প্রায় হয়ে বসে আছে ড্রইংরুমে। একের পর এক কল লাগাচ্ছে মালিহাকে, নিবেদিতাকে। কিন্তু ফোন বন্ধ।

“কবির, মেয়েটা কোথায় গেল? এমনেই চুপচাপ৷ কোনো বিপদ-আপদ হলে রক্ষা করবে কে?”

“এতোই যখন টেনশন নিবেদিতার জন্য, তাহলে বারবার ওকে হার্ট করিস কেন?

“আমি কি ইচ্ছে করে করি না কি? আর ও একটু বুঝতে পারে না? সয়ে নিতে পারে না? তুই একটু খোঁজ নে না!”

“ও কেন তোর কথার আঘাত সহ্য করবে? ও কি রোবট? ওর অনুভূতি নেই? হার্ট হয় না? তুই বিয়ে করে যেন বউ নয়, গোলাম এনেছিস। এজন্যই তো ও…”

কবির দাঁতে দাঁত চেপে করে নিজেকে নীরব রাখে। মালিহা হুমকি দিয়ে গিয়েছে সে মুখ খুললে তাকে তালাক দিবে।

“আচ্ছা, আমার কথা শোন। এসব বাদ দিয়ে এখন প্রজেক্টটা শেষ করি দুজন মিলে, নাহলে চাকরি শেষ!”

“এত প্যারা নিয়ে কী করে! আমার বউ ঠিক নাই, আমি কাজে ধ্যান দিব কী করে?”

কবির আরাধ্যকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাজ করতে বসায়। আরাধ্য বাস্তববাদী পুরুষ নিজেও বুঝে ধ্যান দেয়। সে তো জানে মেয়েটা শান্তশিষ্ট হলেও বোকা নয়। নিশ্চয় অযাচিত কোনো নাটকীয় কাজ করবে না।

___

আবরাহামের কেন যেন নিবেদিতার মুখশ্রী দেখতে বারবার ইচ্ছে করছে। এই যুবতী তার ভাবনা জুড়েই বেশ বসবাস থাকে আজকাল। তাছাড়া আজ কেমন মলিনই লাগলো মেয়েটিকে। চোখজোড়ায় কালো সানগ্লাস এঁটে রেখেছে।

যুবক আসন ছেড়ে পিছনের দিকে তথা নিবেদিতা ও মালিহার আসনের দিকে যায়।

“স্যার আপনি?”

মালিহার কণ্ঠস্বর শুনে সচকিত হয়ে টিশ্যু দিয়ে চোখ মুছে পাশে তাকায়।

“তোমাদের অসুবিধা হচ্ছে না কি দেখতে এলাম।”

“না স্যার, কোনো সমস্যা হয়নি। আপনার মতোন বস থাকতে এমপ্লয়িদের সমস্যা হতে পারে না কি?”

হাসে আবরাহাম। তার টোলের দর্শন পায় সকলে। মালিহা মুগ্ধ নজরে তাকায়।

“তোমার হয়তো কোনো সমস্যা বোধ হয়নি। তবে মনে হয় মিস নিবেদিতার খুব অসুবিধা হচ্ছে।”

নিবেদিতা অশ্রু ভেজা কণ্ঠে জবাব দেয়,
“না, না, স্যার কোনো অসুবিধা হয়নি। একটু শরীর খারাপ এই আর কী।”

আবরাহাম বুঝার ভান করে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের সিটের দিকে চলে যায়। যদিও তার চিন্তা-চেতনা নিবেদিতার মাঝেই স্থির।

সে চলে যেতেই মালিহা উৎফুল্ল হয়ে শুধায়,
“দেখেছিস, আবরাহাম স্যার কত্ত ভালা! আর কী কিউট রে দেখতে! পুরো ক্রাশ খাইসি।”

“তুই কাকে দেখলে ক্রাশ না খাস? ক্রাশ তো তোর প্রতিবেলার ভাতের সঙ্গী।”

মুখ চেপে হেসে দেয় নিবেদিতা। মালিহা তার দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কাটলেও মনে মনে যেন শান্তি পায়। এই হাসিমাখা মুখটাই তার কাঙ্ক্ষিত যে।

আবরাহাম নিজের সিটে বসে চটজলদি একজন এয়ারহোস্টেসকে ডাক দেয়। তাকে কানে কানে কিছু একটা বলে, একটা কাগজ হাতে গুঁজে দিয়ে পাঠিয়ে দেয়।

এয়ারহোস্টেস একটু বাদেই একটি প্লেট নিয়ে হাজির করে নিবেদিতার সম্মুখে। নিবেদিতা একটু চমকিত হয়ে বলে,
“আপি, আমরা অর্ডার দেইনি এসব।”

“মি.সরদার মি.নিবেদিতার জন্য পাঠিয়েছেন।”

নিবেদিতা ঢাকনা সরাতেই দেখে একটা চিকেন স্যান্ডউইচ। তার উপর সস্ দিয়ে স্মাইলি আঁকা। পাশে একখানা চিরকুট। তা খুলে পড়তে শুরু করে সে,
— মায়াবতীরা হাসলে যেন প্রকৃতি হাসে, কাঁদলে যেন গোটা প্রকৃতিই বিষণ্ণ হলো। তাই মায়াবতীদের হাসা আবশ্যক আর কাঁদা নিষিদ্ধ। সুতরাং, কাঁদলে শাস্তি হবে, শাস্তি!

চিরকুটটা পড়তেই নিবেদিতার মুখে হাসি ফুটে উঠে। দূর থেকে আবরাহাম সেই হাসির অনুকরণে চওড়া তিল চমকানো হাসি দেয়। মালিহা দুজনকে অনুসরণ করে কিছু একটা ভাবে। যা একটু বেশিই ভাবায় তাকে।

___

সুখে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। বিকেলে না কি তার বিয়ে তার দ্বিগুণের বেশি বয়সী মানুষের সাথে। আজ সকাল বেলা স্কুলে যাওয়ার সময় মা তাকে আটকায়।

বলেন,
“আজ স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই তোমার। মেহমান আসবে, তাদের সাথে দেখা করতে হবে তোমার।”

দুপুরের দিকে একদল মানুষ বাসায় আসে তাদের। তাকে অনেক ধরনের প্রশ্ন করে, তেমন আত্মীয়-স্বজন না থাকায় অজ্ঞ সুখ এর কারণ ধরতে পারে না। শুধু অবাক ও বিরক্তই হয়।

তারা চলে যাওয়ার ঘণ্টা খাণেক বাদেই তার মা এসে জানায় কালো অর্ধ-টাক ছেলেটির সাথে তার বিয়ে। সে বারবার না করলেও মা তার একটি কথাও শোনে না।

বরং, যাতে পালাতে না পারে তাই তাকেই আটকে চলে যায়। এমতাবস্থায় সুখ পারবে এই বিয়ে নামক নতুন দুঃখ থেকে নিজেকে কি রক্ষা করতে পারবে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here