#নিভৃতে_যতনে
#Part_40
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
কথায় আছে, ‘বিপদ যখন ঘরে আসে ভালোবাসা তখন জানাল দিয়ে পালায়।’ কথাটা শতভাগ সত্য নাহলেও, মিথ্যেও নয়। আমাদের চারপাশে এমন অনেক দাম্পত্য আছে যারা বিপদের সময় একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারে না। হতে পারে না সুখ-দুঃখের সঙ্গী। বরং টাকার মোহে জড়িয়ে বিলাসিতার পিছেই ছুটে যায় অনেকেই। যার দরুন সুখ নামক পাখিকে ধরতে গিয়েই হ্রাস হয়ে যায় অজস্র সম্পর্কের স্থায়ীত্ব। অথচ মানুষ বেমালুম ভুলেই যায় যে, সুখ হচ্ছে মরীচিকা। একে যেই ধরতে যাবে সেই মুখের উপর থুবড়ে পড়বে। আর এইটাই বাস্তবতা। তাই ‘চাই! চাই!’– না করে যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা শ্রেয়। এতে অল্পেই প্রকৃতি সুখের দেখা মিলে।
রোয়েনের কোম্পানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে আজ প্রায় দুই মাস হতে চললো। তথাকথিত সমাজের নজরে এখন তিনি বেকার। আর তাঁর এই বেকারত্ব জীবনে একান্ত সঙ্গী আমি। এই দুই মাসে অনেক কিছুই বদলেছে। বদলেছে আমাদের জীবনের গতানুগতিক ধারা। খানিকটা ভিন্নতা এসেছে সম্পর্কে, সেই সাথে এসেছে ম্যাচুরিটি। প্রগাঢ় হয়েছে একে অপরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। হাতের বাঁধন মজবুত হয়েছে শতগুণ।
কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কারণে রোয়েন তাঁর ন্যায্য বেতন পাননি। তার মোট চার মাসের দিনমজুর পাওনা হলেও পেয়েছিলেন দুইমাসের। অবশ্য সকলে মিলে নিজের ন্যায্য দাবী করেছিল ঠিকই কিন্তু কাজ হয় নি। আপাতত রোয়েনের সেভিং আর বেতন দিয়ে চলছে আমাদের সংসার। বেশ হিসেব করেই চলছি আমরা দুইজন। অহেতুক খরচ প্রায় কমিয়ে দিয়েছি। পলি আন্টিকেও না করে দিয়েছি আমি। কেন না মাস শেষে তাকে মোটা অংকেরই বেতন দিতে হয় যা আপাতত দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথমে অবশ্য তিনি যেতে চাননি, এতবছর ধরে কাজ করার দরুন মায়া জন্মে গিয়েছে আমাদের প্রতি। সেই মায়ার টানেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন। তাকে আমি আমাদের অবস্থা বুঝিয়ে-টুঝিয়ে বিদায় করেছি আর আস্থাও দিয়েছি, পরিস্থিতি ঠিক হলে তাকে আবার নিয়োগ করবো আমরা। পলি আন্টি যাওয়ার পর ঘরের সকল কাজ রোয়েন আর আমি মিলে ভাগাভাগি নেই।
ফ্ল্যাটটা ছিল ব্যাংক লোনে নেওয়া। এতদিন তিনি কিস্তিতে পরিশোধ করছিলেন ঋণটা। কিস্তি প্রায় শেষের দিকে বলে রোয়েন ব্যাংকের সাথে বোঝাপড়া করে সময় নিয়ে নেন। মূলত গ্যাস,পানি,বিদ্যুৎ বিল আর খাওয়া-দাওয়া, যাতায়াতের খরচই টানতে হচ্ছে আমাদের। সেই সাথে মাস শেষে বাবা-মার জন্যও নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা তো আছেই। মাঝে মধ্যে হিসাবে গড়মিল হলেও সামলে নেই দুইজনে মিলেই।
কিন্তু এইসবের মাঝেও রোয়েন নিজের বেকারত্বের কথা জানাননি কাউকে। এমনকি বাবা-মাকেও না। তার ভাষ্যমতে, বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানার পর সকলেই করুণা করতে চাইবে। অহেতুক সান্ত্বনা ছুড়ে মারবে যখন তখন। হয়তো কেউ অনুগ্রহ করে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চাইবে। যা রোয়েনের একদমই সহ্য হয়-না। তিনি না খেয়ে মরবেন তাও কারো নিকট করুণার পাত্র হতে রাজি নন। অবশ্য মানুষটা বেশ আত্মসমপর্ণ। কারো নিকট সে সাহায্য নিতে বা অনুগ্রহের পাত্র হতে রাজি নন। এমনকি টাকা নিতেও তার আত্মসম্মানে লাগে। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি এই স্বভাবের দোষেই তিনি বিয়ের পর আমার বাড়িতে গিয়ে ওসমান সাহেবের থেকে টাকা নেননি। রোয়েনের এই আত্মসম্মানই তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরও বারিয়ে দেয়।
তিক্ত হলেও সত্য এইটাই, ‘টাকা ছাড়া দুনিয়া চলে না।’ এই ভূপৃষ্ঠে বাঁচতে হলে টাকা আবশ্যক।
একমাস হতে চললো বিল্ডিংয়ের মধ্যেই দুটো টিউশনি নিয়েছি। সেই যে ছাদে একবার মুসকানের সাথে কথা হলো এরপরই ওর আর ওর আম্মুর সাথে ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছিল আমার। যার দরুন আমি টিউশনি খুঁজছি তা জানামাত্র মুসকানের আম্মু মানে জাবিন আন্টি মুসকান ও তার বড় ছেলেকে পড়ানোর দায়িত্ব আমায় দিয়ে দিলেন। আমার টিউশনি করানো নিয়ে উনার কোন আপত্তি না থাকায় আমিও সাচ্ছন্দ্যে দুইজনকে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে নিলাম। আজই সেখান থেকে প্রথম স্যালারি পেলাম। জীবনে প্রথম আয় আমার। হোক স্বল্প কিন্তু তাও আমার জন্য এইটা অনেক। এই মূহুর্তে আমি কেমন বোধ করছি তা ভাষায় প্রকাশ্য নয়। শুধু এতটুকু জানি আমার জীবনের উপার্যিত প্রথম আয় আমি রোয়েনের হাতে তুলে দিতে চাইছি। আমি পড়ানো শেষ করে দ্রুত বাসায় চলে আসি। চঞ্চল ভঙ্গিতে চাপতে থাকি ডোরবেলের সুইচ। কিছু প্রহর অতিবাহিত হতেই রোয়েন এসে দরজা খুলে দেন। আমি হাসি মুখে ভিতরে প্রবেশ করি। ড্রয়িংরুমে আসতেই দাঁড়িয়ে পড়ি আমি। মিষ্টি হাসি হেসে রোয়েনকে উদ্দেশ্য করে বলি,
— একটু এইদিকে আসুন তো।
রোয়েন বিনাবাক্যেই আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলেন,
— কি?
আমি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে রোয়েনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলি,
— আমার প্রথম আয়। আমি চাইছি টাকাটা সর্বপ্রথম আপনাকে দিতে।
রোয়েন ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলেন,
— আমি টাকা দিয়ে কি করবো?
— আপনার কাছে রাখবেন।
রোয়েন মুখ ঘুচে বলেন,
— প্রথম আয় তোমার। এইটা নিজের কাছে রাখ আর নিজের মত ইনভেস্ট করো। আমার কাছে রাখতে হবে না।
আমি রোয়েনের হাত টেনে তাঁর হাতে টাকাটা গুঁজে প্রসস্থ হাসি হেসে বলি,
— আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাংক হচ্ছেন আপনি। যার নিকট কি-না আমি পুঁজি জমা রাখাবো আর সেটা ইনভেস্ট করে মুনাফা দেওয়ার দায়িত্ব হবে আপনার। বুঝলেন!
রোয়েন কিছু না বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঠোঁটের কিনারে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে বলেন,
— সবকিছুতে আমাকে না জড়ালে হয়না?
— আপনি না বলেছিলেন আপনারই অংশবিশেষ আমি। তাহলে আপনাকে জড়ালাম কিভাবে বলুন? আমি আর আপনি তো একই সত্ত্বার দুইটি বাস।
রোয়েন হালকা হেসে আমার কপালে ভালোবাসার এক পরশ একে দিতেই লজ্জায় মিইয়ে যাই। নিজের লজ্জা রাঙ্গা চেহারা লুকাতে মুহূর্তেই জড়িয়ে ধরি তাকে। মুখ লুকাই তাঁর বুকের কোনে। এতে রোয়েন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নেন। এক হাত গলিয়ে দেন আমার পিঠে। হঠাৎ নাকে দগ্ধ পোড়া গন্ধ এসে বারি খেতে চট জলদি সরে দাঁড়াই আমি। ক্রোধিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করি রোয়েনের দিকে। কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠি,
— আপনি আবার সিগারেট খেয়েছেন?
আপনার প্রশ্নে যে রোয়েন অপ্রস্তুত বা সংকোচিতবোধ করলেন তা কিন্তু না। উল্টো অকপটে স্বীকারোক্তি করলেন,
— হ্যাঁ খেয়েছি।
— কিন্তু কেন? আপনাকে না মানা করেছি ওইসব ছাইপাঁশ খেতে? তাও এত ত্যাড়ামো কেন করেন?
রোয়েন নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
— সবসময় তো আর খাই না।
— যখন টেনশনে থাকেন তখনই খান তাই তো? কিন্তু তাও খেয়েছেন তো। একবার এইটার নেশা লেগে কি হবে?
— কিছুই হবে না।
আমি আদেশের সুরে বলি,
— কিছু হবে কি হবে না সেটা পরের বিষয়। আপনি এইসব খাবেন না, ব্যস। আপনার জন্য এইসব নিষিদ্ধ।
— আচ্ছা।
আমি এইবার কিছুটা নিভে যাই। আলতো স্বরে বলি,
— এত টেনশন কেন করেন আপনি? কিছু না কিছু একটা হয়েই যাবে। এমন তো নয় হাত গুটিয়ে বসে আছেন আপনি। বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভিউ তো দিচ্ছেই আপনি। একটা না একটা জায়গায় জব হয়েই যাবে।
— যতটা সহজ মনে করছো বিষয়টা ততটা সহজ বিষয়টা না। এই চাকরির বাজারে ভালো মানের একটা চাকরি পাওয়া মুখের কথা নয়। যোগ্যতা থাকলেও অনেক সময় টাকার সামনে হার মানতেই হয়।
কথাটা শুনে আমি চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকি। কথাটা সত্য যে এখনকার পলিসিই হচ্ছে, ‘টাকা পকেটে তো চাকরি হাতের মুঠোয়।’ সাধারণ পদের চাকরিতে জয়েন হতেও এখন বড় অংকের ডোনেশন দিতে হয়। আবার সকল জায়গায় যোগ্যতা অনুযায়ী পদও পাওয়া যায় না। এই জনবহুল দেশে জনসংখ্যার পরিমাণ বৃহৎ হলেও কর্মসংস্থানের পরিমাণ জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। ক্ষণেই বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘনিশ্বাস। আমি ব্যথিত চোখে রোয়েনের দিকে তাকাতেই দেখতে পাই তাঁর মলিন চাহনি। মুহূর্তেই বুকটা দুমড়ে-মুষড়ে যায় আমার। এই চাহনির পিছে যে নিজের প্রতি কতটা ক্ষোভ আর ব্যর্থতা লুকিয়ে আছে তা আমার অজানা না। আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য ঠোঁটের কোনে সরু হাসির রেখা ফুটিয়ে বলি,
— আমি ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর রান্না করে নিচ্ছি।
— আমি রান্না করে ফেলেছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার সাজাচ্ছি।
আমি দীর্ঘ এক হাসি হেসে সম্মতি জানিয়ে চলে যাই ফ্রেশ হতে।
#চলবে