নিভৃতে_যতনে পর্ব ৭

0
3217

#নিভৃতে_যতনে
#Part_07
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

জৈষ্ঠ্য মাসের পনেরো তারিখ আজ। তপ্ত এক সকাল। গুমোট এক ভাব চারদিকে। এই তপ্ত গরমের মাঝেই আমি আর রোয়েন জ্যামে আটকে আছি আধাঘন্টা যাবৎ ধরে। সিগন্যালের জ্যাম নাকি কি-না তা আমার জানা নেই। একে তো গরম তার উপর জ্যাম। আমার তো প্রায় যায় যায় অবস্থা। রিকশায় আছি বিধায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের বিষাক্ত গ্যাস নাকে মুখে এসে বারি খাচ্ছে। তার উপর মাথার উপর তীক্ষ্ণ রোদের ছায়া। রোয়েনের কাছ থেকে দূরত্ব বুঝিয়ে রাখার জন্যই রিকশার হুটটা অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খোলা রাখতে হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার অবস্থা নাজেহাল। ভিতরটা আমার বার বার গুলিয়ে আসছে। কিন্তু কোন মতে নিজেকে সামলে রেখেছি। রোয়েনের অবস্থা বুঝার জন্য আমি আড়চোখে তার দিকে তাকাই। এক চিলতে রোদ এসে বারি খাচ্ছে তার মুখের উপর। ব্রাশ করার চুলের উপর ছড়িয়ে দিচ্ছে সোনালী আভা। কিন্তু সেদিকে কি তার ভাবান্তর আছে? সে তাই ভাবলেশহীন ভাবে বসে এক হাত দিয়ে মোবাইল স্ক্রোল করেই চলেছে। দেখে মনে হচ্ছে তার যেন গরমই লাগছে না। গরম বলতে এই পৃথিবীতে কিছুই নেই। অথচ গায়ের শার্ট ঘামে ভিজে একাকার। এই খাটাশ ব্যাটা যে কি দিয়ে তৈরি আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানে। কিন্তু যত যাই হোক, মানুষ না।

আমি গরমে হাই-হুতাশ করতে করতে নিজেকে শ’খানেক বকা দিয়ে নেই। নিজেই নিজেকে বলি,

— ইউ ডাফার! কে বলেছিল মাত্তব্বোরি করতে? ভালোয় ভালোয় তো রোয়েন উবার বুক করছিল তুই মাঝে কাবাব ম্যায় হাড্ডি কেন হতে গেলি? রিকশার অতৃপ্ত আত্মা ভর করেছিল নাকি তোর উপর? যে রিকশা ছাড়া এক চুলও নড়তে রাজি হলি না তুই? এইবার গরমে জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হো।

কথাটা ভেবেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। রোয়েনের কাছ থেকে আরেকটু সরে বসার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম৷ যাতে কোন ভাবেই তার শরীরের সাথে আমার স্পর্শ না লাগে। কিন্তু রিকশায় কি তা আদৌ সম্ভব? হঠাৎ রোয়েন বলে উঠে,

— গরমে বারবিকিউ হয়ে এইবার মন ভরেছে তো?

আমি তার কথা শুনে কটমট দৃষ্টিতে তাকাই। কাঠ কাঠ গলায় বলি,

— মন আমার। সো সেটা ভরেছে কি-না সেটা নিয়ে আপনার এত ভাবতে হবে না।

সে ভাব নিয়ে বা হাত দিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে করতে বলে,

— কাল পর্যন্ত জানতাম তুমি বুঁচি প্যাঁচি। আজ দেখছি তুমি মাথামোটা ও। নিজের পায়ে কোড়ল মারা কেউ তোমার থেকে শিখুক।

আমি তার কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে বলি,

— এট লিস্ট মানুষ আমার থেকে কিছু শিখতে তো পারবে, আপনার বেলায় তো তাও পারবে না। একটা খাটাশ মার্কা রোবট থেকে কি বাই আর শিখা যায়?

সে আমার কথা শুনে তার বিশ্ব বিখ্যাত ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে বলেন,

— ডু ইউ ইভেন নো, আমার আন্ডারে প্রায় দেড়শো জন কাজ করে?

আমি তার কথায় থমথম থেকে বলি,

— করতেই পারে,তো?

সে আমার কথা শুনে চোখ ছোট ছোট করে চায় অতঃপর বিরবির করে বলে উঠে,

— ডাফার!

কথাটা আমি শুনেও না শুনার ভাণ করলাম। আমি আরেকটু চেপে বসতে যাব তখনই জ্যাম ছেড়ে দেয় আর রিকশাচালক একটান দেন। তাতে আমার ব্যালেন্স কিছুটা নড়বড় হয়ে যায় আর আমি পড়ে যেতে নেই। ঠিক এমন সময় রোয়েন আমার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে আমাকে এক টান দিয়ে আমাকে তার সাথে মিশিয়ে নেন। সাথে সাথে আমি ভড়কে যাই। বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকাই। মূহুর্তেই সরে আসতে নিলেও সে আমায় ছাড়ে না। বরং আগের ন্যায় আমার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে বসে থাকে৷ আমি কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— এইটা কি ধরনের অসভ্যতা?

রোয়েন একবার আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় মোবাইল স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি নত করে বলে,

— হসপিটালে ভর্তি হওয়ার এত ইচ্ছা থাকলে যখন আমি আশেপাশে থাকবো না তখন পূরণ করে নিও। এইসব দৌড়াদৌড়ির কাজ নিতান্তই অসহ্যকর।

আমি তার কথার মর্ম প্রথমে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রই। কথাটা বুঝতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়। অতঃপর কথাটা বুঝতে পেরে আমি ফুঁসে উঠি। কাঠ কাঠ গলায় বলি,

— আমি কি বলেছি আপনাকে আমায় নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে? আমাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না আপনার। কিছু হলে একা একাই হসপিটাল চলে যেতে পারবো। হুহ!

সে ভাবলেশহীন ভাবেই বলে,

— ইউ আর নাও মাই রেসপনসেবলিটি। সো আমার সাথে থাকাকালীন তোমার দায়িত্ব আমারই। এর মধ্যে তোমার কিছু হলে এর দায়ভার আমাকেই পোহাতে হবে। আর যেটা আমি চাই না। গট ইট?

আমি কিছু না বলে কটমট দৃষ্টিতে তাকালাম। এর সাথে কথা বলাই বেকার।

______________________

বাসায় আসতে না আসতেই আমার সব কাজিনরা রোয়েনকে চেপে ধরে। আপ্যায়নে ভরে দেয়। সেই সাথে দুই একটা আন্ডা পিচ্চি ঝুলে পড়ে রোয়েনের গলায়। বড় ছোট সকলেই এই সেই জিজ্ঞেস করে চলেছে তাকে। আর সে খালি হু হা করে জবাব দিচ্ছে। মুখ একদম বাংলা প্যাঁচার মত করে আছে। ভাবসাব এমন যে, “ছেঁড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি।” যেহেতু আমাকে নিয়ে কাউরো মাতামাতি নেই সেহেতু আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে রোয়েনের অবস্থা দেখছি আর মিটিমিটি হাসছি। বুঝতেই পারছি যে, সে না পারছে সইতে, না পারছে কিছু বলতে। জীবনে এই প্রথমবারের মত আমার কাজিনদের নিয়ে গর্ববোধ করতে ইচ্ছে করছে। মনে চাচ্ছে সবগুলোকে একটা বড়সড় পার্টি দেই। কত সুন্দর রোয়েনকে জ্বালিয়ে মারছে।আহা! কি শান্তি! শান্তি!

হঠাৎ আমার দিকে রোয়েনের নজর পড়তে সে ইশারায় আমায় কিছু বলে। আমি প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝি সে আমাকে এইখান থেকে উদ্ধার করতে বলছে। কথা বুঝার সাথে সাথে আমার মুখে পৈচাশিক হাসি ফুটে উঠে৷ আমি মনে মনে বলি,

— আমাকে বুঁচি বলা হয়েছিল না কাল। এইবার বুঝবেন ঠ্যালা।

কথাটা ভেবেই আমি মুখ ঘুরিয়ে গুনগুন করতে করতে হৃদিপুর রুমে দিকে চলে গেলাম। ছেড়ে দিলাম তাকে আমার কাজিনদের কাছে। কেন না আমি চিনি আমার কাজিনদের। তারা একবার কারো পিছে পড়লে তার অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়ে। যেমন এখন রোয়েনের করবে৷ আহা! বাতাসটা এত স্নিগ্ধ কেন?
হৃদিপুর রুমের সামনে আসতেই হৃদিপু দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে। আপ্লূত সুরে বলে,

— সিয়া তুই এসেছিস?

আমি দুষ্টুমির সুরে বলি,

— না আমার অতৃপ্ত আত্মা এসেছে। ভাওওও!

হৃদিপু আমায় ছেড়ে দিয়ে কানে হাতে দিয়ে বলে,

— ইউ খবিশ! কানের পোকার নাড়িভুঁড়িও মেরে দিলি।

আমি কিছু না বলে হু হু করে হেসে উঠি। হৃদিপু আর কিছু না বলে আমায় টেনে তার রুমে নিয়ে যায়। এরপর জুড়ে দেয় দুনিয়ার গল্প। একসময় গল্পের মাঝেই হৃদিপু গম্ভীর হয়ে যায়। মিহিয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে উঠে,

— সিয়া একটা কথা বলি?

— হ্যাঁ বলো। না করেছে কে?

— উফফ মজা না।

আমি এইবার নড়েচড়ে বসে বলি,

— ওকে। বলো!

— তুই কি বিয়েটা মেনে নিয়েছিস সিয়া?

কথাটা শুনেই আমি চুপ হয়ে যাই। কোন উত্তর দেই না। হৃদিপু কিছুক্ষণ আমার উত্তরের আশায় আমার মুখ পানে চেয়ে থাকে। কিন্তু কোন উত্তর না পেয়ে বলে,

— দেখ! যেভাবেই হোক বিয়েটা হয়ে গিয়েছে। হোক সেটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত। হয়েছে তো? তার উপর যতটুকু তোর থেকে শুনলাম, না তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন খারাপ আর না ভাইয়া। তাই বলছি কি লাইফটাকে একটা চান্স দে। নিজের সবটা দিয়ে তাদের ভালবেসেই দেখ না। আশা করি এইবার নিরাশ হবি না। তোর প্রাপ্যটা এইবার তুই পাবি।

আমি হৃদিপুর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলি,

— আমার ভিতরে আর বাকি আছেটা কি?

হৃদিপু আমার হাত তার কোলে নিয়ে বলে,

— এখনো অনেক কিছু আছে বুঝলি। অনেক কিছু জানার আছে,বুঝার আছে। তাই বলছি এই বিয়েটা মেনে নে। সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দে।

আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। হৃদিপু আবার বলে,

— কিছু তো বল?

— ভালো লাগছে না এই বিষয়টা। বাদ দাও তো।

— কিন্তু..

আমি হৃদিপুর কথার মাঝে ফোঁড়ন দিয়ে বলি,

— তুমি থাক আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।

কথাটা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে আসি। চলে যাই নিজের রুমে। মাথা ভিতরটা কেমন এলোমেলো লাগছে। অসহ্য লাগছে সব। শাওয়ার নেওয়ার দরকার। আমি কার্বাড থেকে এক সেট জামা নিয়ে ঢুকে পড়ি ওয়াশরুমে।

#চলবে

ডান হাতটা প্রচন্ড ব্যথা। টাইপ করতে কষ্ট হচ্ছে। অল্প অল্প করে যতটুকু লিখতে পেরেছি ততটুকুই দিয়ে দিলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here