#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৭
শুভ্র বিকেলের সঙ্গে মেঘেদের প্রণয়.. আজ কয়েকদিন যাবৎ প্রচুর দেখা যাচ্ছে। বিকেল শুরু হতে না হতেই মেঘেরা এসে ভীড় জমায় দূর ঐদেশে। যার কারণে রোজ ঠিকমতো প্রাইভেট পড়তেও যাওয়া হচ্ছে না। তবে আজ চৈতালি এসে উপস্থিত হওয়ায় শান্তির বিছানা ছেড়ে উঠতেই হলো অনাকে। ঝটপট জামা বদলে চুলে চিরুনি বোলাতে বোলাতে বললো,
-“আজ না গেলে হয় না?”
-“উহু.. হয় না। দ্রুত কর তো।”
ব্যাগে ম্যানেজমেন্টের একটি খাতা ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়লো অনা। পড়তে তার ভালোলাগে না.. তবে সবাই বলে পড়। প্রেম করতে ভালোলাগে.. অথচ কেউ বলেনা প্রেম কর। অদ্ভুত না? না পড়ে প্রেম-ভালোবাসায় মগ্ন থাকলে বুঝি জীবনে সুখী হওয়া যায় না?
-“তোর কাছে প্রেম-ভালোবাসা মানে কিরে?”
হঠাৎ অনার প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে গেল চৈতালির। তীক্ষ্ণ গলায় সে বললো,
-“তুই কি প্রেমে পড়েছিস?”
-“ধুর! বল না!”
-“কী বলবো?”
-“তোর কাছে প্রেম-ভালোবাসা মানে কী?”
থেমে পড়লো চৈতালি। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“ভালোবাসা কিছুটা এক পাক্ষিক। এক পক্ষ থেকে কাওকে নিঃস্বার্থ ভাবে চাওয়া, তার ভালোলাগাকে নিজের ভালোলাগা বানিয়ে নেয়ার নামই ভালোবাসা। আর প্রেম দু’পক্ষের সেই ভালোবাসার সমন্বয়।”
-“দারুণ এক লজিক দিয়েছিস তো। তা এসব কোত্থেকে জানলি? কাওকে কখনো ভালোবেসেছিস?”
-“তাহলে কী তোকে জানাতাম না?”
চৈতালির কথার পিঠে কথা বাড়ালো না অনা। আবারও হাটতে শুরু করলো রাস্তা ধরে। সামনেই বড় বাজার। বড় বাজারেই ছোট একটি ঘর নিয়ে সেখানে ছাত্রছাত্রীদের পড়ান সবুজ স্যার। স্যারের বয়স খুব একটা বেশি নয় এবং এখনো অবিবাহিত। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, স্যার পছন্দ করে চৈতালিকে। সকলের অগোচরে প্রায়ই চৈতালির দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি দেয়। যেনো তার শরীরের প্রতিটি অংগসমূহ সর্বক্ষণ লজ্জায় ভরপুরই থাকে। ঠোঁট চেপে নিজের হাসিকে নিয়ন্ত্রণে আনলো অনা। তারপর চৈতালির কাঁধে হাত রেখে গলি ধরে এগুতেই নজরে এলো এমাদ। সাথেসাথেই তার মনজুড়ে খেলে গেল খুশির জোয়ার।
-“তুই যা.. আমি আসছি।”
-“কেনো? তুই কই যাবি?”
-“আরে তুই যা না! আমি আসছি তো..”
বেশ জোর করেই চৈতালিকে সামনে এগুতে বলে পেছন ফিরলো অনা। কয়েক কদম এগিয়ে এসে এমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার মুখের সিগারেট নিজের হাতে নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
-“সিগারেট খাচ্ছিলে কেনো?”
মৃদু হাসলো এমাদ। দেয়ালের সাথে নিজের শরীর ঠেসে দাঁড়িয়ে বললো,
-“তোমার দেখা না পেয়ে বোর হচ্ছিলাম। তাই আরকি…”
মুখ ভেংচি কেটে অনা বললো,
-“তোতার তেখা তা তেয়ে তোর তত্তিলাম… না? আজ যদি না আসতাম, তখন কী হতো? তখন কী সিগারেটের ফ্যাক্টরি খুলে বসতে?”
-“আরে না.. কী যে বলো!”
-“কিছুই বলি না। চুলে চিরুনি লাগাওনি না? এলোমেলো চুলেই বেরিয়ে পড়েছো?”
-“হুম..”
-“দাঁড়াও।”
আশেপাশে তাকিয়ে লোকজনের উপস্থিতি দেখে এমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে চুল গুলো ঠিকঠাক করলো অনা। তারপর তার গাল টেনে বললো,
-“ওরে আমার প্যাঁচাটা! এখন দেখো কত সুন্দর লাগছে দেখতে! তা তুমি এখানে কতক্ষণ হলো এসেছো?”
-“এই দশ মিনিট..”
-“এই দশ মিনিটে এই রাস্তা দিয়ে কয়টি মেয়ে গেছে?”
-“আমি কী করে বলবো!”
-“তুমি সেভাবেই বলবে যেভাবে তাদের ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখেছো!”
-“আমি তো ওসব দেখিনি।”
-“মিথ্যে..”
-“সত্যিই।”
-“তিন সত্যিই?”
-“চার সত্যি। এবার বিশ্বাস হলো তো?”
-“কচু হয়েছে। আমি যাচ্ছি।”
-“সিগারেটটা তো দিয়ে যাও!”
-“এই সিগারেট এখন আমি খাবো।”
বলেই দৌড়ে সামনে এগুলো অনা। তার যাত্রা পথের দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো এমাদ। তারপর উঁচু স্বরে বললো,
-“এই অনা। অনা… কাল কিন্তু কলেজের সামনে থাকবো। জলদি এসো…”
লিমনের সাথে ফোনে কথা বলে মাথায় চিরুনি লাগিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে তা লক করলো মেসবাহ। তারপর জোর গলায় কয়েকবার উল্লাসীকে ডাকতেই বেরিয়ে এল সে মুন্নি সরকারের ফ্ল্যাট ছেড়ে। নীল শাড়িজমিনের মাঝে সাদা রঙের সুতোর কাজের একটি শাড়ি পড়েছে সে। সোজা পিঠসমান চুলগুলো খুলে ছড়িয়ে রেখেছে। সাথে কানের একপাশটায় সাদা ফুল গুঁজে দিয়েছে। ঠোঁট ভর্তি করে লাগিয়েছে টকটকে লাল লিপস্টিক, চোখে এঁকেছে গাঁঢ় কাজলের রেখা। অপূর্ব সুন্দর লাগছে। ঈদের দিনটিতেও কি ঠিক এতটাই অপূর্ব দেখাচ্ছিলো উল্লাসীকে? হয়তোবা। তবে কেনো সেদিন তা নজরে আসেনি তার?
-“নাও.. তোমার বউকে সাজিয়ে দিলাম।”
মুন্নি সরকারের দিকে তাকিয়ে সৌজন্য সূচক একটি হাসি দিল মেসবাহ। তারপর এগুলো লিফটের দিকে। এই মহিলা উল্লাসীকে বড্ড পাকামো শেখাচ্ছে। সকালে উল্লাসীর হঠাৎ ওমন আচারণে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো সে। তবে শুক্রবারের নামাযের কথা ভেবে খানিক পরে আবারও ফিরে আসায় উল্লাসীর সেই অদ্ভুত আবদার আবারও শুরু হয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন ভর সেই একই কথা বলে বলে জ্বালিয়ে মেরেছে তাকে। এই মেয়ে যে বড় অবুঝ তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। তবে অবুঝেরও তো একসময় বুঝ হয়, তা এর কবে হবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেসবাহ লিফটের বোতাম চেপে সরে দাঁড়াতেই তার গা ঘেষে দাঁড়ালো উল্লাসী। চোখজোড়া বুজে সজোরে একটি নিঃশ্বাস ভেতরে টেনে নিয়ে বললো,
-“মাথা ঘুরছে আমার।”
উল্লাসীর হাত আঁকড়ে জোরে একটি চাপ দিল মেসবাহ। তারপর নরম স্বরে বললো,
-“আমি তো আছি.. চোখ খোলো।”
-“মাথা ঘোরে..”
-“চোখ বন্ধ করে রাখলে তো মাথা ঘুরবেই। আমার দিকে তাকাও। আমার সাথে কথা বলো। দেখবে কিছুই ফিল হবে না.. এই মেয়ে, চোখ খোলো।”
সময় নিয়ে উল্লাসীকে পর্যবেক্ষণ করলো লিমন। এরপর মেনুকার্ড হাতে নিয়ে বললো,
-“কী খাবি বল?”
-“নরমাল কিছু অর্ডার কর। যাতে উল্লাসীর জন্য খেতে সুবিধা হয়।”
বলেই পাশ ফিরে উল্লাসীর দিকে নজর দিল মেসবাহ। ক্ষীণ গলায় বললো,
-“খারাপ লাগছে?”
-“উহু..”
-“তাহলে কথা বলছো না যে!”
মেসবাহর হাতের আঙুলের মাঝে নিজের আঙুল ডুবিয়ে চোখ তুলে তার দিকে তাকালো উল্লাসী। অস্পষ্ট গলায় বললো,
-“অস্থির লাগছে…”
-“কেনো? আমি তো আছি..”
-“কী গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছিস দুজনে?”
লিমনের প্রশ্নে মৃদু হেসে মেসবাহ বললো,
-“কিছু না.. অর্ডার করেছিস? দ্রুত ফিরতে হবে।”
-“করলাম তো। তা ছুটির দিনে বউকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েও তোর তাড়াহুড়ো? বড্ড বেরসিক মানুষ তুই! উল্লাসী, আমার এই বেরসিক বন্ধু তোমাকে খুব জ্বালায়… না?”
-“চুপ করতো। এসব কী বলছিস?”
-“আরে ব্যাটা তুই চুপ কর। আমাকে আর উল্লাসীর সঙ্গে কথা বলতে দে। তো যা বলছিলাম, মেসবাহ তোমাকে খুব জ্বালায়?”
মাথা নেড়ে উল্লাসী অসম্মতি জানাতেই ফের প্রশ্ন করলো লিমন।
-“তাহলে কি তুমি জ্বালাও?”
-“না.. আমি কেনো উনাকে জ্বালাবো?”
-“তাই তো! তুমি তো আর ছোট বাচ্চা নও। তবে আমার বন্ধু কিন্তু তোমাকে বাচ্চাই ভাবে। পারলে তোমাকে কোলে করে পুরো দুনিয়া ঘুরলে বাঁচে!”
খিলখিল করে হেসে উঠলো উল্লাসী। লোকটি তো বেশ মজার!
-“তুমি হাসছো? আর আমি কাঁদি.. ভাবি আমার একটা বাচ্চা বউ হলে কী হতো!”
-“আপনার বউ আছে?”
-“থাকবে না? আছে আছে.. বউ আমার বাচ্চা নয়। বুড়ো বউ।”
পাশ থেকে কপাল কুঁচকে মেসবাহ বললো,
-“এই.. তুই কী শুরু করলি! থাম তো এবার!”
-“তুই চুপ করতো.. এই উল্লাসী, আমাকে ভালো করে দেখো তো! কী.. দেখেছো?”
একমুহূর্ত লিমনকে দেখে উল্লাসী বললো,
-“হ্যাঁ..”
-“আমাকে দেখে কী মনে হলো তোমার?”
-“কিছুই তো মনে হয়নি।”
-“সুন্দর অসুন্দর কিছুই না?”
-“হয়েছে। সুন্দর মনে হয়েছে।”
-“গ্রেট। এবার মেসবাহর দিকে তাকাও। তারপর বলো, আমাদের দুজনের মাঝে কে বেশি ফর্সা?”
সময় নিল না উল্লাসী। সাথেসাথেই বললো,
-“আপনি।”
-“তার মানে মেসবাহর চেয়ে আমিই সুন্দর৷ এই তো?”
আবারও পাশ থেকে কপাল কুঁচকে মেসবাহ বললো,
-“এসব কী শুরু করলি তুই?”
-“চুপ কর তো তুই। আচ্ছা উল্লাসী.. তোমার পাশে মেসবাহ না থেকে আমি থাকলে কেমন হতো? সেই হতো না?”
উল্লাসীর জবাব দেবার আগেই উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। শক্ত গলায় লিমনকে বললো,
-“এদিকে আয়। কথা আছে।”
-“কী কথা? এখানেই বল! সুন্দরী ভাবিকে ফেলে তো উঠতে মন টানে না!”
-“ব্যাটা তুই উঠবি?”
মেসবাহ ক্ষেপেছে বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়ালো লিমন। দু’হাতজোড়া প্যান্টের পকেটে গুঁজে ধীরেসুস্থে এগুলো মেসবাহর পিছুপিছু।
-“তুই কী করছিস এসব?”
আকাশ থেকে পড়ার ভান করে লিমন বললো,
-“কী?”
-“বুঝিস না কী? আমার বউ, আমি তার পাশে.. অথচ তুই কিনা নিঃসংকোচে ফ্লার্ট করে যাচ্ছিস!”
মেসবাহর কথার তাল না দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে ক্ষীণ গলায় গেয়ে উঠলো লিমন,
-“তোমার কেনো জ্বলেরে বন্ধু তোমার কেনো জ্বলে? তোমার বাচ্চা বউ কারো হলে, তোমার কেনো জ্বলে?”
-“তুই কিছু বললি?”
-“উহু.. গান গাইছি। গান”
-“বাজে বকিস না তো! আমার কোথাও জ্বলে না। আমার জ্বলবে কেনো শুধুশুধু?”
ফোন আবারও পকেটে পুড়ে মেসবাহর কাঁধে হাত রাখলো লিমন। পাশ ফিরে উল্লাসীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বউ তোর কোনো দিক থেকেই বাচ্চা নেই। এমন সুন্দর একটা বউ পাশে রেখে তুই ঘুমাস কেমনে? বলিকি.. এসব জ্বলাজ্বলি বন্ধ করে এবার তোর বাচ্চা বিড়ালটা মেরেই ফেল।”
বলেই মেসবাহর মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলো লিমন। যাক! কাজে দিয়েছে। ব্যাটা প্রচুর ক্ষেপেছে। এতই ক্ষেপেছে যে খানিকক্ষণ এভাবে থাকলে ফুলে ফেঁপে বেলুন হয়ে আকাশে উড়াল দেবে। একগাল হেসে মেসবাহর কাঁধে চাপড় দিল লিমন। তারপর কোমল গলায় বললো,
-“জোক্স আ পার্ট। চলো বন্ধু, সুন্দরী ভাবি আমার অপেক্ষা করছে। ভাবির কাছেই যাই।”
(চলবে)