নিরবতা পর্ব-১৯

0
4883

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৯

পুরো রাত পেটের ব্যথায় ছটফট করে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে উল্লাসী। তাই আর সকালে ঘুম থেকে উঠে তাকে ডাকলো না মেসবাহ। নাস্তা করে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। মেয়েটিকে এভাবে একা ফেলে যেতে কোনোভাবেই মন টানছে না তার। বুকের ভেতরটায় অস্থির লাগছে। তবুও তাকে যেতেই হবে। বাইরে থেকে দরজা লক করে মেসবাহ এগুলো মুন্নি সরকারের ফ্ল্যাটের দিকে। আপাতত উনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায়ন্তর নেই। তাছাড়া মহিলা এমনিতে খারাপও নয়। তবে তার অতিরিক্ত বকবকের কারণে একদমই সহ্য হয়না তাকে মেসবাহর।
-“কী খবর? এত সকাল সকাল আমাকে কী মনে করে মনে পড়লো?”
সৌজন্য সূচক মৃদু হেসে ফ্ল্যাটের চাবি মুন্নি সরকারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মেসবাহ বললো,
-“এটা রাখুন। খানিকক্ষণ পর পর গিয়ে উল্লাসীকে একটু দেখে আসবেন।”
-“কেনো? উল্লাসীর কিছু হয়েছে?”
-“ওই আরকি.. একটু অসুস্থ।”
-“বলো কী! কী হলো আবার ওর? গিয়ে দেখে আসি!”
মুন্নি সরকার ফ্ল্যাটের দিকে এগুতেই তাকে থামিয়ে দিল মেসবাহ। বললো,
-“এখন ও ঘুমোচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘুমোক। আপনি একটুপর গিয়ে ওকে একটু খাইয়ে দিয়ে আসবেন। আমি টেবিলে ব্রেড রেডি করেই রেখে এসেছি। আর আমিও একটু ফ্রি হলে চলে আসবো। আপনি প্লিজ ওকে একটু দেখবেন।”
-“আরে! এভাবে আবার বলতে হবে নাকি! অবশ্যই আমি দেখবো। তুমি যাও।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লিফটের দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে তার উল্লাসীকে ফেলে যেতে। যেনো পুরো জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলছে সে উল্লাসীকে। না চাইতেও অজ্ঞাত এক মায়াজালে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে উল্লাসীর সঙ্গে। তাকে নিয়ে ভাবছে। তার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে। এসব কি মায়া? নাকি অন্যকিছু?

কলেজের গেটে এমাদের দেখা না পেয়ে মন অসম্ভব খারাপ হয়ে এল অনার। কাঁধের ব্যাগ চৈতালির কাছে দিয়ে তাকে ভেতরে পাঠিয়ে সে পায়চারী শুরু করলো রাস্তা ধরে। দু’মাস হলো এমাদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে সে। এই কলেজেরই ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক নুরুল ইসলামের বড় ছেলে এমাদ। পড়াশোনায় খুব একটি মনোযোগী না হলেও বাবার ইচ্ছেতে ঢাকার একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে অধ্যয়নরত রয়েছে সে। তবে মাসের ৭ দিন ঢাকায় কাটালেও বাদবাকি দিনগুলো গ্রামে শুয়ে-বসে কাটায় এমাদ। এভাবেও বুঝি পড়াশোনা হয়? ভেবে পায় না অনা। অবশ্য তার নিজেরই যেখানে পড়াশোনায় মন বসে না সেখানে এমাদের কী করে বসবে? দু’জনে কি দু’পথের যাত্রী? মোটেও নয়। দুজনেই তারা একই পথে গমনকারী…
-“সরি.. সরি। দেরি হয়ে গেল!”
এমাদের ক্লান্তিমাখা মুখ দেখে মৃদু হাসলো অনা। আদুরে গলায় বললো,
-“ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় এভাবে দৌড়ে আসতে হবে? আজ না এলে কী এমন হতো?”
-“তুমি যে অপেক্ষা করতে!”
-“ইশ! আমার প্যাঁচাটা কত ভাবে! চলো.. একটু হেটে আসি।”
-“তোমার কলেজ?”
-“কলেজের তো তোমার মতো দৌড়ানোর সাধ্যি নেই। থাকবে সে নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে।”
হাসলো এমাদ। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে অনার হাতের আঙুলের মাঝে ডুবিয়ে দিল নিজের আঙুল।
-“জানো, কাল রাতে কি স্বপ্ন দেখেছি? দেখেছি তুমি আমার ঘরে এসে আমার কাছে গামছা চাইছো। আমিও তোমায় গামছা এগিয়ে দিচ্ছি। তবে আমি তখন এইবেশে নয়.. শাড়ি পড়া অবস্থায় ছিলাম। স্বপ্নটা সুন্দর না?”
অনার প্রশ্নের জবাবে মাথা নেড়ে এমাদ বললো,
-“হ্যাঁ.. সুন্দর।”
-“বিয়ের পর কি আমি শাড়ি পড়বো?”
-“তুমি চাইলে পড়বে।”
-“তোমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই?”
-“উহু.. তোমার খুশিতেই আমি খুশি।”
এমাদের হাত জোরে চেপে ধরলো অনা। সাথেসাথেই এক অদ্ভুত অনুভূতি ছেয়ে গেল তার মনজুড়ে। দু’চোখ বুজে লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে সে বললো,
-“আমাদের ব্যাপারে আমরা কবে সবাইকে জানাবো?”
-“আরও কিছুদিন যেতে দাও। জানিয়ে দিব।”
-“ঠিকাছে। তবে চৈতালিকে তো জানানোই যায়। প্লিজ.. ওকে জানাই? ওর কাছে আমি কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারিনা। দম বন্ধ বন্ধ লাগে।”
পথ চলা থামিয়ে অনার মুখোমুখি দাঁড়ালো এমাদ। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললো,
-“গোপন প্রেমের গভীরতা বেশি… তাছাড়া কিছুদিন যেতে দাও। সময় হলে আমরা দু’জনেই একইসাথে সবাইকে জানাবো।”
ব্যাকুল স্বরে অনা বললো,
-“সময়টি কবে আসবে?”
-“খুব দ্রুত.. চলো। তোমার কলেজের দিকে এগোই।”
ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে সেই চিরপরিচিত রাস্তা ধরে আবারও এগুলো অনা। এমাদকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সে। যতটুকু ভালোবাসলে তার খুশির জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করতেও সে দু’বার ভাববে না।

হাসপাতালের কাজের চাপ বেশি থাকায় আর বাসায় যাওয়া হয়ে উঠলো না মেসবাহর। তবে ঘন্টাখানেক পর পর মুন্নি সরকারের নাম্বারে কল করে উল্লাসীর খবরাখবর রাখছে সে। এই মেয়েকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই তার। একয়দিন যাবৎ তাকে বাড়িতে একা ফেলে রেখে আসার চিন্তা, আজ থেকে আবারও নতুন চিন্তার সূচনা ঘটলো। অস্থিরতা কাটাতেই দুপুরের রাউন্ড দেয়া শেষ হতেই মুন্নি সরকারের নাম্বার ডায়াল করলো মেসবাহ। অশান্ত মনে অপেক্ষা করতে লাগলো ওপাশ থেকে একটি সাড়ার।
-“মেসবাহ.. তুমি এত কেনো টেনশন করছো বলো তো? এসব তো প্রতিটি মেয়েরই হয়। স্বাভাবিক একটি ব্যাপার এটি।”
এব্যাপারে মুন্নি সরকারের সাথে কথা বলতে অস্বস্তি হলো মেসবাহর। কোনোরকমে কথা কাটিয়ে সে বললো,
-“জ্বি.. তা উল্লাসী দুপুরে খেয়েছে?”
-“না.. ওকে খাওয়াতেই এসেছি। কথা বলবে ওর সাথে? নাও বলো।”
অপরপাশ থেকে উল্লাসীর গলার স্বর কানে আসতেই অস্থির মনে স্বস্তি ফিরলো মেসবাহর। শান্ত স্বরে সে বললো,
-“গোসল হয়েছে?”
-“হ্যাঁ..”
-“ব্যথার কী অবস্থা?”
-“একটু কম..”
-“ধীরেসুস্থে আরও কমবে। মুন্নি ভাবিকে বলো যাবার আগে যেনো পানি গরম করে বোতলে উঠিয়ে দিয়ে যায়। পন্ডিতি করে তুমি একা করো না। গরম পানি হাতে পায়ে লাগতে পারে।”
-“আচ্ছা..”
-“মুন্নি ভাবি কি ভাত নিয়ে এসেছে?”
-“হ্যাঁ..”
-“ঠিকাছে। কোনো বাহানা না দেখিয়ে খেয়ে নাও। আমি দেখি বিকেলের দিকে একবার বাসায় আসবো।”
-“আচ্ছা..”
-“কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বলো। নিয়ে আসবো।”
-“না, কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।”
-“আচ্ছা.. রাখছি।”
ইচ্ছে না থাকা সত্বেও কল কেটে চেম্বারে এল মেসবাহ। অস্থিরতা খানিকটা কমে এলেও উল্লাসীকে একটিবার দেখার জন্য মন উতলা হয়ে উঠেছে। এ কেমন বিপদে পড়লো সে! উল্লাসী ছাড়া কী কিছুই মাথায় আসেনা তার?

ভর সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে রয়েছে উল্লাসী। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। যাক! ভালোই হয়েছে একদিক দিয়ে। ঘুমোনোর সময়টুকুতো একটু শান্তিতে আছে। নয়তো কষ্টে আচ্ছন্ন মুখ নিয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকতো উল্লাসী। দিন শেষে বাড়ি ফিরে যা দেখা মোটেও সুখকর হত না। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে হাতের আইসক্রিমের বাটি ফ্রিজে রেখে এসে শার্ট খুললো মেসবাহ। কিছুক্ষণ বসে ঠান্ডা হয়ে পা বাড়ালো গোসলের উদ্দেশ্যে।

থালাবাটির ঝনঝন শব্দে ঘুম ভাঙলো উল্লাসীর। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো সে। এখন সকাল নাকি রাত? কখন ঘুমিয়েছিল সে? আর কখনই বা উঠলো? বোধগম্য হলো না। সময় নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে সে ধীরপায়ে এগুলো রান্নাঘরের দিকে।
-“আপনি কখন এসেছেন?”
পিছন ফিরে উল্লাসীকে দেখামাত্র হাসি ফুটলো মেসবাহর ঠোঁটে। হাতের আলু রেখে সে এগিয়ে এল উল্লাসীর কাছে। মিষ্টি স্বরে বললো,
-“অনেক্ক্ষণ.. শরীরের কী অবস্থা?”
-“ভালো। কী করছিলেন আপনি?”
-“ভাত টা উঠিয়ে দিলাম। আলুভর্তা আর ডিম ভাজি.. চলবে তো রাতে?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে উল্লাসী পা বাড়ালো ড্রইংরুমের দিকে। ঘুম থেকে উঠার পর কিছুই ভালোলাগছে না তার। কোমর টেসে টেসে আসছে। শরীরে একদম শক্তি পাচ্ছে না। দু’পা প্রচন্ড চাবাচ্ছে..
-“এই উল্লাসী, আপেল খাবে? কেটে দেব?”
ডাইনিং থেকে গলা উঁচিয়ে মেসবাহ ডেকে উঠতেই নাকমুখ কুঁচকে ফেললো উল্লাসী। ক্ষীণ গলায় জবাব দিল,
-“উহু..”
-“আইসক্রিম?”
-“উহু..”
-“হালকা কিছু খেয়ে নাও। ততক্ষণে ভাত হোক।”
-“আচ্ছা হোক। একেবারে ভাতই খাবো।”
আর কথা বাড়ালো না মেসবাহ। এগুলো রান্নাঘরের দিকে। উল্লাসী আসার পর রান্নাঘর কী তার একরকম ভুলতেই বসেছিল সে। মেয়েটি অবুঝ হলেও যে পাক্কা রাধুনি তা মানতেই হবে! অবশ্য হবেই বা না কেনো? নিশ্চয় তার বাড়ির সকলের রান্না নিজে হাতে সামলাতে হয়েছে তাকে। সৎ মা যে কখনোই আপন মা হতে পারে না তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ উল্লাসীর ছোট মা। কী করে পারলেন উনি মিথ্যে লোভ দেখিয়ে ছোট একটি মেয়েকে বিয়ের পিড়িতে বসাতে? জবাবে মেসবাহর বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ভাতের হাঁড়িতে আলু ছেড়ে ডিমের জন্য পিয়াজ, মরিচ কাটতে শুরু করলো সে।

চোখ বুজে শুয়ে থাকার পরও ঘুমের দেখা না পেয়ে উঠে বসলো উল্লাসী। ডিম লাইটের মৃদু আলোয় ঘরের পুরোটা নজরে এলেও কোথাও মেসবাহর দেখা না পেয়ে জোর গলায় ডেকে উঠলো তাকে। খাবারের পাঠ চুকেছে অনেক্ক্ষণ। এখনো কেনো ঘরে আসেননি উনি?
-“কী হয়েছে? কিছু লাগবে?”
সিগারেট হাতে ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকে ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলো মেসবাহ। জবাবে উল্লাসী বললো,
-“উহু.. আপনি কখন ঘুমোবেন?”
-“এইতো.. এখনই।”
-“তো আসুন না! একা একা ঘুম পাচ্ছে না।”
জ্বলন্ত সিগারেট এশট্রেতে ফেলে বিছানায় এল মেসবাহ। বালিসে মাথা গুঁজে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই ওপাশ থেকে উল্লাসী বললো,
-“আপনার কি সিগারেট খুব বেশিই পছন্দ?”
-“বলতে পারো!”
-“কেনো পছন্দ? বিশেষ কী আছে এতে?”
মাথার নিচে এক হাত রেখে ফ্যানের দিকে চেয়ে মেসবাহ জবাব দিল,
-“এতে শান্তি আছে.. ”
-“তাহলে আপনার ভেতরে যখন অশান্তি কাজ করে তখনই আপনি সিগারেট খান?”
-“উহু.. তেমন কিছু নয়।”
-“তাহলে কেমন কিছু?”
-“তুমি ঘুমোও উল্লাসী।”
হতাশ মনে চোখজোড়া বুজলো উল্লাসী। তবে হঠাৎ করে মুন্নি সরকারের বলা কথাগুলো মাথায় আসায় আবারও চোখ মেললো সে। অনুরোধের গলায় বললো,
-“একটু আদর করে দিন না!”
-“আবারও শুরু করলে?”
-“কী হয় একটু আদর করলে? হাসান ভাইও তো মুন্নি ভাবিকে আদর করে। তাহলে আপনি আমায় করেন না কেনো?”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে মেসবাহ বললো,
-“তুমি পিচ্চি বলে। বড় হও.. অনেক আদর দিব।”
-“আমি যেহেতু পিচ্চি তাহলে আমায় পিচ্চি আদরই দিন। বড় হবার পর না হয় বড় আদর দেবেন!”
-“ঘুমোও উল্লাসী..”
-“দিন না! দিন একটু। একটুই তো। দিন না!”
-“ঘুমোও..”
-“দেবেন না আপনি? আমি কিন্তু উঠে মুন্নি ভাবির কাছে চলে যাবো।”
উল্লাসীর ছটফটের সাথে পেরে না উঠে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্লাসীর দিকে এগুলো মেসবাহ। চোখজোড়া বুজে পরম যত্নে কপালের মাঝবরাবর আলতো করে বসিয়ে দিল তার ঠোঁটের ছোঁয়া।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here