#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:১৩
.
.
.
আবির চা এনে দিয়েছে। কঙ্কা খুব আগ্রহ নিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। চা-টা খুবই ভালো হয়েছে। আবির চা খাচ্ছে না। সে বেশ বিরক্ত। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে প্রায়। চারপাশে আবছা আবছা আলো। কিছুক্ষণ পরেই আঁধার হয়ে যাবে। দারোয়ান বাইরের আলো জ্বালিয়ে দিলো। হলুদ রঙের আলো। সঙ্গে সঙ্গেই কতগুলো পোকা এসে জুটলো বাতির চারপাশে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বেশ শীতও নেমেছে। কঙ্কা গায়ে চাদর জড়িয়ে আছে। আবির হাতের সাথে হাত ঘসছে। সে বিরক্তি নিয়ে বলল,
–কঙ্কা, চলো আমার ফ্ল্যাটে যাই। মা খুব রেগে আছে আমার উপরে। আমাদের বাসায় ঢুকতে দেবে বলে মনে হয় না।
কঙ্কা নির্লিপ্তভাবে বলল,
–দেবেন। সারারাত ঠান্ডার মধ্যে ছেলেকে বাইরে রেখে কোনো মা শান্তি পাবেন না। ভবিষ্যতে আমাদের ছেলে যখন এভাবে বিয়ে করে বউ নিয়ে বাসায় আসবে তখন আমিও কিছু সময়ের জন্য ওদের বাইরে বসিয়ে রাখবো।
আবির হকচকিয়ে গেল। শুকনো গলায় বলল,
–আমাদের ছেলে এভাবে বিয়ে করবে?
–নিশ্চয়ই করবে। যার বাবা এরকম সে নিজে আর কেমন হবে?
আবিরের মুখ ছাইবর্ণ হয়ে গেল। কঙ্কা চায়ে শেষবার চুমুক দিয়ে বলল,
–আর যদি তুমি মেয়ের বাবা হও তাহলে তো কথাই নেই।
আবির ভ্রু কুঁচকে ফেললো। বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
–মানে?
– যদি তোমার মেয়ে হয়, তাহলে সেও তোমার মতো কোনো চরিত্রহীনের পাল্লায় পরবে। তুমি এযাবৎ যত মেয়ের ক্ষতি করেছ, তার সমস্ত মূল্য চুকাতে হবে তোমার মেয়েকে। মানুষ যা করে, আল্লাহ তাকে তাই ফেরত দেন। এই হলো নিয়ম।
আবির হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। এত কঠিন কথা বলে ফেলতে কঙ্কার একবারের জন্যও বুক কাঁপে নি। সে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে। আবির মৃদুস্বরে বলল,
–কঙ্কা, আমার মেয়ের মা কিন্তু তুমিই হবে।
কঙ্কা হেসে উঠে বলল,
–নাও হতে পারি। কে জানে কি আছে কপালে? তুমি তো কম মেয়ের কাছে যাও নি জীবনে। দেখো হয়তো কেউ তোমার সন্তানকে ইতোমধ্যে জন্ম দিয়েও ফেলেছে।
আবির কথা বলতে পারলো না। তার গলা শুকিয়ে আসছে। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কঙ্কা আরেকবার হেসে বলল,
–তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভয় পেয়ে গিয়েছ। ভয় পেয়ো না। আমি দোয়া করবো যেন তোমার মেয়ের কখনো কোনো ক্ষতি না হয়। ও যেন দুধেভাতে থাকে। একটা মেয়ে হয়ে অন্য কোনো মেয়ের ক্ষতি চাইবো না আমি। যা বলেছি, শুধু তোমাকে কিছুক্ষণের জন্য চিন্তায় ফেলবো বলে বলেছি। চিন্তা করো না। এমন কিছুই ঘটবে না। তোমার অপকর্মের শাস্তি তুমি নিজেই পাবে।
আবির এবার হেসে ফেলে বলল,
–কে শাস্তি দেবে? তুমি?
কঙ্কাও আবিরের সাথে হেসে বলল,
–শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর আছে।
আবির হাসি থামালো। প্রশ্ন করলো,
–তোমার কি মনে হয়? আল্লাহ সেই শাস্তি তোমার মাধ্যমে আমাকে দেবেন?
–সে শুধু আল্লাহই জানেন। আচ্ছা? তুমি কি আল্লাহকে বিশ্বাস করো, আবির?
আবির হকচকিয়ে গেল। কথার উপরে জোড় দিয়ে বলল,
–নিশ্চয়ই করি।
–তাহলে এত অপকর্ম অনায়াসে করো কি করে?
আবির উত্তর দিলো না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো এই অদ্ভুত মানবীর দিকে। কিছুক্ষণ পর ক্ষীণ গলায় বলল,
–তুমি আসলে কি চাও, কঙ্কা?
কঙ্কা হেসে বলল,
–তোমার সাথে সংসার করতে চাই। তুমি চাও না? তুমি কি আমাকে তালাক দিতে চাও?
আবির ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–জানি না।
কঙ্কা আর কথা বাড়ালো না। আবির শীতল গলায় বলল,
–কঙ্কা, আমি নিজেকে বদলে ফেলার চেষ্টা করছি। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, গত দশ দিন কোনো মেয়ের সাথে আমি কথা বলি নি। সত্যিই একটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চাই আমি।
–ভালো।
–তুমি বিশ্বাস করছো না?
–করছি। শুধু এই চাওয়াটা কতক্ষণ স্থায়ী হবে সেটা বুঝতে পারছি না।
আবির কথা বলল না। তার হঠাৎ মন খারাপ লাগছে। কেন লাগছে বুঝতে পারছে না।
বাসার দরজা খোলা হলো আরও ঘন্টাখানেক পর। দরজা খুললেন আবিরের মা, জাহানারা নিজেই। দরজা খোলার সাথে সাথেই আবির আর কঙ্কা উঠে দাঁড়ালো। কঙ্কা তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টেনে দিলো। জাহানারা থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। মেটে রঙের শাড়ির উপরে টকটকে লাল চাদর পরেছেন উনি। ভদ্রমহিলার চেহারায় মায়া মায়া ভাব। উনার ধবধবে ফর্সা চোখমুখ লাল টকটকে হয়ে আছে, চোখ ফুলে ঢোল। সম্ভবত উনি অনেক কান্নাকাটি করেছেন। একমাত্র ছেলে উনাকে না বলে বিয়ে করেছে, এতে যে উনি অসম্ভব কষ্ট পেয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উনার কষ্ট দেখে কঙ্কার কিছুটা উৎফুল্ল লাগছে। যে এমন একটা ছেলেকে জন্ম দিয়ে এই পৃথিবীতে অবাধে বিচরণ করতে দিয়েছে, তার কষ্ট পাওয়াই উচিত। জাহানারার সাথে বাসার একজন কাজের লোকও এসেছে। জাহানারা অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বললেন,
–আবির, তোর বউকে নিয়ে ভেতরে আয়। বাকিটা পরে ভেবে দেখছি।
আবির শুধু মাথা নাড়লো। জাহানারা কাজের লোকের উদ্দেশ্যে বললেন,
–মজনু, ওদের জিনিসপত্রগুলো ভেতরে ওদের ঘরে দিয়ে এসো।
কথা শেষ করে উনি ভেতরে চলে গেলেন। আবির আর কঙ্কা ধীর পায়ে হেঁটে বাসার ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে প্রথমেই একটা বসার ঘর, তার একপাশে খাওয়ার ঘর। বসার ঘর থেকেও ডাইনিং টেবিলের একাংশ দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত ভেতরে রান্নঘরও আছে, সেটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বসার ঘরের দেয়ালে বেশ কিছু তৈলচিত্র ঝুলানো আছে। সবই মোঘল সম্রাটদের ছবি। এতগুলো সম্রাটের ছবির মাঝে একটা মাত্র ছবি অটোমেন সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞীর। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে না দেখলে সেটা চোখে পরে না। সোফায় বসে আছেন আশরাফউদ্দিন সাহেব। ছিমছাম শরীর, গায়ের রঙ ময়লা, মুখে মেহেদি দিয়ে লাল করা দাড়ি, মাথায় আধপাকা পাতলা চুল। উনার মুখ হাসি হাসি। আবির কঙ্কার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
–আমার বাবা।
কঙ্কা মাথা নিচু করে বলল,
–আসসালামু আলাইকুম, বাবা।
আশরাফউদ্দিন সাহেব হাসিমুখে বললেন,
–ওয়া আলাইকুম সালাম। বসো, মা।
কঙ্কা জাহানারার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
–মা, বসবো?
জাহানারা কঠিন গলায় বললেন,
–বসতে বলেছে বসো। ঢং করবে না আমার সাথে। ঢং আমার পছন্দ না।
আশরাফউদ্দিন সাহেব বললেন,
–তুমি কিছু মনে করো না, মা। তোমার শাশুড়ি মা রেগে আছেন। তুমি বসো।
কঙ্কা বসলো। আবিরও পাশে বসলো। আশরাফউদ্দিন সাহেব আবিরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–তুই বিয়ে করেছিস, আমি খুবই খুশি হয়েছি।
জাহানারা খেঁকিয়ে উঠে বললেন,
–তুমি খুশি হয়েছ! এসব কি বলছো তুমি?
–জাহানারা,শান্ত হয়ে বসো। এত রাগারাগি করো না। মাথা ঠান্ডা রাখতে শেখো।
জাহানারা বসলেন। চোখ কটমট করে কঙ্কার দিকে তাকালেন। আশরাফউদ্দিন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
–তোমার নাম কি, মা?
কঙ্কা নতমুখে উত্তর দিলো,
–কঙ্কা।
–পুরো নাম কি?
–মৌরিন সুলতানা কঙ্কা।
–মাশাল্লাহ! খুব সুন্দর নাম। তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?
–মা, বাবা, আমার আপা আর….
–আর কে?
–নীলয় ভাই।
–সে কে? তোমার ভাই?
–জ্বি না। আমাদের রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়। উনার কেউ নেই বলে বাবা উনাকে মানুষ করেছেন। এখন উনি আমাদের পরিবারেরই একজন।
আশরাফউদ্দিন সাহেব হাসিমুখে বললেন,
–ভালো, খুব ভালো। তা মা, তোমার মা বাবা কোথায় থাকেন?
–এই শহরেই।
–আচ্ছা বেশ। এখন তাহলে হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম নাও। আবির, বৌমাকে ঘরে নিয়ে যা।
আবির উঠে দাঁড়ালো। কঙ্কার দিকে তাকিয়ে বলল,
–এসো, আমাদের ঘর দোতলায়।
_______________________
সন্ধ্যা থেকেই পত্রিকার অফিসে বসে আছে নীলয়। তার উদ্দেশ্য খসরু ভাইয়ের সাথে দেখা করা। খসরু ভাই এই পত্রিকার সাহিত্য পাতার দায়িত্বে আছেন। উনি এখন অফিসে নেই। আজ তিনি সন্ধ্যার পরে আসবেন। নীলয়কে বসতে বলা হয়েছে ওয়েটিং রুমে। ঘরে এসি চলছে। এই শীতে এসি কেন চালানো হয়েছে নীলয় বুঝতে পারছে না। সে ঘড়ির দিকে তাকালো। সন্ধ্যা সাতটা বাজতে চলেছে। খসরু ভাইয়ের আসার নাম নেই। নীলয় উঠে বাইরে গেল। অফিসের একজন পিয়নকে দেখতে পেলো নীলয়। সে খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাঁটছে। নীলয় ডাকলো,
–পিয়ন ভাই, শুনছেন?
পিয়ন খুব বিরক্ত মুখে দাঁড়ালো। সম্ভবত পিয়ন ভাই ডাকটা তার পছন্দ হয় নি। সে বিরস মুখে প্রশ্ন করলো,
–আপনি আবার কি চান? বললাম তো অপেক্ষা করেন।
–ভাই, দয়া করে ঘরের এসিটা একটু বন্ধ করে দিয়ে যান।
–রিমোট দিয়ে নিজে বন্ধ করেন।
–ভেতরে তো রিমোট নেই, ভাই।
–আছে। খুঁজে দেখেন।
–আচ্ছা, খুঁজবো। আপনি তাহলে আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যান।
–আপনারে চা দেবো কেন? আমি এই অফিসের কর্মচারী, আপনার না।
–আমিও এই অফিসেরই অংশ।
–কিভাবে?
–আমার লেখা কবিতা এই পত্রিকার সাপ্তাহিক সংখ্যায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়।
পিয়ন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
–আপনি কবি?
–জ্বি।
–আচ্ছা, বসেন।
পিয়ন চলে গেল। নীলয় ভেতরে গিয়ে বসলো। এসির রিমোট সে খুঁজে পাচ্ছে না। ঠান্ডায় তার হাত পা জমে যাচ্ছে। দু’মিনিটের মাথায় পিয়ন তাকে চা দিয়ে গেল। এসিও বন্ধ করে দিয়ে গেল। এসির রিমোট পরে ছিল সোফার পিছনে। নীলয় চায়ে চুমুক দিলো। অতি জঘন্য চা হয়েছে। চা ঠান্ডা, চিনি আছে কিনা বুঝতে পারা যাচ্ছে না, চায়ের উপরে ভাসছে এক টুকরো লেবু। নীলয় কাপ রেখে দিলো।
খসরু সাহেব এলেন আরও দু’ঘন্টা পরে। মাঝবয়সী ভদ্রলোক, খানিকটা বেঁটে, ক্লিন শেভ করা। উনি ওয়েটিং রুমে ঢুকতেই নীলয় উঠে দাঁড়ালো। খসরু সাহেব বসতে বসতে বললেন,
–কি হে কবি? খবর কি? বসো।
নীলয় বসে বলল,
–আসসালামু আলাইকুম, খসরু ভাই। ভালো আছেন?
–আছি আলহামদুলিল্লাহ। তুমি এই সময় অফিসে যে? শুনলাম বিকেল থেকে বসে আছ। জরুরি দরকার নাকি?
নীলয় ইতস্তত করে বলল,
–না মানে, খুব বেশি জরুরি নয়।
–কি দরকার বলে ফেলো।
–খসরু ভাই, দিনকয়েক আগে পুতুল নামের একটা মেয়ে আমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।
খসরু সাহেব অবাক হয়ে বললেন,
–মাই গড! পুতুল সত্যিই তোমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল নাকি? মেয়েটা দেখছি সত্যিই পাগল হয়ে গেল।
নীলয় বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
–খসরু ভাই, আপনি এমনভাবে পুতুল শব্দটা উচ্চারণ করলেন যেন মেয়েটা আপনার অনেকদিনের পরিচিত!
–পরিচিত মানে? আমি তো ওকে জন্মাতে দেখেছি। ও আমাদের সম্পাদক সাহেবের মেয়ে।
নীলয় হকচকিয়ে গেল। বিস্ময় নিয়ে বলল,
–স…সম্পাদক সাহেবের মেয়ে!
–হ্যাঁ, জার্নালিজম নিয়ে অনার্স করছে। পড়াশোনা শেষ করে এখানেই জয়েন করবে। তোমার কবিতা পড়ে তো সে মুগ্ধ। আমাকে এসে ধরলো। খসরু ভাই, কবি সাহেবের ঠিকানা চাই। মেয়েটাকে কত করে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। কোনো লাভ হলো না।
–কি বুঝানোর চেষ্টা করলেন?
–এটাই যে, কবিদের কবিতাই সুন্দর। বাস্তবে তাদের প্রেমে পরতে নেই। কবিদের দিয়ে প্রেম টেম হয় না। মেয়েটা বুঝলো না। বুঝলে নীলয়, পুতুল একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
নীলয় ঢোক গিলে বলল,
–প্রেম!
–হ্যাঁ, প্রেম। পুতুলের ধারণা ও তোমার প্রেমে পরেছে। তবে আমার ধারণা পুতুলের এই ঘোর খুব শীঘ্রই কেটে যাবে।
–ঘোর কেটে যাবে?
খসরু সাহেব হেসে উঠে বললেন,
–নিশ্চয়ই যাবে। কারণ পুতুল তো তোমার প্রেমে পরে নি। পরেছে তোমার কবিতার প্রেমে। এসব আবেগ দ্রুতই কেটে যায়। যাই হোক, পুতুলের কথা জিজ্ঞেস করতেই কি এসেছিলে?
নীলয় একবার একটু ইতস্তত করলো। তারপর আমতা আমতা করে বলল,
–না মানে….খসরু ভাই, পুতুলের ঠিকানাটা কি পাওয়া যাবে?
খসরু সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন,
–কেন?
–না মানে, উনি ভুল করে একটা কলম আমার কাছে রেখে গিয়েছেন। ওটা ফেরত দিতে হবে।
–ঠিক আছে, কলমটা আমাকে দিয়ে যাও। আমি ফেরত দিয়ে দেবো।
নীলয় বিপদে পরে গেল। কলমটা তো পুতুল তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল। এবার সে কি করবে? খসরু সাহেব বললেন,
–কি হলো? মুখ ভোঁতা করে ফেললে কেন? কলমটা দাও।
নীলয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–কলমটা আমার সাথে নেই, খসরু ভাই। বাসায় রেখে এসেছি। পরে এসে দিয়ে যাব। এখন আসি। আসসালামু আলাইকুম।
নীলয় চলে যাচ্ছিলো। খসরু সাহেব পিছু ডেকে বললেন,
–নীলয়, ঠিকানাটা নিয়ে যাও।
–না থাক। লাগবে না।
নীলয় বেরিয়ে গেল। অফিস থেকে নেমে গেল রাস্তায়। ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলো উদ্দেশ্যহীনভাবে।
__________________________
শাদাব আর সুরমা বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে। রাত অনেক হয়েছে। কোথা থেকে যেন শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। সুরমা ভয়ে শাদাবের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলছে। শাদাব অনেকক্ষণ ধরে একটা কথা বলতে চাইছে। সুরমা কথাটা কিভাবে নেবে বুঝতে পারছে না সে। শাদাব কথাটা শুরু করলো ভূমিকা করে।
–সুর, আজ সারারাত গল্প করলে কেমন হয়?
সুরমা লাজুক হেসে বলল,
–খুব ভালো হয়।
–আচ্ছা বেশ। তুমি গল্প বলো। আমি শুনবো।
–কি গল্প বলবো?
–তোমার ছোটবেলার গল্প বলো। ছোটবেলায় তুমি কি খুব চঞ্চল ছিলে?
সুরমা মৃদু হেসে বলল,
–না, আমি খুব শান্তশিষ্ট মেয়ে ছিলাম। কঙ্কা ভীষণ চঞ্চল ছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে দুষ্টুমি করার জন্য কত মার যে খেয়েছে!
–তাই? তুমি খুব শান্ত ছিলে?
–হ্যাঁ, ছিলাম। মা মরা মেয়েরা চঞ্চল হয় না।
শাদাব সুরমার মুখের দিকে তাকালো। তার চোখেমুখে কষ্টের ছাপ। শাদাব সুরমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
–এসব বলছো কেন? তোমার খালা কি তোমায় কম ভালোবাসেন? উনিও তো তোমার মা।
–হ্যাঁ। খালাও আমার আরেক মা।
শাদাব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
–আজ সকালে তোমার বাবা এসেছিলেন আমার অফিসে।
সুরমা হকচকিয়ে উঠে বসলো। শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো শাদাবের দিকে। শাদাব সুরমার হাত ধরে ফেললো। আদুরে গলায় বলল,
–সুর, কাছে এসো।
সুরমা গেল না। কাঠকাঠ গলায় বলল,
–উনি কেন এসেছিলেন?
–এমনি এসেছিলেন। আমার সাথে দেখা করতে। আমাদের বিয়েতে উনি আসুক সেটা তুমি চাও নি। তাই বিয়ের দিন উনি ছিলেন না। একারণেই আজ এসেছিলেন।
সুরমা কঠিন গলায় বলল,
–কি বলছিলেন?
–তেমন কিছু নয়। স্বাভাবিক কথাবার্তা। তুমি কেমন আছ জিজ্ঞেস করছিলেন।
সুরমা হাসতে শুরু করলো। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। শাদাব উঠে বসলো। সে বুঝতে পারছে যে সুরমা যন্ত্রণার হাসি হাসছে। সে এগিয়ে গিয়ে সুরমার দুই হাত চেপে ধরলো। সুরমা হাসি থামালো। শীতল গলায় বলল,
–এত বছর পর হঠাৎ?
–সুর, তুমি কষ্ট পেয়ো না। আমার ধারণা উনি শুধু আমাকে দেখতে এসেছিলেন। আর কিছু নয়।
–কষ্ট পাচ্ছি না। শুধু ভাবছি।
–কি ভাবছো?
–যখন খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল তখন না এসে এখন কেন এসেছেন সেটাই ভাবছি। আমার মা মারা যাওয়ার একমাসের মাথায় ওই লোকটা আবার বিয়ে করেছিল। তার স্ত্রী আমাকে সহ্য করতে পারতো না। আমাকে ঠিকমতো খেতে দিতো না, আমার সাথে….
সুরমা কথা শেষ করতে পারলো না। তার গলা ধরে এসেছে। শাদাব তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। সুরমা কেঁদে উঠলো। শাদাব স্ত্রীর মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
–থাক, কষ্টের কথা মনে করতে হবে না। তুমি বর্তমান নিয়ে ভাবো। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আর কোনো কষ্ট পাবে না কখনো।
সুরমা মাথা তুলে শাদাবের দিকে তাকালো। রাগ দেখিয়ে বলল,
–ওই ভদ্রলোকের সাথে আর কখনো তুমি কথা বলবে না। বুঝতে পেরেছ?
–আচ্ছা, ঠিক আছে। বলবো না। এবার ঘুমাবে এসো।
সুরমা মাথা নাড়লো। শাদাব তাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পরলো। স্ত্রীকে কাছে টেনে চুম্বন করলো। ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগলো অন্য ভুবনে।
_______________________
কঙ্কা খুব ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে পরেছে। আবির এখনো পরে পরে ঘুমোচ্ছে। আবিরের ঘরটা বেশ সুন্দর। ঘরের মাঝখানে বিশাল বড় বিছানা। বিছানায় ধবধবে সাদা রঙের চাদর। ঘরের দেয়াল নীল রঙের, জানালায় গাঢ় বেগুনি রঙের পর্দা। একপাশের দেয়ালে আবির আর তার মা বাবার ছবি ঝুলানো। তার পাশের দেয়ালে একটা এলইডি টিভি। টিভির সামনে একটা সোফা। কঙ্কা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলগুলো আঁচড়ালো। তারপর নিজের জামাকাপড়গুলো ব্যাগ থেকে বের করে খুব যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখলো। তার মায়ের গয়নাগুলো একটা প্যাকেটে রাখলো। কঙ্কা ঠিক করেছে গয়নাগুলো সে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। এগুলোর আর দরকার নেই।
কঙ্কা মাথায় ঘোমটা টেনে বাইরে এলো। বাসায় পিনপতন নীরবতা। সম্ভবত কেউ এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি। কঙ্কা খুব ধীরে হাঁটছে। শুধু পা ফেলার সাথে সাথে তার নতুন শাড়ির ঘসঘস আওয়াজ হচ্ছে। এই শাড়িটা কঙ্কার শাশুড়ি মা নিজেই গতকাল তাকে দিয়েছেন। খুশি মনে যে দিয়েছেন, তেমন নয়। তবে দিয়েছেন।
কঙ্কা দোতলা থেকে নিচে নেমে এসেছে। নিচেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কঙ্কা রান্নাঘরের দিকে গেল। সেখানে একটা অল্পবয়সী মেয়েকে দেখতে পেলো সে। কঙ্কা চিনতে পারলো না তাকে। কাছে এগিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলো,
–তুমি কি করছো?
সাদা পোশাকে থাকা মেয়েটি চমকে উঠলো। কঙ্কাকে পা থেকে মাথা অব্দি দেখে নিয়ে বলল,
–আপনিই ছোট সাহেবের স্ত্রী?
–হ্যাঁ।
–ও আচ্ছা। আমি নাস্তা রেডি করছি। আমি এ বাড়ির রাঁধুনি।
–ও। তুমি এখানে রান্না করো?
–হ্যাঁ। রান্না করার বদলে আমি এখানে থাকি, খাই। পড়াশোনাও করি।
–তোমাকে আমার শ্বশুরমশাই পড়াশোনা করান?
–হ্যাঁ। আমার কেউ নেই তো। তাই উনি আমাকে রাঁধুনির কাজ দিয়েছেন।
–বাহ! বেশ ভালো মানুষ তো উনি।
মেয়েটা হেসে ফেললো। কঙ্কা হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলো,
–হাসছো কেন?
–উনাকে ভালো বললেন বলে হাসছি।
–উনি ভালো নন?
–জ্বি না। উনি অত্যন্ত খারাপ মানুষ।
–আশ্চর্য মেয়ে তো তুমি! যার সাহায্য নিয়ে বেঁচে আছ, তাকেই খারাপ বলছো?
–এই বাসার অনেক রহস্য আছে, ভাবি। আপনি বুঝবেন না।
কঙ্কা হেসে বলল,
–ধীরে ধীরে সব বুঝবো। আমার বুদ্ধি খুব বেশি।
–বুদ্ধি বেশি হলেই ভালো।
–আচ্ছা? তোমার নাম কি?
– আমার নাম অযাচিনী।
কঙ্কা ভ্রু কুঁচকে বলল,
–অযাচিনী! এটা কেমন নাম?
অযাচিনী হেসে ফেললো। উত্তর দিলো না। টি পট থেকে চা ঢাললো। ট্রেতে এক কাপ চা নিলো। তার সাথে একটা কাঁচের গ্লাস। গ্লাসভর্তি পানির উপরে ছোট সাদা পাথরের মতো কয়েকটা বস্তু ভাসছে। কঙ্কা বলল,
–এগুলো কি?
অযাচিনী হেসে ফেলে উত্তর দিলো,
–এগুলো মেহগনি ফলের বীজ। পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়েছিল সারারাত।
–এগুলো তুমি কাকে দিতে যাচ্ছ, অযাচিনী?
–বাবু সাহেবকে। উনি রোজ ভোরে প্রথমে মেহগনি বীজ ভেজানো পানি খান। তারপর এক কাপ চা খান।
–বাবু সাহেব মানে?
–আপনার শ্বশুর।
–তুমি উনাকে বাবু সাহেব ডাকো? বড় সাহেব কেন নয়?
–এমনি।
অযাচিনী ট্রে হাতে উঠিয়ে নিলো। বলল,
–এটা এবার উনাকে দিতে যাব। উনি এখন বাগানে হাঁটাহাঁটি করছেন।
কঙ্কা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–অযাচিনী, ট্রে আমাকে দাও। আমি দিয়ে আসছি।
অযাচিনী বিনা বাক্য ব্যয়ে তা দিয়ে দিলো।
.
#চলবে………….