#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:১৫
.
.
.
মাথার উপর শীতের দুপুরের সূর্য। মিষ্টি মলিন রোদ গায়ে এসে পরছে। কঙ্কা দাঁড়িয়ে আছে একটা কলেজের সামনে। কলেজের দরজা বন্ধ। ভেতরে কিসের যেন পরীক্ষা চলছে। এ কারণে দারোয়ান তাকে ভেতরে যেতে দিচ্ছেন না। কঙ্কা বেশ কিছুক্ষণ থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। কলেজের সামনের রাস্তাটায় যানবাহনের ভিড় কম। রাস্তার ধার ঘেঁষে কয়েকটা ঝালমুড়ি আর চটপটির দোকান। কলেজের প্রাচীর ঘেঁষে একটা শিমুল তুলোর গাছ। কঙ্কা গাছপালা খুব একটা চেনে না। কিন্তু এই গাছটা সে চেনে। তাদের বাড়িতে একটা শিমুল গাছ ছিল। প্রায় বছর দশেক আগে সেটা কেটে ফেলা হয়েছিল। গাছটা কঙ্কার অনেক স্মৃতির সাক্ষী ছিল৷ গাছটি কেটে ফেলা হবে শুনতেই কঙ্কার মনে দোলা দিয়ে উঠেছিল নিরন্তর আনন্দের শৈশবে সেই গাছের নিচে পাটি পেতে পুতুল খেলার দিন, কখনো বা শিমুলের লাল টকটকে ফুল এনে ঘরে সাজিয়ে রাখার দিন, কখনো মায়ের বকুনি খেয়ে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে কেঁদে ভাসানোর দিনগুলো। মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে বলেছিল যেন গাছটা না কাটা হয়। কিন্তু কঙ্কার কথা শোনা হয় নি। আয়েশা নিষ্ঠুরের মতো বলেছিলেন, “আমি যা বলবো তাই হবে। তুই যখন রোজগার করে এনে আমাকে খাওয়াবি তখন নিজের ইচ্ছার কথা বলিস। আপাতত তোর কোনো ইচ্ছা নেই।”
বাড়ির কথা মনে পড়তেই কঙ্কা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। বুকটা হুহু করে উঠলো। তাকে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হলো। পরীক্ষা শেষ হলো ঠিক দুপুর বারোটা ত্রিশ মিনিটে। কলেজের ভেতর থেকে সবাই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। কঙ্কা দরজার কাছাকাছি গেল এবং এমন একটি সুবিধাজনক অবস্থানে দাঁড়ালো যেখান থেকে সবার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাবে। কঙ্কা নিজের ফোনে পানশি নামের মেয়েটির ছবি আরেকবার দেখে নিলো। তারপর ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটিকে খুঁজতে লাগলো। মনে সংশয় দানা বাঁধছে। পানশিকে খুঁজে পাওয়া যাবে তো? অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় নি তো মেয়েটা? যদি মেয়েটাকে না পাওয়া যায় তখন কি হবে? সকাল থেকে তো সে পানশির জন্যই অপেক্ষা করছে। মায়ের গয়না ফেরত পাঠানো অজুহাত মাত্র। আসল উদ্দেশ্য পানশিই ছিল। পানশির পরিবার কোথায় থাকে সে ঠিকানাও কঙ্কা জোগাড় করেছিল। প্রথমে সেখানেই গিয়েছিল সে। কিন্তু পানশি ঠিকানা বদল করে ফেলেছে। এখন আর সেখানে সে থাকে না। তাই কঙ্কা ছুটে এসেছে পানশির কলেজে। যে করেই হোক, মেয়েটাকে খুঁজে পেতেই হবে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কঙ্কা পানশিকে দেখতে পেলো। কঙ্কা চকিত হয়ে উঠলো। আরও একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখে নিলো মেয়েটিকে। হ্যাঁ, এই সেই মেয়ে। কোনো ভুল নেই। পানশি দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। ওইতো, মেয়েটা এখন রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে; হয়তো রিকশা, অটো বা বাসের জন্য। কঙ্কা ছুটে গিয়ে পানশির পাশে দাঁড়ালো। অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল,
–পানশি, তোমার সাথে খুব জরুরি কথা আছে।
পানশি চমকে উঠে কঙ্কার দিকে তাকালো। তার ভ্রু কুঁচকে গেছে। সে কিছুক্ষণ পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকলো কঙ্কার দিকে। তারপর মৃদু গলায় বলল,
–কে আপনি? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। আমার নাম কি করে জানলেন?
কঙ্কা মুখে হাসি টেনে বলল,
–আমাকে তুমি চিনবে না। আমি তোমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। কিছু কথা আছে তোমার সাথে। একটু সময় দেবে?
–কি কথা? বলুন।
–এখানে নয়। চলো কোথাও বসি।
পানশি বিরক্ত মুখে বলল,
–দুঃখিত! অপরিচিত কারোর সাথে আমি কোথাও গিয়ে বসতে পারবো না।
–কথাগুলো খুব জরুরি, পানশি। তোমার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য চেষ্টা করছি আমি। আমার কথাগুলো শোনো।
–যা বলার এখানেই বলুন।
কঙ্কা ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–আচ্ছা, বেশ। বলছি। কিন্তু তুমি কথা দাও, আমার পুরো কথা তুমি শুনবে।
–আপনি কিন্তু অযথা আমার সময় নষ্ট করছেন। কি বলতে চান তাড়াতাড়ি বলুন। নইলে আমায় যেতে দিন।
কঙ্কা শীতল গলায় বলল,
–পানশি, আবির হোসেন শরিফের সাথে তোমার একটা সম্পর্ক ছিল। ঠিক না?
পানশি হতচকিত হয়ে গেল। তার চোখেমুখে অগাধ বিস্ময়। বড় বড় চোখ মেলে সে তাকিয়ে আছে কঙ্কার মুখের দিকে। কঙ্কা আবার বলল,
–নিজের জীবনটা কেন নষ্ট করছো?
পানশির বিস্ময় এখনো কাটছে না। সে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল,
–আপনি কে?
কঙ্কা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
–আমি আবিরের স্ত্রী।
পানশির বিস্ময় আরও বাড়লো। কঙ্কা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে পানশির চোখে জল জমছে। তবে মেয়েটা দ্রুতই নিজেকে সামলে নিলো। গলায় কঠিন ভাব এনে বলল,
–ও আচ্ছা। শেষ পর্যন্ত আবির তাহলে পথে এসেছে। ভালো। খুব ভালো! শুনে খুশি হলাম। কিন্তু আপনি আমার কাছে কি চাইছেন?
কঙ্কা ঠান্ডা গলায় বলল,
–তোমার একটা এক বছর বয়সী মেয়ে আছে না, পানশি?
পানশি হতভম্ব হয়ে গেল। তার চেহারায় আবারও বিস্ময় দানা বাঁধছে। কঙ্কার শীতল গলার প্রশ্নে তার শরীরে হিম ধরে গেছে। সে উত্তর দিতে পারলো না। কঙ্কা তাকে টেনে নিয়ে একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো।তারপর বলল,
–তুমি নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছো। হয়তো ভাবছো, যে সন্তানের জীবিত থাকার কথা আবির নিজেই জানে না, তার কথা আমি কি করে জানলাম। তাই তো? আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, পানশি। যে অন্যায় আবির তোমার সাথে করেছে, সে অন্যায় আরও অনেক মেয়ের সাথেই ও করেছে। আমি চেয়েছিলাম সেই সব মেয়েদের সাহায্য নিয়ে আবিরের নামে পুলিশ কেস করবো। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হতো না। কারণ ওর বাবার টাকা পয়সার জোর আছে। তাই আমি অন্য পথে হাঁটতে চাইলাম। আর সে পথে হাঁটতে গিয়েই তোমার সম্পর্কে জানতে পারলাম। জানতে পারলাম যে তোমার সাথে আমার স্বামীর সম্পর্ক ছিল এবং তোমার মেয়ের বাবা আমার স্বামী। আবিরের অনেক কঠিন শাস্তি পাওনা ছিল। কিন্তু সেটা আমি ওকে দেবো না শুধুমাত্র তোমাদের সন্তানের কথা ভেবে।
পানশি এবারও কোনো কথা বলল না। কঙ্কা কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষা করলো। তারপর বলল,
–তুমি তোমার মেয়ের অধিকার চাও না, পানসি? ওর একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ চাও না?
পানশি কাঁপা গলায় বলল,
–আ…আপনি আমাকে কি করতে বলছেন?
–তুমি তোমার মেয়েকে নিয়ে আবিরের বাসায় আসবে। সব সত্যি কথা অকপটে সবার সামনে বলবে৷ প্রমাণ করার দায়িত্ব আমার। আমি নিজে তোমাদের বিয়ে দেবো।
পানশির চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। সে কাঠকাঠ গলায় বলল,
–আপনি কি মজা করছেন আমার সাথে?
–না না। আমি সত্যি বলছি। আবিরের সাথে আমি তোমার বিয়ে দেবো। আবির আগে তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয় নি। কারণ তখন সমাজের কেউ এ বিষয়ে জানতো না। কিন্তু এখন সবাই জানবে। আবিরের মা বাবা সমাজে নিজেদের তথাকথিত মানসম্মান বজায় রাখার জন্য তোমার সাথে ওর বিয়েটা দেবেন।
পানশি একইভাবে জবাব দিলো,
–আবির আমাকে বিয়ে করবে কিনা সে ব্যাপারে আমি চিন্তিত নই। কারণ আমি নিজেই আবিরকে বিয়ে করতে চাই না। ওর মতো চরিত্রহীনকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
কঙ্কা মৃদু হেসে বলল,
–চরিত্র তো তুমিও হারিয়েছ, পানশি। আবিরের মতো একাধিক মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়াও নি ঠিকই। কিন্তু ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে আবিরের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে তো জড়িয়েছিলে। তাই না?
পানশি মোমবাতির শিখার মতো দপ করে নিভে গেল। তার চোখে পানি এসে গেছে। সে মাথা নিচু করে বলল,
–ভুল করেছিলাম। আর কোনো ভুল করতে চাই না আমি।
কঙ্কা পানশির কাঁধে হাত রাখলো। কোমল গলায় বলল,
–আমার কথায় কষ্ট পেয়ো না, পানশি। তোমার মেয়েটার কথা ভেবে দেখো একবার। আরও একটা কথা ভাবো। যখন তুমি প্রেগন্যান্ট হয়ে পরেছিলে, তখন আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব, সবার কাছে তোমাকে আর তোমার পরিবারকে গঞ্জনা ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে। ঠিকানা বদল করতে হয়েছে। সব আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়েছে। হয়েছে না?
পানশি কথা বলল না। তার গলা অব্দি কান্না উঠে এসেছে। কঙ্কা স্নেহার্দ্র স্বরে বলল,
–কিন্তু সকল ভর্ৎসনা আর অসম্মান তো তোমার একার প্রাপ্য নয়, পানশি। আবিরও এতে অংশীদার। আবিরেরও অসম্মান আর অপমান প্রাপ্য আছে। বুঝতে পারছো আমার কথা?
পানশি ব্যথিত গলায় বলল,
–পারছি। কিন্তু আমি আপনার কথা রাখতে পারবো না। আমাকে মাফ করুন।
কঙ্কা হেসে বলল,
–আচ্ছা, বেশ। তবুও আমার শ্বশুর বাড়ির ঠিকানাটা আমি তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি।
পানশি কঠিন গলায় বলল,
–দরকার নেই।
–দরকার না থাকলেও দিচ্ছি।
কঙ্কা ব্যাগ থেকে এক টুকরো কাগজ বের করলো। তারপর সেটা পানশির হাতে গুঁজে দিয়ে বলল,
–নাও, এতে ঠিকানা লেখা আছে। সাথে আমার ফোন নাম্বারও লেখা আছে। দরকার মনে করলে ফোন করো। আসছি, পানশি। ভালো থেকো। তোমার মেয়ের জন্য আমার অনেক আদর রইলো।
হাসিমুখে কথাগুলো বলে কঙ্কা রাস্তার দিকে এগিয়ে এলো। একটা রিকশা ডেকে উঠে পরলো। রিকশা চলতে শুরু করতেই এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা অশ্রুকণাগুলো ঝরঝর করে ঝরে পরলো। কঙ্কা চোখ বুজে ফেললো। এমন পরিকল্পনা সে পূর্বেই করে রেখেছিল। এমনটা হবে সেটাও তার আগেই জানা ছিল। তবুও তার চোখে জল আসছে। বুকে কেমন একটা ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। এর কোনো মানে হয়?
______________________________
বিকাল হয়ে এসেছে। সুরমা থম মেরে বসার ঘরের মেঝেতে বসে আছে। পিছনে সোফায় বসে আছেন সাবিনা বানু। উনার হাতে ডিভোর্স পিটিশনের কাগজ। উনি কাঠ হয়ে বসে আছেন। সুরমা দুপুর থেকে একটানা কাঁদছে। তার চোখমুখ ফুলে গেছে। দুপুরে ভাতও খায় নি সে। সাবিনা বানু সুরমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
–মা গো, মনে হয় কিছু ভুল বোঝাবুঝি হইতেছে।
সুরমা কথা বলল না। সাবিনা বানু স্নেহের স্বরে বললেন,
–দুপুরে তো খাও নাই। এখন কিছু খাও। নাহলে শরীর খারাপ হবে।
সুরমা শীতল গলায় বলল,
–না, মা। আপনার ছেলে আগে আসুক। তারপর খাব। ওর মনের যদি এই ইচ্ছা হয় তাহলে আর এক মুহূর্ত আমি এখানে থাকবো না।
সাবিনা বানু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সুরমাকে কিছুতেই বুঝানো যাচ্ছে না। শাদাব ছাড়া কেউ আর ওকে স্বাভাবিক করতে পারবে না। ছেলের অপেক্ষায় চুপচাপ বসে রইলেন তিনি।
শাদাব অল্প কিছুক্ষণ পরেই বাসায় এলো। দরজা খোলা ছিল। শাদাব ‘মা মা’ বলে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ঢুকলো। বাড়িতে সুনসান নীরবতা। শাদাব ভেতরে এসে বসার ঘরে দুজনকে দেখতে পেলো। সে ভেতরে ঢুকলো। তার মায়ের মুখ থমথমে। সুরমার দিকে তাকিয়ে সে খানিকটা ধাক্কার মতো খেলো। সুরমার চোখমুখ লাল হয়ে আছে, চোখের সাদা অংশ অসম্ভব রকমের লালচে, চোখ ফুলে আছে, গলদেশ সিক্ত। শাদাব আসতেই সুরমা মুখ চেপে ধরে ডুকরে উঠলো। শাদাব বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করলো,
–কি হয়েছে, মা? সুরমা কাঁদছে কেন?
সাবিনা বানু উঠে দাঁড়ালেন। হাতের কাগজটা শাদাবের হাতে দিয়ে বললেন,
–এটা আজ দুপুরে পোস্ট অফিস থেকে দিয়ে গেছে।
বলেই বসার ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন। শাদাব ডান হাত থেকে অফিসের ব্যাগটা সোফায় রাখলো। তারপর মায়ের ধরিয়ে দেওয়া কাগজটা মেললো। কাগজটা দেখে সে নিজেই রীতিমতো ধাক্কা খেলো। পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকলো কাগজের দিকে। তারপর উল্টেপাল্টে কাগজটা দেখে নিলো। ধীরে ধীরে চোখ তুলে সুরমার দিকে তাকালো। সুরমা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। শাদাব অস্থির হয়ে বলল,
–সুর, এটা আসলে….
সুরমা শাদাবকে কথা শেষ করতে দিলো না। ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে শাদাবকে ধাক্কা দিলো। কেঁদে উঠে বলল,
–কেন এরকম করলে তুমি? কেন?
শাদাব সুরমার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
–আমার কথাটা তো শুনবে। এই কাগজ….
সুরমা এবার চেঁচিয়ে বলল,
–চুপ করো। আর কিচ্ছু শুনবো না আমি। সম্পর্কটা যখন ভেঙেই দেবে, তখন কেন আবার আমার কাছে এসেছিলে? কি দরকার ছিল? এতটা শাস্তি কেন দিলে তুমি আমাকে?
শাদাব এবার সুরমাকে কাছে টেনে নিলো। স্ত্রীকে নিজের সাথে চেপে ধরে বলল,
–চুপ! শান্ত হও। আমার কথা শোনো আগে।
সুরমা শাদাবকে সরানোর চেষ্টা করে বলল,
–না না। কিচ্ছু শুনবো না। ছাড়ো আমাকে। ছাড়ো।
শাদাব ছাড়লো না। সুরমার চোখ মুছে দিতে দিতে বলল,
–আমার চোখের দিকে তাকাও। ভালো করে তাকাও। আমি কি বলছি মনোযোগ দিয়ে শোনো।
সুরমা তাকালো। অনেকক্ষণ তাকিয়েই রইলো। শাদাব স্ত্রীকে চুমু খেয়ে বলল,
– আমি তোমাকে ডিভোর্স দিতে চাই না, সুর। আমাদের সম্পর্ক ভাঙতে চাই না। সারাজীবন তোমাকে পাশে চাই। বুঝতে পেরেছ?
সুরমা ভাঙা গলায় বলল,
–তা..তাহলে এটা….?
–এই কাগজ আমি অনেক আগেই তৈরি করতে বলেছিলাম, সুর। তখন বলেছিলাম যখন এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিল, যখন আমাদের মধ্যে মান অভিমান চলছিল। কিন্তু উকিল সাহেব কাগজটা পাঠাতে দেরি করে ফেলেছেন। এখন উনি কি করে জানবেন বলো আমাদের মধ্যে যে সব মিটমাট হয়ে গেছে?
সুরমা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো স্বামীর মুখের দিকে। শাদাব মুচকি হাসলো। সুরমার এলোমেলো চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
–তুমি ভীষণ বোকা, সুর। ব্যাপারটা আসলে কি, সেটা ভালোভাবে না বুঝেই এমন কেঁদে ভাসাতে আছে?
সুরমা এবার খপ করে শাদাবকে জড়িয়ে ধরলো। শাদাবের বুকে মুখ গুঁজে হুহু করে কেঁদে ফেললো সে। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
–ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, শাদাব। খুব ভয় পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল তুমি বুঝি সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আর কখনো এমন করো না। কখনো আমাকে ছেড়ে যেয়ো না প্লিজ!
শাদাব আলতো হাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে নিলো। মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
–অনেক কান্নাকাটি হয়েছে। এবার থামো। নিশ্চয়ই দুপুর থেকে কিছু খাও নি। চলো, খেয়ে নেবে।
সুরমা শাদাবের বুক থেকে মাথা তুললো। চোখ নাক মুছতে মুছতে বলল,
–তুমি হাতমুখ ধুয়ে এসো। তোমাকেও চা দিচ্ছি।
শাদাব হেসে বলল,
–খালার বাসায় যাবে না? ব্যাগ গুছিয়েছ? নাকি কেঁদেকেটেই দিনটা পার করলে?
সুরমা হেসে ফেলে বলল,
–কেঁদেকেটে দিন পার করেছি। আজ থাক। অন্যদিন যাব।
–সেই ভালো। কান্নাকাটি করে চেহারার যা হাল করেছ! এই অবস্থায় তোমাকে দেখলে তোমার খালুজান ভাবতেন আমি বোধহয় তোমাকে মারধর করেছি। আমাকে নির্ঘাত পুলিশে দিতেন।
সুরমা হেসে ফেললো। শাদাবের বুকে কিল মেরে বলল,
–যাও! খালি আজেবাজে কথা।
শাদাব দাঁত বের করে হাসলো। হাতে থাকা ডিভোর্স পিটিশনের কাগজ ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলে দিলো। তারপর সুরমার দিকে তাকিয়ে গাঢ় স্বরে বলল,
–আমি উকিল সাহেবকে বলে দেবো, আমাদের ডিভোর্সের কাজ উনাকে আর করতে হবে না। আমরা আর এসব বাজে জিনিস নিয়ে ভাবছি না। আমরা এখন আমাদের সন্তানকে পৃথিবীতে আনার চেষ্টায় ব্যস্ত আছি।
সুরমা সলজ্জ হেসে দৃষ্টি নত করলো। শাদাব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো স্ত্রীর লজ্জারুণ মুখের দিকে।
_____________________________
কঙ্কার বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বিকালের মধ্যেই ফিরতে পারবে বলে ভেবেছিল সে। কিন্তু বাস জ্যামে পরেছিল। সারাদিনের ছোটাছুটিতে সে ক্লান্ত হয়ে পরেছিল। তার উপর সকাল থেকে পেটে কোনো খাবারই পরে নি। শরীর দূর্বল হয়ে এসেছে। হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছিলো তার। ক্লান্ত পা ফেলে যখন সে বাসায় প্রবেশ করলো তখন বাসার পরিবেশ থমথমে। ড্রয়িং রুমে সবাই বসেছিল। কঙ্কা ভেতরে যেতেই সবাইকে দেখতে পেলো। আবির চিন্তিত মুখে বসে আছে। জাহানারার চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি ভস্ম করে দেবেন কঙ্কাকে। একমাত্র আশরাফউদ্দিন সাহেবই শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন।
কঙ্কা হাসার চেষ্টা করে বলল,
–দেরি হয়ে গেল।
আশরাফউদ্দিন সাহেব বললেন,
–ঠিক আছে, মা। ঘরে যাও।
কঙ্কা ঘরে যাচ্ছিলো। জাহানারা কঠিন গলায় বলে উঠলেন,
–দাঁড়াও।
কঙ্কা দাঁড়িয়ে পরলো। জাহানারা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কঙ্কার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
–কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
কঙ্কা বিচলিত হলো না। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
–কুরিয়ার অফিসে, মা। আমার মায়ের গয়নাগুলো ফেরত পাঠাতে।
জাহানারা ঠান্ডা গলায় বললেন,
–কোনো কিছু কুরিয়ারে পাঠাতে এতটা সময় লাগে না। আমাদের কি তুমি বোকা পেয়েছ? বলো কোথায় ছিলে? শ্বশুর বাড়ি আসার পরের দিনই সারাটা দিন বাইরে কাটিয়ে এলে। এই শিক্ষা তোমার? কোথায় ছিলে সারাদিন? বলো, কার সাথে ছিলে?
কঙ্কা এবারও বিচলিত হলো না। নিজেকে শান্ত রেখে উত্তর দিলো,
–মা, গয়নাগাটির ব্যাপার তো। যেখানে সেখানে কি দেওয়া যায়? আমি আসলে আমার পরিচিত আর বিশ্বস্ত একটা কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসে গিয়েছিলাম। ওটা এখান থেকে একটু দূরে। তাই দেরি হয়েছে।
জাহানারা ধমক দিয়ে বললেন,
–অজুহাত দেখছি ভালোই দিচ্ছো। তোমার মতো মেয়ে যে কিনা বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে পারে, তার কাছে এটাই তো আশা করা যায়। অসভ্য মেয়ে!
কঙ্কার চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। সে যথাসম্ভব মৃদু স্বরে বলল,
–বাড়ি থেকে আপনার ছেলেও তো পালিয়েছিল, মা।
জাহানারা হতভম্ব হয়ে গেলেন। এ বাড়িতে উনার মুখের উপরে কেউ কখনো কথা বলে না। এ মেয়ের এত সাহস কি করে হয়? তিনি চাপা গলায় বললেন,
–খবরদার! তর্ক করবে না।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আবির এগিয়ে গেল। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
–মা, কঙ্কার ভুল হয়েছে। রাগ করো না তুমি।
কঙ্কা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলল,
–হ্যাঁ, মা। আমার ভুল হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করুন। আর কখনো আমি এরকম করবো না।
জাহানারা আবিরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–বউয়ের প্রেমে ডুবে গিয়েছিস। তাই বুঝতে পারছিস না। দেখবি এই মেয়ে একদিন তোকে বিরাট বিপদে ফেলবে। দেখে নিস।
কথা শেষ করে জাহানারা ঘরে চলে গেলেন। আশরাফউদ্দিন সাহেব বললেন,
–আবির, বৌমাকে নিয়ে ঘরে যা।
আবির কঙ্কার হাত ধরে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। আশরাফউদ্দিন সাহেব গলা উঁচিয়ে অযাচিনীকে ডাকলেন,
–অযাচিনী, শুনে যাও।
অযাচিনী প্রায় সাথে সাথেই এলো। জানতে চাইলো,
–ডেকেছেন?
–হ্যাঁ, ডেকেছি। তুমি কি করছিলে গো মা?
অযাচিনী বিরক্ত গলায় বলল,
–এরকম স্নেহের নাটক করবেন না। এখানে এখন কেউ নেই। যা বলতে ডেকেছিলেন বলুন।
আশরাফউদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–আবির আর বৌমাকে খাবার দিয়ে এসো।
অযাচিনী নিঃশব্দে রান্নাঘরে চলে গেল।
.
#চলবে………
(আবারও দুঃখিত! আমাকে বগুড়া যেতে হয়েছিল। আজ আবার ঢাকা যেতে হচ্ছে।)