#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:১৭
.
.
.
মাঘের শেষের দিক। আজ ভীষণ শীত পরেছে। শীতের বেলা ফুরিয়ে এসেছে। ঝপ করে একঝাঁক কুয়াশা নেমে এসেছে সন্ধ্যাতেই। বাইরে সন্ধ্যা পোকাদের আনাগোনা খুব একটা নেই। জাহানারা কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। উনার জ্বর এসেছে। মাথার ভেতরে দপদপ করছে। উত্তরের জানালাটা খোলা। হুহু করে শীত ঢুকে পরছে। রাগে জাহানারার শরীর জ্বলছে। তার জ্বর এসেছে, অথচ বাড়ির একটা মানুষেরও তার দিকে কোনো খেয়াল নেই! আবির শুধু সকালে একবার দেখতে এসেছিল। জাহানারা রাগ দেখিয়ে বলেছিলেন, “এক্ষুনি বেরিয়ে যা। আমার সামনে আসবি না।” আবির সাথে সাথে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। অভিমানে জাহানারার চোখে পানি এসে গেছে। মা রাগ করে বেরিয়ে যেতে বলল আর ছেলে সাথে সাথে চলে গেল। এই ছেলের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করলেন তিনি? বেইমান ছেলে একটা! জাহানারা কম্বল ভালো করে টেনে নিলেন। এক কম্বলে শীত যাচ্ছে না। জ্বর বোধহয় ভালোই এসেছে। কাউকে ডেকে আরেকটা কম্বল দেওয়ার কথা বলতে হবে। কিন্তু কাউকে ডাকার মতো শক্তি জাহানারা পাচ্ছেন না। মনে মনে বাড়ির কাজের লোকগুলোকে গালিগালাজ করছেন তিনি। এরা সব করে কি? সারাদিনে ঘরে একবার উঁকি দেয় না। কাজের বেলায় নেই, শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিচ্ছে। নেমকহারামের দল!
দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলো একটা মেয়ে। তার হাতে এক বালতি পানি। জাহানারা জ্বরের ঘোরে তাকে খুব একটা চিনতে পারলেন না। অস্পষ্টভাবে বলে উঠলেন,
–কে? কে?
মেয়েটি উত্তর দিলো না। সে খুব ব্যস্তভাবে উত্তরের খোলা জানালা বন্ধ করলো। তারপর বিছানার পাশে এসে বালতি রেখে জাহানারাকে ঘুরিয়ে শোয়াতে লাগলো। জাহানারা বিতিকিচ্ছিরি শব্দে চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
–খবরদার, অযাচিনী! আমাকে তুই ছুঁবি না। আমার গায়ে হাত দিবি না। ছাড় আমাকে।
মেয়েটি কোমল গলায় বলল,
–আপনি এমন অস্থির হবেন না। আমি অযাচিনী নই। আমি কঙ্কা, মা।
–তুমি! তুমি এখানে কি চাও?
–মা, আপনি চুপচাপ শুয়ে থাকুন। আপনার অনেক জ্বর। আমি আপনার মাথায় পানি ঢালবো।
–দরদ দেখাতে এসেছ? লাগবে না তোমার দরদ। আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।
কঙ্কা গেল না। সে ইতোমধ্যে জাহানারার মাথায় পানি ঢালতে শুরু করেছে। জাহানারা আরেকবার চিৎকার করে বললেন,
–যাও বলছি। চলে যাও। নইলে ঠাস করে থাপ্পড় মারবো তোমাকে।
কঙ্কা নির্বিকারভাবে বলল,
–একটা নয়, একশটা চড় মারুন। তবুও আমি যাব না। আপনি অযথা কথা বলে নিজের শরীর খারাপ করবেন না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন।
জাহানারা চুপ করে গেলেন। চোখ বন্ধ করতেই উনার মনে হলো খাটটা তীব্রভাবে দুলছে। উনি আবার চোখ খুললেন। চারপাশ ঝাপসা দেখছেন। কঙ্কা তোয়ালে দিয়ে উনার মাথা মুছে দিচ্ছে। পানি ঢালা শেষ। জাহানারা কঙ্কার মুখ দেখার চেষ্টা করলেন। ঝাপসা দেখতে পেলেন। চোখ বন্ধ করে জাহানারা কঙ্কার মুখ মনে করার চেষ্টা করলেন। মনে পরছে না। হুট করে অযাচিনীর মুখটা মনে পরে গেল। জাহানারা সাথে সাথে চোখ খুললেন। এই হারামজাদি মেয়েটার মুখ মনে পরছে কেন? আশ্চর্য! কঙ্কা তো সারাদিন উনার চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। তবুও মুখটা মনে পরছে না কেন?
কঙ্কা জাহানারাকে সোজা করে শুইয়ে দিলো। কোথা থেকে যেন আরেকটা কম্বল এনে জাহানারার গায়ে দিয়ে দিলো। কপালে হাত রেখে জ্বর দেখলো। তারপর বলল,
–মা, আপনি শুয়ে থাকুন। আমি খাবার নিয়ে আসছি আপনার জন্য।
জাহানারা বিরবির করে বললেন,
–আমি খাব না।
কঙ্কা কড়া গলায় বলল,
–খেতে হবে, মা। তারপর ওষুধও খেতে হবে। আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকবেন। আমি আপনাকে খাইয়ে দেবো।
জাহানারা কথা বললেন না। কঙ্কা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দোতলার বসার ঘরে আশরাফউদ্দিন সাহেব বসে আছেন। কঙ্কা প্রথমে সেদিকে গেল। একজন ডাক্তারকে খবর দেওয়া দরকার।
ঘরের দরজায় গিয়ে কঙ্কা থমকে দাঁড়ালো। ভেতরে আশরাফউদ্দিন সাহেবের সাথে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। ভদ্রলোক এই শীতের ভেতরেও অনবরত ঘামছেন। ভদ্রলোক মাঝবয়সী হবেন, পরনে সাদা রঙের শার্ট, ঢোলা প্যান্ট। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, গোফ রেখেছেন। কঙ্কা উনাকে চিনতে পারলো না। আশরাফউদ্দিন সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে শান্ত গলায় বললেন,
–ওসি, হিল ট্র্যাক্টস বসবাসের জন্য কেমন? বদলি হয়ে সেখানে যেতে চাও নাকি?
সামনে বসা ভদ্রলোক শুকনো ঢোক গিললেন। কঙ্কা বুঝলো এই ভদ্রলোক থানার ওসি সাহেব। সে পর্দার আড়ালে সরে এলো। কথপোকথন শোনার আশায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই। ভেতর থেকে আশরাফউদ্দিন সাহেবের গলা শোনা গেল। উনি বলছেন,
–তোমার আগে যতজন ওসি এখানে এসেছে, সকলেই আমার কথায় উঠতো বসতো। বিনিময়ে তাদের খুশি রাখতাম আমি। শুনেছি তুমি নতুন। বাড়িতে বউ বাচ্চা আছে। বাচ্চা দুটো বেশ ছোট। ঠিক না?
ওসি সাহেব শুকনো গলায় উত্তর দিলেন,
–জ্বি। ছেলেটা ক্লাস ফাইভে পড়ে, আর মেয়েটা ক্লাস ওয়ানে।
আশরাফউদ্দিন সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললেন,
–গত সপ্তাহে দক্ষিণের সীমান্ত পার হয়ে আমার কিছু প্রোডাক্ট এসেছে। গত রবিবারে সেগুলো এয়ারপোর্টে চালান করার কথা ছিল। তুমি সেগুলো আটক করেছ। টিভিতে হেডলাইন হয়েছে। সাংবাদিকগুলো বেশ আনন্দে প্রতিবেদন বানাচ্ছে। দেখে বেশ ভালো লাগলো। আজকালের ছোকরা সাংবাদিকেরা খুব সাহসী। কি বলো?
ওসি মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন,
–স্যার, আমি ভুল করে ফেলেছি। আপনার নাম যেন কিছুতেই সামনে না আসে আমি সে চেষ্টা করছি। আপনার অধীনস্থ শাখা কোম্পানির নাম এসেছে, স্যার। সেই কোম্পানির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির নাম খবরে প্রচারিত হয়েছে। আপনার নাম আসে নি। আমি…আমি আসতেও দেবো না। যদিও পাবলিক খুব লাফালাফি করছে।
–তাই নাকি? কি বলছে পাবলিক?
–স্যার, সবাই বলছে এর পিছনে থাকা রুই কাতলারা যেন আড়ালে না থেকে যায়। তাদের যেন শাস্তির আওতায় আনা হয়। সর্বনাশা মাদকের এই অবৈধ ব্যবসা যেন বন্ধ হয় পুরোপুরি।
আশরাফউদ্দিন সাহেব হোহো করে হেসে উঠলেন। হাত থেকে চায়ের কাপ রাখতে রাখতে বললেন,
–রুই কাতলা ধরা যে কখনো সম্ভব নয়, এ কথা পাবলিকও খুব ভালো করে জানে। পাবলিকের এই লাফালাফি দু’দিন পরে আপনিই ঠান্ডা হয়ে যাবে। ওটা কোনো চিন্তার বিষয় নয়। তুমি মন দিয়ে নিজের কাজ করো।
–জ্বি, স্যার। চিন্তা করবেন না। আমি সামলে নেবো। কিন্তু আমার উচ্চপদস্থ অফিসার যদি….
আশরাফউদ্দিন সাহেব হেসে ফেলে বললেন,
–সে চিন্তা আমার। তুমি মাঝখানে ঢুকে জিনিসগুলো আটক করেই ঝামেলাটা করেছ।
কথা শেষ করে আশরাফউদ্দিন সাহেব একটা ফাইল ওসির দিকে এগিয়ে দিলেন। ওসি সাহেব ইতস্তত করে বললেন,
–এটা কি, স্যার?
–এটা আমার গত বছরের খরচাপাতির রেকর্ড। মানে কোন খাতে কত খরচ হয়েছে সেটারই হিসাব আর কি! একটু তিন নম্বর পাতাটা খুলে দেখো।
ওসি সাহেব পাতাটা খুললেন। উনার কপাল ঘেমে উঠলো। আশরাফউদ্দিন সাহেব পান চিবাতে চিবাতে বললেন,
–প্রথম লাইনে কি লেখা আছে জোরে জোরে পড়ো।
ওসি সাহেব কাঁপা কাঁপা গলায় পড়লেন,
–মিথ্যা মা..মাদক মামলায় থানার ওসিকে চাকরিচ্যুত করা বাবদ খরচ সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা মাত্র।
ওসির মুখ শুকিয়ে গেছে। আশরাফউদ্দিন সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। ঠান্ডা গলায় বললেন,
–চা খাও, ওসি। তোমার গলা শুকিয়ে গেছে।
ওসি সাহেব মূর্তির মতো চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে তাতে চুমুক দিলেন। চা তখনো যথেষ্ট গরম। কাজেই ওসি সাহেবের মুখ পুড়ে গেল। আশরাফউদ্দিন সাহেব প্রশ্ন করলেন,
–পান খাও?
–জ্বি না।
–ঠিক আছে। এখন তাহলে তুমি এসো।
ওসি সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন,
–স্যার, আমার চাকরির ক্ষতি হলে বউ বাচ্চা নিয়ে পথে বসতে হবে। আমি না বুঝে ভুল করে ফেলেছি। একটু দেখবেন, স্যার।
–নিশ্চয়ই দেখবো। তুমি আমার কাজ দেখলে আমিও তোমারটা দেখবো।
–ধন্যবাদ, স্যার। আপনি একদিন সময় করে আমার বাসায় যাবেন। আমার স্ত্রী খুব ভালো রান্না করে।
–যাব, অবশ্যই যাব। যথা স্বার্থ, তথাই স্বর্গ।
–আজ তাহলে আসি, স্যার। আসসালামু আলাইকুম।
–ওয়া আলাইকুম সালাম।
ওসি সাহেব দরজার দিকে এগিয়ে আসছেন। কঙ্কা বুঝতে পারছে যে তার দরজার পাশ থেকে সরে যাওয়া উচিত। নইলে সে ওসির সামনে পরে যাবে। কিন্তু সে এক পাও নড়তে পারছে না। তার স্থির হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক তাকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তার হাত পা যেন জমে পাথর হয়ে গেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এক নেকড়ের লেজ কাটতে গিয়ে সে যে স্বয়ং বাঘের গুহায় ঝাঁপ দিয়েছে, এতদিন তা সে ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি। এবার সে কি করবে? নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা কি আদৌ সম্ভব হবে? এ বাড়ি কি পানশি আর তার সন্তানের জন্য নিরাপদ হবে? কঙ্কা কিছু ভেবে পেলো না। তার অন্তহীন চিন্তার তল খুঁজে পাওয়ার আগেই ওসি দরজার পর্দা সরিয়ে বাইরে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি কঙ্কাকে দেখতে পেলেন। কঙ্কা নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। ওসি সাহেব কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কঙ্কার দিকে। তারপর বেরিয়ে চলে গেলেন। কঙ্কা কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো। ভেতরের দিকে এক পা এগোতেই আশরাফউদ্দিন সাহেবের গলা ভেসে এলো। উনি ভীষণ শীতল গলায় বললেন,
–বৌমা, অনেকক্ষণ থেকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছ। ভেতরে এসে বসো।
কঙ্কা চমকে উঠলো। উনি টের পেয়ে গেছেন? এখন কি হবে? কঙ্কা চোখ বন্ধ করে বড় করে একবার শ্বাস নিলো। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে ঘরের ভেতরে ঢুকলো কঙ্কা। আশরাফউদ্দিন ইশারায় বসতে বললেন তাকে। কঙ্কা হাসার চেষ্টা করে বলল,
–আমি বসতে আসি নি, বাবা। একটা জরুরি কথা বলার ছিল।
–বেশ তো। বলো কি কথা।
–বাবা, মায়ের জ্বর খুব বেড়েছে। ডাক্তারকে খবর দেওয়া দরকার।
–ঠিক আছে। আমি এক্ষুনি খবর দিচ্ছি।
–আমি তাহলে আসি, বাবা। মায়ের জন্য খাবার নিয়ে যেতে হবে।
কঙ্কা চলে যাচ্ছিলো। আশরাফউদ্দিন বলে উঠলেন,
–যা যা শুনেছ, তার এক বর্ণও যেন তোমার শাশুড়ি মায়ের কানে না যায়।
কঙ্কা চমকে উঠে পিছনে ঘুরলো। মৃদু হেসে বলল,
–যাবে না, বাবা। মানুষটা সারাজীবন ধরে ঠকেছেন, এই আনন্দ সংবাদ উনাকে দিতে আমি ইচ্ছা করি না।
আশরাফউদ্দিন স্বাভাবিক গলায় বললেন,
–ভালো, খুবই ভালো। তোমাকে বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম। তুমি সত্যিই তাই।
কঙ্কা মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো,
–কেন এমন করলেন, বাবা? আপনি তো বলেছিলেন সব অবৈধ ব্যবসা আপনি ছেড়ে দিয়েছেন।
–ছেড়ে দিতে চাইলেই ছাড়া যায় না, মা। আমি ছেড়েছিলাম বটে, কিন্তু এই ব্যবসা আমায় ছাড়ে নি।
–কিছু মনে করবেন না, বাবা। একটা প্রশ্ন করতে পারি?
–করো।
–আপনার পরে কি এই ব্যবসার দায় আবিরের উপরে বর্তাবে?
আশরাফউদ্দিন হেসে বললেন,
–না। আমার মৃত্যুর পরে এই ব্যবসার মালিকানা অন্য কারোর হবে। সেসব আমি ঠিক করে রেখেছি। ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি তোমার শাশুড়ি মায়ের কাছে যাও।
কঙ্কা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রান্নাঘরে যেতেই অযাচিনীকে দেখতে পেলো সে। তাকে দেখেই অযাচিনী এক বাটি স্যুপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
–ম্যাডামের জন্য খাবার নিতে এসেছেন তো? নিন, আমি বানিয়েই রেখেছি।
কঙ্কা চমৎকৃত হলো। এবাড়ির সবাই এরকম আশ্চর্যজনক কেন?
_______________________________
পুতুল গাড়িতে বসে আছে। গাড়ি চালাচ্ছেন খসরু সাহেব। গাড়িতে একটা রবীন্দ্র সংগীত বাজছে।
“আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে
দিবস গেলে করবো নিবেদন…।
আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন।”
পুতুল বিরক্তি নিয়ে বলল,
–খসরু ভাই, গান বন্ধ করুন। অযথা বিরহের গান বাজাচ্ছেন কেন?
খসরু সাহেব গান বন্ধ করলেন। হালকা কেশে বললেন,
–তোমার বাবা বলছিলেন তুমি নাকি বিয়ে করতে চাইছ?
পুতুল নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলো,
–হ্যাঁ, চাইছি।
–কাকে বিয়ে করবে?
–বাবা পাত্র দেখছেন।
–নীলয়ের ব্যাপারে কি ভাবলে?
পুতুল তার বড় বড় চোখ তুলে একবার খসরুর দিকে তাকালো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–উনার ব্যাপারে ভাবার কিছু নেই।
–সেকি? নীলয়কে বিয়ে করার কথা ভাবছো না তাহলে?
–না, ভাবছি না।
খসরু সাহেব আরেকটা গান চালু করলেন। ফ্রেঞ্চ গান। ভাষাটা পুতুল বুঝতে পারছে না। খসরু সাহেব যে মাঝেমধ্যে ফ্রেঞ্চ গান শোনেন, সেটা পুতুলের জানা আছে। গাড়ি সিগন্যালে পরেছে। খসরু সাহেব বললেন,
–পুতুল, আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি?
–না, পারেন না। সিগারেটের ধোঁয়ায় আমার অসুবিধা হয়।
–আচ্ছা, ঠিক আছে। নীলয়কে নিয়ে ভাবছো না কেন জানতে পারি কি?
–না, পারেন না।
–তোমার কষ্ট হবে না অন্য কাউকে বিয়ে করতে?
পুতুল উত্তর দিলো না। চোখ কুঁচকে সামনে তাকালো। খসরু সাহেব বললেন,
–পুতুল, নীলয় ছেলেটা বোধহয় তোমাকে পছন্দ করে। ছেলেটা খারাপ নয় কিন্তু।
পুতুল ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–নীলয় সাহেব আসলে আমার প্রতি নয়, আমি উনার যে প্রশংসাগুলো করি তার প্রতি দুর্বল।
খসরু সাহেব হেসে বললেন,
–তোমার মতো অসাধারণ একটা মেয়ের প্রতি দুর্বল হয়ে যেতে তো কোনো পুরুষের খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়।
পুতুল স্পষ্ট গলায় বলল,
–জানি। জানি বলেই আমি কবি সাহেবের সাথে কথাবার্তা বন্ধ করেছি। কারণ আমি চাই না উনি আমার প্রতি দুর্বল হোন।
– বলো কি?
–ঠিকই বলছি।
সিগন্যাল খুলে গেছে। খসরু সাহেব গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
–পুতুল, আমিও বিয়ে করার কথা ভাবছি।
–ও আচ্ছা।
পুতুলের নির্লিপ্ত উত্তরে খসরু সাহেব মনঃক্ষুণ্ন হলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
–আমার আগের স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর ভেবেছিলাম আর কখনো বিয়ে করবো না। কিন্তু ইদানীং আর একাকীত্ব ভালো লাগে না। দিনশেষে বাসায় ফিরে কারোর সাথে দুটো কথা বলতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকুক।
পুতুল কথা বলল না। খসরু সাহেব নিজে থেকেই বললেন,
–কথাটা স্পষ্ট করে বলতে চাই, পুতুল।
–বলুন।
–আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, পুতুল। তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি।
পুতুল চমকালো না। এমন একটা প্রস্তাব সে আশা করেছিল। খসরু সাহেব পুতুলের উত্তরের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। তারপর নিজেই বললেন,
–তোমার সাথে আমার বয়সের পার্থক্যটা খুব বেশি। কিন্তু তাতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তোমাকে তো ছোট থেকেই চিনি। আমি ভালো একজন সঙ্গী হওয়ার চেষ্টা করবো কথা দিচ্ছি।
পুতুল স্বাভাবিক গলায় বলল,
–আমি ভেবে দেখবো। আপাতত গাড়ির কাঁচটা নামিয়ে দিন, খসরু ভাই।
খসরু সাহেব গাড়ির কাঁচ নামালেন। পুতুল জানালা দিয়ে মাথা বের করলো। তার হঠাৎ খুব কান্না পাচ্ছে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে চোখ দুটো শুকনো রাখার।
.
#চলবে………