#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:১৮
.
.
.
আরও একটা ক্লান্তিকর দিন ফুরিয়ে এসেছে। সারাদিনের কাজকর্ম শেষে বাসায় ফিরছে শাদাব। পশ্চিমের আকাশে সিঁদুরের টিপের মতো মৃদু সূর্য ঢলে পরেছে। কনে দেখা আলোর সাথে ছড়িয়ে পরেছে শীত। শীত বেশ জেঁকে বসেছে। মৃদুমন্দ হিম বাতাস বইছে। শাদাব বাস থেকে নেমে বাকি রাস্তাটা হেঁটে এলো। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একবার আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে কেমন মেঘলা মেঘলা ভাব।
শাদাব কলিং বেলের সুইচ টিপলো। দরজা খুললেন সাবিনা বানু। হাসিমুখে বললেন,
–এসেছিস? আয়।
শাদাব ভেতরে ঢুকলো। সাবিনা বানু প্রশ্ন করলেন,
–আজ একটু দেরি হলো যে তোর?
শাদাব ক্লান্ত গলায় বলল,
–হ্যাঁ, মা। আজ কাজের চাপ বেশি ছিল।
–ঠিক আছে। ঘরে যা। হাতমুখ ধুয়ে আয়। আমি তোর জন্য চা বানাই।
–সেকি? আজ তুমি চা বানাবে? অন্যান্য দিন তো সুরমা এতক্ষণে চা বানিয়ে ফেলে!
সাবিনা বানু মুখ টিপে হেসে বললেন,
–আজ মেয়েটা চা বানাতে পারে নি। ওর একটু শরীর খারাপ।
শাদাব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
–শরীর খারাপ! সকালে অফিস যাওয়ার আগেও তো দেখলাম ও সুস্থ।
–তুই যাওয়ার পর অসুস্থ হয়েছে। যা তো, ঘরে যা। বৌমা ঘরেই আছে।
সাবিনা বানু হাসতে হাসতেই চলে গেলেন। শাদাব হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। সুরমা হুট করে অসুস্থ হয়ে পরেছে? কি হয়েছে ওর? জ্বর আসে নি তো আবার? শাদাব ধীরে ধীরে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। সুরমা বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ঘরের সব জানালা বন্ধ। পর্দা টেনে দেওয়া। ঘরে মৃদু একটা আলো জ্বলছে। শাদাব দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে ভেতরে এগিয়ে গেল। হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপরে রেখে বিছানায় গিয়ে বসলো। সুরমার কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা দেখলো। না, জ্বর আসে নি। তাহলে মেয়েটা অসময়ে শুয়ে আছে কেন? শাদাব কোমল গলায় স্ত্রীকে ডাকলো,
–সুর, শুনছো?
সুরমা মৃদু হাসলো। চোখ বন্ধ রেখেই ছোট্ট করে বলল,
–হু।
শাদাব সুরমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
–তোমার নাকি শরীর খারাপ করেছে? কি হয়েছে, সুর?
সুরমা এবার চোখ খুললো। শাদাবের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,
–কাছে এসো।
শাদাব ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলল,
–কি হয়েছে? বলো তো।
–আরও কাছে না এলে বলবো না।
স্ত্রীর এমন ছেলেমানুষি কথায় শাদাব হেসে ফেললো। সুরমার পাশে শুয়ে পরে বলল,
–আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার বলো।
সুরমা মাথা তুলে শাদাবের বুকে রাখলো। তারপর হুট করে কেঁদে ফেললো। আর্দ্র গলায় বলল,
–আমি খুব ভাগ্যবতী বলেই তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। তোমার মতো একজন মানুষ আমার নিজের হয়েছে।
শাদাব অবাক হলো। হঠাৎ করে এসব কথা বলার হেতু সে বুঝতে পারলো না। এর মধ্যেই খেয়াল হলো, বুকের কাছটাতে শার্ট ভিজে যাচ্ছে। শাদাবের বিস্ময় বাড়লো। সে সুরমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
–সুর, কাঁদছো কেন?
সুরমা কাঁদতে কাঁদতেই জবাব দিলো,
–খুশিতে কাঁদছি।
শাদাব কথা বলতে পারলো না। হঠাৎ করে সে গভীর দুশ্চিন্তায় পরে গেল। সুরমা এভাবে কেন কথা বলছে? ওর সিরিয়াস কোনো রোগ হয় নি তো? কথাটা ভাবতেই শাদাবের বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো। অদ্ভুত একটা চাপ অনুভূত হলো বুকে। খানিকক্ষণ পরে সুরমা স্বাভাবিক হলো। শাদাবের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
–ওমর খৈয়ামের ওই কবিতাটা পড়েছ?
শাদাব আচ্ছন্নের ন্যায় বলল,
–কোন কবিতা?
সুরমা এবার উঠে বসলো। শাদাবও উঠলো। উত্তরের অপেক্ষায় স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সুরমা নিচু গলায় কবিতার লাইনগুলো উচ্চারণ করলো,
–”এইখানে এই তরুর তলে
তোমার আমার কৌতুহলে,
যে ক’টি দিন কাটিয়ে যাবো প্রিয়ে-
সঙ্গে রবে সুরার পাত্র
অল্প কিছু আহার মাত্র
আরেকখানি ছন্দ মধুর কাব্য হাতে নিয়ে।”
শাদাব সুরমার হাত ধরলো। অধৈর্য হয়ে বলল,
–সুর, তোমার কি হয়েছে? বলো প্লিজ! আমি আর এই টেনশন নিতে পারছি না।
সুরমা চট করে শাদাবকে জড়িয়ে ধরলো। কানের কাছে গিয়ে প্রায় অস্পষ্ট গলায় ফিসফিস করে বলল,
–আমাদের ছন্দ মধুর কাব্য আরও মধুর হতে চলেছে।
শাদাব বুঝতে পারলো না। শুধু আলতো হাতে স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকলো। সুরমা এবার গাঢ় গলায় বলল,
–তোমার সুর মা হতে চলেছে। আর তুমি বাবা। আমাদের সন্তান আসতে চলেছে আমাদের সংসারে।
শাদাব ভীষণভাবে চমকিত হলো। এমন কিছু শোনার আশা সে করে নি। স্ত্রীর কথাগুলো তার কান ছুঁয়ে যেতেই অদ্ভুত শিহরণ হলো তার সমস্ত শরীরে। প্রচন্ড একটা খুশির ধাক্কা এসে তার বুকে আটকে গেল। আনন্দের আতিশয্যে তার কণ্ঠনালি রুদ্ধ হয়ে গেল। সে কথা বলতে পারলো না। অনুভূতির সুগভীর ধাক্কা সামলাতে সে শক্ত করে সুরমাকে জড়িয়ে ধরলো। গভীর মমতায় স্ত্রীর মাথায় চুমু খেলো। চোখ দুটো উপচে পরলো জলে। আর কোনো কথাই সে বলতে পারলো না। কিভাবে নিজের ভেতরের অসহ্য সুন্দর অনুভূতিটাকে সে প্রকাশ করবে সেটা বুঝতেই পারলো না। বোধ হয় এই অনুভূতির প্রকাশ কখনোই করা যায় না।
_________________________________
অযাচিনী জাহানারার জন্য খাবার বেড়ে দিচ্ছে। কঙ্কা সামনেই আছে। খাবার পরিবেশন হয়ে গেলে সে তার শাশুড়ি মাকে খাওয়াতে নিয়ে যাবে। উনার জ্বর গত দু’দিনে কিছুটা কমেছে। আজ উনার শরীর বেশ ভালো। কঙ্কা শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে আয়েশ করে চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। সে অযাচিনীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
–আচ্ছা, অযাচিনী? তোমার নাম অযাচিনী কে রেখেছে?
অযাচিনী মৃদু হেসে বলল,
–আমার মা।
–তোমার মা! কিন্তু এমন একটা অদ্ভুত নাম রাখলেন কেন? এর মানে কি?
অযাচিনী শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল,
–আমি অযাচিত বলে আমার নাম অযাচিনী।
কঙ্কা হতভম্ব হয়ে বলল,
–তুমি অযাচিত মানে? সন্তান কখনো মায়ের কাছে অযাচিত হয় নাকি?
অযাচিনী এই প্রশ্নের উত্তর দিলো না। সে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,
–ভাবি, বাবু সাহেব আজ ছোট সাহেবকে কোন অফিসে নিয়ে গেল সেটা কি আপনি জানতে পেরেছেন?
কঙ্কা ভ্রু কুঁচকে অযাচিনীর দিকে তাকালো। আজ সকালে আবির তার বাবার সাথে অফিসে গিয়েছিল। কঙ্কা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আবিরকে মাদক ব্যবসায় জড়াতে হবে না তো? কঙ্কা আশরাফউদ্দিন সাহেবকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি অভয় দিয়ে বলেছিলেন, “চিন্তা নেই, মা। আমার ছেলেকে এই ব্যবসায় আসতে দেবো না আমি। আমার খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের একটা ফ্যাক্টরি আছে। আবির সেই ব্যবসাটাই দেখবে।” তবুও কঙ্কা ভরসা করতে পারছিল না। তাই সে নিজে আবিরদের গাড়িকে অনুসরণ করতে করতে অফিসে পৌঁছে গিয়েছিল। কথাটা অযাচিনীর জানার কথা নয়। কারণ সে কাজটা করেছে লুকিয়ে। সেকারণেই কঙ্কার অবাক লাগছে। অযাচিনী ফিচেল হেসে বলল,
–আমি জানি আপনি বাবু সাহেবের গাড়ি ফলো করছিলেন।
কঙ্কা নিজের বিস্ময় ভাবকে চাপা দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল,
–কি করে জানলে?
–এই বাসায় যা যা হয়, তার সবই আমার জানা। তবে আপনার চিন্তা নেই। আমি কাউকে কিছু বলবো না। আপনার চিন্তা দূর করার জন্য আমি আরও একটা খবর আপনাকে দিতে পারি।
কঙ্কা ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কি?
–ছোট সাহেবকে সত্যিই মাদকের ব্যবসাটা করতে হবে না। ওটা ভীষণ গোপনীয়। কেউ এর ব্যাপারে জানে না। আর বাবু সাহেব জানতে দেবেনও না। নিজের ছেলেকে তো কখনো না। ছেলের চোখে নিজের যে ফেরেশতার মতো ব্যক্তিত্ব উনি এঁকে রেখেছেন, চিরকাল সেটাকেই স্থায়ী করতে চান। ছোট সাহেব ফুড বিজনেসটাই দেখবেন। আপনার চিন্তা নেই।
–তুমি এতকিছু কি করে জানলে?
অযাচিনী হেসে ফেলে বলল,
–ওই যে বললাম, এ বাড়ির সবকিছুই আমি জানি। আপনার সম্পর্কেও আমি অনেক কিছু জানি।
কঙ্কা মুচকি হেসে বলল,
–কি জানো, অযাচিনী? বলো, শুনি।
অযাচিনী এবার খাবারের থালা কঙ্কার হাতে দিতে দিতে বলল,
–আমি যে জানি ঠিক তাও নয়। শুধু অনুমান করছি। আমার অনুমান বলছে আপনি এখানে চিরজীবন থাকতে আসেন নি। খুব শীঘ্রই আপনি চলে যাবেন। আমার অনুমান শক্তি খুব ভালো।
কঙ্কা হাসলো। খাবারের থালা হাতে নিয়ে বলল,
–তুমি খুব বুদ্ধিমতী, অযাচিনী।
–আপনারও খুব বুদ্ধি, ভাবি।
কঙ্কা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–ঠিকই বলেছ তুমি। আমারও অনেক বুদ্ধি। তুমিও বুদ্ধিমতী। আর সবচেয়ে বেশি বুদ্ধি আমার শ্বশুরের। এতগুলো বুদ্ধিমান মানুষ এক ছাদের তলায় কখনো থাকতে পারে না। আর থাকলেও তারা কখনো ভালো থাকে না।
কথা শেষ করে কঙ্কা দোতলায় যেতে শুরু করলো। অযাচিনী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিলো।
কঙ্কা শ্বশুর শাশুড়ির ঘরের সামনে এসে দাঁড়াতেই প্রচন্ড শব্দে কিছু একটা ভাঙার আওয়াজ পেলো। কঙ্কা চমকে উঠলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে চাইলো সে। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কঙ্কা দরজায় টোকা দিতে চাইলো। তার আগেই ভেতর থেকে আশরাফউদ্দিন সাহেবের গলা পাওয়া গেল। উনি চাপা গলায় বললেন,
–জাহানারা! পাগল হলে? জিনিসপত্র ভাঙছো কেন? শান্ত হও, তুমি এখনো পুরোপুরি সুস্থ নও।
জাহানারা হিসহিসিয়ে বলে উঠলেন,
–খবরদার! তুমি আমাকে ধরবে না। তুমি একটা নোংরা লোক। এতগুলো বছর ধরে যে ক্ষত আমি বয়ে বেড়াচ্ছি সেটা তোমার ভালোবাসা দিয়ে কখনো মিটবে না। সব জেনেও তোমার সাথেই আমি সংসার করে যাচ্ছি কেন জানো? কারণ আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
এই কথা কাটাকাটি কানে আসায় কঙ্কা বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। তার কি এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত? তাই উচিত। মা বাবার কথা এভাবে শোনা ঠিক নয়। কঙ্কা চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু জাহানারার আরও কিছু কথা কানে আসায় সে থমকে দাঁড়ালো। জাহানারা বলছেন,
–তোমার সমস্ত নোংরামি আমি মেনে নিয়েছি এই একটা কারণেই। তোমার একটা অবৈধ সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক ছিল বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে। আমি সেটা বুঝে ফেলেছিলাম আর মেনেও নিয়েছিলাম। কারণ আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তোমার সেই পাপের ফল হলো অযাচিনী। তাকে তুমি এই একই বাড়িতে এনে তুলেছ। আমি তাও মেনে নিয়েছি। দিনের পর দিন অযাচিনীর সাথে এক ছাদের তলায় বসবাস করতে গিয়ে আমি ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছি। তবুও আমি তোমার সংসারে থেকে গেছি। কারণ আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
কঙ্কা স্তব্ধ হয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো। ভেতরে জাহানারা চিৎকার করে কাঁদছেন। আশরাফউদ্দিন সাহেব বললেন,
–জাহানারা, অতীতে ভুল করেছিলাম। কিন্তু পরে সেখান থেকে আমি বেরিয়ে এসেছি। ধীরে ধীরে তোমাকে ভালোবেসেছি। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা মিথ্যা নয়।
জাহানারা তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
–তোমার মতো মানুষের ভালোবাসা আমার জন্য একটা অভিশাপ। আর তার থেকেও বড় অভিশাপ হলো আমার নিজের বুদ্ধি। আমার বুদ্ধি বেশি বলেই কাজের মেয়েটার সাথে তোমার সম্পর্কের ব্যাপারটা আমি ধরে ফেলেছিলাম। তুমি ভেবেছিলে, বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছ। সে কিছুই বুঝবে না। কিন্তু আমি সবই বুঝতাম। তোমার জন্য, শুধুমাত্র তোমার অপকর্ম যেন আবির কখনো জানতে না পারে সেজন্য আমি আমার একমাত্র ছেলেকে ছোটবেলা থেকে হোস্টেলে রেখে বড় করেছি। কারণ আমি চাই নি আমার সন্তান তার বাবা সম্পর্কে বিরূপ ধারণা নিয়ে বড় হোক। চাই নি বাবার স্বরূপ জেনে ও কষ্ট পাক। আমি চাই নি ওর মানসিক বিকাশে খারাপ প্রভাব পড়ুক। কিন্তু ওর ভালো করতে গিয়ে আমি ওর ক্ষতি করে দিয়েছি। মায়ের সংস্পর্শে না থেকে আমার ছেলেটাও একটা অমানুষ তৈরি হয়েছে। আর এর জন্যও তুমি দায়ী।
জাহানারা থামলেন। একটু সময় নিয়ে আবার বললেন,
–আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করায় আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। কঙ্কা মেয়েটার উপর রাগও হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হয়, ভালোই হয়েছে। অন্তত কঙ্কা যদি পারে আমার ছেলেটাকে শুধরে দিতে!
কথা শেষ করে জাহানারা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আশরাফউদ্দিন সাহেব উনার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
–আমি তো নিজেকে সেই কবেই শুধরে নিয়েছি, জাহানারা।
জাহানারা হিসহিসিয়ে বললেন,
–একদম মিথ্যা কথা বলবে না। তুমি কি ভেবেছ? তুমি যে এখনো মাদক ব্যবসা করে যাচ্ছো সেটা আমি জানি না? আমি সবই জানি। আমি বোকা সেজে থাকি। কিন্তু বাস্তবে আমি খুব বুদ্ধিমতী। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার কেন এত বুদ্ধি? যদি আমি বোকা হতাম, যদি চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমি ধরতে না পারতাম, তাহলে তো এত কষ্ট আমাকে পেতে হতো না! বুদ্ধি বেশি হওয়া একটা অভিশাপ। অভিশাপ!
–জাহানারা, বিশ্বাস করো, আমি অনেক চেষ্টা করেছি এই ব্যবসা ছাড়ার। কিন্তু আমার…..
এরপরের কথাগুলো আর কঙ্কা শুনতে পেলো না। তার চোখে পানি এসে গেছে। সে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে সরে এলো। নিচে গিয়ে টেবিলের উপরে খাবারের থালা রাখলো। অযাচিনী তখনো রান্নাঘরে কাজ করছিল। সে জানতে চাইলো,
–কি হলো? ম্যাডামের খাওয়া শেষ?
কঙ্কা কোনোরকমে বলল,
–ইয়ে…না, অযাচিনী। মা..মা ঘুমিয়ে আছেন। আমি পরে খাইয়ে আসবো।
কথা শেষ করে কঙ্কা দ্রুত পায়ে সিড়ির দিকে গেল।সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে প্রায় ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। ধপ করে ঘরের মেঝেতে বসে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে উঠলো কঙ্কা। আবির তখন বিছানায় বসে ল্যাপটপে কিছু করছিল। কঙ্কার কান্নার আওয়াজ পেয়ে হকচকিয়ে গেল। বিছানা ছেড়ে নেমে কঙ্কার কাছে এগিয়ে গেল। বিভ্রান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
–কঙ্কা, কি হয়েছে? এভাবে কাঁদছো কেন?
কঙ্কা উত্তর দিতে পারলো না। তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আবিরের অধঃপতনের জন্য এতদিন সে তার শাশুড়ি মাকেই মনে মনে দোষারোপ করে এসেছে। এমন একটা ছেলেকে জন্ম দিয়ে এই পৃথিবীতে বিচরণ করতে দিয়েছেন বলে কঠিন একটা শাস্তি উনাকে কঙ্কা দিতে চেয়েছে। কিন্তু আজ তার ভীষণ আফসোস হচ্ছে। এই মানুষটার জীবনে এত কষ্ট, এত ভীষণ কষ্ট, তা যদি কঙ্কা আগে জানতো তাহলে কখনোই এত আয়োজন করে এই দুঃখ বাড়ানোর ব্যবস্থা করতো না। কিন্তু এখন আর কিচ্ছু করার নেই।
কঙ্কার উত্তর না পেয়ে আবির অস্থির হয়ে গেল। কাছে এগিয়ে গিয়ে স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে কোমল গলায় বলল,
–এভাবে কেন কাঁদছো, কঙ্কাবতী? আমাকে বলো।
কঙ্কা চট করে আবিরের বুকে মাথা রাখলো। ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল,
–কিছু না। এমনিই খুব কষ্ট হচ্ছে। মা বাবাকে মনে পড়ছে।
আবির কিছু বলল না। শুধু শক্ত করে কঙ্কাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। কঙ্কার শান্ত হতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো। আবির তাকে হাত ধরে এনে বিছানায় বসালো। পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো,
–খেয়েছ?
কঙ্কা মাথা নেড়ে না বলল। আবির বলল,
–আমার খুব ক্ষিদে লেগেছে। চলো, খেয়ে নিই।
কঙ্কা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–চলো। আজ আমি আর তুমি, দুজনে মিলে আগে মাকে খাইয়ে দিয়ে আসি। তারপর আমরা খাব।
আবির হেসে বলল,
–আচ্ছা, চলো।
আবির কঙ্কার হাত ধরে দরজার দিকে পা বাড়াতেই কঙ্কার ফোন বেজে উঠলো। আবির বিরক্ত গলায় বলল,
–তোমার ফোনটা বেজে ওঠার আর সময় পেলো না?
কঙ্কা হেসে ফেলে বলল,
–তুমি মায়ের ঘরে যাও। আমি একেবারে খাবার নিয়ে যাচ্ছি।
–তাড়াতাড়ি আসবে।
কঙ্কা হেসে মাথা নাড়লো। আবির চলে গেল। কঙ্কা বিছানা থেকে ফোন হাতে তুলে নিলো। অচেনা একটা নাম্বার থেকে কল এসেছে। কঙ্কা ফোন ধরলো,
–হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
অপর পাশ থেকে শীতল গলায় ভেসে এলো তিনটি শব্দ,
–আপা, আমি পানশি।
.
#চলবে……
(ইউনিভার্সিটির সাথে মানিয়ে নিতে খুব হিমশিম খাচ্ছি। ক্লাস শুরুর এক মাসের মধ্যেই এসাইনমেন্ট, মিড টার্ম সব এসে হাজির হচ্ছে। যারা বলেছিল ইউনিভার্সিটিতে কোনো প্যারা নাই, তারা সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী।😒)