#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:১৯
.
.
.
মা বাবার ঘরে এসে আবির মোটামুটি হতচকিত হয়ে গেছে। মেঝেতে ভেঙেচুরে পরে আছে তার মা বাবার ছবিটা। জাহানারার চোখমুখ লাল টকটকে। অদূরে আশরাফউদ্দিন সাহেব বসে আছেন। উনি খুবই অস্বস্তি বোধ করছেন। আবির শীতল গলায় প্রশ্ন করলো,
–কি হয়েছে, মা?
জাহানারা উত্তর দিলেন না। আশরাফউদ্দিন সাহেব হাসার চেষ্টা করে বললেন,
–আবির, বোস।
আবির বসলো না। একইভাবে প্রশ্ন করলো,
–তোমাদের ছবিটা ভাঙলো কি করে, বাবা?
আশরাফউদ্দিন সাহেব এবার উঠে দাঁড়ালেন। আবিরের হাত ধরে বিছানার একপাশে বসালেন। হাসতে হাসতে বললেন,
–আর বলিস না! তোর মা এই অসুস্থ অবস্থায় ছবির কাঁচটা মুছতে গিয়েছিল। কিন্তু ওর শরীরে কি আর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি আছে? মাথাটা ঘুরে উঠলো আর হাত থেকে ছবিটা পরে গেল।
জাহানারা ঠোঁট বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। মিথ্যা কথা বলায় লোকটার জুড়ি মেলা ভার! আবির এবার মায়ের দিকে তাকিয়ে শাসনের সুরে বলল,
–মা, তোমাকে কে বলেছিল এখন ছবিটা পরিষ্কার করতে?
জাহানারা এবারও নিরুত্তরে বসে রইলেন। আবির মায়ের কাছে এগিয়ে গেল। মায়ের মাথায় হাত রেখে কোমল গলায় বলল,
–মা, তোমার চোখমুখ এমন লাল দেখাচ্ছে কেন?
জাহানারা ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মৃদু স্বরে বললেন,
–জ্বরটা বোধহয় বেড়েছে, বাবা।
আবির মায়ের কপালে হাত রাখলো। জ্বর সত্যিই বেড়েছে। গা প্রচন্ড গরম। আবির মায়ের সামনে বসলো। মায়ের হাত ধরে বলল,
–ওষুধ খেয়ে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে, মা। কঙ্কা এক্ষুনি খাবার নিয়ে আসছে। আমি নিজে আজ তোমাকে খাইয়ে দেবো।
জাহানারা মৃদু হেসে বললেন,
–কি ব্যাপার? আজ মায়ের এত খেয়াল রাখা হচ্ছে?
আবির হেসে বলল,
–মায়ের খেয়াল না রাখলে কার খেয়াল রাখবো?
–হয়েছে, থাক! মাকে যেন কত ভালোবাসো তুমি! বউ বলেছে বলে এসেছিস সেটা বল না।
আবির মাথা চুলকে বলল,
–কি যে তুমি বলো, মা!
জাহানারা এবার হেসে ফেললেন। আবির গভীর মমতা নিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালো। তার মায়ের হাসিটা কি ভীষণ সুন্দর! কি ভীষণ পবিত্র মায়ের এই মায়াময় মুখটা! এই পবিত্রতা লক্ষ্য করে আবির হঠাৎ একটা ধাক্কার মতো খেলো। মায়ের মুখের দিকে তাকাতেই হুট করে জগতের সমস্ত নারীর প্রতি অদ্ভুত শ্রদ্ধাবোধে তার হৃদয় ভরে গেল। এতদিন মায়ের মুখের দিকে এত গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখে নি বলে আফসোসে তার মরে যেতে ইচ্ছা করলো। তার সাথে একটা প্রচ্ছন্ন অপরাধবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইলো। এতকাল ধরে এতগুলো নারীর সাথে এ কি ঘোরতর অন্যায় সে করেছে! কেন সে করলো এমনটা? কেন আরও আগেই মায়ের মুখের দিকে এত গভীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিয়ে সে তাকালো না? অসংখ্য নারীকে শুধু অসম্মান করে গেল। অথচ মায়ের মুখের পবিত্রতা লক্ষ্য করলে জগতের সব নারীকে সম্মান করা কতই না সহজ! কথাগুলো ভেবে আবিরের চোখে জল আসতে চাইলো। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
জাহানারা মুখে হাসি ঝুলিয়েই বললেন,
–কিরে? এভাবে কি দেখছিস?
আবির মৃদু হেসে বলল,
–তুমি ভীষণ ভালো, মা!
জাহানারা অবাক হলেন। ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন,
–তোর কি হয়েছে রে?
–জানি না, মা। আমি বোধহয় দিনকে দিন শুদ্ধ মানুষ হয়ে উঠছি।
জাহানারা গভীর মমতা নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। স্নেহের সুরে বললেন,
–বাবা রে, আমি তোর জন্য দোয়া করি। তুই শুদ্ধতম মানুষ হ। খুব ভালো স্বামী হ। একজন ভালো বাবা হ।
কথা বলতে বলতে জাহানারার চোখ ছলছল করে উঠলো। আবির মায়ের কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো। আশরাফউদ্দিন সাহেব চুপচাপ বসে মা ছেলেকে দেখছিলেন। এবার উঠে দাঁড়ালেন। বুকের ভেতর অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে নিঃশব্দেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো কঙ্কা। হাসিমুখে বলল,
–মা, আপনার শরীর এখন কেমন?
জাহানারা কঙ্কার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আবির মাথা তুললো। কঙ্কা খাবারটা পাশে রেখে আবিরের উদ্দেশ্যে বলল,
–নাও, মাকে খাইয়ে দাও।
আবির খাবারের থালা হাতে নিলো। মাকে খাইয়ে দিতে শুরু করলো। কঙ্কা কোনো কথা না বলে মেঝেতে পরে থাকা ভাঙা কাঁচের টুকরো পরিষ্কার করতে লাগলো। জাহানারা ছেলের হাত থেকে খাবার মুখে নিয়ে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে কঙ্কার দিকে তাকালেন। এই অসাধারণ মেয়েটাকে উনি আগে কেন চিনতে পারলেন না?
জাহানারা কোমল গলায় কঙ্কাকে ডাকলেন,
–বৌমা, কাছে এসো।
আবির চমকে উঠলো। এই প্রথম জাহানারা কঙ্কাকে বৌমা বলে ডেকেছেন। কঙ্কা বিস্ময় নিয়ে তাকালো। শাশুড়ি মা যে সত্যিই এভাবে ডেকেছেন, সেটা কঙ্কার বিশ্বাস হতে চাইলো না। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই রইলো। জাহানারা আবার ডাকলেন,
–কি হলো? এসো।
কঙ্কা এগিয়ে গেল। জাহানারার পাশে বসলো। জাহানারা আলতোভাবে কঙ্কার মাথায় হাত রাখলেন। কিন্তু কোনো কথা বললেন না। মুখে বলার প্রয়োজনও নেই। এই স্নেহের স্পর্শই সমস্ত কথা ব্যক্ত করে দিচ্ছে। কঙ্কার চোখে জল এলো। সে মাথা নিচু করে বিরবির করে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করবেন, মা। আপনার কষ্ট দূর করার উপায় আমার জানা নেই। ”
__________________
আবির অনেকক্ষণ ধরে ঘরে অপেক্ষা করছে। কঙ্কা এখনো ঘুমাতে আসছে না। আবিরের বিরক্ত লাগছে। এত দেরি করছে কেন মেয়েটা? আবির কিছুক্ষণ বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করলো। আজ আকাশে চাঁদ নেই। বাইরে জমাট বাঁধা অন্ধকার। বেশ ঠান্ডা পরেছে। আবির ঘরে এসে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলো। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পরলো। কঙ্কা ঘরে এলো রাত প্রায় এগারোটায়। দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসলো। চুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বলল,
–ঘুমিয়েছ?
আবির গম্ভীর গলায় বলল,
–এতক্ষণ লাগে ঘুমোতে আসতে?
কঙ্কা হেসে ফেললো। কম্বল জড়িয়ে শুয়ে বলল,
–মাকে ওষুধ খাইয়ে অযাচিনীর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করছিলাম।
কঙ্কা মিথ্যা বলল। সে অযাচিনীর সাথে গল্প করছিল না। সে আসলে পানশির সাথে ফোনে কথা বলছিল। সে নিজে যে পানশিকে আসতে বলেছে, এই কথা যেন কিছুতেই কেউ জানতে না পারে সেজন্য বারবার পানশিকে সতর্ক করে দিয়েছে কঙ্কা। পানশির ভালোর জন্যই বলেছে। কারণ এই কথা জানতে পারলে আবিরের বাবা নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ঝামেলা করবেন।
আবির বিরক্তি নিয়ে বলল,
–আজ রাতে অযাচিনীর সাথেই থেকে যেতে তাহলে।
কঙ্কা খিলখিল করে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বলল,
–আচ্ছা, বেশ। তাই যাচ্ছি।
আবির হুট করে হাত ধরে কাছে টেনে আনলো কঙ্কাকে। গভীর দৃষ্টিতে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালো। কঙ্কা মৃদু হেসে বলল,
–কি চাই?
আবির গাঢ় গলায় বলল,
–বাবা হতে চাই।
কঙ্কার সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে কেঁপে উঠলো। এই তিনটি শব্দকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শব্দ বলে মনে হলো তার। পৃথিবীর কোনো স্বামীই তার স্ত্রীর কাছে এর থেকে সুন্দরতম কোনো আবদার কখনোই করতে পারে নি, পারবেও না। কঙ্কা কথা বলতে পারলো না। আবির কঙ্কার চুলের খোঁপা খুলে দিয়ে বলল,
–আমি মানুষ হিসেবে হয়তো খুবই খারাপ। স্বামী হিসেবেও খুব বেশি ভালো নই। কিন্তু বাবা হিসেবে আমি নিশ্চয়ই ভালো হবো, কঙ্কাবতী। তুমি দেখে নিয়ো, আমি ভীষণ ভালো একজন বাবা হবো।
কঙ্কার চোখে পানি এসে গেল। আবিরের বাবা হয়ে ওঠা দেখার ভাগ্য যে কঙ্কার হবে না, একথা সে কি করে আবিরকে বলবে? সে বলতে পারলো না। আবির কঙ্কার চোখ মুছে দিলো। তারপর ধীরে ধীরে কঙ্কাকে টেনে নিলো খুব কাছে। কঙ্কা বাধা দিলো না। কারণ আবির না জানলেও সে নিজে জানে যে আজই আবিরের সাথে তার শেষ রাত।
_____________________________
নীলয়ের আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না। রাত প্রায় দুটো বাজতে চলেছে। নীলয় কবিতা লিখতে বসেছে টেবিলে। কিন্তু সে কিছুতেই একটা লাইনও লিখতে পারছে না। আজ বিকেলে পুতুলের সাথে তার দেখা হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল নয়, নীলয় নিজেই গিয়েছিল দেখা করতে। আর গিয়েই ভীষণভাবে মানসিক ধাক্কা খেয়েছে সে। পুতুল তার বিয়ের খবর দিয়েছে নীলয়কে। হাসতে হাসতে বলেছে,
–নীলয় সাহেব, আমি খসরু ভাইকে বিয়ে করছি। আপনাকে কিন্তু অবশ্যই আসতে হবে।
নীলয় অবাক হয়েছে। পুতুল বিয়ে করবে ভালো কথা। তা বলে খসরু ভাইয়ের মতো একজন মাঝবয়সী লোককে কেন? নীলয় বলবে না বলবে না ভেবেও বলে ফেলেছে,
–খসরু ভাইকে কেন বিয়ে করবে তুমি? খসরু ভাই বয়সে তোমার চেয়ে অনেক বড়। তাছাড়া উনার তো আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল।
এর উত্তরে পুতুল যা বলেছে তাতে নীলয় আরও একবার মুগ্ধ হয়েছে মেয়েটির চিন্তা দেখে। পুতুল বলেছে,
–হ্যাঁ, আগে একবার খসরু ভাই বিয়ে করেছিলেন। সেই স্ত্রী অল্পদিন সংসার করেই চলে গিয়েছিল খসরু ভাইকে ছেড়ে। কিন্তু নীলয় সাহেব, উনি তো এই ব্যাপারটা আমার কাছে গোপন করেন নি। আমাকে স্পষ্ট করে সবটা বলেছেন। অতীত থাকাটা দোষের নয়। সেটাকে বর্তমানে টেনে আনাটাই দোষের। উনি তো আর তা করছেন না। আর বয়সের কথা বলছেন? অসম সম্পর্ক কি এই পৃথিবীতে প্রথমবার হচ্ছে? কত অসম বয়সের স্বামী স্ত্রীই তো এই পৃথিবীতে আছে। তারা কি একে অপরকে ভালোবাসছে না? পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা থাকলেই ভালো থাকা যায়।
নীলয় ব্যথিত গলায় প্রশ্ন করেছে,
–তুমি খসরু ভাইকে ভালোবাসো?
পুতুল হেসে ফেলে উত্তর দিয়েছে,
–এখনো বাসি না। বিয়ের পরে ভালোবেসে ফেলবো।
নীলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। চলে আসার আগে পুতুল নীলয়ের হাতে একটা চিঠি দিয়েছে। নীলয় এখনো চিঠিটা পড়ে নি। বলা ভালো, পড়ার সাহস হয় নি।
নীলয় টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এক কাপ চা বানানো দরকার। কঙ্কা থাকলে বানিয়ে দিতে পারতো। এখন নিজেকেই চা বানিয়ে নিতে হবে। চুলা জ্বালানোর পরে নীলয় হতাশ হলো। কারণ ঘরে পানি নেই। নীলয় চুলা বন্ধ করে দিলো। পানির বোতল হাতে নিয়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে গেল। বসার ঘরের সামনে দিয়ে রান্নাঘরে যেতেই কেউ নীলয়কে ডেকে উঠলো,
–কে? নীলয়?
নীলয় থমকে দাঁড়ালো। বসার ঘরে উঁকি মেরে কলিমউদ্দিন সাহেবকে দেখতে পেলো। আবছা আলোয় কলিমউদ্দিন সাহেব বসে আছেন। নীলয় অবাক হয়ে বলল,
–আপনি ঘুমান নি, চাচা?
কলিমউদ্দিন সাহেব ঠান্ডা গলায় বললেন,
–না রে, ঘুম আসছে না। তুই এত রাতে নিচে এসেছিস যে? কিছু দরকার?
–আসলে চাচা, পানি নিতে এসেছি। খুব চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে। চা বানাতে গিয়ে দেখি পানি নেই।
কলিমউদ্দিন সাহেব আচ্ছন্নের মতো বললেন,
–চা বানাবি? আমার জন্যও এক কাপ বানিয়ে আন তো দেখি।
নীলয় মাথা নেড়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো। দু’কাপ চা বানিয়ে বসার ঘরে এলো। কিন্তু ততক্ষণে কলিমউদ্দিন সাহেব সেখানে বসেই ঘুমিয়ে পরেছেন। নীলয় দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিঃশব্দে কলিমউদ্দিন সাহেবের পায়ের কাছে গিয়ে বসলো। সে জানে আজ কলিমউদ্দিন সাহেবের মনটা খুব খারাপ। আজ সন্ধ্যায় সুরমার মা হওয়ার খবর পেয়ে সবাই আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল। কলিমউদ্দিন সাহেব মিষ্টি কিনে এনেছিলেন। নানা হওয়ার আনন্দ যে কিছু কম নয়, সেটা এই প্রথম অনুভব করলেন তিনি। আয়েশা বেগম যখন পাশের বাড়িতে মিষ্টি দিতে গেলেন বিপত্তি বাঁধলো তখন। পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলা সুখবর শুনে অভিনন্দন তো জানালেনই না, উল্টো দুঃখ প্রকাশ করে বলতে লাগলেন,
–তোমার বোনের মেয়ের জীবন তো ভালোই চলছে। কিন্তু তোমার নিজের মেয়েটা কি কান্ডটাই না করলো! কার না কার হাত ধরে পালিয়ে গেল কে জানে! তোমার জন্য দুঃখ হয়। বোনের মেয়েকে আর একটা রাস্তার ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে নিজের পেটের মেয়েকেই মানুষ বানাতে পারলে না। আসলে তোমাদের কপাল খারাপ। অবশ্য রক্তের ধারা বলেও একটা ব্যাপার আছে…. ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসব কথাবার্তা শুনে হুট করেই আয়েশার ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেল, শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। বাসায় ডাক্তার ডাকতে হলো। ডাক্তার এসে একটা ইঞ্জেকশন দিলেন। তারপর ঘুমের ওষুধ খাইয়ে আয়েশাকে ঘুম পাড়ানো হলো। তারপর থেকেই কলিমউদ্দিন সাহেব ঝিম ধরে বসে আছেন। বাসায় বিরাজ করছে নিঃস্তব্ধতা। রাতে কারোর কিছু খাওয়াও হয় নি।
কলিমউদ্দিন সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে নীলয়ের চোখে জল এলো। সে নিঃশব্দে কলিমউদ্দিন সাহেবের পা স্পর্শ করলো। অস্পষ্ট গলায় বিরবির করে বলল,
–আপনার মতো মানুষ হয় না, চাচা। এই পৃথিবীতে আপনিই হলেন সবচেয়ে ভালো মানুষ। আপনার কষ্ট নিশ্চয়ই দূর হবে।
তারপর উঠে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে ঢুকলো। চায়ের কাপ দুটো সেখানেই পরে রইলো অবহেলায়। কারোরই আর চা খাওয়া হলো না।
ঘরে গিয়ে নীলয় পুতুলের চিঠিটা বের করলো। আলো জ্বালিয়ে চিঠিটা পড়তে উদ্যত হলো। চিঠি বেশি বড় নয়। নীলয় বড় করে একবার শ্বাস নিয়ে পড়তে শুরু করলো। পুতুল লিখেছে,
“কবি সাহেব,
পৃথিবী জটিল। কিন্তু কেন জটিল জানেন? মানুষের জন্য। মানুষ খুব জটিল প্রাণী বলেই পৃথিবীটাকে এত জটিল বলে মনে হয়। মানুষের জীবন যতটা না জটিল আর কুটিল, তারচেয়ে বেশি জটিল মানব মন। মানুষের মন বদল ঘটে। আমি জানি, আমারও ঘটবে। আপনাকে ভালো লেগেছিল। হয়তো ভালোওবেসেছিলাম। কিন্তু আজ আমি বিয়ে করতে চলেছি। যাকে বিয়ে করছি সে মানুষ হিসেবে খারাপ নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, সে আমাকে খুব ভালোবাসে। তাকে বিয়ে করার পর যখন আমার প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করবো, তখন একটা সময় আমিও তাকে ভালোবেসে ফেলবো। তার ভালোবাসার কাছে আমি হেরে যাব। আপনার প্রতি আমার অনুভূতি ফিকে হয়ে যাবে। হ্যাঁ, আপনার স্মৃতিগুলো আমার মনের ভেতর থাকবে বটে। কিন্তু আর কোনো অনুভূতি জাগ্রত হবে না। তখন আমার সমস্ত নতুন নতুন অনুভূতি হবে আমার স্বামীকে ঘিরে। তার মায়ায় পরে যাব, তার প্রেমে জড়িয়ে যাব, তাকে ছাড়া দুনিয়াটাকে আমার মিথ্যা মনে হবে। এভাবেই আমার মন বদল ঘটবে। আপনি হয়তো ভাবছেন, পুতুল ভীষণ নিষ্ঠুর। হয়তো কথাগুলো নিষ্ঠুরের মতোই বলেছি। আপনার বোধহয় এই মুহূর্তে খারাপও লাগছে। কিন্তু একসময় দেখবেন আর খারাপ লাগবে না। আবার জীবনের আরেক পর্যায়ে গিয়ে আপনার মনে হবে, এই ভালো হয়েছে। মনে হবে, পুতুল চলে গিয়েছিল বলেই সুন্দরতম ভালোবাসার মানুষটাকে আমি পেয়েছি। আসলে কি জানেন? জীবনটা ফুলের বাগানে হেঁটে চলার মতো। একটা ফুল মরে যাবে। তারপর আপনি আরও একটা ফুল খুঁজে পাবেন। সেই ফুলকে তুলে এনে ফুলদানিতে সাজাবেন, নিয়ম করে জল দেবেন, ভালো লাগবে, ভালোবাসবেন। এই যে আমি কথাগুলো লিখছি, আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি জানি এই কষ্ট চিরস্থায়ী নয়। এই কষ্ট দূর হবে খুব শীঘ্রই। ভালো থাকবেন, কবি সাহেব। আজ থেকে আপনার জীবনে পুতুল নামের আর কোনো অধ্যায় নেই। পুতুল ঝড়ের মতো আপনার জীবনে এসেছিল। আজ থেকে সেই ঝড়ের চির সমাপ্তি ঘটলো।
ইতি,
সমাপ্ত অধ্যায়।
পুনশ্চ: আর কখনো আমার সাথে দেখা করতে আসবেন না। আর এই চিঠিটা নষ্ট করে ফেলবেন।”
নীলয় চিঠি রেখে চোখ বন্ধ করলো। তার গাল বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। উফ, অসহ্য! নীলয় মনে মনে প্রার্থনা করলো,
“হে পরম করুণাময়! পুতুলের কথাই যেন ঠিক হয়। এই কষ্টময় অনুভূতি যেন আজই শেষ হয়ে যায়। আজকের পর যেন এই কষ্ট আর কখনো না আসে।”
.
#চলবে………..
(একের পর এক এসাইনমেন্ট পেয়েই যাচ্ছি। আমি খুবই দুঃখিত। এখন থেকে নিয়মিত দেবোই দেবো ইনশাআল্লাহ।)
বি.দ্র: সবাই আজ একটু কমেন্ট করার চেষ্টা করবেন প্লিজ। কারণ পেইজের রিচ ডাউন।