#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:৮
.
.
.
উঠানের একধারে মোড়ায় বসে কঙ্কা স্টোভ জ্বালানোর চেষ্টা করছে। স্টোভটা কেরোসিন দিয়ে জ্বলে। এটা জ্বালানো সহজ নয়।, খুব কঠিনও নয়। কিন্তু কঙ্কা পারছে না। সে কখনো এধরণের স্টোভে রান্না করে নি। স্টোভটা বাড়িওয়ালার। কঙ্কা চেয়ে এনেছে। শুধু স্টোভ নয়, সাথে একটা পাতিল আর দুটো কাপও চেয়ে এনেছে। বাড়িওয়ালার কাজের মেয়েটা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে কঙ্কাকে পর্যবেক্ষণ করছে। কঙ্কা কোনো জিনিস নষ্ট করে ফেলছে কিনা সেটা দেখার জন্যই মেয়েটাকে আসলে পাঠানো হয়েছে। সে খুব মনোযোগ দিয়ে সেই কাজ করছে।
কঙ্কা মেয়েটির দিকে তাকালো। গলা উঁচিয়ে তাকে ডাকলো,
–এই মেয়ে, এদিকে এসো।
মেয়েটি এগিয়ে গেল। কঙ্কা জানতে চাইলো,
–তোমার নাম কি?
মেয়েটি হাসিমুখে উত্তর দিলো,
–লিপি।
কঙ্কা কোমল গলায় বলল,
–লিপি, তুমি ভালো আছ?
লিপি মাথা নাড়লো। কঙ্কা আবারও বলল,
–কিছুক্ষণ আগে তুমি আমার জন্য চাপাতি আর চিনি কিনে এনেছ। সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তখন তুমি ভালো আছ কিনা জিজ্ঞেস করা হয় নি। তাই এখন জিজ্ঞেস করলাম।
লিপি হেসে ফেললো। তারপর বলল,
–আপা, আপনে চুলা জ্বালাইতে জানেন না, না?
কঙ্কা চট করে উত্তর দিলো,
–ঠিক ধরেছ। তুমি একটু জ্বালিয়ে দেবে, লিপি?
লিপি কঙ্কার পাশে বসে পরলো। স্টোভে আগুন জ্বালিয়ে দিতে দিতে বলল,
–বাড়িওয়ালা ভাবি কইলো আপনেরা নাকি পালাইয়া আসছেন। সত্য নাকি?
চুলা ধরানো হয়েছে। কঙ্কা চা বানাতে শুরু করলো। চায়ের পানি চড়িয়ে দিয়ে সে বলল,
–স্বামী স্ত্রী কি শুধু বাড়ি থেকে পালিয়েই আলাদা সংসার বাঁধতে আসে?
–তা আসে না। কিন্তু আপনেদের সাথে কোনো জিনিসপত্র নাই যে। না পালাইলে কেউ এমন খালি হাতে আসে? বাসনপত্র তো অন্তত নিয়া আসে।
কঙ্কা চাপাতি দিয়ে দিলো পানিতে। তারপর বলল,
–শোনো লিপি, আমি আমার সংসারের জন্য সব জিনিসপত্র নতুন কিনবো। তাই পুরানো কিছু আনি নি। বুঝতে পেরেছ?
লিপি মুখ টিপে হেসে বলল,
–হ, বুঝছি।
কঙ্কার চা বানানো শেষ। সে চা কাপে ঢেলে চিনি মিশিয়ে নিলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–স্টোভটা তুমি নিয়ে যাও। পাতিল আর চায়ের কাপ আমি গিয়ে দিয়ে আসবো।
কথা শেষ করে কঙ্কা চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। আবির তখনো গভীর ঘুমে। কঙ্কা চায়ের কাপ দুটো পাশে রেখে বিছানায় বসলো। আবিরকে ডাকলো,
–আবির উঠে পরো। সকাল হয়ে গেছে।
আবির বিরক্তি নিয়ে পাশ ফিরলো। কঙ্কা এবার আবিরের কানের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলল,
–ওঠো জলদি।
আবির এবার চোখ মেললো। চোখমুখ বিকৃত করে তাকাতেই কঙ্কার মুখটা চোখে পরলো। কঙ্কা খয়েরি রঙের শাড়ি পরেছে, পিঠে ছড়িয়ে আছে ভেজা চুল, স্বচ্ছ মুখে ভাসছে হাসি। আবিরের মুখের বিকৃত ভাব স্বাভাবিক হয়ে এলো। সে এবার উঠে বসলো। কঙ্কাকে কাছে টেনে বলল,
–তোমাকে শাড়িতে এত সুন্দর লাগে কেন, কঙ্কা?
কঙ্কা হাসলো। পাশে রাখা চায়ের কাপ দুটো হাতে নিলো। এক কাপ আবিরের হাতে দিয়ে বলল,
–নাও, চা খাও।
আবির অবাক হয়ে বলল,
–চা কোথায় পেলে?
–বাড়িওয়ালার কাজের মেয়েটাকে দিয়ে দোকান থেকে চা আর চিনি আনিয়েছি। আর বাকি সব জিনিস বাড়িওয়ালা ভদ্রমহিলার কাছ থেকে ধার নিয়েছি। এই কাপ দুটোও উনাদের।
–তুমি চাইলে আর উনি দিয়ে দিলেন?
–হ্যাঁ, দিলেন। দেবেন না কেন? এবার তাড়াতাড়ি চা শেষ করে ফ্রেশ হও। আমাদের কেনাকাটা করতে যেতে হবে।
আবির ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কেনাকাটা?
–হ্যাঁ। নইলে কিন্তু আজও রান্না করা যাবে না।
আবির কপাল কুঁচকে বলল,
–উফ, যন্ত্রণা!
কঙ্কা হেসে ফেলে বলল,
–জ্বি, জনাব। এটুকু যন্ত্রণা তো সহ্য করতেই হবে। যন্ত্রণা ছাড়া সংসার হয় না।
আবির চা শেষ করলো। তারপর উঠে বাথরুমে চলে গেল। কঙ্কা মেঝেতে পাতা বিছানা তুলে রাখছিল। তখনই আবিরের ফোন বেজে উঠলো। কঙ্কা চমকে গেল। কারণ সে তার নিজের ফোন সাথে আনে নি। এদিকওদিক তাকাতেই ব্যাগের উপরে থাকা ফোনটা চোখে পরলো কঙ্কার। সে ফোন হাতে নিলো। ফোন করছে আবিরের মা। কঙ্কার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। আবির যে পালিয়ে এসেছে সেটা তার বাড়িতে কেউ জানে না। আবির এমনিতেই বাড়ি থেকে দূরে একটা ফ্ল্যাটে থাকে। সবাই জানে, আবির এখনো সেখানেই আছে। কঙ্কা ফোন ধরলো। কোমল গলায় বলল,
–আসসালামু আলাইকুম, মা। আপনি ভালো আছেন?
ওপাশ থেকে ভেসে এলো আবিরের মায়ের কন্ঠস্বর,
–আ..আপনি কে? এটা তো আমার ছেলের ফোন।
কঙ্কা মুখ টিপে হাসলো। গলা শুনে মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলা বেশ ভড়কে গেছেন। কঙ্কা স্পষ্ট গলায় বলল,
–আমি আপনার ছেলের বউ, মা। পরশু রাতে ও আমাকে নিয়ে পালিয়েছে। আর বিয়েও করেছে। আমরা এখন রংপুরের একটা জায়গায় আছি, মা।
আবিরের মা একমুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেলেন। হঠাৎ রাগী গলায় বললেন,
–এই মেয়ে! এসব কি বলছো তুমি?
–ঠিকই বলছি, মা। বিশ্বাস না হলে আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন আবির ওর ফ্ল্যাটে আছে কিনা।
–এই, তুমি আবিরকে ফোনটা দাও। আমি ওর সাথে কথা বলবো।
কঙ্কা কাঁদোকাঁদো সুরে বলল,
–না না, মা। আমি যে আপনাকে সব জানিয়ে দিয়েছি সেটা প্লিজ ওকে বলবেন না। ও তাহলে আমার উপরে খুব রাগ করবে। আপনি ওকে বলবেন যে আপনারা ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে ওকে পাননি বলে খোঁজ নিয়েছেন। ঠিক আছে, মা? এখন রাখছি। আপনার ছেলে চলে আসবে।
কঙ্কা ফোন রাখলো। এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা হাসিটা আর চাপতে পারলো না সে। অট্টহাসিতে ফেটে পরলো কঙ্কা।
___________________
দুপুর হয়ে এসেছে। সুরমা একরাশ বিষন্নতা নিয়ে বসে আছে বারান্দায়। দুপুরের রোদ এসে তাকে ঘিরে ধরেছে। তার চোখ থেকে পানি উপচে পরছে। তার হাতে একটা চিঠি। সকাল সকালই নীলয়কে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল শাদাব। নীলয়কে নিয়ে থানায় যাবে, তারপর সেখান থেকেই অফিসে যাবে– এমনটাই বলে গিয়েছে সে সুরমাকে। যাওয়ার আগে শাদাব সুরমাকে এই চিঠিটা দিয়ে গেছে। সুরমা খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে এই চিঠি পড়তে বসেছিল। কিন্তু চিঠি পড়ে তার ভয়ংকর রকমের মন খারাপ হয়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে যেন জগতের সমস্ত দুঃখ তার বুকে চেপে বসেছে। সুরমা আরেকবার চিঠিটা পড়তে শুরু করলো।
“সুরমা,
তোমাকে প্রিয় বলে সম্বোধন করবো না। কারণ তুমি আমার প্রিয়জন হলেও, আমি তোমার প্রিয়জন নই। তোমার প্রিয় সবসময়ই ছিল অন্য কেউ। তুমি কখনোই আমার স্ত্রী হতে পারো নি, তুমি থেকে গিয়েছ অন্যের প্রেমিকা হয়ে। আর অন্যের প্রেমিকাকে প্রিয় বলার দুঃসাহস ইতোপূর্বে আমি অনেকবার করেছি। এবারে আর করলাম না। যাই হোক, এবার কাজের কথাটা বলে ফেলি। তোমাকে সামনাসামনি বা ফোনে কথাগুলো বলতে পারবো না বলেই এই চিঠি লিখতে হচ্ছে। কথাটা হলো, তুমি আর কখনো আমার সামনে আসবে না। কোনোদিনও আমার সামনে এসে দাঁড়াবে না। আমি তোমার মুখটা আর দেখতে চাই না। তোমাকে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়, সুরমা। তোমার করা অবহেলাগুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে আমার মনে। নিজের স্ত্রীকে এত ভালোবাসা দিয়েও তার কাছ থেকে অবহেলা পাওয়ার অনুভূতিটা বিশেষ ভালো নয়। অবশ্য তুমি এ অনুভূতি বুঝবে না। কারণ প্রেমিকের কষ্ট সম্পর্কেই তুমি শুধু জেনে এসেছ। স্বামীর কষ্ট সম্পর্কে তুমি জানো না। এমনকি স্বামীও যে ভালোবাসতে পারে, তুমি তাও জানো না। তুমি আমাকে ঠকিয়েছ, সুরমা। তোমাকে দেখলে এই কথাগুলো আমার বারবার মনে পড়ে যায়। তাই তুমি আর কখনো আসবে না আমার সামনে। তোমাকে দেখলে যে শুধু কষ্ট পাই, তা নয়; রাগও হয়। তোমাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে সেই অবহেলা তোমাকেও ফেরত দিতে যা তুমি আমাকে দিয়েছ। কিন্তু কি করে দেবো? তুমি যে আমায় ভালোই বাসো না। তাহলে আমার অবহেলা তোমায় কষ্ট কি করে দেবে? আমার মাঝেমধ্যে কি মনে হয় জানো? মনে হয়, যারা তোমার মতো প্রেমিককে মনের ভেতর নিয়ে স্বামীর ঘরে ঢোকে, তাদের মৃত্যুদন্ড হওয়া উচিত। তাহলে আর কাউকে আমার মতো করে কষ্ট পেতে হতো না। আমি আর কষ্ট পেতে চাই না, সুরমা। তাই আমাদের বিচ্ছেদই ভালো। এই ছিল আমাদের শেষ দেখা। আর কখনো আমাদের দেখা হোক, এ আমি চাই না। আর যদি কখনো ভুল করেও তুমি আমার সামনে চলে আসো, তবে সত্যি বলছি, আমি তোমার প্রাণ নিয়ে নেবো। আমার একটুও হাত কাঁপবে না। ভালো থেকো, সুরমা। বিদায়!
ইতি,
শাদাব।”
বড় বড় কয়েক ফোঁটা পানি সুরমার চোখ থেকে গড়িয়ে পরলো চিঠির উপরে। সে চিঠিটা বুকে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করলো। দরজায় কারোর টোকা পরতেই সুরমা তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছলো। চিঠিটা লুকিয়ে ফেললো ওড়নার ভাঁজে। দরজার বাইরে থেকে কলিমউদ্দিন সাহেবের গলা পাওয়া গেল,
–মা সুরমা, ঘরে আছ?
সুরমা উঠে দাঁড়ালো। বারান্দা থেকে ঘরে যেতে যেতে বলল,
–খালুজান, আসুন।
কলিমউদ্দিন সাহেব ঘরে ঢুকলেন। সুরমা চিন্তিত মুখে বলল,
–খালুজান, বসুন তো। আপনি খামোখা উঠে এলেন কেন? আমাকে ডাকলেই তো আমি যেতাম। আপনার এখন বিশ্রাম দরকার।
কলিমউদ্দিন সাহেব চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,
–আমি এখন ঠিক আছি, বড় আম্মা। ঠিক আছি।
সুরমা সামনে বসলো। সে জানে যে তার খালুজান ঠিক নেই। উনি একপ্রকার জোর করেই নিজেকে ঠিক রাখছেন। কারণ উনি জানেন যে উনি ঠিক না থাকলে এ বাড়ির অন্য মানুষগুলোও ঠিক থাকবে না। সুরমা হাসার চেষ্টা করে বলল,
–খালুজান, আপনি চিন্তা করবেন না। থানায় ডায়েরি করা হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি কঙ্কাকে পাওয়া যাবে।
কলিমউদ্দিন সাহেব ইতস্তত করে বললেন,
–মা গো, কঙ্কা কার সাথে গেছে তুমি কি তা জানো? আমারে বলো, মা।
সুরমার চোখে জল এসে গেল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
–বিশ্বাস করুন, খালুজান। আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। ওর কারোর সাথে সম্পর্ক ছিল কিনা, সে ব্যাপারেও ও কখনো আমাকে কিছু বলে নি।
কলিমউদ্দিন সাহেবের মুখ মলিন হয়ে গেল। দুঃখের মেঘ নেমে এলো উনার চোখ জুড়ে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকার পর উনি মৃদু গলায় বললেন,
–নীলয় কি কিছু জানতে পারে, মা?
সুরমা আমতা আমতা করে বলল,
–না মানে, আমি ঠিক জানি না। মনে হয়, জানে।
–ও! ঠিক আছে, মা। ঠিক আছে।
কলিমউদ্দিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে চলে যেতে লাগলেন। সুরমা উঠে দাঁড়ালো। বলল,
–খালুজান, আপনি সকাল থেকে কিছু খান নি। দুপুরেও খান নি। আপনি খান নি বলে বাসার বাকি সবাইও কিছু খায় নি। কঙ্কার জন্য আপনার কষ্ট হচ্ছে আমি জানি। কিন্তু আমরা কি আপনার কেউ নই? আমি কি আপনার মেয়ে না? কঙ্কা কি একাই আপনার মেয়ে? আমাদের জন্য কি নিজেকে ভালো রাখবেন না আপনি? অন্তত খালার জন্য। এবার তো কিছু খেয়ে নিন।
কলিমউদ্দিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–ঠিক আছে, মা। আমি খাব।
সুরমার চোখে আবার পানি এলো। সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
–আপনি খালাকে নিয়ে খেতে বসুন। আমি নীলয়কে ডেকে আনছি।
কলিমউদ্দিন সাহেব চলে গেলেন। সুরমা ওড়নার ভাঁজ থেকে চিঠিটা বের করে বিছানার চাদরের নিচে লুকিয়ে রাখলো। তারপর জগতের সমস্ত দুঃখ বয়ে নিয়ে সে এগিয়ে চলল নিজের কর্তব্যের দিকে।
_________________
থানা থেকে ফিরে আসার পরেই নীলয় কঙ্কার চিঠিটা পড়েছে। সকাল থেকেই চিঠিটা পড়ার জন্য তার মন আঁকুপাঁকু করছিল। কিন্তু চিঠি পড়ার পর থেকেই নীলয় থম মেরে বসে আছে। সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যে কঙ্কা নিজের মনে এত কথা চেপে রেখেছিল। দ্বিতীয় বার পড়ার জন্য নীলয় আবার চিঠিটা হাতে নিলো। বড় করে একবার শ্বাস নিয়ে সে চিঠিটা পড়তে শুরু করলো। কঙ্কা লিখেছে,
“নীলয় ভাই,
আপনাকে যখন প্রেমপত্র দিয়েছিলাম তখন আমার বয়স খুব কম ছিল। অল্প বয়সের প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু তবুও মেনে নিয়েছিলাম, নিতে পেরেছিলাম। কিন্তু একটা সময়ে গিয়ে নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ লাগতে শুরু করলো। সামান্য ব্যাপারে মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি, বকাঝকা আমার ভালো লাগতো না। মায়ের বলা কথাগুলো আমাকে খুব কষ্ট দিতো। জানেন, নীলয় ভাই? আমাদের বাসায় যেবার নতুন রঙ করা হলো, তখন আমি মাকে বলেছিলাম যেন দেয়ালে নীল রঙ করা হয়। কিন্তু মা বলেছিল সাদা রঙ করা হবে। সাদা রঙ কেন ভালো হবে সেটা মা আমাকে বুঝিয়ে বলছিল। আর আমিও মাকে বারবার নীল রঙের কথা বলে যাচ্ছিলাম। এই নিয়ে দু একটা কথা বলতে বলতে মা হুট করে রেগে গিয়েছিল। রাগের মাথায় বলেছিল, ” এটা কি তোর বাড়ি? তোর নিজের বাড়িতে গিয়ে যা খুশি করবি। আমার বাড়িতে তোকে মাতবরি করতে হবে না।” এই কথার পর আর কিছু বলা যায় না। আমি সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। নানান সময়ে এমন অনেক কথাই মা আমাকে বলতো। নীলয় ভাই, আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে মায়ের উপরে আমার রাগ আছে। না, মায়ের উপর আমার কোনো রাগ নেই। কারণ আমি জানি যে মা এসব কথা মন থেকে বলতো না, সবই বলতো রাগের মাথায়। আমার জন্মের পরে মা আরও একবার সন্তানসম্ভবা হয়েছিল। কিন্তু সে সন্তান মারা গিয়েছিল। এই ঘটনা মায়ের মানসিক অবস্থার উপর খুব খারাপ প্রভাব ফেলেছিল। তারপর থেকেই মা হুটহাট করে রেগে যায়। আর রাগের মাথায় কি বলে নিজেও বুঝতে পারে না। এসবই আমি জানি। কিন্তু তবুও মায়ের কথাগুলোকে আমি আমার মাথা থেকে বের করতে পারতাম না। সবসময় মাথায় চেপে বসে থাকতো, আমাকে কষ্ট দিতো। মায়ের কথাগুলোকে শুধু বকা ভেবেই পাশ কাটিয়ে যেতে পারি নি আমি। উল্টে সেটা নিয়ে ভেবে কষ্ট পেয়েছি। এটাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। এ ব্যাপারে আমি কাউকে কিছু বলতেও পারতাম না। আপাকে আমি সব কথা বলতাম। কিন্তু এগুলো আমি আপাকেও বলতে পারতাম না। বাবাকেও না, আর না আপনাকে। মনের ভেতরে কথা জমে থাকতে থাকতে আমার অশান্তি বাড়ছিল। আমার মানসিক অবস্থা খারাপ হচ্ছিলো দিনকে দিন। আমার মনে হচ্ছিলো যে আমাকে বোঝার মতো, আমার কষ্ট বোঝার মতো কেউ নেই এই পৃথিবীতে। ঠিক এমন সময়েই আমার জীবনে আবিরের আগমন ঘটেছিল। আবির আমাকে বলেছিল ও নাকি আমাকে ভালোবাসে। প্রথমে আমি পাত্তা দেই নি। কিন্তু আমার প্রতি ওর কেয়ার দেখে আমি ওর সাথে সম্পর্কে জড়ালাম। ও আমাকে হাসাতে পারতো, আমাকে আনন্দে রাখতে পারতো। এই সবকিছু থেকেই ওর প্রতি ভালোলাগা তৈরি হলো। সম্পর্কের বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমি আমার ভুল ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলাম। ও এমনভাবে আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করতো যা আমার ভালো লাগতো না। এসব নিয়ে ঝগড়াঝাটিও করেছি। কিন্তু আবির পরবর্তীতে এমনভাবে আমার পায়ে ধরে মাফ চাইতো যে মনে হতো ও সত্যিই অনুতপ্ত। আমিও মাফ করে দিতাম। ওর সাথে আমার সম্পর্কের প্রায় দুই বছরের মাথায় একটা মেয়ে আমার কাছে এলো। মেয়েটি এসেছিল সাহায্য চাইতে। মেয়েটার নাম ছিল মীরা। মীরা আমাকে বলেছিল, আবির ওর সাথে প্রতারণা করেছে। আবির ওকে বিয়ে করবে বলে ওকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। কিন্তু তারপর আবির ওর সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়ায় আর ওর গয়নাগাটি, টাকাপয়সা নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসে মীরাকে ফেলে রেখেই। মীরা ফিরে এসে আবিরকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু ওকে আর বিয়ে করে নি আবির। মেয়েটির সমস্ত অভিযোগ এক বাক্যে অস্বীকারও করেছে। বলেছে, ও নাকি মীরাকে চেনে না, কোনোদিনও চিনতো না। মীরা আমাকে অনুরোধ করেছিল যেন আবিরকে শাস্তি দিতে আমি ওকে সাহায্য করি। কিন্তু আমি মীরার একটা কথাও বিশ্বাস করি নি। ওকে কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে আমি বাসায় ফিরেছিলাম। পরের দিন সকালে আমার ফোনে কিছু ছবি আসে। বিভিন্ন মেয়ের সাথে আবিরের অন্তরঙ্গ ছবি। এসব দেখে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো। আমি খুব ভেঙে পরেছিলাম। মীরার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে মীরা আত্মহত্যা করে ফেলেছে। আমার আজও মনে হয় ওর মৃত্যুর জন্য বুঝি আমিই দায়ী! আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আবিরের সাথে আর সম্পর্ক রাখবো না। সমস্ত প্রমাণ হাতে নিয়ে সেদিন আমি আবিরের সাথে দেখা করতে গেলাম আমাদের সম্পর্কটা ভেঙে দিতে। কিন্তু সেদিন আমার কফির সাথে কিছু একটা মিশিয়ে দিয়েছিল আবির, যার কারণে আমি অচেতন হয়ে পরেছিলাম। না, আবির নিজে হাতে করে নি কাজটা। ওয়েটারকে টাকা দিয়ে কাজটা করিয়ে নিয়েছিল। যখন আমার চেতনা ফিরলো ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারি নি। এরপর আমার মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছিল সে আর ব্যাখ্যা করতে বসবো না। শুধু একদিনের ঘটনা মনে করিয়ে দেই। আপনার মনে আছে, নীলয় ভাই? একদিন আপনি আমার হাতে ঘুমের ওষুধ দেখতে পেয়ে ছুটে এসে সেগুলো কেড়ে নিয়েছিলেন? আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, আত্মহত্যা সমাধান নয়। দুঃখ কষ্ট থাকলেই আত্মহত্যা করতে হবে নাকি? অন্যভাবে সমাধানের চিন্তা করতে হবে। আমি সেদিন হাসতে হাসতে বলেছিলাম, “আত্মহত্যা করতে যাব কেন? আমি তো ওষুধগুলো বাবার জন্য এনেছি।” মিথ্যা বলেছিলাম, নীলয় ভাই। আমি আত্মহত্যাই করতে চেয়েছিলাম। আপনার ধমক খেয়ে কাজটা আর করি নি। কারণ আমি ভেবে দেখেছিলাম যে আমি মারা গেলে আবিরের কিছুই যায় আসবে না। ও ঠিকই মুক্তভাবে বেঁচে থাকবে এই পৃথিবীতে। আমি ওকে মুক্ত করে দিতে চাই নি। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এর মধ্যেই আবির আরেক ঝামেলা নিয়ে হাজির হলো। সেদিন আমাকে অচেতন করে কিছু আপত্তিকর ছবি ও তুলেছিল। সেগুলো পাঠিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করলো। তার মাঝেই বাবা আমার বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলেন। আমি চিন্তিত হয়ে পরলাম। যার সাথে বাবা আমার বিয়ে ঠিক করবেন সে হয়তো খুব ভালো মানুষ হবে। হয়তো দুলাভাইয়ের মতো অথবা হয়তো আপনার মতো। একটা ভালো মানুষকে সারাজীবন ঠকিয়ে যেতে মন সায় দিলো না। তাই অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম আবিরকেই বিয়ে করবো। ওকে মুক্ত করে দিয়ে কোনো লাভ নেই। তাই টাকাপয়সা আর গয়নাগাটি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা বললাম। আবির রাজি হলো। আমি জানতাম যে বিয়ে করার আগেই চলে গেলে ও আর আমাকে বিয়ে করবে না। তাই ভেবে রেখেছি আগে বিয়ে সেরে তবেই পালাবো। তাছাড়া আমার শরীরের প্রতি আবিরের আগ্রহ এখনো শেষ হয়ে যায় নি। সেই সুযোগটাই আমি কাজে লাগালাম। নীলয় ভাই, আপনি হয়তো সবসময়ের মতো আমায় পাগল ভাবছেন। কিন্তু একবার ভালো করে ভাবুন, এরচেয়ে ভালো কোনো উপায় ছিল না আমার। তাছাড়া আবিরের সাথে সম্পর্কে জড়ানোটা তো আমারও ভুল ছিল। নিজের ভুল তো পুরোপুরি অস্বীকার করে যেতে পারি না। তাই এই পথে পা বাড়ালাম। আর কোনো মেয়ের সাথে আবিরকে কোনো অন্যায় আমি করতে দেবো না। আপনি ভালো থাকবেন। আমার মা বাবাকে দেখে রাখবেন। ওদের চোখে জল আসতে দেবেন না কখনো। আমি আপনাকে ভরসা করি।
ইতি,
কঙ্কা।”
নীলয়ের মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। সে চোখ বুজে ফেললো। ততক্ষণে খোলা দরজায় এসে সুরমা দাঁড়িয়েছে। সে দরজায় টোকা দিয়ে নীলয়কে ডাকলো,
–ভাই, কি করছিস?
নীলয় চমকে গেল। তাড়াহুড়ো করে চিঠিটা বালিশের তলায় রাখলো। বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়িয়ে বলল,
–কিছু না, আপা। তুমি কিছু বলবে?
সুরমা ভ্রু কুঁচকে বলল,
–ওটা কি লুকিয়ে ফেললি তুই?
নীলয় দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,
–কিছু না, আপা। কিছু না, কিছু না।
সুরমার ভ্রু আরও কুঁচকে গেল। সে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। বালিশের নিচ থেকে চিঠিটা বের করলো। নীলয় নতমুখে দাঁড়িয়ে রইলো। সুরমা চিঠিটা পড়লো। তার চোখের সামনে যেন গাঢ় অন্ধকার নেমে এলো। নিজের সংসার, আপনজনদের দুঃখ, তার সাথে কঙ্কার ভবিষ্যৎ, সমস্ত চিন্তা একসাথে ভর করলো তার মাথায়। হৃদয়ের গভীর থেকে দুঃখ আন্দোলিত হয়ে উঠলো। চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পরতে লাগলো। সে দু’হাতে কপাল চেপে ধরে বসে পরলো। প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল,
–এমন একটা ছেলের সাথে কঙ্কা…!
নীলয় কথা বলতে পারলো না। তার মুখ কালিবর্ণ হয়ে গেছে।
.
#চলবে………..
(প্রতিদিন গল্প দিতে চেয়েও পারছি না। আমি খুবই দুঃখিত সকলের কাছে। আপনারা সবাই দয়া করে মন্তব্য করার চেষ্টা করবেন। আপনাদের মন্তব্য আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে। পেইজের রিচও কমে গেছে। তাই পোস্টটি যাদের কাছে পৌঁছাবে, সবাইই অন্তত রিয়্যাক্ট দেওয়ার চেষ্টা করবেন।)