নিরব রদনে পর্ব-২২

0
1266

#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:২২
.
.
.
নীলয় যখন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলো তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। রাতের অন্ধকার কিছুটা গাঢ় হয়েছে, আকাশের এক কোণে এক টুকরো ধবল চাঁদ উঁকি দিয়েছে। বাড়িটা ভীষণ সুনসান লাগছে। সম্ভবত লোডশেডিং হয়েছে। চারপাশে জমাট বাঁধা অন্ধকার।
বাসার দরজা খুলে দিলো ফতি। তার হাতে একটা মোমবাতি। এখানের এমন পরিস্থিতিতে ফতি আজ বাড়ি যেতে পারে নি, এই বাড়িতেই থেকে যেতে হয়েছে। ক্লান্ত পায়ে বাসায় ঢুকে নীলয় প্রথমেই গেল কলিমউদ্দিন সাহেবের ঘরে। কলিমউদ্দিন সাহেব ঘুমিয়ে আছেন। নীলয় উনাকে ডাকলো না। ফতিকে জিজ্ঞেস করলো,
–চাচা রাতে খেয়েছেন?
ফতি ঘাড় কাত করে ছোট্ট করে বলল,
–হু।
কঙ্কা যে এসেছে আর কলিমউদ্দিন সাহেবকে যে সে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছে, সে কথা অনেক চেষ্টাতেও ফতি উচ্চারণ করতে পারলো না। নীলয় ক্লান্ত গলায় বলল,
–ঠিক আছে। আমি তাহলে ঘরে যাচ্ছি। আপা আর দুলাভাই ওদের বাসায় গেছে। কাল সকালে হাসপাতাল থেকে চাচীকে নিয়ে একেবারে এখানে আসবে।
ফতি শুধু মাথা নাড়িয়ে বলল,
–আচ্ছা।
নীলয় ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ির দিকে পা বাড়ালো। অন্ধকার সিড়ি ভেঙে ছাদে পা দিতেই টুকরো চাঁদের ম্লান আলো এসে চোখে লাগলো তার। নীলয়ের মনে হলো চাঁদটাও আজ তারই মতো বড় ক্লান্ত। নীলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিলেকোঠার ঘরের দরজা খুললো। কাঠের কপাটে ঝনাৎ করে শব্দ হলো। দরজা খুলতেই নীলয় ভীষণভাবে চমকিত হলো। টেবিলের উপরে একটা মোমবাতি জ্বলছে, পাশেই একটা নারী মূর্তি দৃশ্যমান হচ্ছে। আবছা আলোয় তাকে যেন ঠিক কঙ্কার মতো লাগছে! নীলয়ের মনে হলো এ নিশ্চয়ই কোনো ভ্রম। সে চোখ বুজলো। একটু সময় নিয়ে আবার চোখ খুললো। না, নারী মূর্তিটা এখনো দেখা যাচ্ছে। নীলয় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কঙ্কা আসবে কোথা থেকে? এখন কি তার এখানে থাকার কথা? কঙ্কার ছায়ার মতো নারী মূর্তি এবার কথা বলল। হুবহু কঙ্কার গলায় বলল,
–নীলয় ভাই, ভেতরে আসুন। আমি চা বানিয়েছি আপনার জন্য।
নীলয়ের মাথা এবার ঝিমঝিম করে উঠলো। সে কি অন্য কোনো দুনিয়ায় চলে এলো? যেখানে কঙ্কা এখনো এভাবে চা বানিয়ে তার অপেক্ষা করে! নাকি সে সারাদিনের ক্লান্তিতে ভুল শুনছে? নীলয় দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না আর। ধপ করে বসে পরলো মেঝেতে। ছায়ামূর্তি মোমবাতি হাতে দৌড়ে এলো তার কাছে। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
–নীলয় ভাই, আপনি কি ঠিক আছেন? ঠিক আছেন আপনি?
নীলয় মাথা তুলে তাকালো। মোমবাতির আলোয় এবার স্পষ্ট দেখা গেল মুখটা। এ তো কঙ্কাই! কোনো ভুল নেই। নীলয় অস্ফুটে উচ্চারণ করলো,
–কঙ্কা!
কঙ্কার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে মুখে হাসি টেনে বলল,
–হ্যাঁ, আমি। আমি ফিরে এসেছি।
নীলয়ের তখনো ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হলো না। সে ভয়ে ভয়ে হাত বাড়ালো। কঙ্কার একটা হাত ধরলো। ঠান্ডা হাতটা ধরতেই নীলয় চমকে গেল। এ যে সত্যিই কঙ্কা! ভীষণ উচ্ছ্বাস আর বিস্ময়ে নীলয়ের কণ্ঠনালি রুদ্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে নীলয় অস্থির হয়ে বলতে লাগলো,
–কঙ্কা! তুই এসেছিস, কঙ্কা? তুই সত্যিই এসেছিস!
বলতে বলতে নীলয়ের চোখে পানি এসে গেল। কঙ্কা চোখ মুছে বলল,
–হ্যাঁ, আমি সত্যিই এসেছি।
নীলয় চোখ ভরা প্রশ্ন নিয়ে কঙ্কার দিকে তাকিয়ে রইলো। কঙ্কা মৃদু হেসে বলল,
–বলবো, আপনাকে সব বলবো। আগে আপনি শান্ত হোন।
কঙ্কা উঠে দাঁড়ালো। টেবিলে মোমবাতি রেখে নীলয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। নীলয় কঙ্কার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। কঙ্কা বলল,
–আপনি হাতমুখ ধুয়ে আসুন। আমি আপনার চা গরম করে দিচ্ছি। এতক্ষণে বোধহয় ঠান্ডা হয়ে গেছে।
নীলয় বাধ্য ছেলের মতো তাই করলো। কঙ্কা তোয়ালে এগিয়ে দিলো, চা এনে নীলয়ের হাতে দিলো। কাজগুলো সে এমনভাবে করছে যেন প্রতিদিনই সে এ কাজে অভ্যস্ত। বহুদিন যে এ কাজগুলো সে করে নি, সেটা তার হাবভাব দেখে বোঝার উপায় নেই।
নীলয় চায়ে চুমুক দিলো। টেবিলের উপরে রাখা মোমবাতি ফুরিয়ে আসছে। কঙ্কা মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় জানতে চাইলো,
–মা এখন কেমন আছে?
নীলয় হালকা কেশে বলল,
–ভালো।
কঙ্কা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–মায়ের সামনে দাঁড়াবো কি করে, নীলয় ভাই?
–ক্ষমা চাইবি।
–সেই মুখ কি আমার আছে? তাছাড়া, মায়ের এখন এই অবস্থা। হুট করে আমায় দেখলে মা যেই ধাক্কাটা খাবে, সেটা কি মা নিতে পারবে?
–চিন্তা করিস না, কঙ্কা। কাল আপা আসবে। আপা নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সমাধান বের করে ফেলবে।
কঙ্কা হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
–আপা আর দুলাভাই কেমন আছে, নীলয় ভাই?
নীলয় মৃদু হেসে বলল,
–খুব ভালো আছে। কদিন পরে ওদের সংসারে নতুন মানুষ আসছে।
কঙ্কা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
–সত্যি?
নীলয় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। তার চা শেষ হয়েছে। চায়ের কাপ টেবিলে রেখে সে কঙ্কার মুখোমুখি বসলো। কঙ্কার চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় প্রশ্ন করলো,
–আমাকে কিছু প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর দে, কঙ্কা।
কঙ্কা চোখ নামিয়ে নিলো। কাঁপা গলায় বলল,
–কি..কি প্রশ্ন?
নীলয় স্পষ্ট গলায় বলল,
–আবিরকে একেবারে ছেড়ে চলে এসেছিস?
কঙ্কার সদ্য তৈরি দগদগে ঘায়ে প্রশ্নটা তীরের মতো বিঁধলো। তার চোখে জল এসে গেল। চোখ ভরা জল নিয়েই বেশ স্বাভাবিক গলায় কঙ্কা উত্তর দিলো,
–হ্যাঁ। কিছুদিনের মধ্যে আমি ওকে তালাক দেবো।
নীলয় শীতল গলায় বলল,
–এই সিদ্ধান্তের কারণ কি? আবির কি তোকে চায় না?
কঙ্কা হেসে উঠে বলল,
–চায়। চাইলেই আমি সারাটা জীবন আবিরের সাথে সংসার করতে পারতাম, নীলয় ভাই। আবির আমাকে ভালোবেসেছে। আর শুধু আবির নয়, এই কটাদিনে ওই বাড়ির সবার কাছ থেকে যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি সেটা আজীবন আমার মনে থেকে যাবে একটা কলঙ্কের দাগের মতো। কলঙ্ক যেমন মুছে যায় না, তেমনই আমার এই কয়েকটা দিনের সংসারের স্মৃতিও কখনো মুছবে না।
নীলয় কিছুটা সময় নিয়ে আবার বলল,
–তাহলে সব ছেড়ে চলে এলি কেন?
কঙ্কা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–কারণ সবার কপালে সংসার জোটে না। আমি আবিরের সাথে সারাজীবন কাটাবো বলে যাই নি। আমি যে উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছিলাম সে উদ্দেশ্য পূরণ করেছি। নিজের কপাল ভেঙে অন্যের ঘর গড়ে দিয়ে এসেছি।
নীলয় বিভ্রান্ত হলো। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
–মানে?
কঙ্কা শীতল গলায় বলল,
–আজ আমার স্বামীর বাসর রাত, তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে। আমি নিজেই ওদের বিয়ে দিয়ে এসেছি।
নীলয় হকচকিয়ে গেল। প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল,
–কিসব বলছিস?
কঙ্কা খিলখিল করে হেসে উঠলো। নীলয় আরও বিভ্রান্ত হলো। এই পরিস্থিতিতে মেয়েটা এভাবে হাসছে কেন? রহস্য করে কথা বলার স্বভাব মেয়েটার কখনো যাবে না। নীলয় অধৈর্য হয়ে বলল,
–কঙ্কা! আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমাকে কি সব স্পষ্ট করে বলবি?
কঙ্কা হাসি থামিয়ে উত্তর দিলো,
–বলবো, নীলয় ভাই। আপনি ছাড়া আর কাউকে কিছু বলার নেই আমার। আপনাকেই বলবো।
–তাহলে বল।
কঙ্কা আবার মোমবাতির শিখার দিকে তাকালো। তার চোখের দিকে তাকালে মনে হবে যেন তার চোখের ভেতর আগুন জ্বলছে। সে ধীরে ধীরে বলল,
–মোমবাতি শেষ হয়ে আসছে। বাইরে চাঁদ আছে। চাঁদের আলোয় গিয়ে বসবেন, নীলয় ভাই?
নীলয় সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। কঙ্কাকে নিয়ে ছাদের এক কোণায় গিয়ে বসলো। চাঁদের ঠান্ডা আলো তাদের গায়ে পরছে। বহুদিন পরে জ্যোৎস্নার তলায় এভাবে পাশাপাশি বসেছে তারা দুজনে। নীলয়ের মনে হচ্ছে যেন বহুকাল আগের সেই স্বপ্নের নিশালয়ে ফিরে গেছে সে।
সে কোমল গলায় বলল,
–বল, কঙ্কা। আমি শুনছি।
কঙ্কা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মলিন হয়ে আসা চাঁদের দিকে একবার তাকিয়ে অলক্ষ্যে আসা চোখের জলের রেখা মুছে ফেললো। তারপর শুরু করলো হৃদয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকা তার যাতনার কাহিনি। নীলয় একটি কথাও বলল না। কেবল মনোযোগী শ্রোতা হয়ে নীরব জ্যোৎস্নাতলে এক তরুণীর মর্মপীড়ার গাঁথা শুনতে শুনতেই তার রাত কেটে গেল।
_________________________
পুতুলের হঠাৎ মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে গেল। পাশে খসরু সাহেব ঘুমিয়ে আছেন। পুতুল একবার পাশে তাকিয়ে উঠে বসলো। আজ তার বিয়ের রাত। খসরু সাহেবের সাথে আজ তার বিয়ে হয়েছে। আজকের রাত বিশেষ হওয়ার কথা। কিন্তু তেমন কিছুই হচ্ছে না। পুতুলের ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। সে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। আকাশে চাঁদ, জ্যোৎস্না এসে বারান্দায় পরেছে। পুতুলের ভীষণ আফসোস হলো। বিয়ের রাতে বরের সাথে জ্যোৎস্না বিলাস করার বড় শখ ছিল তার। বিয়ের রাতে জ্যোৎস্না ঠিকই হলো, কিন্তু সে শখ আর পূরণ হলো কই? আচ্ছা? নীলয়কে বিয়ে করলে কি এই শখ পূরণ হতো?
পুতুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। চোখে জল প্রায় এসেই গেছে। আচমকা পিছনে খসরু সাহেবের গলা পাওয়া গেল।
–পুতুল, এখানে কি করছো?
পুতুল চমকে উঠলো। তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছে ফেলে পিছনে ফিরলো। আমতা আমতা করে বলল,
–তোমার ঘুমটা ভেঙে গেল?
খসরু সাহেব উত্তর দিলেন না। এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন,
–তুমি এত রাতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছ যে? কি হয়েছে?
পুতুল হাসার চেষ্টা করে বলল,
–তেমন কিছু না। আমার সামান্য মাথা ব্যথা হয়েছে। ভালো লাগছিল না বলে চাঁদ দেখতে এসেছি।
খসরু সাহেব অস্থিরতা নিয়ে বললেন,
–সে কি? মাথা ব্যথা করছে সেটা আমাকে তুমি বলবে তো! দাঁড়াও, আমার কাছে ওষুধ আছে।
পুতুল হেসে ফেলে বলল,
–আরেহ! ওষুধের দরকার নেই। এমনি ঠিক হয়ে যাবে।
খসরু সাহেব এগিয়ে গেলেন পুতুলের দিকে। কিছুটা সংকোচ নিয়ে পুতুলের হাত ধরলেন তিনি। কোমল গলায় বললেন,
–পুতুল, আমি একজন বুড়ো মানুষ। তরুণ প্রেমিকের মতো বলার আগেই প্রেমিকার প্রয়োজন বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা হয়তো আমার নেই। কিন্তু তুমি তোমার প্রয়োজনের কথা মুখ ফুটে আমায় বলবে। যখন যা দরকার হবে, সবটাই আমাকে নির্দ্বিধায় বলবে। আমি সবসময় তোমার খেয়াল রাখার চেষ্টা করবো।
পুতুলের কেমন যেন মায়া হলো! সে মুখে হাসি টেনে বলল,
–আপনি খুব ভালো!
খসরু সাহেব হাসলেন। বললেন,
–ঘুমাতে চলো।
পুতুলের হঠাৎ মনে হলো এই মুহূর্তে জ্যোৎস্না বিলাসের আবদারটা বোধহয় করেই ফেলা যায়। আবার প্রত্যাখ্যানের ভয়ও হলো। কে জানে? হয়তো ভারিক্কী গলায় উত্তর আসবে, “রাত জেগে চাঁদ দেখার কোনো মানে হয়? রাতটা ঘুমোবার জন্য।”
দ্বিধা কাটিয়ে পুতুল শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললো,
–আজ না ঘুমালে কেমন হয়?
খসরু সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। পুতুল আবদারের সুরে বলল,
–আসলে খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চলুন না, আজ আমরা দুজন মিলে চাঁদ দেখি। জ্যোৎস্নায় বসে গল্প করি!
খসরু সাহেব সানন্দে রাজি হলেন। মাথা নাড়িয়ে বললেন,
–হ্যাঁ, চলো। চাঁদ আমার ভীষণ ভালো লাগে। এতকাল চাঁদনী রাতে গল্প করার কেউ ছিল না বলে ঘুমিয়েই কাটাতাম। এখন তো তুমি আছ।
পুতুল দারুণ আনন্দিত হলো। একটু আগে হওয়া আফসোস হুট করেই মিলিয়ে গেল। তারা পাশাপাশি বসলো। খসরু সাহেব বললেন,
–রাত জাগলে তোমার মাথা ব্যথা বাড়বে না তো?
পুতুল তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,
–না না, আমার মাথা ব্যথা সেরে গেছে।
খসরু সাহেব হাসলেন। চাঁদের মৃদু আলোয় স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন। মনে হলো, পৃথিবীর সমস্ত রূপ নিয়ে মেয়েটা উনার পাশে বসে আছে। পুতুল হঠাৎ উনার কাঁধে মাথা রাখলো। হুট করে মেয়েটার চোখে জলও এলো। সেটা মুছে ফেলে সে গুণগুণ করে গান গাইতে শুরু করলো। তার মনে হলো, এইতো! জীবনটা বেশ সুন্দর! পাশের মানুষটার সাথে এই মুহুর্তটাও ভীষণ সুন্দর!
_______________________________
রাত অনেক হয়েছে। আবির সন্দেশকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। সন্দেশ গভীর ঘুমে মগ্ন। বাবার কোলে গভীর শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে সে। মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই আবিরের ভীষণ মায়া হচ্ছে। কঙ্কার বলা একটা কথা মনে পড়ছে বারবার। একদিন কঙ্কা বলেছিল, “তোমার মেয়েও ঠিক তোমার মতো একটা চরিত্রহীনের খপ্পরে পরবে।” দুশ্চিন্তায় আবিরের বুক কেঁপে উঠছে। সে বারংবার মেয়ের কপালে চুমু খাচ্ছে। অস্ফুটে প্রার্থনা করছে, “হে আল্লাহ! আমার কর্মের শাস্তি আমার মেয়েকে দিয়ো না। ওর যেন কখনো বিপদ না আসে।”
পানশি আবিরের পাশে এসে বসলো। আবির একবার তাকালো। পানশি আজ লাল বেনারসি পরেছে। কেমন যেন নিরানন্দে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। সারাদিন জাহানারা কেঁদেছেন। সন্ধ্যার পরে একবার এসে পানশির গলায় একটা হার পরিয়ে দিয়ে গেছেন। পানশির মনে হচ্ছে, সে একটা লড়াইতে নেমেছে। সকলের মনে জায়গা করে নেওয়ার লড়াই।
পানশি নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল,
–তুমি ঘুমাবে না?
আবির মৃদু গলায় বলল,
–ঘুম আসছে না। তুমি ঘুমিয়ে পরো।
পানশি ভেতরের দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল,
–সন্দেশকে দাও আমার কাছে। ওকে শুইয়ে দিই।
–আজ সন্দেশ আমার কাছেই না হয় থাক!
পানশি মেয়ের মুখের দিকে তাকালো। বাবার বুকে ভীষণ শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে দেখে অলক্ষ্যে সে হাসলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বিছানার দিকে পা বাড়ালো। আবির হঠাৎ বলে উঠলো,
–পানশি, বসো।
পানশি সাথে সাথে বসে পরলো। হঠাৎ তার চোখও ভিজে উঠলো। কিছুক্ষণ নীরবতার পরে আবির প্রশ্ন করলো,
–মেয়ের নাম সন্দেশ রেখেছ কি মনে করে?
পানশি মৃদু হেসে বলল,
–আমাদের সম্পর্কের সময় তুমিই বলেছিলে এই নামটা। তুমি বলেছিলে, আমাদের সন্তান হলে তার নাম রাখা হবে সন্দেশ। তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছ। কিন্তু আমার মনে আছে।
আবির কথা বলল না। পানশি আবার বলল,
–তুমি তো কথাগুলো মন থেকে বলতে না, এজন্যই তোমার মনে নেই।
আবির অপরাধীর মতো বলল,
–ক্ষমা করে দিয়ো আমাকে।
–ক্ষমা তো করেইছি। নইলে কি আর তোমাকে বিয়ে করতাম?
আবির একটু ইতস্তত করে বলল,
–একটা কথা বোধহয় তোমাকে বলা উচিত, পানশি।
পানশি ঘাড় কাত করে বলল,
–বলো।
আবির চুপ করে রইলো। বুকে জমানো শব্দগুলো ঠোঁট নাড়িয়ে উচ্চারণ করতে পারলো না। পানশি নিজে থেকেই বলল,
–কথাগুলো বোধহয় কঙ্কা আপাকে নিয়ে। সেজন্য তুমি ইতস্তত করছো। তুমি নির্দ্বিধায় বলো, আমি কিছু মনে করবো না।
আবির ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তোমাকে ভালো রাখার, ভালোবাসার। কিন্তু পানশি, আমি কখনোই কঙ্কাকে ভুলে যেতে পারবো না।
পানশি ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
–আমিও পারবো না।
আবির ভ্রু কুঁচকে তাকালো। পানশি বলল,
–যে মানুষটা আমার আর আমার সন্তানের জীবন গুছিয়ে দিয়ে গেল, তাকে ভুলি কি করে? সারাজীবনে কঙ্কা আপার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ হবে না।
আবির যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তার বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে গেল। পানশির সাথে টুকটাক কথা এগোতে লাগলো। ধীরে ধীরে নিজেদের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের গাঁথা রচনা করতে করতেই সময় কাটতে লাগলো তাদের।
.
রাত বাড়তে থাকলো। আকাশের চাঁদ ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এলো। কঙ্কার রাতটা কেটে গেল নীলয়ের পাশে বসেই, পুতুলের রাত কাটলো স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে, আর আবিরের কাটলো স্ত্রীর সাথে সন্তানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায়। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও বেজে উঠলো একটা রবীন্দ্র সংগীত,
“এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
শুধু সুখ চলে যায়, এমনই মায়ার ছলনা
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না।
এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়
ভুলে যায়……”
.
#চলবে……………
(প্রচন্ড এক রাইটিং ব্লকে পরেছিলাম। লিখতে চাইছি, অথচ কিছুই লিখতে পারছি না, এরচেয়ে কষ্টকর আমার জন্য আর কিছুই ছিল না। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here