#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:২৩
.
.
.
সকাল থেকে আবহাওয়া ভীষণ অদ্ভুত। রোদের মধ্যে টিপটিপ করে বৃষ্টি পরছে। সুরমা রান্নাঘরে চা বানাচ্ছিল। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বারবার বাইরে তাকাচ্ছে সে। ছোটবেলায় এমন বৃষ্টি হলে সে আর কঙ্কা হাত ধরে ছড়া কাটতো। “রোদের মাঝে বৃষ্টি হয়, শেয়াল পন্ডিতের বিয়ে হয়।”
কঙ্কার কথা মনে পরতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো সুরমা। ওদের পরিবারটা এই অবস্থায় এসে দাঁড়াবে, সে কথা কে ভাবতে পেরেছিল? ভীষণ উৎকন্ঠা নিয়ে রাতটুকু কেটেছে সুরমার। সারারাত দুচোখের পাতা এক হয় নি দুশ্চিন্তায়। খালার শরীরের অবস্থা ভালো নয়। আল্লাহ না করুন, যদি ভালোমন্দ কিছু হয়ে যায় তাহলে তার মাথার উপর থেকে স্নেহের ছায়াটাই চলে যাবে। আর খালুজানেরই বা কি হবে? উনি একা বাঁচবেন কি করে? কঙ্কাই বা আছে কোথায়? সুরমা আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার চা বানানো শেষ হয়েছে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছিলো সে। একটু পরেই সে বেরোবে। প্রথমে খালার বাসায় যাবে, তারপর খালুজানকে নিয়ে হাসপাতালে। শাদাবকে তৈরি হতে বলে এসেছে ও।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই সাবিনা বানুর সামনে পরলো সুরমা। উনি গম্ভীর মুখ করে বসে আছেন। সুরমাকে দেখেই বললেন,
–আমার সামনে এসে বসো, বৌমা।
সুরমা থতমত খেয়ে গেল। মায়ের এমন গম্ভীর গলা এই প্রথম সে শুনলো। ইতস্তত করে বলল,
–মা, আপনার ছেলেকে চা-টা দিয়ে আসি?
সাবিনা বানু আরও গম্ভীর হয়ে বললেন,
–চা দিতে হবে না। যা বলেছি তাই করো।
সুরমা সামনের চেয়ারে গিয়ে বসলো। সাবিনা বানুর এমন ভারিক্কি গলায় কথা বলার কারণ সুরমা বুঝতে পারছে না। উনি কি কোনো কারণে অসন্তুষ্ট? সুরমা জড়সড় হয়ে বসে রইলো।
সাবিনা বানু স্বাভাবিক গলায় বললেন,
–বৌমা, তুমি যে এভাবে রোজ রোজ তোমার খালার বাসায় ছোটাছুটি করো, সেটা কি ঠিক হচ্ছে?
সুরমা হকচকিয়ে গেল। এমন কথা সে আশা করে নি। সে চট করে কথা বলতে পারলো না। সাবিনা বানু আবার বললেন,
–তুমি মা হবে দুদিন পর। এই অবস্থায়ও কি এত ছোটাছুটি ঠিক? রোজ রোজ ওই বাসায় যাও, এটা তো ভালোও দেখায় না। তাছাড়া, নিজের সন্তানের কথা তো ভাবতে হয়। তোমার দায়িত্ব তো শুধু ওই বাড়ির প্রতি না। তাই না?
সুরমার চোখে পানি এসে গেল। এই বাড়ির প্রতি কোন দায়িত্বটা সে পালন করে নি? আর তার সন্তানের কথা সে কি ভাবে না? মা এমন কথা কেন বলল? সুরমা কোনোমতে কান্নাটাকে চাপা দিয়ে বলল,
–আসলে মা, আমার খালা তো ভীষণ অসুস্থ। খালুজান একা সামলে উঠতে পারবেন না। তাই আমাকে যেতে হচ্ছে। তবে আপনি যদি না চান তাহলে আমি আর….
সুরমা কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই সাবিনা বানু কঠিন গলায় বলে উঠলেন,
–খবরদার, বৌমা! এভাবে কথা বলবে না। আমি যদি না চাই মানে? কি বলতে চাইছ? আমি কি তোমাকে তোমার খালার কাছে যেতে মানা করছি? আমি যা বলছি তা তোমার ভালোর জন্য।
সুরমা আর কথা বলল না। মাথা নিচু করে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর সাবিনা বানু শীতল গলায় বললেন,
–বসে আছ কেন? যাও, শাদাবকে চা দাও।
সুরমা উঠে দাঁড়ালো। চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। শাদাব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে ঘড়ি পরছিলো। সুরমা চা টেবিলে রেখে বলল,
–তোমার চা।
বলেই বিছানায় বসে পরলো। এতক্ষণ নিজেকে সামলাতে পারলেও আর পারলো না। চোখ বেয়ে জল পরতে লাগলো তার। শাদাব সুরমার দিকে না তাকিয়েই বলল,
–তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হও, সুর। আমার কিন্তু হয়ে গেছে।
সুরমা কথা বলল না, নড়াচড়াও করলো না। শাদাব পিছনে ঘুরে স্ত্রীর দিকে তাকালো। ভালো করে লক্ষ্য করতেই তার ভেজা চোখ দৃষ্টিগোচর হলো শাদাবের। সে অবাক হয়ে বলল,
–সুর! কাঁদছো কেন?
সুরমা তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছে ফেলে বলল,
–কিছু না। খালা অসুস্থ বলে আমার মন খারাপ। তার উপর গতরাতে খালাকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
শাদাব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে সুরমার পাশে গিয়ে বসলো। স্ত্রীর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কোমল গলায় বলল,
–চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আমরা তো এখনই যাব। খালাকে দেখার পরে তোমার মন নিশ্চয়ই শান্ত হয়ে যাবে।
সুরমা নিচু গলায় বলল,
–আমি আজ যাচ্ছি না।
শাদাব হতভম্ব হয়ে গেল। বিস্ময় নিয়ে বলল,
–যাচ্ছো না! কি বলছো?
–হ্যাঁ, যাচ্ছি না। রোজ রোজ যাওয়ার কি আছে?
শাদাব ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কথাটা যেন সুরমার সাথে মিললো না। খালা ভীষণভাবে অসুস্থ, অথচ সুরমা বলছে রোজ যাওয়ার কি আছে! বড্ড বেমানান লাগছে। শাদাব সন্দিহান গলায় বলল,
–কেন যাবে না? সত্যি করে বলো তো।
সুরমা হাসার চেষ্টা করে বলল,
–আরেহ! তেমন কিছু নয়। আমার শরীর ভালো লাগছে না। এই কদিন অনেক ছুটেছি। একটু বিশ্রাম দরকার।
শাদাব অস্থির হয়ে বলল,
–শরীর খারাপ লাগছে? আগে বলবে তো। এই শরীর খারাপ নিয়ে তুমি চা বানাতে গিয়েছিলে কেন? আমি নিজেই বানিয়ে নিতাম।
সুরমা হেসে ফেলে বলল,
–এত অস্থির হতে হবে না। সামান্য শরীর খারাপ। তুমি চা খেয়ে নাও। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
কথা শেষ করে সুরমা বিছানায় শুয়ে পরলো। শাদাব চা হাতে নিয়ে চুমুক দিলো। তারপর বলল,
–তাহলে তুমি বিশ্রাম নাও। আমি গিয়ে ঘুরে আসি?
–হ্যাঁ, যাও।
শাদাব স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই দরজায় সাবিনা বানু এসে দাঁড়ালেন। শাদাব হাসিমুখে বলল,
–মা, ভেতরে এসো। কিছু বলবে?
সাবিনা বানু ভেতরে ঢুকলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
–সুরমা, তুমি যাচ্ছ না?
সুরমা ইতোমধ্যেই উঠে বসেছে। সে উত্তর দিলো না। শাদাব বলল,
–না, মা। ও বলল শরীরটা নাকি খারাপ লাগছে। বিশ্রাম নিতে চায়।
সাবিনা বানু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–মিথ্যা কথা বলেছে। ও যাচ্ছে না কারণ আমি ওকে বকেছি।
শাদাব হকচকিয়ে গেল। সুরমা ইতস্তত করে বলল,
–না না, মা। কিসব বলছেন? আমার সত্যিই একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার।
সাবিনা বানু বিছানায় বসলেন। বললেন,
–আসলে আমার ভয় হয়, মা। শাদাবের জন্মের বছর দুয়েক বাদে আমি আবার সন্তানসম্ভবা হয়েছিলাম। কিন্তু তাকে সুস্থভাবে এই পৃথিবীতে আমি আনতে পারি নি। শাদাবকে নিয়ে ওর নানাবাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলাম। রাস্তার কাদায় পা পিছলে পরে গিয়ে….
উনি কথা শেষ করলেন না। সুরমা অবাক হয়ে দেখলো উনার চোখে পানি। সন্তান হারানোর ব্যথা মা কখনো ভুলতে পারেন না। এক সন্তানের জায়গা অন্য সন্তান দিয়ে পূরণও হয় না। প্রত্যেকের জায়গাই মায়ের কাছে স্বতন্ত্র।
শাদাব মায়ের পাশে বসে আলতো করে মায়ের হাত ধরলো। সাবিনা বললেন,
–আমি চাই না তোদের সাথে তেমন কিছু হোক, চাই না তোদের সুখের সংসারে কষ্ট আসুক। সেজন্যই এত ছোটাছুটি করতে মানা করেছিলাম। হয়তো একটু কর্কশভাবে বলেছি। কিন্তু চিন্তা থেকেই বলেছি। আমার উপরে কোনো রাগ অভিমান রাইখো না, মা।
সুরমার মন মায়ের প্রতি মমতায় ভরে গেল। সে কোমল গলায় বলল,
–আমি কিছু মনে করি নি, মা। আপনি তো ঠিকই বলেছেন।
শাদাব একহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
–মা, তুমি তোমার জায়গায় ঠিক। কিন্তু একটু ভেবে দেখো, যদি সুর আজকে না যায় তাহলে ওর মনটা অস্থির হয়ে থাকবে। সারাদিন ও খালার জন্য চিন্তা করবে। এটাও তো ওর শরীরের জন্য ভালো হবে না, মা।
সাবিনা মাথা নাড়িয়ে বললেন,
–হ্যাঁ, ওকে নিয়েই যা। তুই খেয়াল রাখিস। সাবধানে যাস। যাও, মা। তুমিও রেডি হও।
সুরমা হুট করে বলে উঠলো,
–মা, আপনিও চলুন না আমাদের সাথে। আপনি থাকলে আমি আরও ভরসা পাবো।
সাবিনা বানু হেসে বললেন,
–আচ্ছা, চলো।
______________________________
কলিমউদ্দিন সাহেব মুখ অন্ধকার করে বসে আছেন। পাশে বসে আছে নীলয়। কলিমউদ্দিন সাহেব বিষন্ন এবং চিন্তিত। একে তো স্ত্রী অসুস্থ। তার উপর উনার মেয়েকে নিয়ে নানান অপ্রীতিকর কথা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। কঙ্কা ফিরে আসায় কলিমউদ্দিন সাহেব শান্তি পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, হয়তো বাড়িতে সুদিন ফিরলো। মেয়েটা একটা ভুল করেছিল? তাতে কি? আবার নাহয় নতুন করে শুরু হবে। কিন্তু আজ সকালে পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলা এসে অনেক আজেবাজে কথা শুনিয়ে গেলেন।
সকালে কঙ্কা বাইরের বারান্দায় বসেছিল। নিজের বাসার ছাদ থেকে আচমকা কঙ্কাকে দেখে প্রতিবেশি ভদ্রমহিলা হকচকিয়ে যান। তারপরেই ছুটে আসেন কথা বলতে। ভেতরে ঢুকেই মিষ্টি মুখে বলেন,
–ওমা! কঙ্কা! তুমি এসেছ? কবে এলে?
কঙ্কা স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়,
–এইতো, সবে একদিন হলো।
–কোথায় চলে গিয়েছিলে? শুনেছি তোমার প্রেমিকের সাথে নাকি পালিয়েছিলে। সত্যি?
উনার কথাটায় বিদ্রূপ জড়িয়ে থাকলেও কঙ্কা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অকপটে জবাব দিয়েছে,
–হ্যাঁ, সত্যি। তাকে বিয়েও করেছিলাম।
–তাই নাকি? তা জামাই কোথায়? ডাকো, দেখি।
–নেই। ওকে ছেড়ে চলে এসেছি।
ভদ্রমহিলা এই উত্তরে হতভম্ব হয়ে যান। ভ্রু কুঁচকে বলেন,
–বলো কি? একটা বছরও সংসার করতে পারলে না! পালিয়ে কি লাভ হলো তাহলে? শুধু শুধু বাবা মাকে কষ্ট দিলে আর নিজের জীবনটাও নষ্ট করলে। নাকি বিয়েই হয় নি তোমাদের? এমনি এমনিই এ কয়েকমাস একসাথে থেকেছ, তারপর ছেলে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে। এমন কিছু নয় তো আবার? এ কি ভুল করলে বলো তো! আর কি কখনো তোমার বিয়ে হবে? কে বিয়ে করবে তোমাকে? সারাজীবন মা বাবার ঘরে………
কথাবার্তা এ পর্যায়ে আসতেই কঙ্কা সেখান থেকে উঠে ঘরে চলে গেছে। ভদ্রমহিলা দাঁত চিবাতে চিবাতে বলেছেন, “এখনো দেমাগ কমে নি! কোন ঘাটে গিয়ে তোমার জায়গা হয় আমিও দেখবো।”
বসার ঘর থেকে এই সমস্ত কথাই শুনেছেন কলিমউদ্দিন সাহেব। তারপর থেকেই উনার ভীষণ মন খারাপ। আজ একজন উনার কন্যাকে এসব বলেছে। কাল হয়তো আরও দশজন বলবে। কি করে মেয়েটাকে রক্ষা করবেন উনি? সমাজে কি মেয়েটা আর টিকতে পারবে না?
.
কঙ্কা রান্নাঘর থেকে নাস্তা নিয়ে বেরিয়ে এলো। টেবিলে রেখে বলল,
–বাবা, নাও। নীলয় ভাই, আপনিও খেয়ে নিন। তোমাদের খাওয়া হয়ে গেলে আমরা মায়ের কাছে যাব। কতদিন মাকে দেখি না!
কলিমউদ্দিন সাহেব কথা বললেন না। নীলয় মমতার চোখে কঙ্কার হাসিমুখের দিকে তাকালো। একটা মেয়ে কি করে এত অসাধারণ হতে পারে? ভেতরে এত যন্ত্রণা চেপে রেখেও বাইরের প্রতিকূলতার সাথে হাসিমুখে লড়াই করে চলেছে কি করে? প্রতি মুহূর্তে অবাক হয় নীলয়। এ জীবনে এই বিস্ময় মানবীকে স্বচক্ষে দেখা হয়েছিল, সেও যে এক পরম বিশুদ্ধ অনুভূতি! শুধু কঙ্কা নয়, পুতুল নামের আরও এক বিস্ময়াচারিণীকে দেখেছে সে তার ছোট্ট জীবনে। এক জীবনে দুজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ববান নারীর সংস্পর্শে সে এসেছিল, এইতো অনেক। তাদের কাউকেই না হয় নিজের করে রাখা হয় নি। তাতে কি? হৃদয়ের কোথাও না কোথাও এক চিলতে আশ্রয় তো সে পেয়েছিল! ওহে প্রেম! ওটুকু আশ্রয়েই তো তুমি সার্থক! কে কবে পূর্ণ করে পেয়েছিল তোমাকে?
কঙ্কা মৃদু হেসে বলল,
–কি হলো, নীলয় ভাই? কি দেখছেন?
নীলয় তড়িঘড়ি করে চোখ সরিয়ে নিলো কঙ্কার দিক থেকে। ইতস্তত করে বলল,
–তুই খাবি না?
–হ্যাঁ, খাব তো।
কলিমউদ্দিন সাহেব কঙ্কাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। কঙ্কা পাশে বসলো। কলিমউদ্দিন সাহেব কন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
–মা রে, তুই একটা ভুল করেছিলি। তার মানে এই নয় যে তোর পরিবার তোর পাশে আর থাকবে না। তোর সব ভুল শুধরে নিতে আমি তোকে সাহায্য করবো। মনে রাখবি, তোর বাবা কখনো তোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না।
কঙ্কার চোখে জল এসে গেল। সে মাথা নিচু করে বলল,
–আমি জানি, বাবা। সেজন্যই তো আমি তোমার কাছে ফিরে এসেছি।
আচমকা দরজার কাছ থেকে সুরমার গলা পাওয়া গেল। সে প্রায় চিৎকার করে বলেছে,
–কঙ্কা! তুই?
কঙ্কা উঠে দাঁড়ালো। অস্ফুটে বলল,
–আপা!
এক মুহূর্ত নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো তারা দুজনেই। তারপর ছুটে গিয়ে সুরমাকে জড়িয়ে ধরলো কঙ্কা।
____________________________
আজ সকালের নাস্তাটা বানিয়েছে পানশি। অযাচিনী বারবার নিষেধ করেও পানশিকে বিরত করতে পারে নি। জাহানারা মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন। পানশির সাথে এখনো সহজভাবে কোনো কথা তিনি বলেন নি। আবির সন্দেশকে কোলে নিয়ে টেবিলে বসেছে। পানশি সবাইকে চা দিলো। জাহানারা চায়ে চুমুক দিলেন। চায়ে চিনি হয় নি। উনি বিরস মুখে বললেন,
–কি বানিয়েছ এটা? চিনি দাও নি কেন?
পানশি ভয়ে ভয়ে বলল,
–সরি, মা। বোধহয় কম হয়ে গেছে চিনি। আমাকে দিন। আমি চিনি মিশিয়ে দিচ্ছি।
–থাক, দরকার নেই।
আবির বলল,
–ও চেষ্টা করেছিল, মা।
জাহানারা কথা বললেন না। আশরাফউদ্দিন সাহেব হাসিমুখে বললেন,
–খুব ভালো চা বানিয়েছ, মা।
পানশির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। জাহানারা কঠিন গলায় বললেন,
–খুব ভালো হয়েছে? আমি কি তাহলে মিথ্যা কথা বলছি?
আশরাফউদ্দিন হেসে উঠে বললেন,
–না, জাহানারা। চিনি কম হয়েছে ঠিকই। কিন্তু মেয়েটা খুব ভালোবেসে আমাদের জন্য চা বানিয়েছে। ওটাই তো সব।
পানশির চোখেমুখে আনন্দ ফুটে উঠলো। আবির খুশি হলো। বাবা যে সবটা স্বাভাবিক করতে চাইছে, সেটা দেখে আবিরের ভালো লাগলো। সন্দেশ হঠাৎ আবিরের কোল থেকে নেমে জাহানারার কাছে ছুটে গেল। মিষ্টি করে হেসে বলল,
–মা বলেতে, তুমি আমাল দাদীজান।
দাদীজান শব্দটা সন্দেশ বেশ স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেছে। জাহানারার মন শীতলতায় ভরে গেল। আবির আর পানশি, দুজনেই থতমত খেয়ে গেল। পাছে মা রেগে যায়, সেই ভয়ে আবির তাড়াহুড়ো করে বলল,
–মামনি, বাবার কাছে এসো।
সন্দেশ বাবার কথায় কর্ণপাত করলো না। ছোট্ট হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–কোলে নাও।
পানশি এবার রীতিমতো ভয় পেলো। মেয়েটা একেবারে বাপের মতো গায়ে পরা হয়েছে। পানশি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। মৃদু গলায় বলল,
–মা, এভাবে দাদীজানকে বিরক্ত করতে নেই। চলো, তোমাকে খাইয়ে দেই।
জাহানারা শক্ত গলায় বললেন,
–দাঁড়াও।
পানশি দাঁড়িয়ে গেল। আবির পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো,
–মা, আসলে…
আবিরের কথা শেষ হলো না। জাহানারা একই ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,
–তোমার সাহস তো কম নয়, পানশি। আমার নাতনিকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাচ্ছ! ওকে কোল থেকে নামাও।
পানশি প্রথমটায় বুঝতে পারলো না। একবার আবিরের দিকে তাকালো। তারপর শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
–জ্বি, মা?
জাহানারা ধমকের সুরে বললেন,
–আমার নাতনিকে কোল থেকে নামাও।
পানশি ধীরে ধীরে সন্দেশকে নামিয়ে দিলো। জাহানারা এবার নাতনির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
–এসো তো, দাদুমনি। আমার কোলে এসো। আমি তোমাকে খাইয়ে দেই।
সন্দেশ দৌড়ে গেল। জাহানারা নাতনিকে কোলে নিয়ে চোখেমুখে চুমু খেলেন। পরম মমতায় নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–একদম আমার আবিরের মতো দেখতে হয়েছে। যেন আমার ছোট্ট আবির!
সন্দেশ কি বুঝলো কে জানে? ও খিলখিল করে হাসলো। জাহানারা যত্ন করে নাতনিকে খাইয়ে দিতে শুরু করলেন। পানশির চোখ ছলছল করে উঠলো।কঙ্কা নামক মানুষটার প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধায় মন অবনত হলো আরও একবার।
আবিরের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। নিজের সন্তানকে নিজের মা ভালোবাসছে, এই দৃশ্য দেখতে এত ভীষণ সুন্দর কেন?
______________________________
বেলা ঠিক দুপুর। সূর্য মাথার উপরে। খাড়া রোদে শহর জুড়ে হাহাকার। ঠিক এই সময়েই আয়েশার লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরলো সকলে।
আয়েশা মারা গেছেন। আজ সকালে হাসপাতালে গিয়ে আয়েশাকে আর জীবিত পাওয়া যায় নি। সুরমা কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে পরেছে। তার খালা মারা গেছে, এ কথা ভেবে সে যত না কষ্ট পাচ্ছে, তারচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে এটা ভেবে যে সম্পূর্ণ একা একাই উনি মৃত্যুর সময়টা পার করেছেন। সেই মুহূর্তে কেউ ছিল না উনার পাশে, কেউ মাথার পাশে বসে দুটো কথা বলে নি, কেউ শিয়রে দাঁড়িয়ে সূরা ইয়াসিন পাঠ করে নি, কেউ মুখে একটু পানি দেয় নি। কে জানে? হয়তো কিছু শেষ কথা বলার ছিল। তাও কাউকে বলে যেতে পারলেন না! আহারে! এত কষ্ট! এত কষ্ট!
সুরমা হাউমাউ করে কাঁদছে। শাদাব তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। সে হাহাকার করে বলছে,
–আমার আর কেউ রইলো না। আমাকে দেখার আর কেউ রইলো না।
সাবিনা বানু ছেলের বৌকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। আয়েশার লাশ রাখা হয়েছে বাইরের ঘরে। সুরমা শাদাবের বুকে মাথা রেখে সাদা কাপড়ে মোড়ানো খালার দিকে তাকিয়ে আছে। তার বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সেই ছোটবেলায় ঠিক একইভাবে নিজের মাকে দেখেছিল সে। এই একই দৃশ্য আর কখনো সে দেখতে চায় নি। পরপর দু’বার মা হারাতে কেই বা চায়?
কঙ্কা মায়ের লাশের পাশে থম মেরে বসে আছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। সে সত্যিই বড় দূর্ভাগা! এতদিন পর এসে মায়ের সাথে একটাবার কথা হলো না তার। মা জানলো না যে তার মেয়ে ফিরে এসেছিল! এমন অশুভ কপাল নিয়ে কেউ জন্মায়?
কলিমউদ্দিন সাহেব অসুস্থ হয়ে পরেছেন। উনাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। নীলয় উনাকে ঘরে শুইয়ে রেখে বাইরে এলো। নিজের মায়ের মুখ তার মনে নেই। মা বলতে চাচীর মুখই ভাসে তার চোখে। সেই মাতৃছায়ার প্রয়াণ বারবার ভিজিয়ে দিচ্ছে তার চোখ। তবে নিজের থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে কঙ্কার জন্য। কঙ্কা যেন জমে পাথর হয়ে গিয়েছে। বাসায় আসা আত্মীয় স্বজনরা সবাই কঙ্কার দিকে আঙুল তুলছে। সবাই বলাবলি করছে, মেয়ের দেওয়া আঘাত সইতে না পেরেই এমনভাবে মারা গেল আয়েশা। এসমস্ত কথা নীলয়ের সহ্য হচ্ছে না। মা তো গেছে কঙ্কার, অন্য কারোর তো নয়। যারা এত কথা বলছে, কঙ্কার চেয়ে কি তাদের কষ্ট বেশি? কখনো নয়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, কঙ্কা একটুও কাঁদছে না। এ নিয়েও লোকের কথার শেষ নেই। একজন তো কঙ্কার মুখের উপরেই বলে দিলেন, “ডাইনি মেয়ে! মাকে মেরে ফেলে কেমন শুকনো খটখটে চোখে বসে আছে দেখো!”
তবে নীলয় ঠিকই বুঝতে পারছে ভেতরে ভেতরে কঙ্কা ভীষণ গভীরভাবে ক্ষত বিক্ষত! এমনিতেই মেয়েটার জীবনে কম কষ্ট নেই। এক বিশাল কষ্ট সামলে না উঠতেই আবার এত বড় একটা ধাক্কা। মেয়েটা এত কি করে সইবে? আল্লাহ এই মেয়েটাকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছে? নীলয় বুঝে উঠতে পারে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কঙ্কার কাছে এগিয়ে গেল সে। পাশে বসে কোমল গলায় বলল,
–কঙ্কা, তুই এমন থম মেরে বসে আছিস কেন?
কঙ্কা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–একদিক থেকে ভালোই হলো, নীলয় ভাই। আমাকে নিয়ে সবাই কত আজেবাজে কথা বলছে! এসব মাকে শুনতে হলো না। মা শুনলে সহ্য করতে পারতো না।
নীলয় কাতর গলায় বলল,
–কঙ্কা, তুই কাঁদছিস না কেন? তুই এভাবে থাকিস না। আমার ভয় লাগছে। কান্নাকাটি কর, কঙ্কা। কান্নাকাটি কর। তোর মা মরে গেছে, কঙ্কা। বুঝতে পারছিস? ভেতরের যন্ত্রণাগুলো চেপে রাখিস না এভাবে।
কঙ্কা শীতল গলায় বলল,
–বিশ্বাস করুন, নীলয় ভাই। আমি অনেকক্ষণ ধরেই কাঁদতে চাইছি। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু….কিন্তু আমি কাঁদতে পারছি না। আমার চোখে পানি আসছে না।
নীলয়ের ভীষণ মায়া হলো। সে কথা বলতে পারলো না। কঙ্কা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আশ্চর্য! চোখে পানি আসছে না কেন?
.
#চলবে………