নিরব রদনে পর্ব-২৪ শেষ পর্ব

0
1666

#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#শেষ_পর্ব
.
.
.
কঙ্কা শেষমেশ যেদিন অশ্রুসিক্ত হলো সেদিন হেমন্তকাল। বাতাসে শীতের গন্ধ। প্রকৃতিতে তখন কুয়াশার চাদর জড়ানোর কাটছাট। ভোরের আকাশ তখন ঝাপসা। বাতাসে তখন ভেসে বেড়ায় বুড়ো শিউলির গন্ধ। বারান্দায় দাঁড়ালে ভোরের শিউলির সুবাস ভরা শীতল বাতাসের ঝাপটা লাগে গায়ে। কঙ্কা রোজ এই সময়টায় কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাতাসের শীতল স্পর্শ গায়ে লাগলে মনে হয় যেন মা ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে!
আজ কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। কঙ্কা আজ বারান্দায় দাঁড়ায় নি। মাঝ রাতে একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙেছে। তারপর আর চোখের পাতা এক হয় নি। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতেই ভোরের আলো ফুটেছে। তখনই কঙ্কা উঠে এসেছে ছাদে। আকাশ আজ খানিকটা মেঘলা। কুয়াশা আর মেঘ একসাথে জড়াজড়ি করে মাটি আর আকাশের মাঝে কেমন যেন একটা দেয়ালের মতো তৈরি করেছে। কঙ্কা ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালো। কলিমউদ্দিন সাহেব অস্থির ভঙ্গিতে বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করছেন। কঙ্কা জানে, কিছুক্ষণ পরেই উনি আনমনা হয়ে বসে পড়বেন। এ কাজগুলো উনি রোজই করেন। আয়েশার কবরটা গ্রামের বাড়িতে দেওয়া হয়েছে। তারপর থেকেই এখানে আর কলিমউদ্দিন সাহেবের মন টিকছে না। কঙ্কা একবার ভেবেছিল বাবাকে নিয়ে গ্রামে চলে যাবে। কিন্তু কোর্টে তখন তার আর আবিরের ডিভোর্স কেস চলছিল। এখন অবশ্য তা শেষ। সপ্তাহখানেক হলো ডিভোর্স সার্টিফিকেটও চলে এসেছে। এবার বোধহয় সত্যিই এই শহর ছাড়ার সময় এসেছে।
কঙ্কা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হুট করেই তার চোখে জল এলো। সে আজ স্বপ্নে দেখেছে তার বাবা মারা গেছেন। তারপর থেকেই মনটা অশান্ত হয়ে আছে। বাবা ছাড়া এখন আর কে আছে তার এই দুনিয়ায়? চিলেকোঠার ঘরের দরজা খোলার শব্দে কঙ্কার হুঁশ ফিরলো। সে তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছে পিছনে ফিরলো। নীলয় বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। কঙ্কার পাশে এসে দাঁড়ালো সে। কোমল গলায় প্রশ্ন করলো,
–কাঁদছিলি?
কঙ্কা মৃদু হেসে উত্তর দিলো,
–কাঁদলে ক্ষতি কি? এমনিতেও তো আমার চোখে সময়মতো পানি আসে না। অসময়ে আসছে, আসুক না!
নীলয় হাসলো।
–তা বটে!
কঙ্কা উদাস গলায় বলল,
–সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাবাকে নিয়ে গ্রামে চলে যাব।
আচমকা এমন কথায় নীলয় হকচকিয়ে গেল। কঙ্কা এসব কি বলছে? ওরা চলে গেলে নীলয়ের কি হবে? সেই ছোটবেলায় একা একা রাস্তায় পরেছিল সে। সেখান থেকে তুলে এনে এই পরিবারে কলিমউদ্দিন সাহেব স্থান দিয়েছিলেন তাকে। এই বাড়িতে এতগুলো বছর কি আবারও একা হয়ে যাওয়ার জন্য কাটিয়েছে সে? নীলয় হাসার চেষ্টা করে বলল,
–কিসব উল্টোপাল্টা বলছিস!
কঙ্কা দৃঢ় গলায় বলল,
–ঠিকই বলছি। আমি অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মা মারা যাবার পর থেকে বাবা কেমন যেন হয়ে গেছে। মায়ের কবরটা চোখের সামনে দেখতে পেলেও হয়তো বাবা ভালো থাকবে। আর আমিও যে এখানে খুব ভালো আছি তাও তো নয়। দিনরাত পাড়া প্রতিবেশীর এত কথা শুনতে আমারও ভালো লাগে না, নীলয় ভাই। আর বাবার ব্যবসার দেখাশোনা তো এখন আপনিই করছেন।
নীলয়ের বলতে ইচ্ছা করলো, “আমাকে একলা ফেলে রেখে তুই চাচাকে নিয়ে চলে যাবি, এ তোর কেমন বিবেচনা?” কিন্তু কথাটা সে মুখ ফুটে বলতে পারলো না। অস্ফুটে বলল,
–বেশ! চলেই যা। আমার কি?
কঙ্কা হেসে ফেললো। নীলয়ের মুখের দিকে তাকাতেই তার মনের ভেতরের মেঘ টের পাওয়া গেল। কঙ্কা কোমল গলায় বলল,
–আমি যে অত অবিবেচক নই, সেটা তো আপনি জানেন। আপনাকে একেবারে একা করে দিয়ে যাচ্ছি না। আমি ভেবেছি, আপনার বিয়ে দেবো।
নীলয় চমকে উঠে বলল,
–বিয়ে!
–হ্যাঁ, বিয়ে। আমি একটা মেয়েকে চিনি, নীলয় ভাই। মেয়েটার নাম অযাচিনী। আপনার যেমন কেউ নেই, ওরও কেউ নেই। দুজন দুজনার হয়ে যাবেন। খারাপ হবে না। আপনি বললে অযাচিনীর সাথে কথা বলবো।
নীলয় চাপা গলায় বলল,
–হ্যাঁ, আমি চিরকাল তোর আশ্রয়ে থেকেছি। এখন নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিই কি করে? তুই যা বলবি, তাই তো করতে হবে। আমার আর কি উপায় আছে?
–আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন, নীলয় ভাই? আমার কথায় কি রাগ করেছেন?
–না। আমার মতো চালচুলোহীন ছেলেকে রাগ মানায় না।
কঙ্কা নিজেকে ব্যাখ্যা করার জন্য কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু বলতে পারলো না। তার আগেই নীলয় বলে উঠলো,
–আর কথা বাড়াস না। নিচে যা। চাচার কিছু লাগবে কিনা দেখ।
কঙ্কা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–আজ বাড়িতে আপা আর দুলাভাই আসবেন। আপনাকে একটু বাজারে যেতে হবে।
–যাব। কি কি আনতে হবে বলে দিস।
কঙ্কা মাথা নাড়িয়ে সিড়ির দিকে পা বাড়ালো। নীলয় কঙ্কার দিকে তাকালো। ধীরে ধীরে তার আর কঙ্কার দূরত্ব বাড়ছে। কঙ্কা প্রত্যেক পদক্ষেপে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। সে যত দূরে যাচ্ছে, ততই নীলয়ের মনে হচ্ছে কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা বলা হয় নি। সেই সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে। তার বুকের ভেতর কাঁপন ধরছে। কেউ ভেতর থেকে চিৎকার করে বলছে, “এই সুযোগ, নীলয়। এটাই সময়। এই শেষ সময়টা বৃথা যেতে দিস না। কঙ্কাকে আটকা!”
নীলয়ের কি হলো সে বুঝতে পারলো না। সে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো,
–কঙ্কা, শুনে যা!
কঙ্কা থমকে দাঁড়ালো। পিছনে ফিরে বলল,
–কিছু বলবেন?
নীলয় প্রায় ছুটে কঙ্কার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কঙ্কার চোখের দিকে তাকিয়ে নিঃসঙ্কোচে বলে ফেললো,
–আমায় বিয়ে করবি, কঙ্কা?
কঙ্কা হতভম্ব হয়ে গেল। তার সারা শরীর শিহরিত হয়ে কেঁপে উঠলো। এক মুহূর্ত নিস্তব্ধ কাটলো দুজনের। একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো কঙ্কা। হিসহিসিয়ে বলল,
–করুণা? নাকি ঋণ শোধ?
নীলয় দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,
–না, কঙ্কা। আজ অন্তত আমাকে ভুল বুঝিস না। তোকে করুণা করবো! আমি?
কঙ্কা বিদ্রূপ করে বলল,
–করবেন বৈ কি! আমি তো এখন সবার করুণার পাত্রীই। প্রথমে বাড়ি থেকে দুশ্চরিত্র প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছি, মাত্র কয়েকটা মাস সংসার করেছি। এখন তো সেই সংসারও ভেঙে দিয়েছি। সেই বসন্ত পেরিয়ে হেমন্ত এসেছে। এখন এই সমাজে ডিভোর্সি তকমা নিয়ে নির্লজ্জের মতো বেঁচে আছি আমি। নইলে আমার মতো মেয়ে মানুষের তো গলায় দড়ি দেওয়া উচিত। আমার মতো মেয়ের আর কি ভবিষ্যৎ আছে? নাকি জীবন আছে? এখন যদি কেউ আমাকে দয়া করে বিয়ে করে নেয়, তাহলেই তো আমি বেঁচে যাই। আমার বাবার সম্মানও বেঁচে যায়।
–কঙ্কা!
নীলয় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। কঙ্কার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পরছে। গাল বেয়ে নোনা পানিতে তার চিবুক ভিজে যাচ্ছে, নাকের ডগা লাল হয়ে উঠছে। মেয়েটাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। নীলয় হুট করে কঙ্কার বাহু চেপে ধরলো। গাঢ় গলায় বলল,
–লোকে কি ভাবছে, তাতে আমার যায় আসে না। কারণ লোকে তোকে চেনে না। আমি চিনি। আমি জানি কত বড় মহান আত্মা নিয়ে তোর জন্ম হয়েছে! নিজের জীবন ভেঙে অন্য একটা মেয়ের জীবন গুছিয়ে দেওয়া, অন্য একটা পরিবারকে গড়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা নিয়ে খুব কম মানুষই জন্মায়। তোর মতো সত্ত্বাকে করুণা করবো আমি? এত বড় যোগ্যতা আমার কি কোনোদিন হবে, কঙ্কা? আর ঋণ শোধের কথা বলছিলি না? চাচার মতো মানুষের ঋণ শোধ করার যোগ্যতাও আমার কখনো হবে না। আমি ভীষণ ক্ষুদ্র একজন মানুষ। আমি তোকে বিয়ে করতে চাই, কারণ আমি তোকে ভালোবাসি।
কঙ্কা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছলো। রুক্ষ গলায় বলল,
–ভালোবাসার সময় আর নেই। এখন সবকিছুই বদলে গেছে। আর ভালোই যদি বাসেন তাহলে প্রথমে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন কেন?
নীলয় অসহায় গলায় উত্তর দিলো,
–সাহস করে উঠতে পারি নি, কঙ্কা। ভেবেছিলাম, পরিচয়হীন, সহায় সম্বলহীন ছেলে কি করে বাবার আদরের কন্যাকে আপনার করে নিতে পারবে? কিন্তু…কিন্তু এখন বুঝেছি। ভালোবাসা এত মাপজোখ করে হয় না।
কঙ্কা নীলয়ের থেকে নিজের বাহু ছাড়িয়ে নিলো। শীতল গলায় বলল,
–সময় পেরিয়ে গেছে, নীলয় ভাই। লালন শাহ্ এর কথাটা জানেন তো? সময় গেলে সাধন হয় না..!
কথা শেষ করে কঙ্কা দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেল। নীলয় বিরবির করে বলল,
–সময় পেরোয় নি। এখনো সময় আছে, কঙ্কা। এখনো সময় আছে।

কঙ্কা নিচে নেমে দ্রুতই নিজেকে সামলে নিলো। তার ইচ্ছা করছিল চিৎকার করে কাঁদতে, অশ্রুজলে গোটা জগৎ সংসারকে ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু তার ফুরসত মিললো না। বাবার ঘরে তার ডাক পরলো। সমস্ত কান্নাটাকে বুকের ভেতর চাপা দিয়ে সে এগিয়ে গেল। আজ তার কাঁদার অবসর নেই। তার কাঁধে অনেক দায়িত্ব।
কলিমউদ্দিন সাহেব বিছানায় বসে আছেন। কঙ্কা হাতে খাবারের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। খাবার সামনে রেখে হাসিমুখে বলল,
–বাবা, নাস্তা খাও। তারপর তোমাকে ওষুধ দেবো।
কলিমউদ্দিন সাহেব ইশারায় কন্যাকে বসতে বললেন। কঙ্কা বাবার পায়ের কাছে মেঝেতে বসলো। কলিমউদ্দিন সাহেব ভারী গলায় বললেন,
–একটা কথা ভাবছিলাম, আম্মাজান।
–বলো, বাবা।
–আম্মা, আমার বয়স হচ্ছে। আর খুব বেশিদিন বাঁচবো বলে মনে হয় না। আর শরীরটাও খুব একটা সাথ দিতে চায় না।
কঙ্কার মাঝরাতের সেই স্বপ্নের কথা মনে পড়লো। সাথে সাথে তার বুকটা ধুক করে উঠলো। কম্পিত গলায় সে বলল,
–এভাবে বলো না, বাবা। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? তোমার শরীর ঠিক হয়ে যাবে। এখানকার আবহাওয়া বিষের মতো হয়ে গেছে। আমরা আর এখানে থাকবো না। তোমাকে নিয়ে আমি গ্রামে চলে যাব, বাবা।
–গ্রামে!
–হ্যাঁ, বাবা। মায়ের কবরটা তোমার চোখের সামনে নেই বলে তোমার অস্থির লাগে। আমি বুঝতে পারি।
কলিমউদ্দিন সাহেব মৃদু হেসে বললেন,
–না রে, মা। তেমন কিছু নয়। আয়েশার কবর যেখানেই হোক, ও তো আছে আমার মনের কাছেই। তাছাড়া ওর সব স্মৃতিও তো এই বাড়ি জুড়েই। আমার অস্থিরতা অন্য বিষয় নিয়ে।
কঙ্কা ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কি নিয়ে?
কলিমউদ্দিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–তোমাকে নিয়ে, আম্মা। বয়স হচ্ছে আমার। শেষ সময়ে এসে নিজের মেয়ের জীবনটা গোছানো দেখে যেতে কে না চায়?
কঙ্কা এবার উঠে দাঁড়ালো। শীতল গলায় বলল,
–কি বলতে চাও, বাবা?
কলিমউদ্দিন সাহেব ইতস্তত করে বললেন,
–মা, আরেকটা ভালো ছেলে দেখে…..
–আমাকে বিয়ে করতে কোন ভালো ছেলের দায় পরেছে, বাবা?
–যে তোকে সত্যিই চেনে, তোকে বোঝে।
কঙ্কা কিঞ্চিৎ চমকালো। কথাবার্তা আরও এগিয়ে গিয়ে পাছে নীলয়ের নামটা এসে পরে, সেই ভয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল,
–আমি যাই, বাবা। তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। আপা আসবে আজ। আমাকে ওদের জন্য রান্না করতে হবে।
_______________________
পুতুল দুপুরের খাবার সাজাচ্ছিল। খসরু সাহেব এসে টেবিলে বসলেন। দুদিন ধরে পুতুলকে একটা কথা বলবেন বলে ভাবছেন। কিন্তু বলতে পারছেন না। একবার মনে হচ্ছে, এ কথাটা না বললেও তো চলে। পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, বলা দরকার। কথাটা নিলয়কে নিয়ে। পুতুলের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য হলেও কথাটা বলবেন বলে ঠিক করেছেন তিনি।
পুতুল খাবার এগিয়ে দিলো। মৃদু হেসে প্রশ্ন করলো,
–আজও কি কোথাও যাওয়ার আছে? নাকি আমার উপর দয়া করে বাসায় থাকা যাবে?
খসরু সাহেব হেসে ফেললেন। পানির গ্লাস হাতে নিতে নিতে বললেন,
–আমি বাসায় থাকলে কি তোমার ভালো লাগে?
পুতুল অভিমানী গলায় বলল,
–তোমার কি ধারণা আমার একা একা থাকতেই ভালো লাগে?
খসরু সাহেব এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। খেতে খেতে প্রশ্ন করলেন,
–তুমিও বসো। একসাথে খাই।
পুতুল যেন এর অপেক্ষাতেই ছিল। সাথে সাথেই পাশের চেয়ার টেনে খেতে বসে পরলো সে। খসরু সাহেব একটু ইতস্তত করে বললেন,
–পুতুল, নীলয়ের খবর জানো?
পুতুল চকিত হয়ে উনার মুখের দিকে তাকালো। স্বাভাবিক গলায় বলল,
–খবর বলতে?
–ও যে আমাদের পত্রিকায় আর কবিতা পাঠাচ্ছে না, সেটা জানো?
পুতুল ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–জানি।
–শুনেছি, অন্য এক পত্রিকায় এখন ওর কবিতা ছাপানো হয়। আবার শুনছি, সামনে নাকি ওর বইও আসছে।
–ভালো তো!
খসরু সাহেব পুতুলের মুখের দিকে তাকালেন। পুতুল নির্বিকারভাবে খেয়ে চলেছে। কি যে ভাবছে তা মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। খসরু সাহেব প্রশ্ন করলেন,
–নীলয় আমাদের পত্রিকার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে বলে কি তোমার মন খারাপ হয়েছে?
পুতুল বেশ দৃঢ় গলায় উত্তর দিলো,
–যদি এখনো উনাকে চাইতাম, তাহলে হয়তো খারাপ লাগতো। এখন আর খারাপ লাগছে না।
–এখন আর নীলয়কে নিয়ে কোনো চাওয়া নেই?
–না, নেই। তোমাকে যে মুহূর্তে বিয়ে করেছি, সেই মুহূর্তেই ওই চাওয়ার শেষ হয়েছে। আমি শুধু চাই উনার ভালো হোক। এটুকুই।
খসরু সাহেব আচমকা প্রশ্ন করে বসলেন,
–আর আমার?
পুতুল মৃদু হাসলো। চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
–তোমার সাথে তো আমি নিজেও জড়িয়ে গেছি। তোমার ভালো মানেই তো আমারও ভালো। তোমার কি এখনো আমাকে বিশ্বাস হয় না?
খসরু সাহেব আলতো করে পুতুলের বাম হাতের আঙুল ধরলেন। মৃদু গলায় বললেন,
–হয়, বিশ্বাস হয়।
______________________________
বিকাল হয়ে এসেছে। সুরমা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। কঙ্কা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে সুরমাকে দেখছে। সুরমা এখন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ফোলা পেটে ভ্রু কুঁচকে বসে আছে সে। কঙ্কার উপরে সে অসন্তুষ্ট। সুরমাকে অন্য রকম সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখের নিচে হালকা কালি পরেছে তার। এতে যেন সৌন্দর্য আরও বেড়েছে! কঙ্কার খুব আফসোস হচ্ছে। আপার এমন সুন্দর রূপটা তার মায়ের দেখা হলো না! আপার সন্তানের মুখটাও দেখা হলো না তার মায়ের। কে ভাবতে পেরেছিল এমন কিছু হবে? কথাগুলো ভাবতেই কঙ্কার ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
শাদাব পাশেই বসে চা খাচ্ছিলো। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,
–কঙ্কা, তোমার শেষ সিদ্ধান্ত তাহলে কি?
কঙ্কা শান্ত গলায় বলল,
–নীলয় ভাইয়ের বিয়ে দেবো, দুলাভাই। আমাদের পুচকেটা আসুক আগে। তারপর নীলয় ভাইয়ের বিয়ে। তারপর আমি নিশ্চিন্ত।
সুরমা রাগী গলায় বলল,
–তুই নিজেকে কি মনে করিস? মাদার তেরেসা? পৃথিবীর সবার জীবন গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তোকে দেওয়া হয়েছে?
কঙ্কা হেসে ফেলে বলল,
–আপা, এই সময় এত রাগ ভালো নয়। ওসব কথা ছাড়। তোর তো কালই হাসপাতালে যাওয়ার কথা। তাই না, আপা? আচ্ছা, আপা? ওর নাম ঠিক করেছিস কিছু?
সুরমা এবার সজোড়ে কঙ্কার গালে চড় বসিয়ে দিলো। শাদাব অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,
–সুর! এটা কি করলে?
কঙ্কা কিন্তু বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে রইলো। তার চোখেমুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। সুরমা কঙ্কার হাত চেপে ধরলো। চাপা রাগ নিয়ে বলল,
–যেদিন তুই পালিয়েছিস সেদিন থেকে আমরা একটা মানুষও শান্তিতে নেই। এই বাড়ির মানুষগুলোকে কম অশান্তি পোহাতে হয় নি। আমার দিকে তাকিয়ে দেখ। খালা মারা যাওয়ার পর এখনো পর্যন্ত নিজেকে পুরোপুরি সামলাতে পারি নি। আর এখন আবার তোর চিন্তা। আর কত যন্ত্রণা দিবি আমাকে? নিজের বাবার কথাও কি একবার ভাববি না?
কঙ্কা মলিন গলায় বলল,
–আমি এখন একটা বিয়ে করলেই কি তোদের সবার সব চিন্তা দূর হয়, আপা?
–হয় না? তোকে সুখে দেখতে আমরা চাই না?
কঙ্কা কথা বলল না। সুরমা খানিকটা এগিয়ে গেল। কঙ্কার গালে হাত বুলিয়ে বলল,
–ব্যথা লেগেছে, না?
সুরমার বলার ভঙ্গিতে কঙ্কা হেসে ফেললো। সুরমা বোনের গায়ে আলতো করে হাত রেখে বলল,
–কঙ্কা, তুই একটা মানুষ। এই কথাটা কি ভুলে গেছিস? তোর ভেতরেও তো একটা মন আছে। তোরও ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে, কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চাওয়ার সাধ আছে, কাউকে পাশে পাওয়ার স্বপ্ন আছে। নিজেই কেন সেগুলোকে চাপা দিয়ে রেখেছিস? কেন স্বাভাবিক একটা জীবন পাওয়ার সম্ভাবনা নিজেই পাশে ঠেলে দিচ্ছিস?
–কি করতে বলছো, আপা?
সুরমা কিছুটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
–নীলয়কে বিয়ে কর। যে তোকে সত্যিই ভালোবাসতে চাইছে, তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে কি সুখ পাবি তুই? তুই নিজেকে নিজে ধোঁকা দিয়ে কি পাবি? জীবন অনেক বড়, কঙ্কা। এক জীবনে অসংখ্যবার নতুন পাতা খুলতে হয়। নতুন শুরুর কোনো শেষ হয় না।
কঙ্কা কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়ালো। মৃদু গলায় বলল,
–আমি যাই, আপা। তোমার জন্য খাবার বানাই।
ছোট ছোট পা ফেলে কঙ্কা বেরিয়ে গেল। সুরমা হতাশ ভঙ্গিতে বসে রইলো। শাদাব স্নেহের সুরে বলল,
–চিন্তা করো না। কঙ্কা বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোমার কথাগুলোর মানে ও ঠিকই বুঝবে।
সুরমা নিঃশব্দে বাইরের আকাশের দিকে তাকালো। মনে মনে প্রার্থনা করলো, তাই যেন হয়। _________________________
সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ ভীষণ মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে জাহানারার। পানশিকে চা আনতে বলে উনি বিছানায় বসেছেন। বিছানার একপাশে সন্দেশ ঘুমিয়ে আছে। আজকাল মেয়েটা কিছুতেই উনার কাছ থেকে সরতে চায় না। রাতে ঘুমানোর সময় ছাড়া মাকে খোঁজেও না। দাদি অন্ত প্রাণ যেন! কথাটা ভাবতেই জাহানারা হাসলেন।
চা আনলো অযাচিনী। দরজায় দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে টোকা দিলো। জাহানারা মুখ তুলে তাকালেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
–তুই যে? আমি তো পানশিকে বলেছিলাম চা আনতে।
অযাচিনী ইতস্তত করে বলল,
–হ্যাঁ, নতুন ভাবিই চা বানিয়েছে। কিন্তু উনাকে আবির ভাই ডেকেছে তো, তাই আমাকে চা আনতে হলো।
–ঠিক আছে। দিয়ে যা আমাকে।
অযাচিনী ভয়ে ভয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলো। জাহানারার হাতে চা দিয়ে সে চলে যাচ্ছিলো। জাহানারা পিছু ডেকে বললেন,
–অযাচিনী, তোর বাবু সাহেব কোথায়?
–বাগানে আছেন। ডেকে দেবো?
জাহানারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–দরকার নেই। তুই এদিকে আয়।
আশরাফউদ্দিন সাহেব আজকাল অধিকাংশ সময়টা কাটান বাগানে। একা একা বসে চা খান, এমাথা থেকে ওমাথা হাঁটাহাঁটি করেন। কে জানে? সারাজীবনের পাপকর্মের হিসাব করেন কিনা?
অযাচিনী কিছুটা দূরত্ব রেখে বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। জাহানারা তার দিকে না তাকিয়েই বললেন,
–ড্রেসিং টেবিলের উপরে নারিকেল তেলের বোতল আছে। ওটা আর চিরুনিটা নিয়ে আয়। আমার চুলে তেল মাখিয়ে দে।
অযাচিনী চমৎকৃত হলো। বিস্ময় নিয়ে বলল,
–ম্যাডাম! আ…আমি আপনাকে ছোঁবো?
জাহানারা মৃদু হেসে বললেন,
–কঙ্কার থেকে শিখেছি, অযাচিনী। রাগ, অভিমান, কষ্ট, এসব বাঁচিয়ে রেখে খুব একটা লাভ নেই। জীবন তো একটাই। তাই না?
অযাচিনীর চোখে জল এলো। সে দ্রুত সেটা লুকিয়ে ফেললো। সে বুঝতে পারছে, কঙ্কা চলে গেলেও কোথাও একটা রয়ে গেছে।

আবির ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে। হালকা করে কুয়াশা ঘিরেছে চারপাশ। ডিভোর্স সার্টিফিকেট হাতে আসার পর থেকেই আবিরের মন বিষন্ন ছিল। শেষ পর্যন্ত কঙ্কার সাথে সবটা ছিন্ন হয়েই গেল! অল্প দিনের জন্য এসে অনেকটা মায়ায় ডুবিয়ে দিয়ে গেছে মেয়েটা। স্বল্প সময়ের অতিথিরা বুঝি এমনই হয়। তবে কঙ্কা তাকে গোটা একটা জীবনযাপন শিখিয়ে দিয়ে গেছে। আবির এখন জানে, জীবন এগিয়ে যাবেই। নিজে এর সাথে এগিয়ে যেতে না পারলেই অসুবিধে। সেজন্যই আজকাল তার পানশির প্রয়োজন বোধ হয়। বোধ হয়, এই জীবনটা কাটাতে হলে পানশিকে তার দরকার। একটা সময় মানুষ বোধহয় শুধু মানুষ খোঁজে। মানুষ আসলে বেঁচে থাকার জন্যই বারবার ভালোবাসে। আবির দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
পানশি তাড়াহুড়ো করে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। ঘর অন্ধকার। বারান্দায় একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে। সেই আলোতেই আবিরকে দেখা যাচ্ছে। আবির তাকে কেন ডেকেছে সেটা সে বুঝতে পারছে না। আবির কখনোই তাকে ডাকে না। সন্দেশ ছাড়া আর কোনোকিছু নিয়ে তাদের কথাও হয় না। পানশি বারান্দার দরজা ঘেঁষে দাঁড়ালো। কিছুটা উঁচু আওয়াজে বলল,
–আমাকে ডাকছিলে?
আবির ঘুরে তাকালো। হাসার চেষ্টা করে বলল,
–হ্যাঁ, ডেকেছি। এসো।
পানশি বারান্দায় গেল। জানতে চাইলো,
–সন্দেশ কোথায় সেটা জানতে চাও? মায়ের ঘরে ঘুমিয়ে আছে। এবার যাই? আর কিছু দরকার হলে বলো।
আবির হেসে ফেললো। মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
–মনে হচ্ছে আমার উপরে তুমি খুব অসন্তুষ্ট। আমার কি ঠিক মনে হচ্ছে?
পানশি স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলো,
–না তো। অসন্তুষ্ট কেন হবো?
–সন্তুষ্ট হওয়ার মতোও তো কিছুই করি নি।
পানশি অন্যদিকে ফিরে তাকালো। কথা বলল না। আবিরও কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কয়েক মুহূর্ত এভাবেই কাটলো। একটা সময় পানশিই মুখ খুললো,
–আমি আসি। রাতের রান্না হয় নি। বাবা বাগানে আছেন। কিছু খাবেন কিনা জেনে আসি।
পানশি চলে যাচ্ছিলো। আবির আচমকা বলে উঠলো,
–পানশি, সরি।
পানশি থমকে দাঁড়ালো। প্রথমটায় কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। আবির আবার বলল,
–নতুন করে শুরু করতে মানুষের কিছু সময় দরকার হয়। তুমি নিশ্চয়ই সেটা বুঝতে পারছো।
পানশি এবারও কথা বলল না। আবির একবার ইতস্তত করলো। তারপর হাত বাড়িয়ে পানশির হাত ধরলো। পানশি কেঁপে উঠলো। আবির কোমল গলায় বলল,
–আমি সত্যিই সরি।
পানশির চোখে এবার জল এসেছে। সে কিছু বলতে পারলো না। চেষ্টা করেও ঠোঁটের দেয়াল ভেদ করে শব্দ উচ্চারিত হতে পারলো না। মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। আবির নিজে থেকেই বলল,
–বিছানার উপরে একটা নতুন শাড়ি আছে। তুমি যদি সেটা এক্ষুণি পরে আমার সামনে আসো, তাহলে বুঝবো আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ। আর শাড়িটা না পরলে বুঝবো, আমাকে ক্ষমা করো নি।
পানশি এরপরেও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। স্থির হয়ে আসা পা দুটোকে নড়াতে কিছুটা সময় লাগলো তার। ধীরে ধীরে পানশি ঘরে গেল। আবছা আলোতেও আবির দেখলো পানশি শাড়িটা হাতে নিয়েছে। আবির হাসলো। ও জানে, পানশি শাড়িটা পরবে।
_______________________
রাত গভীর হয়েছে। কঙ্কা এখনো জেগে। ছাদের একপাশে রাখা বেঞ্চিতে বসে আছে সে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পরেছে। কঙ্কার গ্রামে চলে যাওয়ার প্রস্তাব নাকচ হয়েছে। বিকাল থেকেই সুরমার বলা কথাগুলো ভাবছে সে। হঠাৎই নিজেকে কেমন খালি খালি লাগছে। বুকের গভীরে চেপে রাখা শূন্যতাটা অনেক দিন পরে তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। কেমন একটা বিশ্রী অস্থিরতা।
নীলয় তার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বেঞ্চের একপাশে বসে গম্ভীর গলায় বলল,
–ঘুমাতে যাবি না?
–আপনাকে একটা প্রশ্ন করবো বলে এখানে বসে ছিলাম। আমি জানতাম আমাকে দেখলে আপনি ঠিকই আসবেন।
নীলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–সবই জানিস, সবই বুঝিস। তবুও….
–তবুও কি?
–কিছুই নয়। কি প্রশ্ন করবি? কর।
কঙ্কা মৃদু স্বরে বলল,
–আমার জীবনে যা ঘটেছে, তা নিয়ে আপনার মনে কখনো আপত্তি জন্মাবে না তো? কখনো মনে হবে না তো যে ভুল করেছেন?
নীলয় কিছুটা নড়েচড়ে বসলো। কঙ্কার দিকে এগিয়ে গেল। একটু সময় নিয়ে বলল,
–আমাকে কি তুই চিনিস না?
–নিশ্চয়ই চিনি। তবুও আপনি নিজের মুখে বলুন। প্লিজ!
নীলয় সাথে সাথেই বলে ফেললো,
–কখনোই না। তেমন কিছু এই জীবনে অন্তত আমি ভাবতে পারবো না। বরং সবসময় আমার মনে হবে এ আমার বড় সৌভাগ্য। খুব বড় সৌভাগ্য না হলে তোকে পাওয়া যায় না, এটা আমি বিশ্বাস করি।
কঙ্কা কিছুটা ইতস্তত করে বলল,
–আমার জীবনে যা ঘটে গেছে, তা নিয়ে কিন্তু আমার কোনো আফসোস নেই। আক্ষেপও হয় না। আমি ওই কয়েকটা মাসে অনেক নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। ওই বাড়ির চমৎকার কিছু মানুষের সাথে আমার সখ্যতা হয়েছে। আবির, অযাচিনী, মা, বাবা, সবাই একেকজন আশ্চর্যময় মানুষ। জীবনে এমন কতগুলো আশ্চর্যজনক মানুষকে দেখাটাও ভাগ্যের ব্যাপার। সেই স্মৃতিটুকু আমার জীবনে আছে, থাকবে। এর বেশি কিছুই নয়। নীলয় ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–আক্ষেপ যদি নাই থাকে, তাহলে নতুন শুরুতে এত আপত্তি কিসের?
–আপত্তি? ঠিক তা নয়। হয়তো সংকোচ।
–কিসের সংকোচ?
কঙ্কা নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
–ফিরে আসার সংকোচ।
–সংকোচ তো আমারও ছিল। আমি কাটাতে পারলে তুই কেন পারবি না?
–কি জানি? শুধু সংকোচ বোধহয় নয়। হয়তো অভিমানও।
–কার উপরে অভিমান, কঙ্কা?
কঙ্কা উদাস গলায় উত্তর দিলো,
–কে জানে? হয়তো নিজের উপর, অথবা জীবনের উপর। কিংবা কে বলতে পারে? হয়তো আপনার উপর।
নীলয় কাতর গলায় বলল,
–কি করলে তোর এমন নিষ্ঠুরের মতো অভিমান ভাঙবে, কঙ্কা? বল, আমি তাই করবো।
কঙ্কা নীলয়ের দিকে তাকালো। অন্ধকারেরও একটা নিজস্ব আলো আছে। সেই আলোতেই কঙ্কা নীলয়ের মুখ দেখলো। নীলয় ততক্ষণে তার একটা হাত ধরেছে। কঙ্কা প্রায় অস্পষ্ট গলায় ফিসফিস করে বলল,
–কিচ্ছু না। শুধু চুপচাপ বসে থাকুন।
নীলয় তাই করলো। আচমকাই কঙ্কা নীলয়ের বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠলো। নীলয় থামানোর চেষ্টা করলো না। শুধু আলতো করে কঙ্কার মাথায় হাত রাখলো। আজ সে কঙ্কাকে থামতে বলবে না। মেয়েটা কাঁদুক, যত খুশি কাঁদুক। কখনো কখনো নীরব কান্নাগুলোকে ঝরে যেতে দিতে হয়।
.
#সমাপ্ত।
[জীবনে কান্নারা আনাগোনা করে। কিছু কান্না ঝরে যায়, আর কিছু নীরবে রয়ে যায়।]
________________________________
(কিছু কথা: আমার ভীষণ অনিয়মের জন্য আমি দুঃখিত। যারা আগেও আমার লেখা পড়েছেন, তার হয়তো জেনে থাকবেন আমি সচরাচর এত দেরিতে গল্প পোস্ট করি না। কিন্তু এবারে বেশ কিছু ঝামেলা পার করেছি আমার ব্যক্তিগত জীবনে। তাছাড়াও আমি এই গল্পের শেষের দিকে এসে প্রচন্ড একটা রাইটিং ব্লকে পরেছিলাম। লিখতে চেষ্টা করতাম, কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠতাম না। দুটো লাইন লিখতেই কেমন যেন ধৈর্যহারা হয়ে পরতাম। লিখতে চাইছি কিন্তু পারছি না, এই কষ্টকর অনুভূতি আমি কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না। শেষ পর্বটা লিখতেও অভাবনীয় বেশি সময় লেগেছে আমার। নিজেকে দিশেহারা লাগতো। এতদিন ধরে সবাইকে অপেক্ষায় রেখে আমি নিজেও খুব অস্থিরতায় ভুগতাম। এতকিছুর পরেও যারা শেষ পর্যন্ত গল্পটা পড়েছেন, আমার সাথে থেকেছেন, তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা। আপাতত গল্পটা শেষ করতে পারার প্রশান্তি নিয়েই আমি বিদায় হচ্ছি। নিয়মিত গল্প দিতে পারবো, এই নিশ্চয়তাটুকু না নিয়ে আমি আর লেখালেখিতে ফিরবো না। বিদায়!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here