নিরালায় ভালোবাসি পর্ব-১০

0
700

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
৯ .

আজ ঠাণ্ডা একটু কমই আছে। নাহলে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলো কী শীতের পোশাক ছাড়া থাকতে পারে। কিন্তু এর কারণটা মনে হয় একটা মেয়েই বলতে পারবে। আসলে সাজুগুজু করলে ঠান্ডার মাঝে মেয়েদের ঠাণ্ডা ঠিক লাগে না। ওই যে আমরা শীতের সময় দেখি না, বিয়ে বাড়িতে মেয়েদের মাথায় রুমাল তো দূর পরনে শীতের কিছুই থাকে না। তবে কিছু মেয়ে সেক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম। আবার কিছু মেয়ের পরনের চাদরটা অতীব দুর্ভিক্ষের ন্যায় পড়ে থাকে। বেচারারা জড়বস্তু হওয়ার দরুণ কেবল গর্জে উঠে বলতে পারে না, “হে রমণী গণ দয়া করিয়া আমাদের তোমরা ন্যাপথলিন মাখিয়ে আলমারিতে আগের ন্যায় রেখে এসো। এমন অপমানিত বোধ করি আমরা আগে হয়নি।”

ইচ্ছে নীরব যখন ছাদে এলো তখন দেখে এখানে নীরবের সব বন্ধুই রয়েছে। তার মধ্যে অনেকে তার স্ত্রী তো কেউ গার্লফ্রেন্ড কে এনেছে। একদিকে আবার ইপশিও আছে। এই মেয়ে কোন ফাঁকে এখানে এসেছে কে জানে। নীরবকে দেখে তো সব বন্ধুতে একেবারে হামলে পড়েছে। হুট করেই ইপশি বলে ওঠে, ” তোরা জানিস নীরবের বউ খুব ডেঞ্জারাস। তবে নীরবকে খুব ভালোবেসে তাই তো আমাকে টিকটিকি আরশোলা দেখিয়ে ভয় দেখিয়েছিল। ”

সকলের সামনে এমন একটা কথায় নীরবের কাশি উঠে গেলো। নীরবের বন্ধু গুলো এটা জানলেও তাদের স্ত্রী, গার্লফ্রেন্ডরা শুনে ইচ্ছের দিকে চোখ বড়ো বড়ো তাকালো। সোহেলের গার্লফ্রেন্ড হিতৈষী মজা করে ইচ্ছের কাঁধে ধাক্কা মেরে বললো, ” তাই নাকি বৌদি।
এতো দেখি জবরদস্ত লাভ স্টোরি। ”

ইচ্ছে অসস্তি নিয়ে আশেপাশে তাকালো। আগে জানলে ও এখানে আসতো না। আগে তখন ওর মাথায় বুদ্ধি কম ছিল। নীরবের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে কতো ভুল কাজ করে ফেলছে। ইসস, তখন যদি ও এমনটা না করতো তবে হয়তো নীরবকে ওর দায়িত্ত্ব নিতে হতো না। ইচ্ছের ভাবনার মাঝেই ইপশি পুনরায় বললো, ” আরে সে তো নকল টিকটিকি ছিল। তো আমি একদিন ওকে ডেকে বলি আজ কী দিয়ে ভয় দেখবে ও? কিন্তু আমি কি করে জানবো এই মেয়ে নিজের সঙ্গে আরশোলা নিয়ে গিয়েছে।”

সকলে হা হা কর হেসে উঠলো। রিন্টুর স্ত্রী কবিতা হাসতে হাসতে রেলিঙে গা এলিয়ে দিল।
– ” তো সেই আরশোলা কি তোমার গায়ে ছেড়ে দিয়েছিল?”

নীরব হাসে। আড় চোখে ইচ্ছেকে দেখে। আগের ইচ্ছে যদি এখানে থাকতো, তবে হয়তো টিকটিকি কী আরশোলা ধরে এনে ইপশির গায়ে এতক্ষণে ছুঁড়ে মারত। নীরব জানে ইপশি কেউ। মেয়েটা অন্য ধাঁচের। নিজের ঢাক নিজেই পেটায়। ভালো খারাপ যা মুখে আসে তাই বলতে পারে ইপশি। মন রেখে কথা বলতে ইপশি পারে না। ও বলেই হয়তো কথা গুলো এক নিমেষে বলে দিলো। অন্য কোনো মেয়ে হলে কখনোই এই কথা গুলো হেসে হেসে বলতে পারতো না। তাও আবার সেই কান্ড রটনা কারি কারোর নামে প্রশংসা করে।

– ” না না ছাড়ে নি। শুধু বলেছিল, এবার কিন্তু আসল আরশোলা আছে। নকলের কারবার বন্ধ ইপশি ম্যাম।”

সকলের হাসির মাঝে নীরবের একটা কল এলে নীরব নীচে চলে যায়। ঠিক নীচে না কয়েক ধাপ সিঁড়ি নীচে।

হিতৈষী এবার ইচ্ছে কে চেপে ধরে। তার সঙ্গে কবিতাও যোগ দেয়।
– ” কী ইচ্ছে, নীরব দাদাকে তো খুব ভালোবাসো। ”

– ” ভাবা যায় কেউ এমন করতে পারে।”

ইপশি বলে, ” তোমাকে আজ খুব করে বকতাম। কিন্তু রজত বললো বলেই এবারের মতো ছেড়ে দিলাম তোমাকে। ”

ইচ্ছে আগেও কিছু বলেনি এখনও বললো না। কেবল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। হুট করেই কবিতা বললো, ” বিয়ের কতো বছর হলো ইচ্ছে?”

এতক্ষণ নীরবের বন্ধুরা দূরে দাঁড়িয়ে সবই শুনছিল। এবার তাদের থেকে রীতেশ বললো, ” এইতো কয়েক সপ্তাহ আগেই নীরব বিয়ে করলো। কাউকেই বলেনি খুব ছোটো করে। আমরা তো জানতামই না। আজ সোহেল বললো। ”

হাসির মুহূর্তে বিষ্মাদ যেনো হুট করেই এসে পড়ে। হাসি খুশি চলা সুন্দর পরিবেশ হুট করেই অন্ধকার হয়ে যায়। যা এই মুহূর্তে ঘটতে চলেছে। রীতেশ এর বলা কথা গুলো শুনে ইপশি হুট করেই বলে উঠলো,

– ” কী বলছিস, ইচ্ছের তো বিয়ে হয়েছে প্রায় কয়েকমাস। ইনভাইট না হয় ছিলাম না কিন্তু পাড়া আমাদের পাশাপাশি। সব খবরই পাওয়া যায়। ”

হিতৈষী মুখ ফসকে বলেই ফেললো, ” এটা তো দ্বিতীয় বিয়ে।” ধমকে উঠল সোহেল। সব কথাই সে হিতৈষী কে বলে। তেমনি এই বিষয়টাও বলা ছিল। কিন্তু এই ভাবে যে জনসম্মুখে এই কথাটা ও বলে বসবে তা ভাবনি সোহেল। জানলে হয়তো ভুলেও বলতো না।

ইচ্ছে থমথমে মুখে সিঁড়ি ঘরের দরজার দিকে তাকায়। কিন্তু নীরবকে না দেখে ও আশাহত হয়। এই পরিস্থিতিতে তো ও পড়তে চায় না। কষ্ট হয় ওর। এর আগেও শুনেছে । কিন্তু নীরবের জন্যে প্রতিবার নিজেকে স্পেশাল ফিল করেছে ইচ্ছে। আজও ওর নীরবকে প্রয়োজন।

ইপশি বলে উঠলো, ” তার মানে তোমার আগে বিয়ে হয়েছিল। তাহলে নীরবকে বিয়ে করলে কেনো?”

জবাব নেই ইচ্ছের কণ্ঠে। চোখ জোড়া আস্তে আস্তে লাল হয়ে যাচ্ছে। কণ্ঠ নালী শব্দের অপেক্ষায় থেকে থেকে জ্বলে উঠছে।

– ” কী হলো ইচ্ছে বলো। নীরবকে বিয়ে করলে তবে?”

ততক্ষনে সকলে ইপশিকে থামাতে চেষ্ঠা করছে। কিন্তু ইপশি কারোর মনের অপ্রকাশিত ক্ষত গুলোকে না বুঝেই বলে চলে আবোল তাবোল।

” নিশ্চয়ই আগের বরকে ছেড়ে দিয়েছো না। সত্যিই তুমি নীরবকে খুব ভালোবাসো। ” ইচ্ছে চুপ। কান্না গুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে গলায়। আজ ওর কণ্ঠ নালীকে বড্ড নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। ইপশি পুনরায় বলে, ” বোবা হলে নাকি। কিছু বলছো না যে।”

ছাদের মধ্যে ঠাণ্ডা পরিবেশ কথা নেই কারোর মুখেই কেবল ইপশি ব্যতীত। নীরব যখনই ছাদে পা রাখে ধাক্কা লাগে কারোর সাথে। ছুটে বেরিয়ে যায় ইচ্ছে। থমকে যায় নীরব। সব কিছু বোঝার আগেই ইপশি বলে,
” আমাকে তো খুব অপছন্দ ছিল। আর তোর বউ কোন দিকে ভালো। কোনোদিকে না। আবার দেখি কথাও বলতে পারে না। আগে তো পকপক করতো। বোবা হয়ে গেছে নাকি? ”

ধমকে উঠল নীরব, ” কার নামে কি বলছিস জানিস নিশ্চয়ই। ভুলে যাবি না ইচ্ছে আমার স্ত্রী। কী বলছিস ওকে? ও বেরিয়ে গেলো কেনো?”

সব খুলে বললো সোহেল। সকলেই বলে উঠলো, ও একটাও কথা বললো না কেনো?”

– ” কেনো আবার, আমার মনে হয় বোবা। শেষে বোবাকে বিয়ে করলি নীরব।

– ” ইনাফ ইজ ইনাফ ইপশি। অনেক বলেছিস। ও বোবা হলেও আমার স্ত্রী, খোঁড়া হলেও আমার স্ত্রী। আর ওকে নিয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করবে এটা আমি চাইনা। যেখানে আমি ওকে আগলে রাখি। তুই ওকে এমন বলার সাহস কোথায় পেলি? ”
নীরবের এক একটা কথায় ভয় পায় ইপশি। নীরব তারাহুর করে ছুটলো। ইচ্ছেকে খুঁজতে হবে ওর। যাওয়ার আগে বলে গেছে, ” আজ তোকে ছেড়ে দিলাম। পরবর্তী সময়ে আমার থেকে খারাপ কাউকে দেখবি না।

নীরব তো চলেই গেল কিন্তু ইপশির মন তখনও বলছে, যাহ বাবা, আমি খারাপ কী বললাম।

————————————————–

ঘর অন্ধকার করে মেঝেতে বসে রয়েছে ইচ্ছে। গায়ের চাদরটা আসার পথে কোথাও হয়তো পড়ে গেছে। মনের মধ্যে হাজারও ভয়, হাজারও কান্না বেঁধে বসে রয়েছে ইচ্ছের।

ইচ্ছের পড়ে থাকা চাদরটা সিঁড়ি থেকে পেয়েছে নীরব। তারপর প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়িতে ফিরেছে ও। বাড়ি এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা। রুমা দেবী গেছে ননদের বাড়ি তাথৈ কে রেখে আসতে। আজ আশাও কাজে আসেনি। নীরব ঘরে ঢুকে লাইট অন করা মাত্রই রেগে গেলো। ঠান্ডার মাঝে ইচ্ছে মেঝেতে বসে রয়েছে। আগে গিয়ে নীরব ইচ্ছেকে মেঝে থেকে তুলে ধমক দিলো। বিছানার সঙ্গে চেপে ধরলো ইচ্ছেকে।

– ” তোর এতো রাগ ইচ্ছে আমার উপর যে কথাই বলিস না। ঠিক আছে আমি তো তোকে কিছু বলি না। কিন্তু তুই আজ নিজের অপমান ও মুখ বুঝে হজম করলি। কেনো করলি? তোর আত্মসম্মান নেই? কেনো শুনলি ওর কথা? ওরা তোকে বোবা বলছিল। বোবা। ”

ছলছল চোখে নীরবের দিকেই তাকিয়ে আছে ইচ্ছে। নীরবের এই দৃষ্টি কষ্ট দিচ্ছে। ইচ্ছেকে ছেড়ে বারান্দায় চলে গেল নীরব। মাথা প্রচুর গরম। ও আজ ইচ্ছেকে ছেড়ে না গেলে এত কথা ইচ্ছের প্রাপ্র ছিল না। আর ইচ্ছে, সেও কেনো সহ্য করবে। পাশ থেকে ইরা বলে চলেছে, পিকু। বিশেষত ইরা কাউকে দেখলেই ডেকে ওঠে। নীরবের অভ্যেস আছে। কিন্তু আজ সে অতিমাত্রায় রেগে। তাই রেগে ইরার খাঁচায় একটা থাপ্পড়ের ন্যায় চড় বসলো নীরব। ধমকে বললো, ” চুপ কর।”

নীরবের ধমকে ঘরে বসে থাকা ইচ্ছে কেঁপে উঠলো।

( চলবে )

{ বিঃ : মনের জমা প্রশ্ন গুলো জমা করে রাখুন। শীঘ্রই উত্তর পাবেন। }

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here