# নিরালায় ভালোবাসি
তুহিনা পাকিরা
১৩ .
নীরব যখন কলেজে পৌঁছায় ইচ্ছে তখন ক্লাসে। তাই নীরব ক্যাম্পাসের মাঠে একাই বসে থাকে। এই একই কলেজে এক সময় ওউ পড়াশোনা করেছে। এখন অবশ্য অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। ওই যে কিছুটা দূরে টবে থাকা কুন্দ ফুল গুলো এখন বোধহয় সংখ্যায় বেড়েছে। বকুল ফুল গাছটা আর দেখা যাচ্ছে না। গাছটা বোধহয় কেটে দিয়েছে। ওই গাছটা ওদের বন্ধুদের যে কতো নাম লেখা আছে তার হিসেব নেই। হয়তো সেই বেঞ্চ গুলোও নীরবকে ডেকে উঠে বলতে পারে, কী রে কী রকম চলছে দিনকাল? আমাদের মনে পড়ে তোর? এখনও কতো স্যার এক ঝটকায় দেখলেই বলে দেবে, আরে তুই নীরব না! কেমন আছিস?
ইচ্ছের ক্লাস শেষ হয় প্রায় আধা ঘন্টা পর। ক্লাস থেকে বেরোতেই সর্বপ্রথম নিতু এসে ওকে আর রক্তিমা কে ডাকে। নিতু বলে, ” চল ক্যান্টিনে চল। আমি যেহেতু তোদের বড়ো দিদি তাহলে আজকের ট্রিট আমার তরফ থেকে। তোদের জিজুর জন্ম দিন আজ। কিন্তু তিনি তো বহুত ব্যস্ত। ব্যাস আমিও, পকেট থেকে তিন হাজার বার করে কথা বলেছি।”
রক্তিমা ইচ্ছের কাঁধে হাত রেখে হাসতে যাচ্ছিল তার আগেই নীরব গিয়ে ইচ্ছেকে সাইডে নিয়ে যায়। ব্যাস এর ফলে যা হবার তাই হলো। রক্তিমা গিয়ে সোজা ইউনিয়ন কে ধাক্কা। ইউনিয়ন এর ছেলেটা সেই মুহূর্তে হাঁ করে জল খাচ্ছিল। কিন্তু ধাক্কার ফলে পুরো মুখময় জলে জলময়। তার মধ্যে নাকে মুখে জল ঢুকে যাওয়ার দরুন সে খুকখুক করে কেশে উঠলো। নিতু পুরোটাই হাঁ করে দেখলো। কিছুই করতে পারলো না। বেচারি রক্তিমা যে কান্ডটা করলো তাতে তার হাত পা কাঁপছে। শুনেছে এই ইউনিয়ন মারাত্মক রাগী। একটা বকা দিলেই হয়তো ও ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেই দেবে।
– ” ওই কে রে? ” রক্তিমাকে চোখের সামনে দেখেই নিখিল বুঝেছে এই মেয়েই কাজ টা করেছে। তাই গম্ভীর গলায় বলল, ” এই মেয়ে ঠেললে কেনো আমাকে?”
রক্তিমাও ভয়ের চোটে ফাঁকা হলের দিকে হাত দেখিয়ে বলে, ” আমি না তো, ওই যে ঐখানের লোকটা।”
নিখিল হলের দিকে তাকিয়ে দেখে কেউ একটা দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। ওকে জলে ভিজিয়ে আরামে কথা বলা নিখিলের সহ্য হলো না। রক্তিমার স্কার্ফের শেষ অংশ দিয়ে মুখের বড়ো দাঁড়ি গুলো কোনো মতে মুছে নিখিল এগিয়ে গেল সেই দিকে। রক্তিমার ইচ্ছে করলো এই ইউনিয়নের মাথা ফাটিয়ে দিতে। ওর পছন্দের স্কার্টটা ভিজিয়ে দিল। ” যতসব” বলেই ও নিতুর কাছে চলে গেলো।
নিখিল গিয়ে ফোনে কথা বলা লোকটার হাতের বোতলটা কেড়ে বোতলের ক্যাপ খুলতেই অবাক, এ যে নিউ লাইবেরিয়ান। পিছন থেকে দেখলে মনে হবে কোনো স্টুডেন্ট। অবশ্য সামনে থেকেও তাই মনে হয়। কিন্তু মাথার মধ্যে দুই একটা পাঁকা চুল দেখলে বোঝা যায়, অবিবাহিত এই স্যারের বিয়ে হওয়া মুশকিল। কিংবা হলেও হতে পারে।
– ” কী করছো এটা? বোতলটা এই ভাবে হাতে নিলে কেনো?”
স্যারের ধমকে ইউনিয়নের ভয় হলো বটে। ” আসলে স্যার দেখলাম আপনার জলের বোতল খালি তাই ভাবলাম একটু জল এনে দিই।”
– ” চোখে দেখো না এতে জল ভর্তি। তবে আনলে এনে দাও। এই ঠাণ্ডা কনকনে জল আমি খেতে পারছি না। যাও নিয়ে যাও।”
কোনো মতে নিখিল ওখান থেকে পালিয়ে বাঁচে। অপরকে এতদিন হুকুম করে কতো কি করানো ছেলেটা শেষে জল আনতে ক্যান্টিনে যায়।
অপর দিকে ইচ্ছে আর নীরব বসে রয়েছে ক্যাম্পাসের মাঠে। ইচ্ছে চুপ চাপ ঘাসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর নীরব ইচ্ছের হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলা করে যাচ্ছে। কখনো আঙ্গুল দিয়ে হাতে আঁকি বুঁকি করছে, কখনো বারবার ইচ্ছের হাতের পাঁচ আঙুলকে গুনে সংখ্যা বাড়াচ্ছে। যেমন এই মুহূর্তে নীরবের গোনা মতে ইচ্ছের আঙ্গুলের সংখ্যা 75 টা।
-” এই ইচ্ছে তোর কী শরীর খারাপ?”
মাথা তুলে নীরবের দিকে দেখে ইচ্ছে। হ্যাঁ ওর শরীর একটু খারাপ বৈকি। গা হাত গুলো কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, কেমন একটা জ্বর জ্বর ভাব। গলাও ব্যথা করছে। একটু আগেই ক্লাসে খুব কাশছিল। কিন্তু নীরবকে সে কিছুই বলতে পারলো না। ইচ্ছে এতদিনে এটুকু বুঝেছে যে নীরব ওর কথা না বলার কারণ টা এখনও জানে না। আর যখন থেকে বুঝেছে তখন থেকেই একটা ভয় ওকে জড়িয়ে রয়েছে। নীরব যদি কখনো সেই কারণ জানতে পারে তাহলে নির্ঘাত ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। কিন্তু বিয়ের আগে ও ভেবেছিল নীরব ওকে দয়া করে বিয়ে করছে। যদিবা নীরব ওকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছে, তা ইচ্ছে জানে। কিন্তু কোনো দিন তার সিকি ভাগ ও ইচ্ছেকে বুঝিয়ে দেইনি।
– ” কী রে কী জানতে চাই….”
কথাটা নীরবের মুখ দিয়ে আর বেরোতে পারলো না। হুট করেই মনে পড়ে গেলো কিছুক্ষণ আগে বাড়ির ঘটনা।
– ” ইচ্ছে শোন, ”
ইচ্ছে কী শুনবে তার আগেই নীরব নিজের দুই হাতের মুঠোয় ইচ্ছের মুখ ধরে নিলো। অবাক তো ইচ্ছে হলো তবে কোথাও যেনো আনন্দ হলো, ভালো লাগলো। মনে হলো আজ সে খুব খুব খুশি।
– ” আমি তোকে এতদিন কথা না বলার জন্যে খুব বকেছি তাই না। আসলে কী বলতো আমি জানতাম না যে তুই কথা বলতে …, ”
ইচ্ছের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায় নীরব। ইচ্ছের মনটা হুট করেই কেঁদে উঠলো। নীরব নিশ্চয়ই তাকে আর মানবে না। বোবা মেয়েকে নিয়ে কেই বা সংসার করে। কিন্তু নীরব এর মনের কথা গুলো হয়তো ইচ্ছে জানে না। যেই ছেলেটা ইচ্ছে কথা বলতে পারে না শুনে শুধু এটা ভেবেছে যে সে ইচ্ছেকে কথা না বলার জন্যে কতো বকেছে। যার মনে একবারও এটা আসেনি যে একটা বোবা মেয়েকে নিয়ে সে কীকরে থাকবে। সে আর যাই হোক কারোর খুঁত সে ধরবে না।
– ” এই ইচ্ছে তুই কি এখন কাঁদবি নাকি? একদম কাঁদবি না, সবাই ভাববে আমি তোকে বকেছি। আর নাহলে আমার অদেখা শালী এসে বলবে , ” এই আপনি বুঝি আমার বন্ধুকে মারধর করেন?”
নীরবের বলার ভঙ্গিতে না চাইতেও ইচ্ছে হেসে ফেলে। নিস্তব্ধ হাসি, তবে প্রাণবন্ত। নীরব একভাবে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই ওর মাথায় নিজের ঠোঁট ঠেকিয়ে বলে, ” এইভাবে হাসবি তুই। তোকে মন খারাপ দেখলে কেমন যেনো পেঁচি পেঁচি লাগে। আর শোন তোর কথা বলার দরকার নেই। তোর ভাব ধারা দেখে তোকে বোঝার দায়িত্ব আমার। তুই খালি সারাদিন হাসিখুশি থাকবি। আর একটু বউ বউ হবি। তুই বউদের মতো ঝগড়া করিস না আমার সাথে। সে ঠিক আছে। কিন্তু আমি চাই তুই আমার সঙ্গে মারপিট করবি। চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে বাজারে পাঠাবি, ছুটির দিনে ঘর পরিষ্কার করতে হেল্প করাবি, তোকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া করাবি। মনে থাকবে?
ইচ্ছে হাঁ করে নীরবের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই মুহূর্তে নিতু আর রক্তিমা ওদের সামনে গিয়ে বসে। নিতু বললো, ” শুধু চুল কেনো মাঝে মাঝে ঘুরতে না নিয়ে গেলে কি অফিস থেকে রাত করে বাড়ি ফিরলে ঘরের দরজা খুলতে ভুলে যাবি। ”
রক্তিমা বললো, ” বাহ্ জিজু বাহ্।”
– ” আরে তোমরাই আমার শালিক পাখি মানে শালী আরকি।”
নিতু মাউন্টেন ডিউ এর ক্যান খুলে নিজের গলা ভিজিয়ে ইচ্ছের দিকে এগিয়ে দিলো। কিন্তু ইচ্ছে নীরবের দিকে তাকিয়ে ঠিক ক্যান টা নিতে পারলো না। উল্টে নীরবই হাতে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ” কবে থেকে এইসব ইচ্ছে খাচ্ছে শালিক পাখিরা?”
– ” কেনো? ওর কী খাওয়া বারণ নাকি? ” নিতুর কথায় রক্তিমা বলে,
–
– ” হ্যাঁ। তুমি জানোনা নিতু দি?”
মাথা নাড়ে নিতু, যার মানে ও জানে না। কী করে জানবে ইচ্ছে কে দিলে ও তো না বলেনি কোনো দিন। ”
নীরব চোখ গরম করে ইচ্ছের দিকে তাকালো।
– ” কাল থেকে রোজ বাসক পাতার রস তোর খাদ্য তালিকায় বাড়লো। এখন বাড়ি চল। বাড়িতে গেস্ট এসেছে। আসার সময় তোকে নিয়ে যেতে বলেছে। ”
কথা টুকু বলেই নীরব উঠে দাঁড়ালো। ইচ্ছেও ঠোঁট ফুলিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ও কী করবে মাউন্টেন ডিউ পেলে ওর আর কিছুই লাগে না। তাই তো মাঝে মাঝেই খেয়েছে। তবে বেশি না অল্প। দুই ঢোক। নিতু আর রক্তিমা ইচ্ছেকে বাই বলে বিদায় দিলো।
নীরব আর ইচ্ছে ক্যাম্পাস থেকে বেরোনোর আগে নীরব হাত বাড়িয়ে কারোর চোখ পড়ার আগেই টপাটপ চার পাঁচটা কুন্দ ফুল তুলেই হাত বন্ধ করে নিলো। তার পাশেই ফুল গাছে হাত দিতে নিষেধ করা সাইন বোর্ড যেনো নীরবের কাজে অখুশি হয়ে বলে দিলো, তোর পুরোনো অভ্যেস এখনও যাইনি ফুল চোর?
কিন্তু জড় বস্তু আজ পর্যন্ত কথা বলতে পারেনি। তাই কথা গুলো নীরব কী আশেপাশের কেউই শুনলো না। তবে ইচ্ছে ভ্রু কুঁচকে নীরবের দিকে তাকিয়ে ইশারায় ওকে বোর্ডের দিকে তাকাতে বোঝালো। কিন্তু নীরব স্মার্টলি এগিয়ে গিয়ে বলে,
– ” বই চুরি, ফুল চুরি কোনো চুরিই নয়। তুই জানিস না?”
ইচ্ছে ঘাড় নাড়ে, যার মানে সে জানে না। নীরব ওর মাথায় টোকা দিয়ে বললো, ” বউ আপনি কিচ্ছু দেখেননি। এখন বাড়ি চলুন। ”
(চলবে)