নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
১৫ .
ঠিক বিকেল পাঁচটার সময় বর অর্থাৎ ধীর যাবে বিয়ে করতে। আর তারজন্যে বিয়েবাড়ির প্রতিটা ব্যক্তি সাজ সজ্জায় ব্যস্ত। নীরব ও কয়েকজন ধীরের বন্ধু মিলে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধীর রয়েছে বাড়ির ভিতরে, কী সব নিয়ম রয়েছে। সেই কাজেই সে ব্যস্ত। আধা ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নীরবের পা ব্যথার জোগাড়। অপরদিকে ধীরের বন্ধু গুলো একে অপরের নানা পোজে পিক তুলে দিচ্ছে। অসহ্য লাগছে নীরবের। ইচ্ছেটাও রেডি হচ্ছে। ও এলে ওকে খানিক রাগালে ভালো লাগতো নীরবের। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সেঁজুতি আসছে। গাড়ির কাছেই আসছে। পরনে তার অফ হোয়াইট লাহেঙ্গা, বেশ মানিয়েছে মেয়েটিকে। তার উপর চোখে একখানা চশমাও দেখা যাচ্ছে। কই নীরব আগে তো মেয়েটিকে চশমায় দেখেনি। তবে মানিয়েছে বেশ। কিন্তু মেয়েটিকে দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না সে সাজগোজ করেছে নাকি না।
– ” এই যে সেঁজু, তুমি কি জানো না মেয়েদের বেশি সাজলে ভূতের মতো লাগে। আর কম সাজলে মনে হয় খাবার ডায়টিং এর ন্যায় সাজহীন রয়েছে। তো তুমি কীসের ন্যায় এইমুহুর্তে দাঁড়িয়ে রয়েছো?”
– ” আমার নাম সেঁজুতি, সেঁজু নয়। ”
কথাটুকু বলেই গাড়ির একেবারে পিছনের দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে বসে গেলো সেঁজুতি। নীরব ও গিয়ে মাঝের সাইটের দরজাটা খুলে বাইরে পা ঝুলিয়ে গাড়িতে বসে গেলো। এই মেয়েটাকে এই মুহূর্তে একটু রাগাবে ও।
– ” আরে ওই একই হলো। তোমার সাজ এতো কম কেনো, আমি তো তাই ভাবছি। মনে হচ্ছে সাজগোজ করেছো আবার করোনি। ”
সেঁজুতি চোখের চশমাটা হাত দিয়ে একটু নাড়িয়ে বললো, ” আমিও তবে আপনাকে বলতে পারি আপনি একটু কমই সাজগোজ করেছেন। আপনার উচিৎ ছিল আরও ঘণ্টা খানেক মুখে মেকাপ করার। ”
– ” আর বলো না সেঁজু, এই লুকেই বউ আমার ফিদা। আরও ঘণ্টা খানিক সাজগোজ করলে বেচারি হয়তো ডবল ফিদা হয়ে যাবে। তখন আবার তোমাদেরই সামলাতে হবে। তোমাদের কষ্ট দিই কীকরে বলো। তোমরা এখন ঘুরবে, প্রেম করবে তা না করে তোমাদের ডিস্টার্ব করলে চলবে বলো। ”
নীরবকে অসহ্য লাগলো সেঁজুতির। পুনরায় নামের পিন্ডি করে দিয়েছে। ধীর ওকে বলেছিল অবশ্য, নীরব হলো প্রচুর ঘাঁড়তাঁড়া। সেঁজুতি কথা বাড়ায় না, কানে হ ইয়ার ফোন গুঁজে নেয়। নাহলে ও নির্ঘাত নীরবের মাথা ফাটিয়ে দিতো।
– ” তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে সেঁজুতি? না মানে আমার এক বন্ধু আছে ওউ ঠিক তোমার মতো নাকের উপর রাগ। ঘটকালি করবো তবে।”
সেঁজুতি বোধহয় শোনেনি কথা গুলো। শুনলে নীরবের হাল বেহাল হওয়ার ছিল। আর সেটাই ভাবালো নীরবকে, যে এই মেয়ে কিছু বলছে না কেনো? কিন্তু নীরব ভাবেনি বিয়ে বাড়ির মতো হইহুল্লোড় জায়গায় এই মেয়ে কানে হেডফোন গুঁজে বসে রয়েছে। তবে নীরব ও কম যায় না। সেঁজুতির কান থেকে ইয়ার ফোনটা নিয়ে নিজের কানে গুজে দিলো। যেখানে একটা ইংলিশ সং হচ্ছে, যা নীরবের পছন্দ হলো না। যখন তখন যা তা গান শুনতে ভালো লাগে না।
– ” কী সব গান শোনো, একটু কোথায় ভালো ভালো গান শুনবে তা না। কিসব ড্রিম, ক্রিম গান শুনছো।”
সেঁজুতি রাগী চোখে নীরবের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই ছেলেটার সাহস কম নয়। ওর জিনিসে হাত দিতে যেখানে সকলে ভয় পায় সেখানে এ কিনা ডাইরেক্ট কেঁড়ে নিয়ে নিলো। আর একটু আগে কী যেনো বললো, ওর বিয়ে! বিয়ে করবে তো ও তবে নীরবের ঘাঁড় যেইদিন মতকাটে পারবে সেই দিন।
– ” হেই সেঁজু, এতো রাগো কেনো? আমি কিন্তু এতটা রাগী না। তবে আমার বন্ধু খুব রাগী। তোমাকে টেক্কা দিয়ে চলে যাবে।”
গাড়ির সিটে সেঁজুতি জোরে একটা ঘুষি মারলো। বিড়বিড় করে বলে উঠলো সেঁজুতি, আবারও বিয়ে, অসহ্য। নীরব এই মুহূর্তে গান না শুনলে ঠিকই বুঝতে পারতো যে এই মেয়ে কী পরিমাণ রাগী।
নীরব তখনও বাইরে পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে। কানে চলছে নীরবের অপছন্দের গান। খানিকটা দূরেই নীরব আর ধীরের বাড়ি। ওখান থেকে সকলে বেরিয়ে আসছে। এক্ষুনি গাড়ি ছাড়বে। বিয়ের মণ্ডপে যেতেও তো সময় লাগবে। তপতীর বিয়ের ডেকোরেশন যেখানে হয়েছে সেটা এখান থেকে প্রায় 20 কিমি। নীরবের কানে বাজতে থাকা গানটা শুনে নীরব বললো, ” এতক্ষণে একটা ভালো গান এলো। নীরবও গানটা গেয়ে উঠলো,
” এক মুঠো স্বপ্ন এসে ছুঁয়ে যায় সারাক্ষণ চেয়ে থাকি আমি তার আশায়। একমুঠো ইচ্ছে রাখি লুকিয়ে হৃদয়ে, হয়না সাজানো ভালোবাসা…….. ভালোবাসার এ কী জ্বালা।”
গানের প্রতিটা শব্দের উচ্চারণের মাঝেই যেনো নীরবের চোখ দুটো কোথাও একটা আটকে গেলো। হ্যাঁ ইচ্ছের দিকেই আটকেছে। দক্ষিণী রমণীর ন্যায় তার পরনে কাঞ্জিভরম শাড়ির পাশাপাশি সেখানকার স্টাইলের গহনা। সিঁথি ভর্তি সিঁদুর পড়ে চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপা করা। নীরব খানিক দূর থেকেই বুঝেছে এটাই ইচ্ছে।
কথায় বলে তোমার স্পেশাল মানুষটা যখন তোমার চোখের সামনে আসে তখন তোমার অনুভূতি হয় কেমন যেনো একটা। ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তবে নীরব বোধহয় অনুভব করতে পারছে। তবে এই অনুভূতি কতোটা ঠিক কে জানে? হাঁ করে তাকিয়ে থাকা নীরবকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল সেঁজুতি। ভূত দেখলো নাকি, এই রকম ভাবে বাইরে কাকে দেখে এই ছেলে?
– ” এই যে শুনুন দাদা, কিছু কি হয়েছে আপনার? ”
নিজের বুকের বাম দিকের পাঞ্জাবির খানিক অংশ মুঠোয় ভরে নেয় নীরব। সেঁজুতির কথায় বলে, ” হয়েছে, কঠিন এক রোগ হয়েছে আমার। কই আগে তো কখনো এমনটা হয়নি, এই কদিন ঠিক কী এমন হলো? এটা কি ম্যাজিক? ”
– ” কী ম্যাজিক?”
– ” আমার দৃষ্টির অর্ধেকের বেশি অংশ যেনো ব্লার। শুধু সেই দৃশ্যমান। এ কী করে হয় বলো? তবে তুমি খুকি বুঝবেনা। ”
সেঁজুতি রাগী চোখে নীরবের দিকে তাকালো, ” কী বুঝবোনা? আমি কি বাচ্চা নাকি যে বুঝবোনা! ”
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো নীরব। একটু সামনে এগিয়ে গিয়েও পিছিয়ে এসে বলে গেলো, ” ভালোবেসেছ কোনোদিন?” বলেই হাওয়া।
তপ্ত শ্বাস ফেললো সেঁজুতি। ভালোবাসা আবার কী? ভালোবাসার সারমর্ম বোঝার মত ক্ষমতা তো ওর নেই। আসলেই নেই। সামনের সিটে নীরবের রেখে যাওয়া ইয়ার ফোন কানে গুজে নিলো ও। বিরবির করে বললো, ” ভালোবাসার সূক্ষ্ম অনুভূতি যদি আমি অনুভব করতে পারি, তাহলে বুঝবো আমিও ভালোবাসতে পারি।”
——————————————————————
বসন্তের বিকেল আর দারুন মিষ্টি হাওয়া দেবে না তাই বুঝি হয়, হয় না। ঝড়ের গতিতে গাছের পাতা গুলো নড়ে চলেছে। ইচ্ছের একদিকে এই হাওয়া ভালো লাগছে তো অপর দিকে ইচ্ছের শাড়ির তা ভালো লাগছে না। পতাকার ন্যায় উড়ে চলেছে। কিছুতেই এই আঁচলটা কে সামলাতে পারছে না ইচ্ছে। আর ইচ্ছেই এই কষ্টটা নীরবের ঠিক সহ্য হলো না। তাইতো ছুটতে ছুটতে ইচ্ছের কাছে এসে ইচ্ছের উড়ন্ত আঁচলটা ধরে ইচ্ছের কাঁধের অপর পাশে ফেলে দেয়। চমকে ওঠে ইচ্ছে, নীরবও তাকায় ওর দিকে। এই দৃষ্টিতে ছিল ভালোবাসার অনুভূতির অজস্র মেলা, অজস্র প্রজাপতি।
– ” কী করছিস এখনও, চল গাড়ি ছাড়বে তো।”
ঘাড় নাড়ে ইচ্ছে। এগিয়ে যায় গাড়ির কাছে। তবে নীরবের মনটা কেমন যেনো অশান্ত হয়ে যায়। মন বলে ওঠে একবার এই রমণীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু নীরব তো তা পারবে না। আদৌ এটা ভালোবাসা কি ও তো ঠিক জানে না। তবে সূক্ষ্ম অনুভূতির হাত বাড়িয়ে নীরব ইচ্ছের হাত ধরে সামনে হাঁটা দেয়। শুধু পারে না একবার জড়িয়ে ধরতে।
( চলবে )
{ বিঃ : ভালোবাসা বুঝি হয়েই গেছে। আর সেঁজুতি কে নিয়ে ভয় নেই। ওর জন্যে অন্য একজন আছে। তবে সেটা নিরালায় ভালোবাসি গল্পে না। অন্য নামের এক গল্পে ওর দেখা পাওয়া যাবে। তাই চিন্তা নেই। আর ইচ্ছে কোনো দিন কথা বলতে পারবে কি? এর উত্তর সময় বলবে। তবে এটুকু বলা যায় যেটা ইচ্ছের সাথে ম্যাচ করা উচিত তাই হবে। হ্যাপি রিডিং}