নিরালায় ভালোবাসি পর্ব-১৬

0
644

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
১৬ .

– ” এ কী দাদা, গাড়িটা এই রাস্তা দিয়ে কেনো নিয়ে যাচ্ছেন? শর্টকার্ট দিয়ে গেলেই তো ভালো হতো।”

গাড়ি ভর্তি সকলে হাহা করে হেসে ওঠে। ধীরের এক বন্ধু তো বলেই দেয়, বিয়ে করার জন্যে কি তোর আর তরসইছে না? এই দাদা আপনি যেখান দিয়ে যাচ্ছেন সেখান দিয়েই চলুন। পারলে আরও আধা ঘন্টা লেট করে চলুন। আমরাও সকলে একটু দেখি বন্ধুর কষ্ট।

আবারও গাড়িতে হাসির রোল পড়ে গেলো। তারা সকলে বিয়ে দিতে চলেছে। যে রোড দিয়ে যাবার কথা সেই রাস্তা দিয়ে কেনো যে নিয়ে যাচ্ছে না, তাতেই টেনশন ধীরের। যদিও বা এই গাড়িটা বোধহয় একাই এই রোড দিয়ে যাচ্ছে। বাকি গাড়ি গুলো শর্টকার্ট রাস্তা দিয়েই নিশ্চয় যাবে! কিন্তু ধীরের ভাবনাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে গাড়ির ড্রাইভার বলে উঠলো, শর্টকার্ট রোডে তো কাজ চলছে। তাই সব গাড়ি এইখান দিয়েই যাচ্ছে।

– ” কী? ”
– ” হ্যাঁ স্যার, এই রোড দিয়েই আমাদের যেতে হবে।”

থেমে গেল ধীর,তারমানে ইচ্ছেও এক রোড দিয়েই যাবে। কিন্তু ইচ্ছে যদি ভুলেও এই রোড, সেই বাড়িটার টের পায় তবে তো, না না কি হবে এবার? ধীরের খুব রাগ হয়। নিজের উপর নয়, তপতীর বাবার উপর। কতো করে বলেছিল, বিয়েটা যেনো বাড়ি থেকে দেওয়া হয়। কী দরকার আধা ঘণ্টার রাস্তা ছেড়ে তিন ঘণ্টা জার্নি করার। কিন্তু রিটায়ার আর্মি অফিসারের ইচ্ছে বিয়ের জন্যে বড়ো একটা লজ তো ভাড়া করতেই হবে। ধীর মাঝে মাঝে ভেবে পায় না, ওর বোনের নামের সাথে মানুষের অদ্ভুত ইচ্ছের কী দরকার। যার নাম ইচ্ছে সেই নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করবে। বাকিরা কেনো করবে। এখন তো তার জন্যে ওর চিন্তা হচ্ছে নাকি।
—————-

সকল বরযাত্রী বিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করেছে। বিয়ে এখনও শুরু হয়নি। রাত আটটা নাগাদ বিয়ের লগ্ন। নীরব দের গাড়িটা সবার শেষে লজের সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। চারিদিকে নানান লাইটের কারুকার্যে সকলের পোশাক থেকে শুরু করে শরীরের রঙটাও সেই রঙের ন্যায় হয়ে গিয়েছে। নীরব ইচ্ছেকে রাস্তার এক ধারে দাঁড় করিয়ে সামনের দিকে কিছু কারণে গিয়েছে। সেঁজুতি পাশের এক অজ্ঞাত ব্যক্তির রয়েল এন্ড ফিল্ড গাড়িতে বসে বসে ইচ্ছে কে দেখছে। নীরব যাওয়ার আগে ওকেই দায়িত্ত্ব দিয়েছে ইচ্ছেকে যেনো দেখে রাখে।

– ” ইচ্ছে দি!”

পিছন ফিরে সেঁজুতির দিকে তাকায় ইচ্ছে। চোখের ইশারায় জানতে চায় , কিছু বলবি?

– ” বিয়ে করার জন্যে এই ঘাড় তেঁড়াকেই পেলে। পৃথিবীতে কতো সুন্দর সুন্দর ব্যাক্তি রয়েছে। যেমন, এই যে আমি যে এই গাড়ির উপর বসে রয়েছি, এই লোকটাকেই দেখো না। ওই যে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে কিন্তু দেখতে পাচ্ছে এক অচেনা মেয়ে এই গাড়িতে বসে রয়েছে। কিন্তু সে কিছুই বলছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ”

সেঁজুতির দেখানো পথে ইচ্ছে তাকালো কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না। তবে সেখানে যে কেউ ছিল তা কিছুক্ষণ আগেই ইচ্ছে তের পেয়েছে।

– ” ওই এসে গেছে তোমার বর, সরি বর্বর। ”

– ” আমি বর্বর নয়, তোমার বর হবে বর্বর। রোজ মদ খেয়ে এসে তোমাকে ঠাঙ্গাবে, তোমার শাশুড়ি তোমাকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করাবে। আমি তোমার বরকে বলে দেবো, তোমাকে যেনো সবসময় মারের মধ্যে রাখে। তাহলেই তখন বুঝবে, কে বর, আর কে বর্বর! ”

নীরবের কথায় সেঁজুতি হাঁ করে নীরবের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ ফুলিয়ে নিলো। যে বিয়ে করবে না তার বর কিনা বর্বর। হুই।

নীরব ইচ্ছের হাত ধরে সামনে হাঁটা দিলো।
-“ইচ্ছে চল এখান থেকে।” একবার পিছন ফিরে সেঁজুতি কে বললো, “আর এই যে বর্বর পত্নী বর্বরি যাও ভিতরে যাও। এখন থেকে দেখে রাখো কিভাবে বিয়ে হয়। ”

নীরব, ইচ্ছের যাবার দিকে তাকিয়ে সেঁজুতি বসে থাকা প্রিয় গাড়ির মিররের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠলো, ” ফালতু লোক।”

– ” এই যে মিস!”

কারোর ডাকে পিছনে ফিরতেই কারোর রাগী চোখ দেখে সেঁজুতি ভয় পেলো না, তবে বিস্মিত হয়েছে বটে। এই লোকটি আর কেউ নয় এই গাড়ির মালিক।

– ” গাড়ি থেকে আপনি নেমে দাঁড়ালে আমার খুব ভালো লাগতো। সো প্লিজ,”

ছিটকে সরে দাঁড়ালো সেঁজুতি। হুট করেই লোকটাকে বড্ড ভয়ংকর লাগছে। মনে হচ্ছে এক নিমেষে কাউকে খুন করতেও পিছু পা হবে না। লোকটি কোনো কথা না বলেই গাড়ি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। মুখে তার বিরাজ করছে এক ভয়ঙ্কর হাসি, যে হাসিতে কারোর জন্যে মুগ্ধতা না, রয়েছে গভীর এক রহস্যের গন্ধ।
———–
নীরব আর ধীর যেই মুহূর্তে বিয়ের আসরে গেলো, তখন মালা বদল হচ্ছে। ধীর খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে তপতীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, আসলে মনে মনে বড্ড তার লজ্জা লাগছে। প্রেয়সিকে বুঝি এতো লোকের ভিড়ে প্রাণ খুলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখা যায়। হয়তো হুট করেই কেউ এখন বলে উঠবে, এতো দেখিস না, তোরই বউ। তপতী লাজুক দৃষ্টিতে একবার ধীর কে দেখে চোখের পাতা নামিয়ে নিলো। হুট করেই যেনো বুকের মাঝে কেমন একটা হচ্ছে। বিয়েটা পারিবারিক ভাবে ঠিক হলেও, দুজনেই দুইজনকে ভালো মতো চিনে নিয়েছে। একে একে বিয়ের প্রতিটা অনুষ্ঠান প্রায় শেষের পথে। নীরব ইচ্ছের হাত ধরে বিয়ের মণ্ডপের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইচ্ছের অপর পাশে রয়েছে সেঁজুতি।

– ” ইস, এখন মনে হচ্ছে বিয়েটা এই ভাবে ধুমধাম করে করলেও হতো। কী বলিস? ”

নীরবের কথায় ইচ্ছে বেশ লজ্জা পেলো। তবে সেঁজুতি ফট করে বললো, হ্যাঁ করুন না কে মানা করেছে। তবে ইচ্ছে দি কে আপনাকে আর দেবো না। আপনি ঠিক মত তার খেয়াল রাখেন না।

খেঁপে গেলো নীরব, ইচ্ছের হাত ধরে ওকে ওর অপর পাশে জড়িয়ে ধরে বললো, বললেই হলো। আমার বউ আর আমারই থাকবে। তুমি বেশি ফটর ফটর করো না। না হলে কাউকে একটা ধরে এই মুহুর্তেই তোমার গলায় তাকে ঝুলিয়ে দেবো। দেন আমি বলবো, বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা। সরি ওটা বাঁদরী হবে।

নীরবের কথায় প্রতিবারই সেঁজুতি হেরে যায়। এই বারেও তাই। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু এই সবের মাঝেও ইচ্ছের কী হলো কে জানে। নীরবের এতক্ষণ জড়িয়ে থাকায় অসম্ভব ভালো লাগা তৈরি হলো। আবেশে নীরবের এক হাত জড়িয়ে ধরলো। নীরব ভাবছিল ইচ্ছের কথা। এতো দিনে এটুকু ও বুঝেছে ইচ্ছেকে ছেঁড়ে ও থাকতেই পারবে না। আর আলাদা হবার চিন্তা অনেক দূর। হঠাৎই ইচ্ছের হাত জড়িয়ে ধরায় নীরবের কী হলো কে জানে। ইচ্ছের মাথায় পরম যত্নে, পরম অনুভূতির সংমিশ্রণে নিজের অধর স্পর্শ করলো। আর ইচ্ছে সে তো কেঁপে উঠলো। যা দেখে নীরব না হেসে পারলো না।

————

বিকেলের এক ঝড়ো হাওয়ার মাঝে ইরার সঙ্গে ইচ্ছে ছাদের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা সপ্তাহ হলো নীরবকে ঠিক মতো কাছেই পায় না সে। নীরব কেমন যেনো অন্যরকম হয়ে গেছে। ইচ্ছেকে দেখেও যেনো দেখে না। এই যে ইচ্ছে আজ নিজের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে নীরবের বারান্দার দিকে তাকিয়ে নীরবকে দেখছে, সেই খেয়াল বোধহয় নীরবের নেই। হয়তো ও জানেও না যে ইচ্ছে কাল রাতে এই বাড়িতে এসেছে। এখনও ফিরে যায়নি। নীরব হয়তো এটাও ভুলে গেছে ইচ্ছে এই কদিনের মতো হাসি খুশি আর নেই। হারিয়ে গিয়েছে আগের অন্ধকারে। অথচ সেই বিয়ের রাতে নীরবকে মনে হয়েছিল সে হয়তো ইচ্ছেকে খুব খুব ভালোবাসে। কফি কাপে চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালো নীরব। রেলিঙে হেলান দিয়ে প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে উঠল ইচ্ছের সঙ্গে কাটানো সময় গুলো। এই বারান্দায় তারা দুজনে এই দুই মাস কতো স্মৃতি কাটিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরব। মন বলে সত্যের মুখোমুখি না হলেই তুই পারতিস নীরব। যদিবা হলি আবেগে ভেসে যাবার পর। তলিয়ে যাবার আগে উঠে আয়, সেইটাই বোধহয় ভালো।

ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা ইচ্ছের চোখে চোখ পড়তেই ঘুরে গেলো নীরব। কিন্তু ইচ্ছে সে তাকিয়ে রইলো নীরবের দিকে। শব্দহীন অনুভূতি গুলো বলে উঠলো ,

“আমার হৃদয়ের লুকানো বারিধারার স্রোত তোমাতেই আবদ্ধ। তোমার হৃদয়ের খরস্রোতা নদী আমি। ভালোবেসে যত্ন করে আগলে রাখতে পারো না! কষ্ট দিতে বুঝি ভালো লাগে? তুমি কি বোঝো না আমারও কষ্ট হয়!”

(চলবে)

{ শরীর অসুস্থ ছিল। তীব্র মাথা ব্যাথায় গল্প লেখা সম্ভব ছিল না। দুঃখিত}

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here