নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
২০ .
– ” বাবু তুমি এমন কেনো করো? ”
– ” কী করি? আমি তো তোমার সোনা ছেলে। আমি তো এখন খেলি।”
দ্বীপ নিজের বল নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে। বারবার ইচ্ছে করে গেটের দিকে বল ছুঁড়ে দিচ্ছে। আবার সেটা আনতে ছুটছে। যা নিহির একদম পছন্দ না। নিহি খুব ভালো মতোই বুঝেছে যে, দ্বীপ বাইরে যেতে চাইছে। এই ছেলে বাড়িতে থাকতেই চায় না। অন্যদিন দ্বীপ ওর দাদুর সাথে ঘুমালেও আজ সে ঘুমায়নি। বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এই ভর দুপুর বেলা এমনিই রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকে। তার উপর মাঝে মাঝেই সামনের রাস্তা দিয়ে বাস, লরি চলছে।
নিহি ভালো করে ছেলের উপর নজর রেখেছে যাতে বাইরে না যায় কিন্তু এই ছেলেকে বিশ্বাস নেই। হয়তো দেখা যাবে কয়েকদিন আগের মতো আবার বাইরে বেরিয়ে যাবে। নিহি আর নিহির ছেলে নিহির বাবার বাড়িতেই থাকে। সেই ঘটনার পর থেকেই নিহির মনটা ভেঙে গেছে। যাকে এতটা ভালোবেসেছিল সেই কিনা ওর আড়ালে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে। সেই মেয়েটার জীবন পর্যন্ত নষ্ট করে দিয়েছে। অথচ নিহিকে কমফোর্ট এর মধ্যে রেখেছিল। এমন তো নয় যে সে নিহিকে ভালোবাসে না কিংবা নিহির সঙ্গে থাকতে পারছে না। তাহলে বিয়ে করার দরকার কী ছিল? ওই মেয়েটার জীবন কি ফেলনা!
তবুও বাস্তবতার দিক দিয়ে, এইসব কিছুর পরেও নিহি ফিরে যেতে চেয়েছে সুবীরের কাছে। নিজের জন্যে না অন্তত ছেলেটার জন্যে। সুবীরের স্ত্রীর মর্যাদা সে আর রাখতে পারবে না। তবে সুবীরের সন্তানের মা তো তাকে সারাজীবন থাকতে হবে। কিন্তু দ্বীপ নিজেই যেতে চাইছে না। দ্বীপ যতবারই সুবীরকে দেখছে ভয় পাচ্ছে। কিছুতেই সে সুবীরের কাছে যেতে চায় না। এর কারণ নিহি জানে না। কী জন্যে এতো ভয়! ইচ্ছের ঘটনাটা তো সুবীরের মা করেছিল। তবে ওর ঠাম্মি কে ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু ও বাবাকে কেনো ভয় পায়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিহি কিছুতেই পাচ্ছে না। তবে কি ওর জানার আড়ালে অন্য কিছু আছে?
দ্বীপ কিছুক্ষণ পরে আবারও গেটের দিকে বলটা ছুড়তে সেটা গিয়ে কারোর গায়ে আঁছাড় খেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। দ্বীপ বলটা নিতে যেতে সামনে এগোলেও সামনের মানুষটাকে দেখে ভয়ে চোখ মুখ ঢেকে মায়ের পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো।
– ” মা একে যেতে বলো, আ..মার ভয় করছে।”
নিহি পিছন ফিরে দ্বীপকে কোলে তুলে নিলো। ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বললো, ” কী হয়েছে? এতো ভয় কীসের?”
কিন্তু দ্বীপ এতো পরিমাণে কাঁদছে যে অগত্যা নিহি দ্বীপকে নিয়ে বাড়ির ভিতরের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু সুবীরের ডাকে পরক্ষণেই থমকে দাঁড়ালো। তারমানে সুবীরকে দেখেই এতো ভয়!
– ” প্লিজ নিহি বাড়ি ফিরে চলো। বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি। কিন্তু, ”
নিহি পিছন ফিরলো না। প্রসঙ্গ ফিরিয়ে বললো, ” তুমি বাড়ি যাও। আমি ওকে বুঝিয়ে নিয়ে আসবো। ”
কাঠ কাঠ গলায় কথাগুলো বলে নিহি বাড়ির ভিতরে চলে গেল। আর সুবীরের তো খুশির অন্ত নেই। ইচ্ছেকে একটু কী টাইট দেবার প্রস্তুতি নিলো, এর মধ্যেই ওর স্ত্রী ওর কাছে ফিরে যাবার কথা বলছে। সুবীরের মন বলে উঠলো, কোনো মেয়েই তার স্বামীর সঙ্গে অন্যকে মেনে নিতে পারে না। আর যদি তারা দেখে যে সতীন তার কষ্টে আছে তবে তো কথাই নেই তারা আরও বেশি খুশি হয়। সুবীর বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। চোখ দুটো আনন্দে চকচক করছে। ভাবতেই তার আনন্দ হচ্ছে, নিহি যদি জানে যে ইচ্ছেকে কিভাবে কষ্ট দেবে বলে ঠিক করেছে ও। তাহলে নির্ঘাত নিহি খুশি হবে।
নিহি দ্বীপকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। ছেলেটা আজও ভয় পেয়েছে। কতো কষ্ট করে বুঝিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে ওই জানে। দ্বীপের অপর পাশে বসতেই ওর খেয়াল গেলো পাশের টেবিলের উপর। জায়গাটা এখন ফাঁকা, আগে ওই খানে ওদের তিনজনের একটা ফ্যামিলি পিক ছিল। কিন্তু সেই দিন দ্বীপকে হসপিটাল থেকে বাড়ি আনার পরপরই দ্বীপ ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। আর সেই ছবি ওখানে রাখেনি সে। নিহি হাত বাড়িয়ে টেবিলের মাঝের ড্রয়ারটা খুললো। ভিতর থেকে ছবির ফ্রেমটা বের করে আনলো। ছবিটার উপরের কাঁচ গুলো চিড় খেয়েছে, উপর উপর কয়েকটা কাঁচ ও উঠে রয়েছে তবে তা খুলে যায়নি। নিহি গভীর ভাবে ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক ওদের সম্পর্কের মতোই যেনো অবস্থা ফ্রেমটার।
°°°°°°°°°°°°
হসপিটালের পাশাপাশি দুটো কেবিনের একটায় ইচ্ছে আরেকটায় দ্বীপ রয়েছে। একজনের অবস্থা জীবন মরণের মাঝামাঝি। তো আরেকজন সেন্সলেস। নিহি সেই মুহূর্তে কী করবে ভেবে না পেলেও পরমুহুর্তে বুদ্ধি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আশেপাশের কয়েকজন মানুষকে ডেকে নিয়েই সে তাড়াতাড়ি হসপিটালে আসে। ইচ্ছেকে অপরেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়েছে ডক্টর। কিছুই তারা এই মুহূর্তে বলতে পারছে না। অপর দিকে দ্বীপ এর শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। পথে আসার সময় দুই বার বমিও করেছে সে। আসলে ওর ছোটো মাথাটা সেই মুহূর্তে দেখা ওতো রক্ত সহ্য করতে পারেনি। আপাতত ওকে পাশের কেবিনে ডক্টর চেক করছে।
পথে আসার সময় নিহি শুনেছে ওদের সঙ্গে আসা লোক দুটো বলেছিল যে , মেয়েটি নাকি সুবীরের স্ত্রী। আরে যা শুনে নিহির নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। নিজের উপরই ওর ঘৃণা হচ্ছে। শেষে ওর ভালোবাসার মানুষটাই কিনা ওকে ঠকালো।
– ” নিহি শোনো আমার কথা,,”
নিহির ভাবনার মাঝে কখন যে সুবীর ওর পাশে এসে বসেছে ও জানে না। তবে নিহি যখনই সুবীরকে ওর পাশে দেখলো সেখান থেকে উঠে চলে গেল। যা জানার তা ও জেনে নিয়েছে আর কিচ্ছুটি জানার নেই।
নিহির সাথে আসা লোকের মধ্যে একজন ইচ্ছের পরিবারকে খবর দিয়েছে। তারা এসে যাবে হয়তো! নিহির ভাবার মাঝেই ইচ্ছের বাবা, মা, দাদা সেখানে চলে আসে। বোনের খবর শুনে ধীর অসম্ভব রেগে ছিল। এমনকি পুলিশ অবধি সেখানে আসে। পাড়ার লোকেরা সুবীরের উপরে সোচ্চার হলে সুবীরের মা নিজে স্বীকার করেন যে সব কিছু তিনিই করেছেন।
সেই দিন দ্বীপকে সুস্থ্য করে বাড়িতে আনা গেলেও ইচ্ছের অবস্থা ছিল করুন। কাঁচের বেশির ভাগ অংশ ওর গলায় ফুটে গিয়েছিল। ডক্টর তো বাঁচবে আশা করতে অবধি পারছিল না।
কাঁচের উপর হাত লাগতেই ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো নিহি। পুরোনো কয়েকমাস আগের স্মৃতিটা ওর কাছে করুণ ছিল। হাতের রক্তগুলো নিহির কাছে ঠুনকো মনে হলো। এ আর এমন কী? এই থেকে অধিক রক্তাক্ত হতে ও কাউকে দেখেছে। দেখেছে মানুষটাকে নিজের সব হারাতে। নতুন করে শুরু করতেও দেখেছে। সে যদি পারে তবে নিহি কেনো পারবে না? অবশ্যই পারবে। অন্যায়ের সাথে কোনো আপস নয়।
———————————
ইরা অনেকক্ষণ ধরে ‘ পিকু ‘, ‘ পিকু ‘ বলে ডেকে চলেছে। আসলে ও ওর বোন-বন্ধুকে ওর উপর আকর্ষিত করতে চাইছে। কিন্তু, ইচ্ছে এক ধ্যানে দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পা ছড়িয়ে বারান্দায় বসে রয়েছে ও । কোলে মাথা দেওয়া ব্যাক্তিটি পরম শান্তিতে ওর কোলে ঘুমিয়ে রয়েছে।
ইচ্ছে নীরবের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। ইচ্ছে তো কাল এখান থেকে চলে যাবে তাই নীরব আজ ওর সঙ্গে সঙ্গেই থাকছে। এই যেমন ইচ্ছের কোলে মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছে।
ইচ্ছের আগের মতো আবারও ঘুম আসে না। ঠিক যেমন হসপিটালে ছিল। সেবার পঁচিশ দিন পড়ে যখন চোখ খুলে তাকিয়ে ছিল, ও ছিল হসপিটালের বেডে। এর আগেও ওর জ্ঞান ফিরেছিল কিন্তু ডক্টর ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রেখেছিল ওকে। জ্ঞান ফিরে ইচ্ছে নিজের সামনে নিজের পরিবার, নীরবের মা কে দেখলেও দেখেনি কেবল নীরবকে। খারাপ লেগেছিল খুব। কিন্তু পর মুহুর্তেই মনে পড়েছিল যে এখন ও বিবাহিত। বর্তমানে সে তার স্বামীর কাজে এই হসপিটালের বেডে। খারাপ লাগা কমেছিল। বেড়েছিল অভিমান। কিন্তু সেই অভিমান ও স্থায়ী হলো না, যখন বুঝলো গলার স্বর বাইরে প্রকাশিত হচ্ছে না। শব্দগুলো গলার মধ্যেই ফিরে যাচ্ছে তখন তাচ্ছিল্য এসেছিল নিজের প্রতি। যা এখনও ইচ্ছে নিজের মধ্যে জমিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝে ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, কষ্ট গুলোই আমায় ছুঁয়েছে, সুখগুলো কী তবে আমাকে ভীষন রকম অপছন্দ করে? তাই হয়তো পাশেই ঠিক ভাবে ঘেঁসে না।
নীরব হালকা করে নরে উঠলো। ইচ্ছে সেই দিকে তাকিয়ে নীরবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ও এই মানুষটাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু মানুষটা ওকে পছন্দও হয়তো করে না। তাই না? ঘাবরে গেলো ইচ্ছে, সত্যিই কি পছন্দও করে না? নাকি জানার বাইরেও কিছু কথা থাকে?
( চলবে )