নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
২৩ .
সুবীরদের বাড়িটা বহু পুরোনো। কিন্তু রেনোভেট করে নেওয়ায় দেখলে মনে হয় না বাড়িটা সুবীরের বাবার দাদুর আমলের। তাই হয়তো নীরব কিংবা রজত কারোরই ধারণা নেই যে এই বাড়িতে গোপন একটি ঘর পর্যন্ত রয়েছে। তারা তো এক নাগাড়ে প্রতিটা ঘর দেখে চলেছে। কিন্তু ইচ্ছে তো দূর সেখানে কোথাও সুবীরের টিকি অবধি দেখা যাচ্ছে না। নীরব তিন তলা পুরো দুইবার চক্কর দিয়ে দোতলায় এলো। রজত তখন একটা দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে।
– ” রজত তোমরা ঠিক দেখেছো তো, ইচ্ছেকে এই বাড়ি তেই কী আনা হয়েছে? ”
– ” আরে হ্যাঁ রে বাবা। এই বাড়ির মধ্যেই তো সুবীর ইচ্ছেকে রেখে কোথায় একটা বেরিয়ে গেছে। এতক্ষণে ফিরেছে কিনা তাও জানি না।”
ভাবনায় পড়ে গেলো নীরব। একটা বাড়িকে এতবার খোঁজার পরেও তাকে দেখা যায় না কেনো?
– ” নীরব!”
রজতের ডাকে ঘোর ভাঙলো নীরবের। কপালের ঘাম টুকু মুছে বলল, ” হ্যাঁ, কিছু বলবে?”
– ” বলছি এক টা বিষয় কী খেয়াল করেছো? এখানের প্রতিটা ঘর সাউন্ড প্রুফ। ঘরে কথা বলার ফিসফাস শব্দ গুলো এখানে নর্মাল শব্দের মতো মনে হচ্ছে। কিন্তু বাইরে না সেই শব্দ যাচ্ছে, আর না বাইরে থেকে ভিতরে শব্দ আসছে।”
– ” তাই তো দেখছি। ” পরমুহূর্তে নীরবের , ইপশির কথা মনে পড়লো। পরমুহূর্তে ভাবলো ওকে হয়তো রজত গাড়িতে রেখে এসেছে। সেই ভেবেই নীরব জানতে চাইলো, ” ইপশি কোথায় ?”
– ” ইপশি নীচের ঘর গুলো দেখছে।”
– ” তুমি কি পাগল হয়েছ রজত? ওকে তুমি এখানে নিয়ে এসেছ?? ”
– ” কিছু করার নেই, আমার কথা শোনেনি। তাই আনতে হলো। চলো আমরা বরং নীচে যাই। এখানে তো কাউকেই দেখছি না। ”
——————————
ইপশি নীচের ঘর গুলো খোঁজার মুহূর্তে বাইরে দরজার আওয়াজ পায়। ইপশি তখন হলঘরের দিকেই আসছিল। বাইরের আলোয় সুবীরকে দেখে বেচারী ভয় পেয়ে কোথায় পালাবে ঠিক করতে পারে না। ছুটে চলে যায় সিঁড়ির তলার দিকে। কিন্তু সুবীরের বুটের আওয়াজ গুলো ওর দিকে আসছে দেখে প্রচণ্ড ভয়ে ও ফ্রিজের পিছনে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সুবীর ফ্রিজের দিকেই এগিয়ে যায়। ভয়ে হাত পা কাঁপতে থাকা ইপশি বলে দিতেই যাচ্ছিল, আমার কিছু করবেন না, আমি কিছু জানি না। কিন্তু তার আগেই সুবীর ফ্রিজের মাথা থেকে চাবির গোছাটা নিয়ে একটা দরজা খুলে ভিতরে চলে যায়। ইপশি অবাক হয়ে সেই ঘরের দিকে তাকালে প্রথমে ভুতুড়ে ঘর মনে হলেও পরে চোখে পড়ে ইচ্ছে কে। আস্তে আস্তে ওই লুকানো জায়গা থেকে বাইরে বেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে ও। একবার ভেবেছিল রজতকে ইনফ্রম করবে। কিন্তু তার আগের সুবীরের কথা শুনে নিজের বুদ্ধি মত্তার পরিচয় দিয়ে সুবীরের বলা প্রতিটা শব্দ মুঠোফোনে বন্দি করে। ও চাইলেও পারে না সেই মুহূর্তে ইচ্ছেকে বাঁচাতে। কিন্তু সুবীরের বলা শেষ কথা টুকু ওর আর সহ্য হয় না। আচমকাই সে গিয়ে একটা লাথি মারে সোফায়। যার দরুন খুব তাড়াতাড়ি পতন হয় সুবীরের।
সুবীর বুঝতে পারে না হুট করে কী করে ও পরে গেলো। পড়ে নিজেই বিটকেলে হেসে ওঠে।
– ” আমি জানতাম তো নীরব বাবু এখানে ঠিক আসবে। আর এলো ও,…..”
পিছন ফিরতেই থেমে যায় সুবীর। এই অচেনা মেয়েটি কে? কিন্তু ভাবনা তার বেশিক্ষণ টেকে না। তার আগেই ভাঙ্গা সোফার একটা কাঠ নিয়ে অচেনা মেয়েটির হাতের মার খেতে থাকে। আর ইচ্ছে, সে তো অবাক হয়ে ইপশির দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই ন্যাকা স্বভাবের মেয়েটি কিনা ওকে বাঁচাতে এসেছে। তাও এতো রাতে, একা! নাকি সঙ্গে আরও কেউ আছে। নীরব! তার মানে নীরব কী এসেছে? কথাটা মাথায় খেলতেই চট করে সিদ্ধান্তে যায় ইচ্ছে। অসম্ভব, নীরব এখানে আসতে পারে না। সে তো আর ইচ্ছে কে চায় না। যে এতো রাতে এইখানে এসেছে ইচ্ছেকে বাঁচাতে। কখনো ই সম্ভব না।
ইচ্ছের ভাবনার মাঝেই ইপশি এসে ইচ্ছের কাঁধে হাত রেখে হুড়মুড় করে বলে দিলো,” ইচ্ছে ওঠো, চলো আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে। ”
সুবীর তখন মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। ইপশি কম করে ঘা পঁচিশ তো ওকে মেরেইছে। ইচ্ছে তখনও নির্বিকার চিত্তে ইপশির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ইপশি পুনরায় ইচ্ছেকে ঠেলা মারলো ওঠার জন্যে। কিন্তু ইচ্ছে সেই জায়গায় বসে মাথা নাড়লো, ও এইখান থেকে কোথাও যাবে না। কিছুতেই যাবে না। আজ না হয় ও মৃত্যু স্বাদই নিলো।
ইচ্ছেকে যাবার কথা বলতে বলতে ক্লান্ত ইপশি এবার কেঁদে দিলো। ওর ধারণা ও সেই দিন ইচ্ছেকে অপমান করেছিল তাই ইচ্ছে ওর উপরে খুব রাগ করেছে। ইপশি কে নিয়ে কেউ হাসলে, কেউ বকলে, কেউ যদি ওকে মারেও তাও ওর সহ্য হয়। কিন্তু কেউ যদি ওর উপর রেগে থাকে , কথা বলতে চায় না, ইগনোর করে তবে ওর ভীষন কষ্ট হয়। চোখ দুটো তখন ছলছল করে ওঠে। তখন চোখের জল গুলো ইপশির সঙ্গে বেইমানি করে। ওর কোনো শাসানি, বারণ শোনে না। গাল বেয়ে ঝরে পড়ে।
– ” আমি সেই দিন তোমায় অমন করে বলে ছিলাম বলে তুমি আমার উপর রেগে আছো না ইচ্ছে! আমি জানি আমি খারাপ। কোথায় কি বলতে হয় জানি না। কাকে কি বললে সে দুঃখ পাবে বা সে হাসবে আমি তা জানি না। কিন্তু এর জন্যে তুমি নিজের ক্ষতি করো না। আমার জন্যে কারোর কোনো ক্ষতি হোক সেটা আমি চাই না। আর তুমি বিশ্বাস করো আমি সেইদিনের জন্যে তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি ছিলে না। এইবার অন্তত চলো।”
একসময়ের দুষ্টু মিষ্টি শত্রুকে যদি এমন ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে দেখা যায় তবে আশ্চর্য্যের বেশি হাসি পাবে। ইচ্ছের ও হাসি আসছে। ইপশি পাশে তাকিয়ে দেখলো সুবীর ওঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে প্রতিবার। ইপশির কান্নার মাঝেও হাসি পেলো। জীবনে একটা কাজের কাজ করেছে। ওর মা শুনলে আর নিশ্চয়ই বলবে না,” উদ্ধার করে দিয়েছো। ”
– ” আরে ইচ্ছে চলো না। আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগছে এখানে। আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোমাকে
সরি বলছি। এইবার তো চলো।”
ইচ্ছের কী হলো কে জানে? ও উঠে দাঁড়ালো। নিজের জন্যে না হোক অন্তত এই অবুঝ মেয়েটির জন্যে। ইচ্ছে ভালোই বুঝেছে, এই মেয়েটা ওকে ছাড়া কোথাও যাবে না।
– ” ইচ্ছে চলো, তোমার কোনো চিন্তা নেই। সুবীর আর তোমার কিছু করতে পারবে না। এইবার ও শুধু জেলের চালের কাঁকর বাছতে পারবে। আমি সব রেকর্ড করে নিয়েছি চলো। ”
ইচ্ছের হাত ধরে বাইরের দিকে ছুটলো ইপশি।
নিজের এতো কষ্টের প্ল্যান বিফলে যাওয়ায় একেই তো ক্ষেপে ছিল সুবীর। সেই ক্ষোভে যোগ হলো, ইপশির শেষ কথা গুলো। পা এবং কোমরের ব্যথা কে অগ্রাহ্য করে ইচ্ছেদের পিছু নিলো সুবীর।
ইপশি তখন বাইরের দরজা খুলছিল। সুবীর ইচ্ছের হাত ধরে টান দেবার চেষ্টা করলো। সেই মুহুর্তে সুবীরের মাথার চুলগুলো টেনে ধরলো নীরব। প্রচণ্ড ক্ষোভে গমা গম করে এক একটা ঘুষি পড়তে লাগলো সুবীরের মুখে, পেটে। যত ক্ষোভ ছিল সব বের করতে লাগলো নীরব। সুবীর ও যথা সম্ভব নীরব কে প্রতিহত করতে লাগলো। কিন্তু নীরবের সঙ্গে সুবীর ঠিক পেরে উঠছে না। এলোপাথাড়ি মার সুবীর আর কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। হাতের সামনে থাকা ছোটো দেওয়াল ঘড়িটা নীরবের কপালে আঘাত করলো। আচমকা আক্রমণে নিজেকে বাঁচানোর যথা সম্ভব চেষ্টা করলেও বেশ গভীর ভাবেই মাথাটা কেটে যায় নীরবের। তাও সুবীরকে ছাড়ে না নীরব। কিন্তু সুবীর নিজেকে কোনোমতে নীরবের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। রজত তখন পুলিশ নিয়ে ভিতরে চলে এসেছে।
– ” ইউ আর অ্যান্ডার অ্যারেস্ট সুবীর বাবু। ”
রজতের কথায় পাগলের মতো হেসে উঠে সুবীর। এই হাসি কোনো পাগলের হাসি না। এই হাসি ধূর্ততার। সকলকে হকচকিয়ে দেওয়ার একটা টেকনিক। আর সেই কাজটাই সুবীর করলো। পাশে থাকা ইপশির হাত থেকে ছো মেরে ফোনটা নিয়ে পিছু হটতে থাকে। ফিচেল হেসে বলে, ” সম্ভব না আমাকে ধরা। ”
সেই মুহূর্তের ধাক্কা খায় কারোর সঙ্গে। নিহি, সুবীরের পিছনে দাঁড়িয়ে। তার পাশে ধীর। নিহির চোখ মুখ কঠিন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে হাহাকারে মরে যাচ্ছে যেনো।
– ” আজ সকালে দ্বীপ কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে তার বাবাকে কেনো এতো ভয় পায়? ও বললো, ‘বাবা তো বাজে, ইচ্ছে দিদিকে মেরেছে। জানো মা, কতো রক্ত বেরোচ্ছিল। ‘ বুঝলাম ছেলেটা না চাইতেও তার বাবার কৃতকার্য দেখেছে। আমি চাই না আমার ছেলেটা কোর্টে এক ঘর লোকের সামনে সাক্ষী হিসেবে দাঁড়াক। আমি চাই না দ্বীপ তার বাবার জন্যে নিজের মধ্যে কোনো অনুশোচনা রাখুক। কিন্তু আমি ইচ্ছের প্রতি অন্যায় হতে দেখতেও পারবো না। তোমার অন্যায় মেনে নিয়ে বাঁচা আমার পক্ষে সম্ভব না। অনুশোচনায় আমি রোজ দগ্ধ হই। এইবার তুমি বাবা হিসেবে ভাবো তোমার ছেলেকে কী আমি কোর্টে নিয়ে গিয়ে হাজির করবো! নাকি নিজের কৃত কর্মের শাস্তি তুমি নিজেই গ্রহণ করবে! ”
ছলছল চোখে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকায় সুবীর। কান্না ভেজা চোখে পুলিশের নিকট নিজেকে স্যারেন্ডার করে সে। কোনো বাবাই হয়তো নিজের ছেলে মেয়ের চোখে নিঁচু হতে চায় না। সুবীর ও পারলো না। এমনিই তো তার ছেলে ওকে দেখে ভয় পায়, কান্না করে। কিন্তু এখন যদি আত্মসমর্পণ না করে তাহলে হয়তো ঘৃণা করবে।
( চলবে)
{ বিঃ : সবাইয়ের কথায় আমি আজ সকালে এই পর্বটা দেবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু হুট করেই অ্যালার্জির জন্যে লেখাই হয়নি। তাও নাকে মুখে রুমাল বেঁধে এই পর্বটি লিখলাম। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।}