নিরালায় ভালোবাসি পর্ব-৪

0
810

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
৪ .

কয়েক গুচ্ছ ফুলের মালায় ঘেরা বিছানায় বসে রয়েছে ইচ্ছে। লাজুক নববধূর ন্যায় মুখে তার লজ্জার আভা টুকুও নেই। আছে কেবল ভয়; অজানা এক ভয়। যেই ভয়ে থেকে থেকেই কেঁপে উঠছে ও। ঘরে নীরবের দেখা এখনও পাওয়া যাইনি। বাইরে থেকে কিছু আত্মীয়ের হাসাহাসির আওয়াজ ভেসে আসছে ইচ্ছের কানে। গতকালই নীরব ও ইচ্ছের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। খুব সহজ ভাবেই সব হয়েছে, বিয়েতে যাদের না বললেই নয় তাদেরই কেবল বলা হয়েছিল। তাও কেবল পাড়া প্রতিবেশীদের।

হঠাৎই দরজা খোলার শব্দ পেয়ে চমকে উঠলো ইচ্ছে। মাথা তুলে দেখলো নীরব এসেছে। পরনের শেওয়ানী টায় ওকে বেশ ভালোই মানিয়েছে। ইচ্ছে ওকে ভালোকরে হয়তো এখনই দেখলো। নাহলে বিয়ের সময় ইচ্ছে ছিল নির্লিপ্ত, মাথা কাজ করছিল না। চিৎকার করে নিজের ভয়টা সকলকে বোঝাতে গিয়েও সে ব্যর্থ হয়েছে। আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিল বাবার দিকে কিন্তু ওখানেই যে ওর সব আশা শেষ ছিল। ইচ্ছের বিয়েতে সব থেকে খুশি হয়তো অনুপ বাবুই ছিলেন। তার বহু আশা মেয়েটা কে সুখে দেখার। আর সেটা যখন পূর্ণ হচ্ছে খুশি তো হবেনই। যার চমক তার চোখে মুখেতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল। আর সেই চমকই আটকে দিলো ইচ্ছেকে। বাবাকে এতো খুশি হয়তো ও আগে কখনো দেখেইনি। তাই কিছুই করতে পারেনি। জীবনের এতো বড়ো সিদ্ধান্তটা ও না পারলো নিজে নিতে, আর না কেউ ওর সম্মতি চাইলো। আসলে মেয়েদের জীবনের ইচ্ছে গুলো পাখির ডানার মতো স্বাধীন না। তারা চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে অনেক কিছু করে উঠতে পারেনা। জলের স্রোতে কেবল ভেসে চলে এই ঘাট থেকে ওই ঘাট।

– ” এখন ওর সঙ্গে আমার থাকতে হবে। মানুষ জীবনে যা একেবারেই চায় না তাই পেতে হয়। আমাকেও হলো।”

নীরবের বিড়বিড় করে বলা কথা গুলো হয়তো ইচ্ছে বুঝতে পারে। হঠাৎই মনের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয় ইচ্ছের। চোরা চোখে নীরবকে দেখে, বোঝার চেষ্টা করে নীরব কি রেগে আছে! কিন্তু কোনো কিছুই বোঝে না। তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে নেমে একপাশে সরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ও। ইচ্ছের এইরূপ ব্যবহারে আহাম্মকের মতো ওর দিকে তাকায় নীরব। ইচ্ছে কী করতে চাইলো তা নীরবের মাথার উপর দিয়ে গেল। দুইহাতে মাথার চুলগুলো টেনে ধরে নীরব। এখন এই শীতের মাঝেও ইচ্ছেকে দেখে ওর প্রচুর গরম লাগছে।
ইচ্ছের পরনের সাউথ ইন্ডিয়ান ভারী শাড়ি দেখে সত্যিই যে কারোরই কেমন এক তীব্র অসস্তি হবে।

_” যা এই ভারী শাড়িটা চেঞ্জ করে আয়। যতই শীতকাল হোক এই শাড়িতেই মনে হয় তুই এবার হেলে পড়ে যাবি।”

দীর্ঘ নয় মাস পর নীরবের গলায় নিজের সম্পর্কে কোনো কিছু শুনলো ইচ্ছে। মনের মধ্যে দিয়ে ওর যেনো কোনো এক শীতল বাতাস বয়ে গেল। কিন্তু সেই শীতল স্রোতকে ঠান্ডার আভাস ভেবে ইচ্ছে ভুল করলো। নীরবের কথায় ঘাড় নেড়ে সায় দিলো। ইচ্ছে তো এখান থেকে পালানোর সুযোগেই ছিল। তাই সুযোগটা পেতেই তারাহুরো করে একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

ইচ্ছের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নীরব তপ্ত শ্বাস ফেললো। পকেট থেকে মায়ের দেওয়া হাতের বালা জোড়া বিছানার পাশের টেবিলের একটা ড্রয়ারে রাখলো। রুমা দেবী বারবার করে নীরবকে জানিয়েছে এই বালা জোড়া যেনো ইচ্ছেকে নীরব নিজের হাতে পরিয়ে দেয়। আর নিজের তরফ থেকে একটা গিফট যেনো ও ইচ্ছেকে দেয়; এটা নিয়ম। নীরবের মনে কেবল একটাই প্রশ্ন, ও বিয়ে করেছে বলে ইচ্ছেকে উপহার দেবে। তাহলে ইচ্ছে কি দেবে? ওর ও তো উচিত নীরবকে কিছু গিফট দেওয়া। প্রতিটা মানুষ গিফট ভালোবাসে। তেমনি ইচ্ছে যদি কোনো গিফট দেয় তাহলে নীরবেরও বেশ ভালো লাগবে।
—————

– ” পেনের নীব, তুমি প্লিজ আমাদের বিয়েটা মেনে নাও।”

বিকেল শেষের মুহূর্তে নীরব দাঁড়িয়ে ছিল নিজের বাড়ির ছাদে। হঠাৎই ইচ্ছের আগমনে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে নীরব।

– ” এই ইচ্ছে কি করছিস, যা তো এখান থেকে। দেখছিস না আমি হাওয়া খাচ্ছি। ”

ইচ্ছে দমলো না। চোখ মুখ শক্ত করে বললো, ” আমি জানতে চাই তুমি বাবাকে কেনো না বলেছো? আমাকে বিয়ে করলে তোমার কি এমন ক্ষতি হবে ! আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।”

তীব্র বিরক্ত হলো নীরব। বিয়ে করতে চায় না এর জন্যে আবার কৈফিয়ত লাগবে নাকি।

– ” তোর এই এতো এতো বকবকানি অসহ্য লাগে আমার। মাঝে মাঝে মনে হয় কানে কালা হয়ে যাই। আর সত্যি বলতে আমার তোকে বউ হিসেবে পছন্দও না। ছার এতো কথায় কী কাজ! তুই অন্য কাউকে বিয়ে করতেই পারিস, সমস্যা কি? শুনলাম তো তোর বাবার কাছে একটা ছেলের সম্বন্ধ এসেছে। নাম সুবীর দেববর্মণ। দেখতেও ভালো, জব করে, তোর সাথে দারুন মানাবে। যা এখানে না দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ি যা, সাজুগুজু কর। কাল তোকে দেখতে আসবে। বেশি না বকে বিয়েটা করে নে। ”

কথা গুলো মন দিয়ে শোনে ইচ্ছে। চোখের কোনায় যে কখন জল জমেছে তা ও বোঝেনি। তবে সেই মুহূর্তে ও পারে না কেবল দৌড়ে সেখান থেকে চলে যেতে। কিন্তু যাবে কিভাবে, ওর পা গুলো যেনো ওই খানেই আটকে রয়েছে। নীরব খানিক অন্যমনস্ক হয়ে অন্য দিকে তাকাতেই ইচ্ছে চলে যায় সেখান থেকে। সিঁড়িতে পায়ের শব্দে নীরব বোঝে ইচ্ছে চলে গেছে। কিন্তু ওর মনে জাগে না কোনো মায়া কি অনুতাপ। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ছাদ ময় পায়চারি করে ও।
———–
হঠাৎই সেন্টার টেবিলের উপর থেকে নিজের পা জোড়া ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে গেলেই তন্দ্রা ভাব কেটে যায় নীরবের। তখন বালা জোড়া রেখে সোফায় বসে। হঠাৎই হারিয়ে যায় ওদের পুরোনো সেই ছোটো গল্পে। যেই গল্পের শেষটা ওর জানা হয়নি; তবে এইবার হয়তো এই গল্পটা ওদের উপন্যাসের আকার ধারণ করতে চলেছে। যার শেষটা হয়তো ওদের জন্যে নিরালায় ভালোবাসাময় হয়ে উঠবে।

কিন্তু নীরবের ভাবনার মাঝেই ওর ঘুম এসে যায়। হঠাৎ করেই বারান্দা থেকে আসা শীতল বাতাসে সারা শরীর কাঁপুনি দিয়ে ওঠে নীরবের। যার জন্যে চোখ খুলতে হয় ওকে। ঘড়ির কাঁটায় তখন সবে সাড়ে বারোটা। নীরবের মনে আছে বারোটা দশ পনেরোয় ও ঘরে এসেছিল। তারমানে বেশিক্ষণ হয়নি।

উঠে দাঁড়ালো নীরব, ইচ্ছেকে বালা জোড়া দিতে হবে। নাহলে কাল সকালে ওর মা ইচ্ছের হাতে বালা দুটো না পেলেই ওকে বকবে। কিন্তু ঘরের কোথাও ইচ্ছেকে না দেখে নীরব ওয়াশ রুমের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু ইচ্ছে সেখানেও নেই। ভয় হলো নীরবের। কোথায় গেলো এতো রাতে! পরমুহূর্তেই কিছু ভেবে নীরব বারান্দায় ছুটলো। কিন্তু বারান্দাতেও ইচ্ছে নেই। নীরব ‘ ইচ্ছে ‘ বলে ডেকে ঘরের দিকে যেতে গিয়েও থেমে গেল। ওর দৃষ্টি কিছু একটা আকর্ষণ করতে চাইছে, কিন্তু সেটা কি?
হাতের চুড়ির ঝনঝন শব্দের উৎপত্তি খুঁজে নীরব দেখলো , বারান্দার কোণার দিকে মেঝেতে একটা বেডশিট পেতে তার উপরে ইচ্ছে শুয়ে রয়েছে। গায়ে রয়েছে একটা চাদর।

ইচ্ছেকে এই অবস্থায় দেখে রেগে গেল নীরব। এই ঠান্ডার মধ্যে কী করছে ইচ্ছে? হনহন করে ইচ্ছের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর মাথাটা ধরে ওকে উঠে বসালো।

আচমকা এই কাজে ইচ্ছে চমকে উঠে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করলো। ইচ্ছের মুখ দেখলেই যেনো বোঝা যাবে ও যেনো খুব ভয়ের সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু নীরব ইচ্ছের মুখ থেকে হাত দুটো সরিয়ে দাঁড় করিয়ে গায়ের চাদরটা ভালো করে ইচ্ছেকে জড়িয়ে দিলো।

– ” এই বাড়ির বউ তুই, কাজের মেয়ে না। এই ভাবে কে এখানে শুয়ে থাকে? ঠাণ্ডায় মরে যাবি তো। আমি তোকে নাহয় একবার বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু এখন তা বলে আগের ঘটনার জন্যে আমার উপর রাগ করে নিজেকে কষ্ট দিবি। ”

নীরবের বলা প্রথম কথা টুকু শুনেই হারিয়ে গেলো ইচ্ছে। কানের মধ্যে ভেসে উঠছে কিছু কথা। যতবার কথা গুলো মনে পরছে ইচ্ছের তত মাথা দপদপ করছে। বারবার যেনো কেউ বলে চলেছে, “এই বাড়ির কাজের লোক তুই, বউ না।”

– ” কী রে কি বললাম কানে গেলো?” শান্ত চোখে নীরবের দিকে তাকাতে নীরব আবারও বললো,
– ” যা ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়। ”

ইচ্ছে বিনা বাক্যে ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।

– ” শোন!”

পিছন ফিরে তাকালো ইচ্ছে। কিন্তু নীরবের গম্ভীর গলা শুনে ও আরও ভয় পেয়ে গেলো।

– ” বিছানার ডান পাশটা আমার। ওই দিকটা ছেড়ে অপর দিকে ঘুমিয়ে পড়। আমি ডান দিক ছাড়া ঘুমাতে পারি না। ”

( চলবে )
{ বিঃ : এক্সামের জন্যে গল্প দিতে দেরী হয়েছে। তার জন্যে আমি খুব দুঃখিত। এবার রেগুলার দেবো। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।}

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here