নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
৫ .
তিন সপ্তাহ বাদেই ছিল নীরবের বাইরে যাওয়ার ফ্লাইট। কবে ফিরবে ও জানে না। কয়েক মাস কী বছর ঠিক নেই। অপর দিকে অনুপ বাবু নীরবকে পুনরায় ইচ্ছেকে বিয়ের কথা জানালে নীরব আবারও অসম্মতি জানায়। সেই কথা ইচ্ছের কানে যায়। আসলে ওই দুই পরিবারের সকলের হাতে পায়ে ধরে বলেছিল, ও নীরবকে বড্ড ভালোবাসে। কিন্তু নীরবের এতটা অসম্মতি জেনে, আর এই সবে ইচ্ছের কষ্টের কথা চিন্তা করে পরিবারের সকলে ভালো সম্বন্ধকে আর না করেনি। বিয়ের জন্যে রাজি হয়ে যায়। ইচ্ছের কথা তারা হয়তো অন্য ভাবে ভেবেছিল। নীরবকে মনে করে কষ্ট না পেয়ে নতুন সম্পর্কে জুড়ে দিয়ে ওর মন থেকে নীরবকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিল। এতে যাইহোক, নতুন জীবনে ইচ্ছে নীরবকে ভুলে যাবে। কিন্তু ইচ্ছের জীবনের সেই সিদ্ধান্ত ওর সারাটা জীবন কে ধ্বংস করে দিয়েছে। ছয়টা মাসের সেই সংসার কেমন ছিল তা বোধহয় ইচ্ছে নিজে বললেও তার সমাপ্তি হবে না।
ইচ্ছেকে ঘরে পাঠিয়ে নীরব রেলিঙে ভর দিয়ে আকাশের তারার ভিড়ে হারিয়ে গেলো। চোখের সামনে ভেসে উঠল কতো শত স্মৃতি। দিনটা ছিল ইচ্ছের বিয়ের দুই সপ্তাহ আগের ঘটনা।
অনুপ বাবুর থেকে নীরব পেয়েছিল ইচ্ছের বিয়ের কিছু দায়িত্ব। যা নিয়ে সে ছিল প্রচণ্ড ব্যস্ত। আর ইচ্ছে, সে করে চলেছিল নীরবকে বোঝানোর চেষ্টা। কিন্তু যতবার বুঝিয়েছে তত বারই বিফল হয়েছে। কিন্তু হাল ছাড়েনি সে। কিন্তু এইবারের চেষ্টাটা হয়তো ইচ্ছের কাছে শেষ চেষ্টাই ছিল। এর পর ইচ্ছে হয়তো চোখ তুলেও অন্তত নীরবের দিকে তাকাতো না। আর সেটাই হয়েছিল। নীরব সেইদিন ডেকোরেশনের জন্যে কাউকে ফোন করেছিল। কথা বলার মাঝেই ইচ্ছে গিয়ে নীরবের বুকে মিশে যায়। থমকে যায় নীরব, ফোনটা ও হাত থেকে নীচে পড়ে যায়। ফোনের ওপাশের ব্যাক্তি ‘হ্যালো’ বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ফোনটা কেটে দেয়।
– ” আমি বিয়ে করবো না ওই লোককে। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি, বলো। তুমি এইরকম করো না। ওই লোকটা ভালো না। খুব খারাপ, প্লিজ। ”
ইচ্ছের কথায় নীরবের ঘোর কাটে। ইচ্ছের মিথ্যে শুনে কপালের রগ ফুলে উঠে। নিজেকে ওর থেকে ছাড়াতে বেশ কষ্ট করতে হয় ওকে। ইচ্ছে এমন ভাবে ওকে আঁকরে ধরেছিল যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। সত্যিই হয়তো তাই হয়েছিল। কিন্তু ইচ্ছের ইচ্ছা শক্তির জোরে হয়তো নীরবকে ইচ্ছে পেয়েছে। কিন্তু এখন ইচ্ছে নীরব কেনো কারোর জীবনের সঙ্গেই জড়াতে চায়নি।
– ” তুই আমাকে ভালোবাসিস এই কথাটা কেনো যেনো আমার আজ অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। তুই তো জোর করে আমাকে পেতে চাইছিস। আর যার জন্যে আজ তুই সুবীরের মতো ছেলের নামে মিথ্যে বললি। তোর আগে আমাদের সবার ওর সাথে কথা হয়েছে। ও কেমন তা আমরা বুঝেছি। সরি ভুল বললাম, তুই তো ওর সঙ্গে আজ দেখা করতেই যাসনি। তুই তো তোর ওই বান্ধবীর বাড়িতে কাটিয়ে এই সবে বাড়িতে আসলি। তাও নিজের বাড়ি না, আমাদের বাড়ি। ”
নীরব কী করে ইচ্ছের মিথ্যে ধরলো ইচ্ছে জানে না। সত্যিই ইচ্ছে সুবীরের সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। ওর এক বন্ধুর বাড়িতে বসে দুই বন্ধু মিলে এতক্ষণ ঠিক করেছে কী করে নীরবকে বোঝাবে। কিন্তু নীরব জেনে যাওয়ায় ইচ্ছে বেশ লজ্জিত হয়। এই মানুষটাকে ও কোনোদিন মিথ্যে বলেনি। নীরবকে ও জ্বালিয়েছে, বকেছে, ঝগড়া করেছে কিন্তু মিথ্যা বলেনি। আজ বলতে হলো। সেই মানুষটার জন্যেই বলতে হলো। যেনো ওকে হারিয়ে না ফেলে।
– ” সরি, আমি মিথ্যে বলতে চাইনি। আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর এটা শত ভাগ সত্য। ”
ইচ্ছের কথা শুনে নীরব শান্ত চোখে ওর দিকে তাকালো। ইচ্ছের চোখ দিয়ে তখন ঝরে চলেছে মুক্তোর মতো জলের বিন্দু। কিন্তু নীরবের কিছুক্ষণ আগের মতো এবারেও মনে হলো ইচ্ছে নাটক করছে। বেশ শক্ত করে ইচ্ছের হাত খানা ধরলো,
– ” চল আমি তোকে বিয়ে করবো। ”
ইচ্ছের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। নীরব কি সত্যি বললো? এই মুহূর্তে ওর হাতে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করছে, ঠিক শুনলো তো। নাকি স্বপ্ন দেখলো।
ইচ্ছের মুখের এক চিলতে হাসি পর্যবেক্ষণ করে নীরব বলে উঠলো, ” একটা কথা সারাজীবন মাথায় রাখিস, তুই আমাকে জোর করে নিজের করতে চাইছিস। এর পর তো আমি তোর মুখ দেখতেও চাইবো না। তুই কি সত্যিই এতটা খারাপ ইচ্ছে? ”
এক চিলতে রোদের মাঝে হঠাৎই যেমন এক পশলা বৃষ্টি এসে আকাশ মেঘলা করে দেয়, তেমনই ইচ্ছের মুখে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার।
– ” চল ইচ্ছে সবাই কে বলি আমি তোকে বিয়ে করবো। তোকে তো বিশ্বাস হচ্ছে না। হয়তো দেখা যাবে সুবীরের সাথে বিয়ের পর দিনই না তুই ওর নামে কোনো লেম এক্সকিউজ দিয়ে ডিভোর্স চেয়ে বসিস।”
নীরবের দিকে একবার তাকিয়ে খুব সাবধানে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়ালো ইচ্ছে। নিজেকে ওর অপরাধী মনে হলো। বহু কষ্টে নিজের শ্বাসের গতি কমিয়ে বললো, ” চিন্তা করো না আমি খুব ভালো একটা সংসার পাতবো। তোমাদের পছন্দের পাত্রের সঙ্গে। আর দেখো খুব সুখী হবো। যে তোমরাই বলবে নজর না লাগে তোদের সম্পর্কে। ”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরব। ইচ্ছের মুখে শোনা শেষ কটা শব্দ। আর কোনো কথা বলেনি ও। তারপরের সপ্তাহে বিয়ের পর ইচ্ছে যখন সুবীরের বাড়ি যাচ্ছিল, নীরবের দিকে একবার তাকিয়ে হাত জোর করে প্রণাম করেছিল। সেই দিনই শেষ ওদের দেখা। তারপর কাল ওদের বিয়েতে নীরব ওকে সেইদিনের পর প্রথম দেখলো। কিন্তু এই ইচ্ছে নীরবের কাছে অজানা। ইচ্ছের মাঝে কিছু একটা কমতি নীরব লক্ষ্য করেছে এই দুইদিন। শুধু কি বিয়ের জন্যে নাকি অন্য কারণ, কে জানে!
{ এতক্ষণ অতীত ছিল। এবারের বর্তমানের মাটিতে পদার্পণ করলো নীরব }
– ” বাবা তুমি তো জানো আমি ওকে কখনোই ভালোবাসিনি। ও হয়তো আমার ভাগ্যে ছিল, তাই না? তাই হয়তো ওর জীবন টা নতুন রূপে আমার সাথে জুড়ে গেছে। আমি জানি না ওকে কখনও ভালোবাসতে পারবো কিনা! তবে আমি চেষ্টা করবো ওকে ভালোবাসার। জানোতো ধীর আগের দিন অনুপ কাকুকে বলছিল, আমি নাকি ইচ্ছেকে কষ্ট দেবো। আরেকবার যেন ভেবে দেখা হয়। বাবা তুমি দেখো আমি আমার দিক থেকে খুব চেষ্টা করবো। ইচ্ছেকে খুব ভালো রাখবো। ওর কোনো কষ্ট হবে না। ওকে আমি ভালো রাখবই। এটা আমার প্রমিশ। বিয়ে যখন হয়েছে ও আমার স্ত্রী , ও আমার দায়িত্ব। তবে সব শেষে ও ভালোবাসা আমার অবশ্যই হবে। কিন্তু আমি তো ওর মায়ায় পড়তে এখনও পারিনি। জানিনা ভবিষ্যতে কি হবে। তবে যা হবে তাতে আমরা দুইজনে একসঙ্গে থাকবো, ভালো থাকবো আমরা খুব সুখী হবো দেখো।”
মনের মধ্যে জমে থাকা কথা গুলো নীরব আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে বললো। নীরবের ছোটো থেকে বিশ্বাস ওর বাবা ওর সঙ্গে সবসময় আছে। তিনিই ওকে সঠিক পথ নির্ণয়ে সহযোগিতা করবেন। এখন এতো কথা বলতেই মনটা ওর ফ্রেশ হয়ে গেলো।
————————
নীরবের বলা মতো ঠিক জায়গায় ইচ্ছে শুয়েছে। নীরব ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ইচ্ছে এতক্ষণে ঘুমে কাঁদা। ইচ্ছের গায়ে ভালো মতো কম্বলটা জড়িয়ে অপর প্রান্ত নিজের গায়ে টেনে নিলো নীরব। মুখে বিড়বিড় করে বলে উঠলো, ” জীবনে আমাকে কতো কী করতে হচ্ছে। প্রথমে তো ওর সঙ্গে বিয়ে এখন আবার একই কম্বল শেয়ার করতে হচ্ছে। তবে যাইহোক তুই আমার বউ। ”
চোখ বন্ধ করলো নীরব। হঠাৎই যেনো সৃষ্টিকর্তা ওর উদ্দেশ্যে ধ্বনিত করলো,
–” তো তোর কেমন মেয়ে পছন্দ রে নীরব?”
নীরবে হাসলো নীরব। চোখ বন্ধ করে সুন্দর এক হাসি হাসলো। সৃষ্টিকর্তার প্রশ্নে যেনো সে খুব খুশি। অবশেষে কেউ তো ওর মনের কথা জানতে চাইলো।
নী : “যে মেয়ে আয়না না দেখে সোজা টিপ পড়তে পারে।”
সৃ : এই ভাবনা কোথা থেকে মস্তিষ্কগত করলি?
নী : একটা কবিতায় এই লাইনটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। সেই থেকেই আমার এটা প্রিয় লাইন। আর কখন যেনো প্রিয় মানুষের মধ্যে এই ব্যাক্তিত্ব আমি কামনা করি কে জানে। তবে সবার সব ইচ্ছে তো পুরন হয় না। তবে আমার ইচ্ছে পূরণ না হলেও ইচ্ছেকে পেয়েছি।
সৃ : আমি তোর জন্যে ভালো কিছুই রেখেছি। তোর জীবনসঙ্গী হয়তো তোর মনের মতোই।
নী : ধুর।
সৃষ্টিকর্তা চুপ করে গেছে। চোখ খোলে নীরব। কিছু ভুলে গিয়েছিল। আলো জ্বললে ওর ঘুম হয় না। হঠাৎই চোখ খুলে তাকাতেই চোখে আলো পড়তে চোখ জ্বালা করলো ওর। ইচ্ছে বিছানার শেষ প্রান্তে শুয়ে রয়েছে। নীরব হাত বাড়িয়ে একদম ওর পাশে টেনে আনলো। ইচ্ছেও পুতুলের মতো নীরবের গা ঘেঁসে শুয়ে রইলো। নীরব ক্রমাগত হাই তুলছে। চোখ খুলে চাইতে পারছে না ঠিক মতো। তবুও হাত বাড়িয়ে পাশের টেবিলের ড্রয়ার খুলে মায়ের দেওয়া বালা জোড়া বের করলো। অপর হাতে বিছানার পাশের আলোর সুইচ টা বন্ধ করে পুনরায় শুয়ে পড়ল। ঘুম চোখে ইচ্ছের দুই হাতে বালা জোড়া পরিয়ে যেনো শান্তি পেলো ও। মুখে হাসি নিয়ে চোখ বুজলো। বিড়বিড় করে বললো,
– ” আমার দেওয়া গিফট পড়ে দেবো। তৈরি করতে দিয়েছি। হলেই পাবি। শুভ রাত্রি।”
( চলবে)
{ বিঃ : অতীত এর কিছু কথা আছে বর্তমানে। আর ওখানে লেখা ‘ নী ‘ মানে নীরব আর ‘ সৃ ‘ মানে সৃষ্টি কর্তা কে বুঝিয়েছি। শেষের এই ‘নী’ এবং ‘সৃ’ কনসেপ্টটা একটু অন্যরকম চেষ্টা করে লিখলাম। ভুল হলে ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানবেন। }