#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ১১
___________
২৩.
‘আমার চোখের ঘুম নষ্ট করে আছ কি তুমি ঘুমিয়ে?
একবার দেখ জল ভরা নদীতে তাকিয়ে,
আজ ভালোবাসার এক সমুদ্দুর নিয়ে আছি আমি অদূরে দাঁড়িয়ে।’
রিমার সাথে থাকতে থাকতে টুকটাক ছন্দ গঠনের প্রক্রিয়া কাজ করে আলীর মনে। তবে সেটা ভীষণ একান্তে, প্রিয়জনের ক্ষেত্রে। আজ-ও ব্যতিক্রম ঘটল না সেটার। সুইজারল্যান্ডে এসেও মনটা পড়ে রয়েছে সেই ছোট্ট গ্রামের ছোট্ট কিশোরী বধূয়ার পানে। সুইজারল্যান্ডের ঠান্ডা আবহাওয়ায়ও তার শান্ত মন আঞ্জুমানের কথা ভেবে অশান্ত, বেসামাল, তাপীয় হয়ে আছে। মেয়েটাকে দেশে ফেলে এসে মনের মধ্যে শান্তির ছিটেফোঁটাও পাচ্ছে না আলী। যদিও ভেবেছিল, দূরত্ব বাড়লে ভালোবাসার গুরুত্ব কমবে। তা আর হলো কই? গুরুত্বের পারদ ডিঙিয়ে সুউচ্চে অবস্থান করে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে ভালোবাসা নামক অপদার্থ পদার্থটা তাকে। যদিওবা আগে ভালোবাসাটা সদ্য কলি থেকে পরিস্ফুটিত হতে নিয়েছিল, কিন্তু তার আগে ভালোবাসার প্রকাশের ভয়ে ভীত হয়ে দাবিয়ে রাখার চেষ্টায় দূরত্ব বাড়ানোর ফন্দিতে সুইজারল্যান্ডে আসাটা কাজে লাগাল আলী। তা সত্ত্বেও পরিবর্তনের নাম নিশানাও দেখছে না। সারাক্ষণ ভেতরটা উশখুশ করে আঞ্জুমান নামক বন্দি পাখির জন্য। আঞ্জুমানকে ভালোবাসা শিখার নামে নিজের দাবিয়ে রাখা ভালোবাসা কাল হয়ে, বারবার তার মনের মধ্যে ঝড় তুলে আঞ্জুমানকে কাছে পাবার। লিমাকে যদিও আঞ্জুমানের কাছে রেখে এসেছে, তবুও সত্য সম্মুখে আসাও তাকে ক্ষণে ক্ষণে ভীত করে তুলছে। অবশ্য ভয় পাওয়ার মতো মানুষ আলী নয়, শুধু চিন্তা বলা চলে। মনে হয় না তার কথা ডিঙিয়ে লিমার মুখ খুলবে। আবার অতিক্রম করতেও পারে, আঞ্জুমানের প্রিয় সখি বলে কথা৷ যাকে হাত করে আঞ্জুমানকে পেতে চাওয়া। যদিও পরিকল্পিত পরিকল্পনা অর্ধেক সম্পন্ন হয়েছিল। পরে সুযোগ করে দিয়েছিল, নিজে আঞ্জুমান’ই। মন খারাপ করে আত্মহত্যা করতে গিয়ে। পরের চালগুলো আলী দিয়েছিল শুধু। বাড়িটাকে খালি করে করিম মিয়াকে দিয়ে গ্রামের গণ্যমান্য, সম্মাননীয় ব্যক্তিবর্গদের জড়ো করে। সেখানে অবশ্য নিজের লোকও ছিল কিছু। অতঃপর যা হওয়ার তাই হলো। একটু কষ্ট যদিও লেগেছিল আঞ্জুমানের সম্মানহানি হওয়ায়। তবুও করার কিছু ছিল না। কথায় আছে না, ‘কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়’ সেটা বিবেচনা করে নিজেকে দমিয়ে রেখেছিল। মনের ভীতের অংশ তখন প্রশ্ন করে,
‘এসব জানার পরে থাকবে তো তোমার আঞ্জু?’
আলী সশব্দে বলল,
‘থাকবে। তাকে থাকতে হবে। আমার ভালোবাসা থাকতে বাধ্য করবে।’
ভেতরকার সত্তা কিছুই বলল উলটে হেসে উঠল আত্মাভিমানে, অহংবোধে। যা জানান দেয়, কাজটা আলীর ঘৃণিত ছিল। চঞ্চলার ছটফটে, ব্যাকুলা হয়ে চলনশীল স্থগিত করে কেমন চুপচাপ, শান্ত, নিথরে বানিয়ে দিয়ে আলীর আশানুরূপ সাফল্য অর্জনে হার নিশ্চিত করে; যদি ঘটনা আঞ্জুমানের কর্ণগত হয়।
‘কী হলো তোমার? একা একা কী থাকতে বাধ্য করবে বলছিলে?’
‘তুমি ঘুমাওনি?’
আলীর সম্পূর্ণ কথা রিমা শুনেনি বিধায় কথা ঢাকতে অন্য প্রসঙ্গে ঢুকে যায় আলী।
‘কেন? শরীর খারাপ করছে?’
এতক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা, ছাদযুক্ত বারান্দার হিমশীতল বাতাস থেকে সরে এলো, বারান্দা কাচের দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ঘুমঘুম চোখের রিমার কাছে। ঠান্ডা হাত দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিলো। আলীর অতিশয় শীতল হাতের স্পর্শে রিমা খানিক কেঁপে উঠল। দুপুরের লাঞ্চের পরের ঘুমে শরীর তার ম্যাজম্যাজ করছে। আবারও বিছানায় যাওয়ার ইচ্ছে জাগছে। দু-হাত দিয়ে আলীর গলা জড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘নাহ, শরীর ঠিক আছে। শুধু একটু ম্যাজম্যাজ করছে।’
রিমার কোমর ধরে কাছে টেনে নিয়ে আলী বলল,
‘তাই না কি? তাহলে বিবি সাহেবার ম্যাজম্যাজ ভাব কমিয়ে দেই।’
আলীর মুখে দুষ্টুমির বাঁকা হাসিে দেখে বুঝতে পারল লোকটার মনের অভিব্যক্তি। তাই কিছু না বলে লজ্জাময় হাসি দিয়ে মুখ লুকালো আলীর বুকে।
২৪.
রাতের শিফটের নার্সের সাথে সর্বক্ষণ লেগে থাকে লিমা। রাতের শিফটে কর্মরত নার্সের কর্মকাণ্ড দেখার পর থেকেই লিমার রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ফোঁসফোঁস শুরু। দিনের বেলার নার্সটা কাজ-কর্ম ঠিকঠাক করে। আঞ্জুমান তো বেশিরভাগ সময়টা ঘুমিয়ে কাটায়। একটু ধরে খাওয়ানো, যেটা কেবল লিমা’ই করে। ওয়াশরুমে নেওয়া-আনা, গোসল করানোর এসব কাজ কেবল নার্সরা করে; কারণ গায়ের ক্ষতের জন্য। আবার ড্রেসিং করা তো রয়েছেই। কিন্তু রাত্রি প্রহরের নিয়োজিত নার্সটা রাতে পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে কাটায়। যেটা হাতেনাতে ধরেছে লিমা। রাতে হঠাৎ আঞ্জুমান জেগে যায় ওয়াশরুম যাওয়ার তাগিয়ে। অথচ নার্সটা দিব্যি আরামসে ঘুমাচ্ছে। ওয়াশরুমের চাপের তাগিদে সর্বশেষে ডাক দিয়েও যখন নার্সের ঘুম ভাঙাতে অক্ষম হলো আঞ্জুমান, তখন নিজ উদ্যোগে কাঁপন ধরা শরীর নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার উদ্যত হলো ওয়াশরুমের দিকে। কিন্তু নাহ, বাঁধাপ্রাপ্ত হলো শরীর তার সাথে সায় দিলো না। কাঁপাতে কাঁপতে দু-কদম এগিয়েই ধরাস করে পড়ে গেল। ব্যথার ওপর ব্যথায় সম্ভবত গলায় শক্তির জোগান দেয়, তাই সে চিৎকার দিয়ে উঠল। সেই শব্দে নিচ তলায় অবস্থানরত কাজের লোকদের কোয়ার্টারে আলাদা আলাদা রুমে থাকা লিমা ও করিম মিয়ার কানে পর্যন্ত পৌঁছে গেল। দ্রুত কদম বাড়ালো ওপরের তলায় গেস্ট রুমের দিকে। এদিকে চিৎকারে নার্স ঘুম চোখে ওঠে হতভম্ব হয়ে বসে রইল। খানিকক্ষণ বোঝার চেষ্টায় সে হলোটা কী? নিচে পড়ে থাকা আঞ্জুমানের গোঙানি তার ধ্যানচ্যুত করে। এগিয়ে হড়বড়িয়ে আঞ্জুমানকে তুলে ধরার আগেই লিমা এসে তাকে উঠিয়ে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলো। আঞ্জুমানের দরজা সবসময় খোলা রাখা হয়, আলীর আদেশ। অতঃপর সকালে গরম গরম হয়ে খবরটা পৌঁছে যায় আলীর কাছে। রাগান্বিত আলী নার্সকে সামনে পায়নি ভাগ্য ভালো বলে। শুধু চাকরিচ্যুত হয়েছে, সাথে হাসপাতালের চাকরি থেকেও। সেই থেকেই আঞ্জুমানের খেয়াল লিমা রাখে। আর দিনের বেলার নার্সকে কড়া নজরে রাখে। এই তো আঞ্জুমান সুস্থতা হলেই ছুটি সকলের। কিন্তু লিমার? সত্যিই কি ছুটি হবে?
‘কীরে সই কী ভাবছ এত?’
ধ্যানচ্যুত লিমার ভাবনাগুলো আপাতত ছুটি নিলো।
‘কী কইলি?’
‘কিছুই শুনোস নাই?’
মাথূ নেড়ে না বুঝালে আঞ্জুমান মন খারাপের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লিমাকে বলল,
‘তুই আর আগের মতোন নাই রে লিমা। আগের মতো ছোটাছুটি, দুষ্টামিও নাই।’
‘তুই-ই বা কি আছোস আগের লাহান?’
আচমকাই কথাখান বলে লিমা হতবুদ্ধি হয়ে গেল। প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি পরে বুঝল। তার করা প্রশ্নে আঞ্জুমানের মুখে নেমে এলো মেদুর ছায়া। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসা মুখ ডানপাশের জানালা গলিয়ে তাকিয়ে দেখল বাগানের গাছে বসা পাখিদের ভালোবাসা। নাম না জানা এক পাখি আরেক পাখির মাথায় ঠুকরে দিচ্ছে, তবুও সেই ঠুকর খাওয়া পাখি আরো ঘেঁষে রয়েছে অত্যাচার করা পাখির সাথে।
‘ পরিস্থিতি আমারে বদলায় দিছে।’
অবাক হয়ে চেয়ে রইল লিমা তার দিকে। কঠিন শব্দে তৈরি বাক্য আঞ্জুমানের মুখে গম্ভীরতা এনে দিলো। সাথে বুঝিয়ে দিলো ভেতরে থাকা কষ্টের পাহাড় খুবই বিশাল। তার দিকে তাকিয়ে লিমার খুবই খারাপ লাগা সাথে অপরাধবোধ হচ্ছে। সে তো জানে সবকিছুই। এক মন চূয় বলতে তো আরেক মন বলে, আঞ্জুমান তোকে ভুল বুঝব। তার চোখে হারাইবি আগের সই’য়ের ভালোবাসা।
চলবে…