নিশুতি_তিথি পর্ব ৭

0
510

#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ৭
___________

১৩.
হসপিটালের ফিনাইলের ভরপুর গন্ধে আলীর নাজেহাল অবস্থা। তার হসপিটালের এই গন্ধে শ্বাসনালি আঁটকে যাওয়ার মতো। এসবে সে বেশ একটা অভ্যস্ত নয়, বড়োজোর অতিব প্রয়োজন ছাড়া কখনো এ-মুখো হয়নি সে। সরকারি হসপিটালে দ্রুত আঞ্জুমানের চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য আসা। কিন্তু ডাক্তার’রা সেখান থেকে ফিরিয়ে দেয়। দিক-বেদিক হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ডাক্তাদের কলার ধরে ঝাঁঝালো কণ্ঠে তাঁদের ওপর রাগ ঝাড়ে আলী। তখন করিম মিয়া এগিয়ে এসে মাথা ঠান্ডা করে অন্যত্র নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়। সেই আবার গাড়ি ঘুরিয়ে বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয় আঞ্জুমানকে। সেখানে দ্রুত চিকিৎসা শুরু হয়। দোতলা ক্লিনিকের দ্বিতীয় তলার ওটির রুমের সামনে পাতানো চেয়ারে বসে আলী। দু’হাত জড়ো করে কপালে ঠেকানো। করিম বারবার লক্ষ করছে, খুব গভীরভাবে। তার কাছে বিষয়টা বপশ অদ্ভুত ঠেকছে। কখনো আলীকে কারো জন্য এত চিন্তিত হতে দেখা যায়নি। এই যে চিন্তা সেটা কীসের? আঞ্জুমানকে পেয়েও হারিয়ে ফেলার? সে তো জানে সেখানে অন্য কোনো অভিপ্রায় নিহিত। আরকিছু ভাবতে পারছে না করিম মিয়া। এমন নিষ্পাপ, পবিত্র মেয়েটার ভাগ্য জুড়ে এই নিষ্ঠুর, নির্মম, পাষাণ, জঘন্যতম পুরুষটাই এলো! এলো না কি আনা হলো তা শুধু সময়ের ব্যবধানে জানা যাবে।

‘রক্ত লাগবে পেশেন্টের।’

নার্সের কথা শুনে অবনত হওয়া মুখ তুলে ওপরে তাকালো আলী। অতঃপর করিম মিয়াকে ডেকে রক্ত জোগাড়ের আদেশ দিলো। মনে মনে করিম মিয়া ভেবে নিলো, আর যাই হোক আলী কখনো কাউকে ভালোবাসতে জানে না। নাহলে প্রিয়জনের জন্য রক্ত জোগাড়ের কাজটা তার মতো কাজের লোকের হাতে ন্যস্ত করত না।

বিকেলের গোধূলি আলোয় হলদেটে আভা ছড়ানো আকাশের মধ্যমনি সূর্যটাকে দেখে একপ্রকার প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে আলীর। এটা কি সত্যি আলোর দিশারীর শান্তি না কি আঞ্জুমানের সুস্থতার ইঙ্গিতে মনের কোণে স্বানুভাব দেখাল।

‘বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত।’

ডাক্তারের কথায় জানালার কাচ দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার জন্য নিক্ষিপ্ত করা দৃষ্টি এবার ফিরিয়ে নিয়ে মনোযোগী হলো আলী সম্মুখের চেয়ারে অবস্থান করা মানুষটার কথা শুনতে।

‘জি, সমস্যা নেই।’

‘আঞ্জুমান আপনার কী হয়?’

খানিকটা চুপ থেকে ওপাশ থেকে উত্তর আসে গম্ভীর গলার,

‘আমার বউ।’

‘ওহ, আই সি। তা এমন ঘটনা ঘটল কী করে?’

আলীর মেজাজের পারদ এবার তুঙ্গে। এত বিষয়-বিশ্লেষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করার কী আছে বুঝে আসে না তার। প্রয়োজনীয় কথা বলবে তা না ব্যক্তিগত বিষয়াদি জানার আগ্রহ তাঁর। ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে আলী প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করে,

‘আঞ্জুমান এখন ঠিক আছে?’

জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন ডাক্তার সাহেব বুঝে যান তাঁর করা প্রসঙ্গ পালটাতে চাচ্ছে আলী। তাই তিনিও আলীকে বিব্রত না করে বললেন,

‘হুম, আপাতত তো সুস্থ বাকিটা সেরে ওঠবে প্রোপার দেখাশোনার মাধ্যমে। তার প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল হতে হবে। মেয়েটার শরীরে রক্তশূন্যতা রয়েছে, সাথে ওজনটাও কম। রক্তের ঘাটতি কমাতে ভালো-মন্দ, পুষ্টিকর খাবার খাওয়াবেন। অল্প বয়সের মেয়ে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করা ঠিক হয়নি। আবার আপনাদের মধ্যে এইজ ডিফারেন্ট মাচ।’

শেষোক্তিটা বেশ আফসোসের সুর টেনে বললেন ডাক্তার। কিন্তু পুরো কথার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মস্তিষ্কে ধরলেও শেষের উক্তি দু’টো আলীর তুঙ্গে ওঠা মেজাজে গেঁথেছে। যার ফলে সম্মুখের টেবিলে বলশালী হাতের থাবায় শব্দ করে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘আপনার মাথা শুধু ডাক্তারি করার কাজে মন দেন না কি অন্যের স্ত্রীকে নিয়ে। নাহলে ফল হিসেবে ডাক্তারি করার জন্য মাথা আর মাথার জায়গায় থাকবে না।’

ডাক্তার-ও বেশ ঘাবড়ে যান। চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে আলীর প্রস্থান লক্ষ করে আটকে রাখা দম ছাড়েন।

১৪.
‘বাবা, থাক কিছু বলো না আর।’

‘বলব না মানে। সাহস কত বড়ো এ মেয়ের! আমার মেয়েকে কষ্ট দিয়ে কথা বলে।’

থমথমে বিরাজমান ড্রয়িংরুমের শোভাবর্ধক স্থানটা। যেন আর ক্ষণকালের মধ্যে দূর আকাশের বাজ এই রুমেই পড়বে। কিন্তু তার আগেই রিমা তার বাবাকে বারবার অনুরোধ করে বুঝাচ্ছে কথা আর না বাড়াতে। কিন্তু আফজাল সাহেবের এক কথা।

‘আমার মেয়ের চোখে অশ্রু ঝরানোর কারণ যে তাকে আমি দু-চোখে সইতে পারব না। তার বিচার হবে, কঠিন বিচার।’

‘প্লিজ বাবা, ক্লাম ডাউন প্লিজ। বড়ো ভাবি তো মিথ্যে কিছু বলেনি। সত্যিটাই তো বলল। সন্তানের মুখ যে দেখেনি, সে কীভাবে উপলব্ধি করবে একজন সন্তানের অস্তিত্বকে?’

বলেই বাঁধভাঙা জোয়ার এলো রিমার দু’চোখের পাতা জুড়ে। এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন আফজাল সাহেব। ব্যবসায়ী, শক্ত-পোক্ত মনের মানুষ তিনি। তবুও আজ মেয়ের কষ্টে ব্যথিত হৃদয় নিংড়ানো অশ্রুরাও বইছে তাঁর চোখের কোলে। অনেক মানত করে পাওয়া মেয়েটার কেন একটু কষ্টে সারাজীবনের দুঃখ বয়ে বেড়াতে হবে? সন্তান জন্মদানে অক্ষমতার স্বীকার হওয়া একমাত্র মেয়েটার কষ্ট যে তিনি সহ্য করতে পারছেন না। এরইমধ্যে বড়ো বউ সেটা খুঁচিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে রক্তাত্ত করল। রিমাকে বুক থেকে সরিয়ে বড়ো বউ নাবিলার উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘আজই বাড়ি থেকে চলে যাবে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেও। রাকিব রেখে আসবে তোমাকে।’

বাবার দেওয়া আদেশ শুনে নিজের কান্না থামিয়ে দিয়ে বড়ো ভাবির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, মেয়েটাও কাঁদছে অঝোর ধারায় তবে সেই কান্নার কারণ ভিন্ন। তার সন্তানরা তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। এই দৃশ্য এক ঝলক তাকিয়ে দেখে ফের বড়ো ভাই রাকিবের দিকে নজর ফিরালো। সে জানে বাবা যে আদেশ করবে, সেটা ন্যায়-অন্যায় যাই হোক না কেন ভাইয়েরা তা মাথা পেতে নেবে। সেজন্যই তো বড়ো ভাই নিচু মস্তকে বসে আছে সোফায়, কোনো তর্কে জড়াননি। ছোটো ভাবি তার মা’য়ের সাথে বসে আছে সোফাতে। মেজো ভাই, ভাবি এখানে বিদ্যমান নেই। তিনি গিয়েছেন শ্বশুর বাড়িতে মেজো ভাবির মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে, তাঁকেই দেখতে গিয়েছেন। এত সুন্দর পরিবার হঠাৎই কেমন ছিন্নভিন্ন হয়ে বিদীর্ণ রূপ ধারণ করল, তা কেবল তার জন্য? নাহ, সে তো তার পরিবারকে হাসিখুশি ফ্যামিলি রূপে দেখতে চায় না কি আকাশের মেঘলা কালো রঙের মতোন। তাই দ্রুততর উত্তেজিত কণ্ঠে রিমা তার বাবার উদ্দেশ্যে বলল,

‘বড়ো ভাবি যদি চলে যায়, তাহলে কিন্তু আমি-ও চলে যাব গ্রামে। তখন দেখবে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকব তবুও তোমাদের কাছে ফিরব না।’

১৫.
আঞ্জুমানকে নিয়ে সেই সকাল থেকে দৌড়াদৌড়ি করে আলীর খেয়াল ছিল না রিমার কথা। সারাদিনে পার করে নিশীথে আঞ্জুমানের মাথার কাছে বসে খেয়াল এলো রিমার কথা। মেয়েটার সাথে সেই যে, কোন একবেলা কথা হয়েছে ভুলেই বসেছে। এত এত ঝামেলায় কি মনে থাকার কথা না কি। না জানি তাকে ফোনে না পেয়ে কী কী পাগলামি শুরু করেছে। ভাগ্য ভালো যে, তাকে না পেয়ে গ্রামে চলে আসেনি। যদি আসতো তখন কী হতো? ভাবতেই রিমাকে ফোন দিয়ে কথা বলা জরুরি মনে করল। নিজের ফোন তো বাড়িতে রেখে এসেছে তাই ক্লিনিকের থেকে ফোন করল। এদিকে রিমা জাগ্রত অবস্থাতেই ছিল বিধায় অচেনা নম্বরে রিসিভ করে আলীর কণ্ঠ শুনে অস্থিরচিত্তে বলে উঠল,

‘এই তুমি ঠিক আছ তো? কী হইছে তোমার ফোন বন্ধ ছিল কেন? আর এটাই বা কার নম্বর?’

তার উদ্বিগ্নতার স্বর বেশ ক্রদনরত শোনাল। মনে মনে হাসল আলী। মেয়েটা তার জন্য পাগলপ্রায়। এই যে তাদের সন্তান হয় না, তবুও চায় না তার স্বামীকে ভাগ করতে। সন্তানের জন্য কাঁদবে তবুও স্বামীকে হারানোর কথা উঠলে, সন্তান চাওয়ার আশা ছেড়ে দেয়। বিয়ের বছর দুয়েক বাদে যখন তাদের সন্তান হবে না জানল, সমস্যাটা রিমার ছিল। তখন মেয়েটার কান্না থামানোর মতো জো ছিল না। সারাক্ষণ দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াত, ঘুম যেত না, চুপচাপ যেন সর্বহারা হয়ে বসে থাকত। তখন ভালোবাসার চাদরে এনে খুব আদরে আদরে আলী তাকে আয়ত্তে আনে। অবশ্য বেশি একটা সময়ও লাগেনি কাজটা করতে। মেয়েটা যে তাকে খুব করে চায়। কন্ট্রোল করার অর্ধেক কাজ তো আফজাল সাহেব’ই তো করে দিয়েছিলেন। তাও আবার অজান্তেই। মেয়ে যখন তাঁর বাচ্চার জন্য আধপাগল, তখন তিনি আলীকে আরেকটা বিয়ে করার প্রস্তাব করেন। ব্যস! কাজ হয়ে গেল, স্বামীকে অন্য মেয়ের সাথে বোধহয় কোনো বাঙালি মেয়েই সহ্য করতে পারে না। যতোই সে মর্ডান হোক না কেন। রিমাও সন্তানের চিন্তা বাদ দিয়ে তখন স্বামী নামক অত্যধিক ভালোবাসার ব্যক্তি আলীকে আকাড়ে ধরে এত বছর পার করল। কিন্তু আফসোস! সেই তো অন্য ফুলের গন্ধ পেয়ে মৌমাছি ছুটল সে ফুলের গন্ধ নিতে। আটকে রাখতে পারল কি আর? পৈশাচিক হাসি খেলে গেল আলী আকবরের কালচে পুরু ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here