#নিয়তি
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
৫.
আমার শ্বাশুড়ি আম্মাকে ডেকে আনা হয়েছে। আমাদের সোফাঘরটা মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে মানুষে গিজগিজ করছে। আব্বা,আম্মা,ভাইয়া,ভাবী তো আছেনই, আমার দাদীকেও বড় কাকার বাসা থেকে ডেকে আনা হয়েছে। আমার বড় কাকা, বড় কাকাতো সাদাফ ভাইও এসেছেন। সবাই কঠিন দৃষ্টিতে প্রহর সাহেবকে পরখ করছেন। প্রহরের পাশেই ভয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে রয়েছে অধরা। আমি ভাবীর পাশে দায়সারাভাবে বসে রয়েছি। আমার কেন যেন ভীষণ ফুরফুরে লাগছে। আমাকে থাপ্পড় মারার ঘটনাটা আমি সঙ্গে সঙ্গে এসে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি। প্রহর সাহেবের প্রিয়তমা যে কে,তাও সবাইকে চিৎকার করে করে বলেছি। বড় ভাবী আমাকে চুপ করতে বললেও আমি চুপ করিনি। কেন চুপ করব? আমি কী স্টার জলসার ওই অসহায়, অবলা নায়িকা নাকী! আমার সঙ্গে অন্যায় হবে আর আমি মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকব? কক্ষনো নয়। প্রহর সাহেবকে তার প্রাপ্য অতি অবশ্যই বুঝিয়ে দিবো।
শ্বাশুড়ি মা বেক্কলের মতো তাকিয়ে রয়েছেন আমার দিকে। মাত্র দু’দিনের পরিচয়, তবুও আমার মায়া হচ্ছে ভীষণ। উনি খুব ভালো মনের মানুষ। আব্বা শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে নিজের ছেলের কুকীর্তি গুলো তুলে ধরতে লাগলেন। সব শুনে উনি প্রথমে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসব সত্যি?’
আমি ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়লাম। বাবা বললেন, ‘আপনার কী আমাদের কথা বিশ্বাস হয় না? আমার মেয়েকে আবার কী জিজ্ঞাসা করেন?’
‘দেখুন ভাইসাহেব, আমি তো বলি নাই যে আপনাদের কথা অবিশ্বাস করছি। এখানে অন্যায় হলে আপনার মেয়ের সাথে হইছে,এখানে কথা বলার অধিকার ওর সবার আগে। তাই ওকে জিজ্ঞেস করলাম।’
বাবা খানিকটা নিভলেন। এবার দাদী কথা বলে উঠলেন। আমার দাদী বরাবরই ভীষণ তেজী মানুষ,বয়সের ভার তার কণ্ঠস্বরের তেজস্বতা মিলিয়ে দিতে পারেনি এখনো। প্রহর সাহেবকে কত প্রকার শাস্তি দিতে চায়- তা এক এক করে উল্লেখ করলেন। বড় কাকা বললেন, ‘আল্লাহ আমাদের মেয়েকে বাঁচাইছে। ভাগ্যিস আরও পরে গিয়ে এসব বের হয়নি। বিয়ের দেনমোহর দিয়ে তবেই আপনাদের যেতে হবে বলে দিলাম। আপনার লম্পট ছেলেকে এভাবে ছেড়ে দিবো না আমি।’
‘দেনমোহর দিয়েই বিদায় হবো,সেটা আপনাদের বলতে হবে না। বুঝলেন?’ থমথমে মুখে স্বগতোক্তি করলেন প্রহর সাহেব। শ্বাশুড়ি মা খেঁকিয়ে উঠলেন। টেনে টেনে বললেন, ‘তোমার লজ্জা করে না এতকিছুর পরও কথা বলতে? আর অধরা,তুমিই বা কীভাবে পারলা! আমাকে অথবা তোমার মা’কে একবার আগে থেকে বলে দেখতা। আমরা কী তোমাদের বিয়ে দিতাম না? কীসের জন্য এই মেয়েটার জীবন নষ্ট করলা?’
‘ফুপু, আমি নাহয় না বলতে পারছি লজ্জায়,ভয়ে, আপনার ছেলে কী বলতে পারে নাই? আমি তাকে কতবার বলছিলাম আমাদের সম্পর্কটা সবাইকে জানাতে। কিন্তু সে শুধু সময় চাইছে। আমার সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় আরও নানান জায়গায় সম্পর্ক করছে। এইজন্যে তাকে নিয়ে আমার ভয়টা বেশি। আমি মাঝখানে এইসব নিয়েই একটা ঝামেলা করি, তারপর আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়। তার কিছুদিন পরই জানতে পারি, আপনারা নাকী উনার বিয়ে ঠিক করছেন আর উনিও রাজী। আমি না পারতে সবকিছু মেনে নিছি। জিজ্ঞেস করেন উনাকে,আমি বলছিলাম এই বিয়েটা না করতে। কিন্তু উনি আমার উপর রাগ দেখিয়ে বিয়েটা করছে নাকী। পরে আবার নিজেই সেধে আসছে আমার কাছে। রূপ ভাবী শ্যামলা,দেখতে ভালো না। কতকিছু বলছে আমাকে! আমি কী এতটাই ফেলনা নাকী?’
আমার সহ্য হচ্ছে না। নিজেদের রামলীলা কত সুন্দর বলে বেড়াচ্ছে গুরুজনদের সামনে! নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার। আমি নড়েচড়ে বললাম, ‘এখানে বড়রা আছে। একটু বিবেচনা করে কথা বলো অধরা।’
অধরাকে দেখলাম আমার দিকে রক্তচক্ষু করে তাকাতে। আমি পুরোপুরি উপেক্ষা করলাম। যেই লোক ঘরের জান্নাত ফেলে বাহিরের জাহান্নামের প্রতি আকর্ষিত থাকে,আল্লাহ তাকে হেদায়েত করুক। তাদের সুখে রাখুক- দোয়া করলাম মনে মনে। চোখজোড়া ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। সামান্য রাগারাগির কারণে আমার জীবনটাকে দু’জনে বলি করে দিলো! বাবা বলতেন, এই পৃথিবী ভীষণ নিষ্ঠুর, আমি বিশ্বাস করতাম না। তখন তো বাবা মায়ের ছত্রছায়ায় থেকেছি, তাই বুঝতাম না। এখন মনে হচ্ছে,বাবা-মায়ের মতো আপন আর কেউ নেই। কেউ হতেই পারে না। বাবা-মা বাদে পৃথিবীর সবাই স্বার্থপর, নিষ্ঠুর। আমি ঢুকরে উঠলাম। সবাই আমার দিকে একযোগে তাকাল। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে উঠে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। দরজা আঁটকে দিলাম। দেয়ালে পিঠ দিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম কোনোমতে। ভেতরটা ভেঙেচুরে আসছে। জীবনে কেউ শুনেছে বিয়ের তৃতীয় দিনে কোনো মেয়ের ডিভোর্স হয়েছে? আমার হয়েছে। কী অদ্ভুত নিয়তি! সারাজীবন ফুলের ন্যায় নির্মল,হাস্যজ্বল থাকা মেয়েটির গায়ে এক নিমিষেই তালাকের তকমা লেগে গেল। এই সমাজ কী আমাকে শান্তিতে দম নিতে দিবে এরপর?
বাহিরে ভীষণ হট্টগোল চলছে। আমি সবটা শুনছি ঘরে বসেই। একেকজন একেক কথা বলছেন। প্রহর সাহেবের গলাও শুনতে পাচ্ছি। তিনি বারংবার অহংকারী ধরনের কথাবার্তা বলছেন। আবার সাফাই গাইছেন। অধরার গলা দুইবার শুনতে পেলাম। নিজেকে নির্দোষ উপস্থাপন করছে! আমার হাসি পেল। হঠাৎ শুনলাম, শ্বাশুড়ি মা বলছেন, ‘তোরা কী মনে করিস? এগুলোর পর আমি ভালোভাবে মেনে নেবো তোদের? কক্ষনো না।’
আমি অবাক হলাম। নিজের মতো আরও একটি নারীকে দেখলাম যিনি পেটের সন্তানকেও ছাড় দিচ্ছেন না অন্যায়ের জন্য। আমি কেন দেবো? দেবো না… কাকা বারবার দেনমোহর শোধ করে বিদায় হতে বলছে। এরপর নাকী কাগজ কলমে তালাক করিয়ে দেবে। এরকম ফ্যামিলির সাথে তিনি আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চান না। আমি তখনই দরজা খুলে ঘর থেকে বের হলাম। দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, ‘আমি দেনমোহর চাই না। দেনমোহরের এক টাকাও নিবো না।’
ভাবী বললেন, ‘কী বলিস এসব?’
‘আমার সাথে যা ঘটেছে তা চার-পাঁচ লাখ টাকায় শোধ হয়ে যাবে? এতই ঠুনকো আমি তোমাদের কাছে?’
‘তাহলে কী চাস তুই? বল!’
সাদাফ ভাই এই প্রথম মুখ খুললেন। আমার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। বয়সে প্রায় ৯ বছরের বড় উনি আমার। একটি ৬ বছর বয়সী মেয়েও আছে তার। আমি সেকেন্ড তিনেক চুপ করে থেকে বললাম, ‘উনাকে আমি জেলে দিবো। আমার সাথে যা করেছে, তা নিয়ে মামলা করব। কোনো জরিমানা আমি মানবো না। জেলে থাকুক কিছুদিন, কষ্ট বুঝুক, হুশ চলে আসবে এমনিতেই।’
প্রহর সাহেব বিস্ময় নিয়ে আমাকে দেখছেন। অধরা কটমট করে তাকিয়ে,আমার গায়েই লাগছে না। আমি আমার কথার উপর অনড় রইলাম। এরপর অনেকেই আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল। এটা নাকী বেশি হয়ে যায়। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে চাইলাম না। কথার ভোল পাল্টালাম না। আমার এক কথা,উনাকে জেল খাটতেই হবে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে শ্বাশুড়ি মা আমার সাথে একমত হলেন। প্রহর সাহেব অবিশ্বাস্য কণ্ঠে ‘মা’ বলে ডাকলেন। আমার শান্তি লাগছে,ভীষণ শান্তি। আমার মতো আর কোনো মেয়ে যেন না ঠকে,তা আমি দেখে ছাড়বো।
চলবে…
(পরের পর্ব পরশুদিন পাবেন। বড় পর্বই পাবেন)