নীরব রোদনে পর্ব-২

0
1517

#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:২
.
.
.
ছাদ থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই কঙ্কা তার মায়ের সামনে পরলো। আয়েশা বেগম পানি খেতে উঠেছিলেন। দরজা খোলা দেখে সেখানেই অপেক্ষা করছিলেন। কঙ্কা ভেতরে ঢুকতেই তিনি বলে উঠলেন,
–এত রাতে কোথায় গিয়েছিলি?
কঙ্কা বিচলিত হলো না। দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
–ছাদে, মা।
আয়েশা বেগমের ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন,
–ছাদে? বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টির মধ্যে মাঝরাতে তোর ছাদে যাওয়ার কি দরকার পরেছিল?
কঙ্কা হাসিমুখে জবাব দিলো,
–বৃষ্টিতে ভিজতেই তো গিয়েছিলাম, মা।
–এই রাতে বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়েছিলি?
–হ্যাঁ, মা। গিয়েছিলাম।
আয়েশা বেগম কপাল কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আবছা আলোয় মেয়ের শরীর থেকে গড়িয়ে পরা পানি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর উনি কঠিন গলায় বললেন,
–কঙ্কা, তুই আমার চোখকে ফাঁকি দিবি বলে ভাবিস? আমি আগেও তোকে রাত বিরাতে নীলয়ের ঘরে যেতে দেখেছি। কেন যাস?
কঙ্কা প্রথমে হকচকিয়ে গেল। মা এমন একটা প্রশ্ন করতে পারে সে কখনো ভাবে নি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে কঙ্কা বলল,
–দরকার থাকলেই যাই, মা। দরকার না থাকলে যাই না।
আয়েশা এবার কিঞ্চিৎ ধমকের সুরে বললেন,
–দরকার থাকে? মাঝরাতে নীলয়ের ঘরে তোর দরকার থাকে?
–আচ্ছা, যাও। দরকার থাকে না। আমি এমনিতেই যাই। তাতে অসুবিধা কি, মা?
আয়েশা বেগম রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
–অসুবিধা তুই বুঝিস না? তুই একটা যুবতী মেয়ে। এত রাতে একটা পুরুষ মানুষের ঘরে গেলে কি অসুবিধা তুই বুঝিস না?
কঙ্কা এবার চোখমুখ কুঁচকে বলল,
–মা, তোমার মনটা বড় ছোট।
আয়েশা হতভম্ব হয়ে বললেন,
–কি বললি তুই? আমার মন ছোট? একটা ঠাস করে চড় মারবো তোকে, অসভ্য মেয়ে।
কঙ্কা গাল এগিয়ে দিয়ে বলল,
–চড় মেরে শান্তি পেলে মারো। তাড়াতাড়ি মারো। আমি ঘুমাতে যাব।
আয়েশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–কঙ্কা, তোর বাবা তোর বিয়ে ঠিক করছেন। পরশু তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। তুই এই সময় উল্টোপাল্টা কিছু করবি না। আমাকে আর যন্ত্রণা দিস না।
–দেবো না। কালকের পর আমায় নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না, মা।
কথা শেষ করে কঙ্কা ঘরে চলে গেল। আয়েশা বেগম আরও কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। মেয়েটা কি বলতে চাইলো?
নিজের ঘরে এসে কঙ্কা প্রথমে ভেজা কাপড় বদলালো। তারপর বিছানায় শুয়ে আবিরকে ফোন করলো। আবিরের ফোন যখন কঙ্কার ডাক জানান দিচ্ছে তখন আবির নিজের ফ্ল্যাটের বিছানায় এক তরুণী শরীরে মগ্ন। ফোন বেজে বেজে কেটে গেল। কঙ্কা আবার ফোন করলো। এবার ফোন ধরা হলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো আবিরের বিরক্তিমাখা কন্ঠস্বর,
–কি ব্যাপার, কঙ্কা? শান্তিতে ঘুমাতে দেবে না?
কঙ্কা রাগী গলায় বলল,
–ঘুমাচ্ছো তুমি? কাল রাতে যে আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করছি সে খেয়াল আছে তোমার? সব ব্যবস্থা করেছ?
আবিরের গলা এবার সহজ হয়ে এলো। সে আদরমাখা গলায় বলল,
–সরি, জান। ঘুমিয়ে পরেছিলাম তো, তাই ওভাবে কথা বলে ফেলেছি। তুমি চিন্তা করো না। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। তুমি শুধু রাত দশটায় রেলস্টেশনে আসবে। তোমার বাসা থেকে একটু সামনেই আমার বন্ধু বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। বুঝতে পেরেছ?
–হ্যাঁ, বুঝেছি। তুমি এখন কি করছো, আবির? চলো না, আজ আমরা সারারাত গল্প করি।
–ইয়ে…কঙ্কা, কাল তো অনেক কাজ। আজ ভালো করে ঘুম দরকার না? ঘুমিয়ে পরো, জান। লাভ ইউ।
কল কেটে গেল। কঙ্কা বিছানা ছেড়ে নামলো। এই ছেলেটার সাথে সে যে কেন পালাচ্ছে নিজেও বুঝতে পারছে না। নিজের জীবনের সাথে জুয়া খেলে কি লাভ হবে তার? অবশ্য তার না হোক, তার মায়ের হবে। তাকে নিয়ে তো তার মায়ের অভিযোগের শেষ নেই। মাঝে মাঝে তো মা নিজেই তাকে অভিশাপ দিয়ে বসে। সামান্য মতের অমিল হলেই বলে ওঠে, “এত সুখ সারাজীবন থাকবে না, কঙ্কা। বাপের আদরে আছিস তো। তাই বুঝতে পারছিস না। বিয়ের পরে দেখবি দুঃখ কাকে বলে। তোর নাকের জল, চোখের জল, সব একাকার হবে তখন। মারে কষ্ট দেওয়ার ফল ভুগবি তুই।” হয়তো মা কথাগুলো মন থেকে বলে না। কিন্তু কথাগুলো কঙ্কার খুব খারাপ লাগে। মা তাকে বকতেই পারে। তাই বলে এসব কথা বলবে কেন? অন্যকিছু বলে কি বকা দেওয়া যায় না? কঙ্কা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। মায়ের বিয়ের শাড়ি আর কিছু গয়না সে খুব সাবধানে চুরি করে এনেছে। মায়ের আলমারি থেকে বিশ হাজার টাকাও এনেছে। জিনিসগুলো সযত্নে একটা ব্যাগে রাখলো সে। তার সাথে আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিলো। ব্যাগটা গুছিয়ে আলমারির পিছনে লুকিয়ে রেখে সে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো। হঠাৎ করেই তার খুব মন খারাপ লাগছে। পালিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে?
________________________
সারারাত এক বন্ধুর ব্যাচেলর মেসে কাটিয়ে ভোরবেলা বাড়ি ফিরলো শাদাব। সদর দরজা তখনও খোলা। শাদাবের মা, সাবিনা বানু ফজরের নামাজ পড়ে বসার ঘরে বসে ছিলেন। সাদাব বাড়িতে আসতেই উনি শাদাবকে ডাকলেন,
–শাদাব, এদিকে আয়।
শাদাব ধীরে ধীরে বসার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সাবিনা প্রশ্ন করলেন,
–রাতে কোথায় ছিলি?
শাদাব ইতস্তত করে উত্তর দিলো,
–অফিসের কাজ ছিল, মা। এক কলিগের বাসায় থাকতে হয়েছিল রাতে।
–বিকালে অফিস থেকে ফিরে আবার রাতেই কলিগের বাসায় যেতে হলো?
শাদাব কাঁপা গলায় মিথ্যা বলল,
–হ্যাঁ, মা। আসলে জরুরি একটা কাজ সকালের মধ্যে শেষ করার ছিল।
–আজ তো শুক্রবার। আজই শেষ করার ছিল?
–আব..হ্যাঁ, মা।
সাবিনা সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন,
–বৌমার সাথে কি তোর কিছু হয়েছে, শাদাব?
শাদাব প্রথমে থতমত খেয়ে গেল। একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থেকে উত্তর দিলো,
–না তো, মা।
–ঠিক আছে। ঘরে যা। তোর সাথে পরে কথা বলবো।
শাদাব ঘরে গিয়ে ঢুকলো। সুরমা তখনও মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। তার চোখ ফুলে গেছে, চোখের সাদা অংশ মারাত্মক লালচে। শাদাবের বুকে ধুক করে উঠলো। তার ইচ্ছা হলো, সুরমার কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। আদর করে বুকে টেনে নিতে। কিন্তু এই ইচ্ছাকে শাদাব মোটেও প্রশ্রয় দিলো না। শাদাব নিজেও সারারাত ঘুমাতে পারে নি। তার নিজের চোখও লালচে রঙ ধারণ করেছিল। সে সুরমার দিকে এক পলক তাকিয়েই বিছানায় গিয়ে বসলো। সুরমা তাড়াহুড়ো করে শাদাবের কাছে গেল। হড়বড় করে বলতে লাগলো,
–কোথায় ছিলেন আপনি সারারাত? ফোনটা পর্যন্ত ফেলে গিয়েছিলেন? আপনি জানেন কতটা চিন্তা হচ্ছিলো আমার?
শাদাব ক্লান্ত গলায় বলল,
–আমার জন্য তোমাকে চিন্তা করতে কে বলেছে? কদিন পরেই তো তোমার মুক্তি। কাজেই এখন আর এসব নাটক করার প্রয়োজন নেই।
সুরমা হঠাৎ রেগে গেল। শাদাবের পাশে বসে ওর টি শার্টের কলার চেপে ধরে বলল,
–চুপ! একদম চুপ করুন। অনেক হয়েছে এসব। কিসের মুক্তি? কিসের ডিভোর্স? কোনো ডিভোর্স হবে না আমাদের। আমরা সারাজীবন থাকবো একসাথে। বুঝেছেন আপনি?
শাদাব একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সুরমার দিকে। তারপর ফিক করে হেসে ফেললো। কলার থেকে সুরমার হাত ছাড়িয়ে তাকে বুকে টেনে নিলো। সুরমা কেঁদে ফেললো। শাদাব স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
–সম্ভব নয়, সুরমা। আমাদের সম্পর্ক ভাঙতেই হবে।
সুরমা মাথা তুলে শাদাবের মুখের দিকে তাকালো। রাগী গলায় বলল,
–এত সহজ ভেঙে দেওয়া? আমি কি আপনার গার্লফ্রেন্ড নাকি যে যখন তখন ছেড়ে যাবেন? আমি আপনার বিয়ে করা বউ।
শাদাব মৃদু গলায় বলল,
–আমাদের সম্পর্ক কি কখনো মন থেকে গড়ে উঠেছে, সুরমা?
সুরমা আহত চোখে তাকিয়ে রইলো। শাদাব আবার বলল,
–আমাদের বিয়ের আট মাস চলছে, সুরমা। এই আট মাসে আমি কি কম চেষ্টা করেছি তোমাকে আপন করে নেবার? কিন্তু তুমি তো কখনো তোমার মনে আমায় জায়গা দাও নি। স্ত্রীর সব দায়িত্ব পালন করতে। কিন্তু সারাক্ষণ মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াতে। আমি কতশত চেষ্টা করেছি তোমার মন ভালো করার। কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। সেদিন রাতের কথা তোমার মনে আছে, সুরমা? তুমি বলেছিলে, তুমি নাকি অঞ্জন দত্তের বেলা বোস। আর বেলারা নাকি স্বামীর সংসারেও প্রেমিককে বাঁচিয়ে রাখে আজীবন। স্বামীর সংসারে হাসিমুখে সব দায়িত্ব পালন করে যায়। আর মনে মনে প্রেমিকের সাথে দেখা লাল নীল সংসারের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখে আর আফসোস করে। কেন, সুরমা? কেন? লাল নীল সংসার কি শুধু প্রেমিককে বিয়ে করলেই পাওয়া যায়? স্বামী কি ভালোবাসতে পারে না? বেলাদের শুধু তাদের প্রেমিকরাই ভালোবাসে? স্বামী ভালোবাসে না? বলো, বাসে না?
সুরমা মাথা নিচু করে ফেললো। অপরাধীর মতো বলল,
–আমি ভুল করেছি। আমায় মাফ করে দিন।
শাদাব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। বলল,
–তোমার সেই কথাগুলো আমাকে কতখানি যন্ত্রণা দিয়েছিল সেটা তুমি কখনো বুঝবে না। আমি তোমায় ভালোবাসি, সুরমা। গভীরভাবে ভালোবেসেছি আমি তোমাকে। কিন্তু আমার ভালোবাসাকে কখনো মূল্য দাও নি তুমি। অঞ্জন দত্ত তোমাদের শিখিয়েছে ভালোবাসে শুধু প্রেমিকরা, স্বামীরা নয়। তুমি তাই শিখেছ। সেজন্যই আমার ভালোবাসা তুমি কখনো অনুভব করতে পারো নি। সে চেষ্টাই কখনো করো নি। অঞ্জন দত্তরা আজীবন শুধু বলেছে প্রেমিকদের কথা। প্রেমিকদের প্রেমিকার অন্যের স্ত্রী হওয়ার কষ্টের কথা। শিখিয়েছে অতীত নিয়ে আক্ষেপ করে বর্তমানকে অবহেলার কথা। তুমি সেই সবকিছু শিখেছ। কিন্তু তাদের মাঝখানে স্বামী নামক যে তৃতীয় ব্যক্তিটি আছে তার অনুভূতির কথা কেউ কখনো বলে নি। অঞ্জন দত্ত কখনো স্বামীর ভালোবাসার কথা বলে নি, অসম্ভব ভালোবাসার বদলে স্ত্রীর অবহেলা পাওয়া স্বামীর কষ্টের কথা বলে নি। যে স্ত্রীর মনে প্রাক্তনের বসবাস, সে স্ত্রীর স্বামীর অনুভূতি নিয়ে কেউ কখনো বলে নি। এই দিকটা কেউ কোনোদিন ভাবে নি। বিবাহিতা মেয়ে যখন প্রাক্তনের জয়গান করেছে, তখন সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছে, “ভালোবাসা মরে না।” কিন্তু কেউ একজনও সেই মুহূর্তে মেয়েটির স্বামীর কথা ভেবে দেখে নি। কেউ কখনো তোমাকে বলে নি যে নতুন করে ভালোবাসা যায়, ভালোবাসা রূপ বদলায়। তুমি কখনো এই কথাটা বিশ্বাস করো নি।
শাদাব থামলো। বহুদিনের জমিয়ে রাখা কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে তার। সুরমা মাথা নিচু করে কাঁদছে। শাদাব সুরমার দিকে তাকালো। প্রশ্ন করলো,
–আমি যদি মনে মনে নিজের প্রাক্তন প্রেমিকাকে ভালোবেসে যাই, আর তোমার সাথে শুধুই অভিনয় করি, তাহলে কি তুমি মেনে নিতে পারবে?
সুরমা আঁতকে উঠে বলল,
–না নাহ!
শাদাব হাসলো। বিদ্রূপ করে বলল,
–কি আশ্চর্য! নিজে অন্য কাউকে ভালোবাসবে। আর স্বামী অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবে না?
সুরমা ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,
–আপনি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আরেকটা বিয়ে করবেন?
শাদাব চোখ বুজে বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল,
–নিশ্চয়ই করবো। যে মেয়ে আমাকে খুব ভালোবাসবে, আমি তাকে আমার বউ করে আনবো।
সুরমার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করলো, “আমি আপনাকে ভালোবাসি, শাদাব। আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আপনার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করার শক্তি আমি পাই নি। ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে। বেলারাও নতুন করে ভালোবাসে। পুরানো স্মৃতিকে একপাশে রেখেও নতুন করে ভালোবাসা যায়। দ্বিতীয় বার ভালোবাসার মানুষকে হারানোর মতো শক্তি বেলাদের আর থাকে না। আপনি হারিয়ে যাবেন না, শাদাব। যাবেন না!”
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সুরমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরলো। কিন্তু একটা বর্ণও সে মুখে বলতে পারলো না। শাদাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–তোমার মনের খবর আগে জানলে আমি তোমাকে বিয়েই করতাম না। তুমি নতুন করে আর কাউকে ভালোবাসতে পারবে না, এ কথাটা তুমি তোমার খালুজানকে বলতে পারো নি। কিন্তু আমাকে তো বলতে পারতে, সুরমা। আমাকে বললে আমি নিজ দায়িত্বে বিয়েটা ভেঙে দিতাম। অযথা আমার জীবনে এত কষ্ট নিয়ে এলে তুমি। কোনো মানে হয় এসবের!
সুরমা এবারও কথা বলতে পারলো না। শাদাব উঠে দাঁড়ালো। তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। সুরমা চোখের জল মুছে ফেললো। সে এত সহজে হার মানবে না। শাদাব যাই বলুক, নিজের করা ভুলগুলো সে শুধরে নেবে। কিন্তু কিছুতেই তার সংসারটা সে ভাঙতে দেবে না। নিজের সংসারকে সে বাঁচাবেই।
ঘন্টাখানেক পর মাথা মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো শাদাব। সুরমা তখনও একভাবে বিছানায় বসে আছে। শাদাব একটা জামা গায়ে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। সুরমা শান্ত গলায় বলল,
–শুয়ে পরলেন যে? নাস্তা খাবেন না?
শাদাব চোখ বন্ধ রেখেই উত্তর দিলো,
–না। আমি ঘুমুবো। আমাকে বিরক্ত করবে না।
সুরমার ইচ্ছা হলো, শাদাবকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর। কিন্তু পাছে শাদাব আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়! তাই সে নিজের ইচ্ছাকে দমন করলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো।
.
শাদাবের ঘুম ভাঙলো দুপুরে। আড়মোড়া ভাঙতেই সুরমার মুখটা চোখে পরলো তার। সুরমা কিছুটা সাজগোছ করেছে, নতুন শাড়ি পরেছে, চোখে কাজল পরেছে। চোখের লালচে ভাব বেশ অনেকটা কমে গেছে। শাদাবকে তাকাতে দেখেই সুরমা মুখে হাসি টেনে বলল,
–আপনি উঠেছেন? হাতমুখ ধুয়ে খেতে আসুন। তারপর আমাদের যেতে হবে।
শাদাব উঠে বসলো। ভ্রু কুঁচকে বলল,
–যেতে হবে মানে? কোথায় যাব?
সুরমা হাসিমুখেই বলল,
–খালা ফোন করেছিল। কাল কঙ্কাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। তাই আমাকে আর আপনাকে যেতে বলেছে আজকে। আপনি তো জানেন, আমার মা মারা যাওয়ার পরে যখন বাবা আরেকটা বিয়ে করলেন, তখন থেকেই খালা আর খালুজানই আমাকে মানুষ করেছেন। আমাকে নিজেদের আরেক মেয়ে বলেই মানেন উনারা। বাড়িতে যা কিছুই হোক, উনারা আমাকে ছাড়া সেটা ভাবতেই পারেন না।
শাদাব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–ঠিক আছে। তোমাকে আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো।
সুরমার মুখ মলিন হয়ে গেল। সে মৃদু স্বরে বলল,
–পৌঁছে দিয়ে আসবেন মানে? আপনি আমার সাথে ওখানে থাকবেন না? আমি তো আপনার ব্যাগও গুছিয়েছি।
–আমি থাকতে পারবো না, সুরমা। আমার অফিসে কাজ আছে।
–দুটো দিন কি ওখান থেকে অফিসে যাওয়া যায় না?
–না, যায় না।
–কিন্তু বিয়ের পর থেকে যতবার ওই বাড়িতে গিয়েছি, আপনি তো আমার সাথে গিয়েছেন। আর থেকেছেনও। ওখান থেকেই তো অফিসে গিয়েছেন।
শাদাব শান্ত গলায় বলল,
–হ্যাঁ, থেকেছি তোমার সাথে। কিন্তু এবার আর থাকবো না।
সুরমার ভীষণ মন খারাপ হলো। শাদাব বিছানা ছেড়ে নেমে বাইরের দিকে পা বাড়ালো। গলা উঁচিয়ে বলল,
–মা, আমাকে খেতে দাও।
সুরমার চোখ জলে ভরে উঠলো। শাদাব সবসময় তাকে সাথে নিয়ে খেতে বসতো। ইদানীং আর সেটা করছে না। এমনকি সুরমা খেয়েছে কিনা সেই খোঁজও রাখছে না আজকাল। শাদাবের এত অবহেলা সে নিতে পারছে না। শাদাব কেন এভাবে বদলে যাচ্ছে? আগের শাদাবকে কি আর কখনো ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়?
.
#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here